বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থা অকার্যকর হতে বসেছে by রঘুরাম রাজন
২০১৫ সাল শেষ হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের কয়েকটি মাত্র জায়গায় প্রবৃদ্ধির গতি ঊর্ধ্বমুখী। যে সময় উন্নত ও উদীয়মান দেশের বাজারের অভ্যন্তরীণ প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল, সে সময় এটা খুবই বিপজ্জনক এক পরিস্থিতি। এতে কয়েকটি বিষয় বোঝা যায়, যার মধ্যে রয়েছে শিল্পায়িত দেশের উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া, মহামন্দার ঋণের ভার অসহনীয় হয়ে ওঠা, আর উদীয়মান বাজারের রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধির মডেল সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা।
তা হলে মানুষ কীভাবে চাহিদা পড়ে যাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নেবে? তত্ত্বগতভাবে সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বাড়ে, কর্মসংস্থান হয়। আর বাস্তবে দেখা যায়, আগের ঋণের ভারের কারণে যদি ভোক্তার চাহিদা পড়ে যায়, তা হলে নতুন বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফার পরিমাণও কমে যায়। এক শতাব্দীকাল আগে কান্ট উইকসেল নিউট্রাল রিয়েল রেটের কথা বলেছিলেন; হালকাভাবে বললে, এটা হচ্ছে অর্থনীতিকে পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান ও স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সুদের হার। এই পরিস্থিতিতে এটাও নেতিবাচক হতে পারে। সে কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপ্রচলিত মুদ্রানীতি গ্রহণ করে, যেমন কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং (যেখানে সুদের হার কমানো ও মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই সরকারের সিকিউরিটি কেনে)। এটা যে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও ভোগ বাড়ায়, তেমন নজির কিন্তু একদম অবিমিশ্র নয়।
পৃথিবী প্রতিযোগিতা-মূলকভাবে মুদ্রাব্যবস্থায় সহজিকরণের নীতি গ্রহণের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেখানে শেষমেশ কেউই লাভবান হচ্ছে না। চাহিদা বাড়ানোর আরেকটি প্রলুব্ধকর উপায় সরকারি ব্যয় বাড়ানো। উন্নত দেশগুলো তো দৃশ্যত সব বিনিয়োগ করেই ফেলেছে। আবার সবাই যখন বিদ্যমান অবকাঠামো সংস্কার ও প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা দেখতে পান (যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সেতু), তখন মন্দ বিনিয়োগ মানুষের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ, এর ফলে কর বেড়ে যেতে পারে, মানুষের পারিবারিক সঞ্চয় বেড়ে যেতে পারে, আর করপোরেট বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। তর্কযোগ্যভাবে বলা যায়, সর্বশেষ মহামন্দার আগেই কিন্তু শিল্পায়িত দেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কমে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ট্রেজারি সচিব ল্যারি সামার্স ‘সেকুল্যার স্ট্যাগনেশন’ শব্দবন্ধটি জনপ্রিয় করেছিলেন। এটা দিয়ে তিনি বুড়ো মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিজনিত চাহিদা পড়ে যাওয়া ও ধনীদের আরও ধনী হওয়ার বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছেন। এই স্থবিরতার কারণ হচ্ছে, বুড়ো হয়ে গেলে মানুষের খরচ কমে যায়, আর ধনীদের চাহিদারও তো একটা সীমা আছে, একটা পর্যায়ের পর তাদেরও তো আর ভোগের চাহিদা থাকে না।
নিম্ন প্রবৃদ্ধির এই কাঠামোগত কারণটি দূর করার জন্য কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন: যে পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে অধিকতর প্রতিযোগিতা সৃষ্টি, অংশগ্রহণ ও উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধির বাড়বাড়ন্ত হয়। কিন্তু এ ধরনের কাঠামোগত সংস্কার কায়েমি স্বার্থের বিপক্ষে যায়।
উন্নত দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যদি এতই কঠিন হয়, তা হলে আমরা নিম্ন প্রবৃদ্ধি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি না কেন? কারণ, সর্বোপরি উন্নত দেশের মাথাপিছু আয় তো অনেক বেশি।
লেগে থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে অতীতের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। ষাটের দশকে শিল্পায়িত দেশগুলো জনগণকে বৃহত্তর সামাজিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যেটা পরবর্তীকালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজস্বগতভাবে ফাঁপা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে আরও তীব্র হয়েছিল। তা ছাড়া সামাজিক ঐকতানের জন্য প্রবৃদ্ধি খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ, তরুণদের আগের প্রজন্মকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে কাজ করে টাকা উপার্জন করতে হবে, আর তারা তো কিছু হলেই প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে পারে। আর প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও বিশ্বায়নের কারণে যদি একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের প্রবৃদ্ধির জন্য মধ্যবিত্তের ভালো চাকরির সম্ভাবনা কমে যায়, তা হলে অসমতার মাত্রা কমাতে আরও প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন।
আবার মূল্যহ্রাসের সম্ভাবনাও থাকে। এটা ঠিক যে মূল্যহ্রাস হলে বিদ্যমান ঋণের বোঝা আরও ভারী হয়। কিন্তু ঋণ অত্যধিক হয়ে গেলে মূল্যস্ফীতি না ঘটিয়ে তা সুনির্দিষ্টভাবে পুনর্গঠন করা ভালো।
এসব যুক্তিকে থোড়াই কেয়ার করে মূল্যহ্রাসের ভূত সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তাড়িয়ে বেড়ায়। সে কারণেই শিল্পায়িত দেশের অর্থনীতিগুলো উভয়সংকটে পড়ে: অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের পদক্ষেপ অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় সেই বাস্তবতার সঙ্গে কীভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর রাজনৈতিক জরুরতকে মেলানো যায়। ঋণ মওকুফ করা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, আবার কাঠামোগত সংস্কার করতে গেলে সরকারকে এত যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় যে তার পক্ষে সহজেই এটা করা সম্ভব নয়। উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর আরেকটি পন্থা আছে: আক্রমণাত্মক মুদ্রানীতির মাধ্যমে বিনিময় মূল্য কমিয়ে দিয়ে রপ্তানিকে প্রণোদনা দেওয়া। আদর্শিকভাবে উদীয়মান দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর দেওয়া অর্থে বলীয়ান হয়ে ওই রপ্তানির ভোক্তায় পরিণত হবে, অন্যদিকে তারা ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করে। এতে করে বিশ্বের মোট চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু ১৯৯০ সালে উদীয়মান দেশগুলোর শিক্ষা হয়েছে যে বিদেশি পুঁজির ওপর ভর করে আমদানি বাড়ানো নীতি হিসেবে বিপজ্জনক। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক দেশই নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়, তারা তখন চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত রাখতে শুরু করে। তারা তখন বিদেশি মুদ্রার মজুত রেখে নিজেদের মুদ্রার প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়।
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর বেন বার্নানকি বাহ্যিক উদ্বৃত্তের ব্যাপারটি বোঝানোর জন্য ‘গ্লোবাল সেভিংস গ্লাট’ নামে একটি শব্দবন্ধ তৈরি করেন, অর্থাৎ বৈশ্বিক সঞ্চয়ের আধিক্য। বিশেষ করে, তিনি উদীয়মান বাজারের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়টি শনাক্ত করেন, যেটা ক্রমশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থান করে নিচ্ছিল। বার্নানকি এটার ক্ষতিকর পরিণতি সম্পর্কে বলেছিলেন, বিশেষ করে সম্পদের ভুল বণ্টনের বিষয়টি, যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহায়ণ খাতে বুদ্বুদ্ সৃষ্টি হয়।
আদর্শ পৃথিবীতে প্রবৃদ্ধির রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা অর্থনীতির সম্ভাবনাকে ছাড়িয়ে যাবে না। বাস্তব দুনিয়ায় তো আর সামাজিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি, অতি ঋণ ও দারিদ্র্য দূর হবে না, তাই আমাদের টেকসই প্রবৃদ্ধির পথ খুঁজতে হবে। সর্বোপরি আমাদের আরেক দেশের ক্ষতি করে নিজের উন্নতি নিশ্চিত করা যাবে না। যেমন, আমাদের অপ্রচলিত মুদ্রানীতি ও দীর্ঘ মেয়াদে বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ করা যাবে না, যার কারণে প্রাথমিকভাবে পুঁজির নির্গমন হয় ও প্রতিযোগিতামূলক মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়।
মোদ্দাকথা হচ্ছে, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) বৈশ্বিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে, সে জন্য তাকে এমন অপ্রচলিত মুদ্রানীতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে (বিনিময় হারের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি হস্তক্ষেপসহ)। এখন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পৃথিবী প্রতিযোগিতামূলকভাবে মুদ্রাব্যবস্থায় সহজিকরণের নীতি গ্রহণের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেখানে শেষমেশ কেউই লাভবান হচ্ছে না। মুক্ত বাণিজ্য ও দায়িত্বশীল বৈশ্বিক নাগরিকতার ধারা তৈরি করে পৃথিবীব্যাপী টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায়, যে জিনিসটির প্রয়োজন তার খুব বেশি।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রঘুরাম রাজন: ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর।
তা হলে মানুষ কীভাবে চাহিদা পড়ে যাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নেবে? তত্ত্বগতভাবে সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বাড়ে, কর্মসংস্থান হয়। আর বাস্তবে দেখা যায়, আগের ঋণের ভারের কারণে যদি ভোক্তার চাহিদা পড়ে যায়, তা হলে নতুন বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফার পরিমাণও কমে যায়। এক শতাব্দীকাল আগে কান্ট উইকসেল নিউট্রাল রিয়েল রেটের কথা বলেছিলেন; হালকাভাবে বললে, এটা হচ্ছে অর্থনীতিকে পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান ও স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সুদের হার। এই পরিস্থিতিতে এটাও নেতিবাচক হতে পারে। সে কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপ্রচলিত মুদ্রানীতি গ্রহণ করে, যেমন কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং (যেখানে সুদের হার কমানো ও মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই সরকারের সিকিউরিটি কেনে)। এটা যে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও ভোগ বাড়ায়, তেমন নজির কিন্তু একদম অবিমিশ্র নয়।
পৃথিবী প্রতিযোগিতা-মূলকভাবে মুদ্রাব্যবস্থায় সহজিকরণের নীতি গ্রহণের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেখানে শেষমেশ কেউই লাভবান হচ্ছে না। চাহিদা বাড়ানোর আরেকটি প্রলুব্ধকর উপায় সরকারি ব্যয় বাড়ানো। উন্নত দেশগুলো তো দৃশ্যত সব বিনিয়োগ করেই ফেলেছে। আবার সবাই যখন বিদ্যমান অবকাঠামো সংস্কার ও প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা দেখতে পান (যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সেতু), তখন মন্দ বিনিয়োগ মানুষের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ, এর ফলে কর বেড়ে যেতে পারে, মানুষের পারিবারিক সঞ্চয় বেড়ে যেতে পারে, আর করপোরেট বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। তর্কযোগ্যভাবে বলা যায়, সর্বশেষ মহামন্দার আগেই কিন্তু শিল্পায়িত দেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কমে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ট্রেজারি সচিব ল্যারি সামার্স ‘সেকুল্যার স্ট্যাগনেশন’ শব্দবন্ধটি জনপ্রিয় করেছিলেন। এটা দিয়ে তিনি বুড়ো মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিজনিত চাহিদা পড়ে যাওয়া ও ধনীদের আরও ধনী হওয়ার বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছেন। এই স্থবিরতার কারণ হচ্ছে, বুড়ো হয়ে গেলে মানুষের খরচ কমে যায়, আর ধনীদের চাহিদারও তো একটা সীমা আছে, একটা পর্যায়ের পর তাদেরও তো আর ভোগের চাহিদা থাকে না।
নিম্ন প্রবৃদ্ধির এই কাঠামোগত কারণটি দূর করার জন্য কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন: যে পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে অধিকতর প্রতিযোগিতা সৃষ্টি, অংশগ্রহণ ও উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধির বাড়বাড়ন্ত হয়। কিন্তু এ ধরনের কাঠামোগত সংস্কার কায়েমি স্বার্থের বিপক্ষে যায়।
উন্নত দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যদি এতই কঠিন হয়, তা হলে আমরা নিম্ন প্রবৃদ্ধি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি না কেন? কারণ, সর্বোপরি উন্নত দেশের মাথাপিছু আয় তো অনেক বেশি।
লেগে থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে অতীতের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। ষাটের দশকে শিল্পায়িত দেশগুলো জনগণকে বৃহত্তর সামাজিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যেটা পরবর্তীকালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজস্বগতভাবে ফাঁপা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে আরও তীব্র হয়েছিল। তা ছাড়া সামাজিক ঐকতানের জন্য প্রবৃদ্ধি খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ, তরুণদের আগের প্রজন্মকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে কাজ করে টাকা উপার্জন করতে হবে, আর তারা তো কিছু হলেই প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে পারে। আর প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও বিশ্বায়নের কারণে যদি একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের প্রবৃদ্ধির জন্য মধ্যবিত্তের ভালো চাকরির সম্ভাবনা কমে যায়, তা হলে অসমতার মাত্রা কমাতে আরও প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন।
আবার মূল্যহ্রাসের সম্ভাবনাও থাকে। এটা ঠিক যে মূল্যহ্রাস হলে বিদ্যমান ঋণের বোঝা আরও ভারী হয়। কিন্তু ঋণ অত্যধিক হয়ে গেলে মূল্যস্ফীতি না ঘটিয়ে তা সুনির্দিষ্টভাবে পুনর্গঠন করা ভালো।
এসব যুক্তিকে থোড়াই কেয়ার করে মূল্যহ্রাসের ভূত সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তাড়িয়ে বেড়ায়। সে কারণেই শিল্পায়িত দেশের অর্থনীতিগুলো উভয়সংকটে পড়ে: অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের পদক্ষেপ অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় সেই বাস্তবতার সঙ্গে কীভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর রাজনৈতিক জরুরতকে মেলানো যায়। ঋণ মওকুফ করা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, আবার কাঠামোগত সংস্কার করতে গেলে সরকারকে এত যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় যে তার পক্ষে সহজেই এটা করা সম্ভব নয়। উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর আরেকটি পন্থা আছে: আক্রমণাত্মক মুদ্রানীতির মাধ্যমে বিনিময় মূল্য কমিয়ে দিয়ে রপ্তানিকে প্রণোদনা দেওয়া। আদর্শিকভাবে উদীয়মান দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর দেওয়া অর্থে বলীয়ান হয়ে ওই রপ্তানির ভোক্তায় পরিণত হবে, অন্যদিকে তারা ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করে। এতে করে বিশ্বের মোট চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু ১৯৯০ সালে উদীয়মান দেশগুলোর শিক্ষা হয়েছে যে বিদেশি পুঁজির ওপর ভর করে আমদানি বাড়ানো নীতি হিসেবে বিপজ্জনক। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক দেশই নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়, তারা তখন চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত রাখতে শুরু করে। তারা তখন বিদেশি মুদ্রার মজুত রেখে নিজেদের মুদ্রার প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়।
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর বেন বার্নানকি বাহ্যিক উদ্বৃত্তের ব্যাপারটি বোঝানোর জন্য ‘গ্লোবাল সেভিংস গ্লাট’ নামে একটি শব্দবন্ধ তৈরি করেন, অর্থাৎ বৈশ্বিক সঞ্চয়ের আধিক্য। বিশেষ করে, তিনি উদীয়মান বাজারের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়টি শনাক্ত করেন, যেটা ক্রমশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থান করে নিচ্ছিল। বার্নানকি এটার ক্ষতিকর পরিণতি সম্পর্কে বলেছিলেন, বিশেষ করে সম্পদের ভুল বণ্টনের বিষয়টি, যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহায়ণ খাতে বুদ্বুদ্ সৃষ্টি হয়।
আদর্শ পৃথিবীতে প্রবৃদ্ধির রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা অর্থনীতির সম্ভাবনাকে ছাড়িয়ে যাবে না। বাস্তব দুনিয়ায় তো আর সামাজিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি, অতি ঋণ ও দারিদ্র্য দূর হবে না, তাই আমাদের টেকসই প্রবৃদ্ধির পথ খুঁজতে হবে। সর্বোপরি আমাদের আরেক দেশের ক্ষতি করে নিজের উন্নতি নিশ্চিত করা যাবে না। যেমন, আমাদের অপ্রচলিত মুদ্রানীতি ও দীর্ঘ মেয়াদে বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ করা যাবে না, যার কারণে প্রাথমিকভাবে পুঁজির নির্গমন হয় ও প্রতিযোগিতামূলক মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়।
মোদ্দাকথা হচ্ছে, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) বৈশ্বিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে, সে জন্য তাকে এমন অপ্রচলিত মুদ্রানীতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে (বিনিময় হারের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি হস্তক্ষেপসহ)। এখন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পৃথিবী প্রতিযোগিতামূলকভাবে মুদ্রাব্যবস্থায় সহজিকরণের নীতি গ্রহণের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেখানে শেষমেশ কেউই লাভবান হচ্ছে না। মুক্ত বাণিজ্য ও দায়িত্বশীল বৈশ্বিক নাগরিকতার ধারা তৈরি করে পৃথিবীব্যাপী টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায়, যে জিনিসটির প্রয়োজন তার খুব বেশি।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রঘুরাম রাজন: ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর।
No comments