রাজনীতিতে সুবাতাস বইছে! by সোহরাব হাসান
ইতালীয়
সমাজবিজ্ঞানী পিটার বারটোসি বাংলাদেশের সমাজের চালচিত্র ব্যাখ্যা করতে
গিয়ে গেল শতকের আশির দশকে লিখেছিলেন, ‘উচ্চ রাজনৈতিক অংশীদারত্বের দীর্ঘ
ঐতিহ্য আছে।’ কিন্তু সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রত্যাশা মেলাতে না পারলে ভয়ংকর
পরিস্থিতির তৈরি হয়। বছর খানেক আগেও বাংলাদেশের মানুষ সেটি হাড়ে হাড়ে টের
পেয়েছে। রাজনীতি এখনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। গত বৃহস্পতিবার সিলেট
চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত সেমিনারটি ছিল ‘দ্রুত
অগ্রগতির সোপানে বাংলাদেশ: সিলেটের ভূমিকা’ নিয়ে। অর্থনৈতিক–বিষয়ক সেমিনারে
বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যার কথা থাকবেই। কিন্তু
সেদিন সেমিনারের প্রধান অতিথি ও অতিথিদের বক্তৃতায় অর্থনীতির পাশাপাশি এমন
কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য উঠে আসে, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, দেশের
রাজনীতি সঠিক খাতে প্রবাহিত না হলে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও থেমে যেতে বাধ্য।
সাম্প্রতিক পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এবং ৫ জানুয়ারি ঢাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে অনেকেই রাজনৈতিক সুস্থিরতার লক্ষণ বলে মনে করেন। সেদিন সেমিনারের প্রধান অতিথি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘অনেক ঘটনা ও প্রাণক্ষয়ের ÿপর রাজনীতিতে সুবাতাস বইছে। এটিকে শক্তিশালী করতে হলে দুটি ঘোষণা প্রয়োজন। এক. বিএনপিকে ঘোষণা দিতে হবে যে ২০১৯ সালে তারা জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। দুই. সরকারকেও সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ঢেলে সাজানো হবে।’ সেই সঙ্গে তিনি এও উল্লেখ করেন যে অনেকে বলেন রাজনীতিতে সমস্যা ও সংকট আছে। আমি বলি অস্বস্তি আছে।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞ একজন শিক্ষাব্রতী। তিনি বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব (পিএস) ছিলেন। বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন। বিদেশ থেকে এসে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ রকম একজন ব্যক্তি যখন রাজনীতি বিষয়ে কোনো বক্তব্য রাখেন, তখন সেটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হয়।
তাঁর দুটি প্রস্তাবই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও যোগ করা প্রয়োজন যে রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তাভাবনা ও মনমানসিকতা না বদলালে কেবল দুটি ঘোষণাই রাজনৈতিক স্থিতি আনতে পারবে না। রাজনীতিতে পথ ও মতের ভিন্নতা থাকবে। কর্মসূচি ও পরিকল্পনায় ফারাক থাকবে। সবকিছু এক হলে তো দেশে একটিই রাজনৈতিক দল থাকত। তবে মনে রাখতে হবে, সেই পথ ও মতের ভিন্নতা যেন রাজনীতিকে বিদ্বিষ্ট ও হিংসাশ্রয়ী না করে। সব ধরনের দমনপীড়ন কিংবা অন্তর্ঘাত থেকে রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশে রাজনৈতিক সংকট আর অস্বস্তি যাই থাকুক না কেন এর অবসান হতে হবে।
কিন্তু কীভাবে? প্রথমত, রাজনীতিতে আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর নির্বাচনের সময় তৃতীয় আম্পায়ার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার সুযোগ নেই। তাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকেই আম্পায়ার ঠিক করতে হবে। এ ব্যাপারে ফরাসউদ্দিন নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি যোগ্য লোক দিয়ে নতুন কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায় ‘২০১৭ সালে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সরকারকে বলতে হবে যে এই কমিশনকে পুনঃ নিয়োগ দেওয়া হবে না। যোগ্যতর লোককে বেছে নিতে হবে।’ তাঁর বক্তব্য সমর্থন করে সেমিনারে অপর এক বক্তা বলেছেন, ‘যোগ্য লোকদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন যদি পুনর্গঠিত হয়, তবে ভবিষ্যতে নির্বাচন নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব।’
তবে সেই সংঘাত ও সংঘর্ষের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে দুই দলের মৌখিক ঘোষণাই যথেষ্ট নয়। প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশন কীভাবে কাজ করবে, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। অভিজ্ঞতা বলছে, এর আগে একাধিক নির্বাচন কমিশন নির্দলীয় সরকারের অধীনে বাঘের মতো দাপট দেখালেও দলীয় সরকারের আমলে এসে বিড়াল বনে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বিচারপতি আবদুর রউফের কথা বলতে পারি। ১৯৯১ সালে তাঁর নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পেরেছিল। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে মিরপুরে ও পরে মাগুরার উপনির্বাচনে তারা সবকিছু ওলটপালট করে দিলেও নির্বাচন কমিশন কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। ফলে মাগুরা উপনির্বাচনের কেলেঙ্কারি থেকেই শুরু হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন।
অন্যদিকে মোহাম্মদ আবু হেনার নেতৃত্বাধীন কমিশন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন যে নির্বাচনটি করেছে, তা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচনে যখন কারচুপি করে সরকারদলীয় প্রার্থীকে বেসরকারিভাবে জয়ী ঘোষণা করা হলো, তখন মোহাম্মদ আবু হেনা সেটি গেজেট করতে রাজি হননি। তাঁর পদত্যাগের পরই উপনির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করা হয়।
অতএব নির্বাচন কমিশনে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের পাশাপাশি প্রয়োজন তাদের নির্বিঘ্নে কাজ করতে দেওয়ার সুযোগ। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে ঢের ক্ষমতা দিলেও ক্ষমতাসীন দল কখনোই চায়নি যে সেটি তারা প্রয়োগ করুক। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে এন্তার অভিযোগ। তাদের দুর্বলতা ও দোদুল্যমানতা সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই নির্বাচন কমিশনই গাজীপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করেছে, যার প্রতিটিতে বিরোধী দলের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হবিগঞ্জে সরকারদলীয় সাংসদের শূন্য আসনে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। সরকারি দলও সেই নির্বাচনে বাধা দেয়নি। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনী রাজনীতি বিপরীত ধারায় চলতে থাকে।
তাই আমরা ড. ফরাসউদ্দিনের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেও রাজনৈতিক অস্বস্তি দূর করতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে আরও কিছু ঘোষণা আশা করি। প্রথমত, নির্বাচন কমিশনকে বশে রাখা কিংবা কথায় কথায় প্রত্যাখ্যান করার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কমিশন যাতে স্বাধীনভাবে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে জন্য আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব স্বাধীনতাই ধুলায় গড়িয়ে যায়, যদি আর্থিক স্বাধীনতা না থাকে। অন্য নির্বাচনের সময় না হলেও জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে; যাতে অস্থায়ীভাবে হলেও তারা পছন্দসই লোকবল নিয়োগ করতে পারে।
এই মুহূর্তে বিরোধী দল যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং হরতাল–অবরোধ না করার ঘোষণা দেয়, দেশবাসীর জন্য তা হবে বিশাল আনন্দ ও স্বস্তির বিষয়। কিন্তু সেই ঘোষণার সঙ্গে সরকারকেও একটি ঘোষণা দিতে হবে যে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার কোনো অবস্থায় তারা খর্ব করবে না। ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজ নিজ দলীয় কার্যালয় এলাকায় জনসভা করেছে, নিজ নিজ দলের কর্মসূচি ও রাজনীতি জনগণের সামনে তুলে ধরেছে, তাতে সরকারের কোনো সমস্যা হয়নি। দেশবাসী আশা করে, আগামী দিনেও বিএনপি যেখানে জনসভা-মিছিল করতে চাইবে, সরকার তাতে বাদ সাধবে না। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া বিরোধী দলের কাউকে গ্রেপ্তার করে কিংবা মামলা ঠুকে হয়রানি করবে না।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে এ রকম ঘোষণাও আসতে হবে যে তারা কেউ কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। দলের কেউ নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তাঁকে আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে। একই সঙ্গে এ রকম ঘোষণাও আসা প্রয়োজন যে ভোট ও ভোটারের নিরাপত্তা রক্ষায় তাঁরা বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে একযোগে কাজ করবেন। নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হলেও এত বড় কর্মযজ্ঞ তারা একা করতে পারে না। সে কারণে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভোটার, প্রার্থী, রাজনৈতিক দল—সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। নির্বাচনী অনিয়ম, ভোট কারচুপি, সিল মারা ইত্যাদির দায়ে যদি দু-চারজনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে অন্যরা এ ধরনের গর্হিত ও ঘৃণিত কাজ করতে সাহস পাবে না।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন যাকে অস্বস্তি বলেছেন, সেটি আসলে রাজনৈতিক ব্যাধি। এই ব্যাধিটি উপশমের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরাই প্রতিবার ভুল ওষুধে কিংবা ভুল অস্ত্রোপচারে সেই ব্যাধিটি বাড়িয়ে তুলেছেন। আগে নির্বাচন এলে জোরেশোরে কালোটাকা ও পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য কমানোর দাবি উঠত। এখন প্রধান উদ্বেগ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটি দিতে পারবেন কি না? না, তাঁর ভোটটি অলৌকিকভাবে দেওয়া হয়ে যাবে? অলৌকিক ভোটের মহড়া থেকে মুক্ত হতে সব পক্ষকে সহিষ্ণু ও সংযত হতে হবে। ভোটার অর্থাৎ জনগণের ওপর আস্থা রাখতে হবে; যা সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনে কমই দেখা গেছে।
তবে সেমিনারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল যে অতি মূল্যবান কথাটি বলেছেন, তা হলো ‘দেশ অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি দুর্বৃত্তরা প্রশ্রয় পায়। তবে তার চেয়েও বেশি ÿক্ষতি হবে, যদি ভালো মানুষ চুপ থাকেন।’ গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো সবার বাক্ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করা (কোনোভাবেই সেই স্বাধীনতা অন্যের স্বাধীনতা খর্ব করবে না)। বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই এমন গণতন্ত্র চায় না, যাতে সবাইকে মুখ বন্ধ করে থাকতে হয়। আর মুখ বন্ধ করা গণতন্ত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষমতাসীনেরাই। তাদের পায়ের নিচের মাটি যে সরে যাচ্ছে, সেটি টের পান না।
মানুষকে কথা বলতে দিলে জনপ্রিয়তার বিষয়টি ভোটের আগেই আন্দাজ করা যায়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
সাম্প্রতিক পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এবং ৫ জানুয়ারি ঢাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে অনেকেই রাজনৈতিক সুস্থিরতার লক্ষণ বলে মনে করেন। সেদিন সেমিনারের প্রধান অতিথি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘অনেক ঘটনা ও প্রাণক্ষয়ের ÿপর রাজনীতিতে সুবাতাস বইছে। এটিকে শক্তিশালী করতে হলে দুটি ঘোষণা প্রয়োজন। এক. বিএনপিকে ঘোষণা দিতে হবে যে ২০১৯ সালে তারা জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। দুই. সরকারকেও সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ঢেলে সাজানো হবে।’ সেই সঙ্গে তিনি এও উল্লেখ করেন যে অনেকে বলেন রাজনীতিতে সমস্যা ও সংকট আছে। আমি বলি অস্বস্তি আছে।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞ একজন শিক্ষাব্রতী। তিনি বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব (পিএস) ছিলেন। বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন। বিদেশ থেকে এসে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ রকম একজন ব্যক্তি যখন রাজনীতি বিষয়ে কোনো বক্তব্য রাখেন, তখন সেটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হয়।
তাঁর দুটি প্রস্তাবই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও যোগ করা প্রয়োজন যে রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তাভাবনা ও মনমানসিকতা না বদলালে কেবল দুটি ঘোষণাই রাজনৈতিক স্থিতি আনতে পারবে না। রাজনীতিতে পথ ও মতের ভিন্নতা থাকবে। কর্মসূচি ও পরিকল্পনায় ফারাক থাকবে। সবকিছু এক হলে তো দেশে একটিই রাজনৈতিক দল থাকত। তবে মনে রাখতে হবে, সেই পথ ও মতের ভিন্নতা যেন রাজনীতিকে বিদ্বিষ্ট ও হিংসাশ্রয়ী না করে। সব ধরনের দমনপীড়ন কিংবা অন্তর্ঘাত থেকে রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশে রাজনৈতিক সংকট আর অস্বস্তি যাই থাকুক না কেন এর অবসান হতে হবে।
কিন্তু কীভাবে? প্রথমত, রাজনীতিতে আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর নির্বাচনের সময় তৃতীয় আম্পায়ার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার সুযোগ নেই। তাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকেই আম্পায়ার ঠিক করতে হবে। এ ব্যাপারে ফরাসউদ্দিন নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি যোগ্য লোক দিয়ে নতুন কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায় ‘২০১৭ সালে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সরকারকে বলতে হবে যে এই কমিশনকে পুনঃ নিয়োগ দেওয়া হবে না। যোগ্যতর লোককে বেছে নিতে হবে।’ তাঁর বক্তব্য সমর্থন করে সেমিনারে অপর এক বক্তা বলেছেন, ‘যোগ্য লোকদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন যদি পুনর্গঠিত হয়, তবে ভবিষ্যতে নির্বাচন নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব।’
তবে সেই সংঘাত ও সংঘর্ষের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে দুই দলের মৌখিক ঘোষণাই যথেষ্ট নয়। প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশন কীভাবে কাজ করবে, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। অভিজ্ঞতা বলছে, এর আগে একাধিক নির্বাচন কমিশন নির্দলীয় সরকারের অধীনে বাঘের মতো দাপট দেখালেও দলীয় সরকারের আমলে এসে বিড়াল বনে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বিচারপতি আবদুর রউফের কথা বলতে পারি। ১৯৯১ সালে তাঁর নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পেরেছিল। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে মিরপুরে ও পরে মাগুরার উপনির্বাচনে তারা সবকিছু ওলটপালট করে দিলেও নির্বাচন কমিশন কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। ফলে মাগুরা উপনির্বাচনের কেলেঙ্কারি থেকেই শুরু হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন।
অন্যদিকে মোহাম্মদ আবু হেনার নেতৃত্বাধীন কমিশন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন যে নির্বাচনটি করেছে, তা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচনে যখন কারচুপি করে সরকারদলীয় প্রার্থীকে বেসরকারিভাবে জয়ী ঘোষণা করা হলো, তখন মোহাম্মদ আবু হেনা সেটি গেজেট করতে রাজি হননি। তাঁর পদত্যাগের পরই উপনির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করা হয়।
অতএব নির্বাচন কমিশনে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের পাশাপাশি প্রয়োজন তাদের নির্বিঘ্নে কাজ করতে দেওয়ার সুযোগ। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে ঢের ক্ষমতা দিলেও ক্ষমতাসীন দল কখনোই চায়নি যে সেটি তারা প্রয়োগ করুক। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে এন্তার অভিযোগ। তাদের দুর্বলতা ও দোদুল্যমানতা সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই নির্বাচন কমিশনই গাজীপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করেছে, যার প্রতিটিতে বিরোধী দলের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হবিগঞ্জে সরকারদলীয় সাংসদের শূন্য আসনে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। সরকারি দলও সেই নির্বাচনে বাধা দেয়নি। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনী রাজনীতি বিপরীত ধারায় চলতে থাকে।
তাই আমরা ড. ফরাসউদ্দিনের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেও রাজনৈতিক অস্বস্তি দূর করতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে আরও কিছু ঘোষণা আশা করি। প্রথমত, নির্বাচন কমিশনকে বশে রাখা কিংবা কথায় কথায় প্রত্যাখ্যান করার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কমিশন যাতে স্বাধীনভাবে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে জন্য আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব স্বাধীনতাই ধুলায় গড়িয়ে যায়, যদি আর্থিক স্বাধীনতা না থাকে। অন্য নির্বাচনের সময় না হলেও জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে; যাতে অস্থায়ীভাবে হলেও তারা পছন্দসই লোকবল নিয়োগ করতে পারে।
এই মুহূর্তে বিরোধী দল যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং হরতাল–অবরোধ না করার ঘোষণা দেয়, দেশবাসীর জন্য তা হবে বিশাল আনন্দ ও স্বস্তির বিষয়। কিন্তু সেই ঘোষণার সঙ্গে সরকারকেও একটি ঘোষণা দিতে হবে যে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার কোনো অবস্থায় তারা খর্ব করবে না। ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজ নিজ দলীয় কার্যালয় এলাকায় জনসভা করেছে, নিজ নিজ দলের কর্মসূচি ও রাজনীতি জনগণের সামনে তুলে ধরেছে, তাতে সরকারের কোনো সমস্যা হয়নি। দেশবাসী আশা করে, আগামী দিনেও বিএনপি যেখানে জনসভা-মিছিল করতে চাইবে, সরকার তাতে বাদ সাধবে না। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া বিরোধী দলের কাউকে গ্রেপ্তার করে কিংবা মামলা ঠুকে হয়রানি করবে না।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে এ রকম ঘোষণাও আসতে হবে যে তারা কেউ কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। দলের কেউ নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তাঁকে আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে। একই সঙ্গে এ রকম ঘোষণাও আসা প্রয়োজন যে ভোট ও ভোটারের নিরাপত্তা রক্ষায় তাঁরা বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে একযোগে কাজ করবেন। নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হলেও এত বড় কর্মযজ্ঞ তারা একা করতে পারে না। সে কারণে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভোটার, প্রার্থী, রাজনৈতিক দল—সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। নির্বাচনী অনিয়ম, ভোট কারচুপি, সিল মারা ইত্যাদির দায়ে যদি দু-চারজনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে অন্যরা এ ধরনের গর্হিত ও ঘৃণিত কাজ করতে সাহস পাবে না।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন যাকে অস্বস্তি বলেছেন, সেটি আসলে রাজনৈতিক ব্যাধি। এই ব্যাধিটি উপশমের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরাই প্রতিবার ভুল ওষুধে কিংবা ভুল অস্ত্রোপচারে সেই ব্যাধিটি বাড়িয়ে তুলেছেন। আগে নির্বাচন এলে জোরেশোরে কালোটাকা ও পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য কমানোর দাবি উঠত। এখন প্রধান উদ্বেগ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটি দিতে পারবেন কি না? না, তাঁর ভোটটি অলৌকিকভাবে দেওয়া হয়ে যাবে? অলৌকিক ভোটের মহড়া থেকে মুক্ত হতে সব পক্ষকে সহিষ্ণু ও সংযত হতে হবে। ভোটার অর্থাৎ জনগণের ওপর আস্থা রাখতে হবে; যা সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনে কমই দেখা গেছে।
তবে সেমিনারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল যে অতি মূল্যবান কথাটি বলেছেন, তা হলো ‘দেশ অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি দুর্বৃত্তরা প্রশ্রয় পায়। তবে তার চেয়েও বেশি ÿক্ষতি হবে, যদি ভালো মানুষ চুপ থাকেন।’ গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো সবার বাক্ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করা (কোনোভাবেই সেই স্বাধীনতা অন্যের স্বাধীনতা খর্ব করবে না)। বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই এমন গণতন্ত্র চায় না, যাতে সবাইকে মুখ বন্ধ করে থাকতে হয়। আর মুখ বন্ধ করা গণতন্ত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষমতাসীনেরাই। তাদের পায়ের নিচের মাটি যে সরে যাচ্ছে, সেটি টের পান না।
মানুষকে কথা বলতে দিলে জনপ্রিয়তার বিষয়টি ভোটের আগেই আন্দাজ করা যায়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments