মৌলিক পর্যায়ে নজর দিতে হবে by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকরিজীবীদের বেতনে একটি বড় উল্লম্ফন হওয়ায় তাঁরা স্বস্তিবোধ করছেন। তবে এবার বেতন কমিশনের রিপোর্টে যেসব বেতনভুক্ত গোষ্ঠী আপেক্ষিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা আন্দোলনে নামছেন। এই গোষ্ঠী আকারে ছোট হলে এবং ক্ষমতাহীন হলে দাবি যতই ন্যায্য হোক না কেন, তা উদ্বেগের কারণ হয় না। অন্যথায় তার জন্য বেতন স্কেলে পরিবর্তন আনতে হয়। দাবির যৌক্তিকতা বড় কথা নয়, সংক্ষুব্ধ গোষ্ঠী কতটা শক্তিশালী, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। তবে সংক্ষুব্ধ চাকরিজীবীদের বিষয়টি সুরাহা করতে মৌলিক পর্যায়ে তার সমাধানের চেষ্টা করা উচিত।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সরকারের ক্যাডারভুক্ত কিছু কর্মকর্তা সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। এ বিষয়ে অনেক দিন ধরেই এঁরা তাঁদের অসন্তোষ জানিয়ে এলেও সম্ভবত যথাযথভাবে আমলে নেওয়া হয়নি বলে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক। শিক্ষকেরা মনে করছেন, সীমিত সম্পদে দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে বিশাল জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হবে, যার চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। এই শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে একসময় আমাদের সমকাতারে দাঁড়িয়ে থাকা কোরিয়া, মালয়েশিয়া উন্নয়নের মাপকাঠিতে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। সুতরাং দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে শিক্ষকদের ভূমিকা হবে অগ্রপথিকের।
মেধাবী ও দক্ষ স্নাতক শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে নানা প্রণোদনা দিতে হবে। সুবিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা এমআইটিতে চাকরি করা একজন ভারতীয় দিব্যি সেই লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে আইআইটিতে যোগদান করছেন। নিশ্চয়ই শুধু দেশপ্রেম নয়, নানা ধরনের প্রণোদনাও তাঁকে উৎসাহিত করে। আমাদের দেশে এমনটি হয় না। একইভাবে প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলতে পারেন, সীমিত সম্পদের দেশে সম্পদের সুষম ও শ্রেয়তর বিনিয়োগ দেশের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে, তাই দেশের উন্নয়নে তাঁদের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
একইভাবে চিকিৎসকেরা দেখাবেন দেশের ভগ্ন স্বাস্থ্য ও অপ্রতুল স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদিতে তাঁদের ভূমিকার গুরুত্ব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখাবে অসীম চাহিদার দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখা দেশের উন্নয়নে কত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি পেশার কর্মকর্তারা দেশের উন্নয়নে তাঁদের গুরুত্বের কথা অকাট্য যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। প্রকৃতপক্ষেই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর একান্ত অংশগ্রহণেই দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। এর মধ্যেও বিভিন্ন পেশার কর্মকর্তাদের দক্ষতার অনুপাতে সুযোগ-সুবিধার বণ্টন হলে নিশ্চয়ই নাগরিকেরা নিজেদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলবেন এবং আমরা সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হব।
নিশ্চয়ই ব্যবস্থাপনা কিংবা শিল্প ও উৎপাদন-সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির পড়ালেখায়/গবেষণায় বিভিন্ন কাজে মানুষের দক্ষতাকে পরিমাপ করার পদ্ধতি রয়েছে। আমরা যদি মনে করি, আমাদের কর্মকাণ্ডের কোনো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জিত হয়নি অথবা উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য অধিকতর দক্ষ ও মেধাবী স্নাতকদের যোগদানে উৎসাহিত করা উচিত, তাহলে সেই পেশায় প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দেশের উন্নয়নে সব নাগরিকের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তারপরেও দক্ষতা ও মেধা অনুসারে বেতনকাঠামো নির্ধারণ করলে মানুষ অধিকতর দক্ষ হতে উৎসাহিত হবে এবং দেশ অগ্রগতির পথে ধাবিত হবে। তাই একটি বেতনকাঠামোতে সংক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর বিক্ষোভের মাত্রা দেখে কাঠামোতে পরিবর্তন আনা সমস্যা সমাধানের উপায় হতে পারে না।
দেশ ও সমাজের উন্নয়নে একটি নির্দিষ্ট পেশার অবদান কতটুকু, তা পরিমাপের নিশ্চয়ই একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করা যেতে পারে। পদ্ধতি যতটা নৈর্ব্যক্তিক হবে, তার গ্রহণযোগ্যতা ততটা বেশি হবে। তবে আমরা চাইব, সাধারণ মানুষের করের পয়সায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্নাতক শিক্ষার্থী তঁার অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে দেশের সেবা করুক। একজন সুদক্ষ মেধাবী প্রকৌশলী কিংবা চিকিৎসাশাস্ত্রে পটু স্নাতক যদি এমন চাকরিতে আগ্রহী হন যে তাঁর তরুণ বয়সের চার-পাঁচ বছরের অর্জিত জ্ঞান কোনো কাজে আসবে না, তাহলে তা আমাদের সিস্টেমের গলদ হিসেবেই বিবেচিত হবে, তাঁর শিক্ষাজীবনের পেছনে করা বিনিয়োগ থেকে যথাযথ রিটার্ন দেশ ও জাতি পাবে না।
দেশসেবার এমন ক্ষেত্র নেই, যেখানে আমরা সবিশেষ দক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তেমন কাঙ্ক্ষিত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে সফল হয়নি, যদিও আমরা বলব শিক্ষায় বিনিয়োগের বড়ই অভাব। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ কিংবা সামরিক–শাসিত পাকিস্তানেও শিক্ষার পেছনে যে বরাদ্দ, আমাদের তা নেই। গবেষণা করার সুযোগ মহাসীমিত। একইভাবে আমাদের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক কোনো গোষ্ঠীই প্রশংসনীয় অবদান রাখতে পারেনি। ব্যতিক্রম হলো পোশাকশিল্পের অশিক্ষিত–অর্ধশিক্ষিত মহিলারা, মধ্যপ্রাচ্যে নিগৃহীত হওয়া অর্ধদক্ষ মানুষেরা আর আমাদের দেশের কৃষিবিদেরা, যাঁরা সংকুচিত আবাদযোগ্য ভূমিতে দুই গুণ মানুষের অন্নের ব্যবস্থা করছেন।
আমি যখন স্কুল-কলেজের ছাত্র ছিলাম তখন সব মেধাবী ছাত্রেরই বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার স্বপ্ন ছিল। অবশ্য এর ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়, তবে তা ব্যতিক্রমই। এগুলো সম্ভবত চাকরির সুযোগ-সুবিধা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই ব্যবহারিক শিক্ষা ছাত্রদের এবং তাদের অভিভাবকদের কাছে অধিকতর লোভনীয়। চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে একজন অভিভাবক ২০ লাখ টাকা ব্যয় করতে প্রস্তুত, তাই বলে এক গাদা বিষয়ের নাম করা যেতে পারে তা টাকা দিয়ে পড়া তো দূরে থাক, একজন ভর্তি-ইচ্ছুক শ্রেয়তর কোনো বিষয় না পেয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। আমাদের ছেলেমেয়ে ও তাদের অভিভাবকেরা ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রতি বাতিকগ্রস্ত। আমি নিশ্চিত, এ বিষয়গুলো পড়তে না পারাটা অনেকের জন্যই শাপেবর। আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছেলেকে চিনি, অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এক বছর পড়ে সে যখন বুঝতে পারে এ বিষয়ে তার ভালো ফল করার কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন সে তার পরেরবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় ওপরের দিকে জায়গা পেয়ে তুলনামূলকভাবে কম চাহিদার একটি বিষয় পড়ে শিক্ষক হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে গিয়ে সেখানে শিক্ষকতা করছে।
দেশের সুষম উন্নয়নে প্রতিটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। ক বিষয়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্র এবং খ বিষয়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্রের মধ্যে তুলনা করতে নেই। কিন্তু তারপরও আমরা জানি, অন্তত একাডেমিক অনুশীলনীর জন্য আমাদের যথেষ্ট তথ্য রয়েছে, যা দিয়ে তুলনা করা সম্ভব। অন্তত গড়ে তো বলা যাবে সাধারণ ছাত্রদের কাছে কোন বিষয় আকর্ষণীয় এবং কোন বিষয়ে অধিকতর মেধাবী ছাত্ররা ভর্তি হয়ে থাকেন। এখন আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যাবুলেশনের কম্পিউটারাইজড করা হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে প্রতি বিষয়ের, প্রতি বিষয়ের চাকরিজীবীর, তিনি প্রকৌশলী হোন, ব্যবস্থাপক হোন, চিকিৎসক হোন আর সচিব হোন, বিভিন্ন পরিসংখ্যান বের করতে পারি, তা বিশ্লেষণ করতে পারি, তাঁর থেকে জ্ঞান উদ্ধার করতে পারি এবং জাতীয় পরিকল্পনায় তা ব্যবহার করতে পারি, এমনকি পে–স্কেল তৈরিতে তা কাজে লাগাতে পারি। তবে এ কাজটি করতে চাইলে এখনই করতে হবে। কারণ, কিছুদিনের মধ্যেই কেরানি থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত সবাই জিপিএ-৫ প্রাপ্ত হবেন।
আমাদের পড়ালেখার নানা স্তরে মেধাবী স্নাতকদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করা সুকঠিন। এর মধ্যেও কেন জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করেন, অনেক সময় অনেক গুণ বেশি বেতনের চাকরি বাদ দিয়ে হলেও। মেধাবী স্নাতকদের ধন্যবাদ। এখন অবশ্য চিকিৎসক, প্রকৌশলীদের কেউ কেউ পাঁচ-ছয় বছরের পড়ালেখাকে শূন্য ধরে ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দিচ্ছেন। সরকার যে তাঁর পেছনে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে প্রকৌশলী কিংবা চিকিৎসক হিসেবে শিক্ষা দিল, দেশ তাঁর ওই সেবা থেকে বঞ্চিত হলো।
যিনি পদার্থবিজ্ঞানের সৌন্দর্য উপলব্ধি করেছেন, কিংবা রসায়নের তত্ত্ব, প্রকৌশলের কঠিন বিষয় যিনি আয়ত্ত করতে পেরেছেন, অথবা মানবদেহের জটিল রহস্য, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়ে এসব জ্ঞান–বুদ্ধিকে বিকশিত করা দূরে থাক, তা ভুলে গিয়ে শুধু শ্রেয়তর জীবনযাপনের জন্য অন্য পেশায় চলে যাবেন, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। যদিও আমাদের মতো সীমিত সম্পদের দেশে এটাই কঠিন বাস্তবতা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা খুবই তাত্ত্বিক এবং আনাড়ি বলেই সম্ভবত এই পেশায় নাম লেখান। আমার বিভাগে সবাই ভালো ছাত্র। এদের মধ্যে যারা পড়ালেখায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে, কেউই এখন পর্যন্ত নিজের ক্ষেত্র ছেড়ে অন্য ক্ষেত্রে চাকরি করছে বলে শুনিনি। নানা বিষয়ে চাকরির প্রণোদনা এমন হওয়া উচিত, যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জিত জ্ঞান জনকল্যাণে ব্যবহার করা যায়। বিশ্বায়নের যুগে এবং আমাদের বিদেশপীড়িতের প্রেক্ষাপটে একজন স্নাতকের বহির্বিশ্বে মূল্যও আমরা বিবেচনায় আনতে পারি।
দেশের সিংহভাগ মানুষ কোনো বেতন স্কেলে উপার্জন করেন না। বেতন বৃদ্ধির ফলে নিত্যপণ্যের সম্ভাব্য ঊর্ধ্বমুখী মূল্যে তাঁদের মধ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তবে জাতীয় পে–স্কেলে বেতন না পাওয়া মানুষের সংখ্যা বেতনভুকদের থেকে অনেক বেশি। এদের সিংহভাগ যথেষ্ট শক্তিহীন আর অন্য অংশের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যবসায়ীরা অধিকতর হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে বেতন বৃদ্ধির ফায়দা লোটেন, যার ফলে বেতন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কোনো সংগ্রাম, আন্দোলন নেই; পে–স্কেল নির্ধারণে এই বিষয়টিও আমলে নেওয়া উচিত।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সরকারের ক্যাডারভুক্ত কিছু কর্মকর্তা সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। এ বিষয়ে অনেক দিন ধরেই এঁরা তাঁদের অসন্তোষ জানিয়ে এলেও সম্ভবত যথাযথভাবে আমলে নেওয়া হয়নি বলে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক। শিক্ষকেরা মনে করছেন, সীমিত সম্পদে দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে বিশাল জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হবে, যার চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। এই শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে একসময় আমাদের সমকাতারে দাঁড়িয়ে থাকা কোরিয়া, মালয়েশিয়া উন্নয়নের মাপকাঠিতে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। সুতরাং দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে শিক্ষকদের ভূমিকা হবে অগ্রপথিকের।
মেধাবী ও দক্ষ স্নাতক শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে নানা প্রণোদনা দিতে হবে। সুবিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা এমআইটিতে চাকরি করা একজন ভারতীয় দিব্যি সেই লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে আইআইটিতে যোগদান করছেন। নিশ্চয়ই শুধু দেশপ্রেম নয়, নানা ধরনের প্রণোদনাও তাঁকে উৎসাহিত করে। আমাদের দেশে এমনটি হয় না। একইভাবে প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলতে পারেন, সীমিত সম্পদের দেশে সম্পদের সুষম ও শ্রেয়তর বিনিয়োগ দেশের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে, তাই দেশের উন্নয়নে তাঁদের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
একইভাবে চিকিৎসকেরা দেখাবেন দেশের ভগ্ন স্বাস্থ্য ও অপ্রতুল স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদিতে তাঁদের ভূমিকার গুরুত্ব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখাবে অসীম চাহিদার দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখা দেশের উন্নয়নে কত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি পেশার কর্মকর্তারা দেশের উন্নয়নে তাঁদের গুরুত্বের কথা অকাট্য যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। প্রকৃতপক্ষেই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর একান্ত অংশগ্রহণেই দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। এর মধ্যেও বিভিন্ন পেশার কর্মকর্তাদের দক্ষতার অনুপাতে সুযোগ-সুবিধার বণ্টন হলে নিশ্চয়ই নাগরিকেরা নিজেদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলবেন এবং আমরা সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হব।
নিশ্চয়ই ব্যবস্থাপনা কিংবা শিল্প ও উৎপাদন-সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির পড়ালেখায়/গবেষণায় বিভিন্ন কাজে মানুষের দক্ষতাকে পরিমাপ করার পদ্ধতি রয়েছে। আমরা যদি মনে করি, আমাদের কর্মকাণ্ডের কোনো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জিত হয়নি অথবা উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য অধিকতর দক্ষ ও মেধাবী স্নাতকদের যোগদানে উৎসাহিত করা উচিত, তাহলে সেই পেশায় প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দেশের উন্নয়নে সব নাগরিকের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তারপরেও দক্ষতা ও মেধা অনুসারে বেতনকাঠামো নির্ধারণ করলে মানুষ অধিকতর দক্ষ হতে উৎসাহিত হবে এবং দেশ অগ্রগতির পথে ধাবিত হবে। তাই একটি বেতনকাঠামোতে সংক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর বিক্ষোভের মাত্রা দেখে কাঠামোতে পরিবর্তন আনা সমস্যা সমাধানের উপায় হতে পারে না।
দেশ ও সমাজের উন্নয়নে একটি নির্দিষ্ট পেশার অবদান কতটুকু, তা পরিমাপের নিশ্চয়ই একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করা যেতে পারে। পদ্ধতি যতটা নৈর্ব্যক্তিক হবে, তার গ্রহণযোগ্যতা ততটা বেশি হবে। তবে আমরা চাইব, সাধারণ মানুষের করের পয়সায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্নাতক শিক্ষার্থী তঁার অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে দেশের সেবা করুক। একজন সুদক্ষ মেধাবী প্রকৌশলী কিংবা চিকিৎসাশাস্ত্রে পটু স্নাতক যদি এমন চাকরিতে আগ্রহী হন যে তাঁর তরুণ বয়সের চার-পাঁচ বছরের অর্জিত জ্ঞান কোনো কাজে আসবে না, তাহলে তা আমাদের সিস্টেমের গলদ হিসেবেই বিবেচিত হবে, তাঁর শিক্ষাজীবনের পেছনে করা বিনিয়োগ থেকে যথাযথ রিটার্ন দেশ ও জাতি পাবে না।
দেশসেবার এমন ক্ষেত্র নেই, যেখানে আমরা সবিশেষ দক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তেমন কাঙ্ক্ষিত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে সফল হয়নি, যদিও আমরা বলব শিক্ষায় বিনিয়োগের বড়ই অভাব। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ কিংবা সামরিক–শাসিত পাকিস্তানেও শিক্ষার পেছনে যে বরাদ্দ, আমাদের তা নেই। গবেষণা করার সুযোগ মহাসীমিত। একইভাবে আমাদের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক কোনো গোষ্ঠীই প্রশংসনীয় অবদান রাখতে পারেনি। ব্যতিক্রম হলো পোশাকশিল্পের অশিক্ষিত–অর্ধশিক্ষিত মহিলারা, মধ্যপ্রাচ্যে নিগৃহীত হওয়া অর্ধদক্ষ মানুষেরা আর আমাদের দেশের কৃষিবিদেরা, যাঁরা সংকুচিত আবাদযোগ্য ভূমিতে দুই গুণ মানুষের অন্নের ব্যবস্থা করছেন।
আমি যখন স্কুল-কলেজের ছাত্র ছিলাম তখন সব মেধাবী ছাত্রেরই বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার স্বপ্ন ছিল। অবশ্য এর ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়, তবে তা ব্যতিক্রমই। এগুলো সম্ভবত চাকরির সুযোগ-সুবিধা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই ব্যবহারিক শিক্ষা ছাত্রদের এবং তাদের অভিভাবকদের কাছে অধিকতর লোভনীয়। চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে একজন অভিভাবক ২০ লাখ টাকা ব্যয় করতে প্রস্তুত, তাই বলে এক গাদা বিষয়ের নাম করা যেতে পারে তা টাকা দিয়ে পড়া তো দূরে থাক, একজন ভর্তি-ইচ্ছুক শ্রেয়তর কোনো বিষয় না পেয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। আমাদের ছেলেমেয়ে ও তাদের অভিভাবকেরা ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রতি বাতিকগ্রস্ত। আমি নিশ্চিত, এ বিষয়গুলো পড়তে না পারাটা অনেকের জন্যই শাপেবর। আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছেলেকে চিনি, অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এক বছর পড়ে সে যখন বুঝতে পারে এ বিষয়ে তার ভালো ফল করার কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন সে তার পরেরবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় ওপরের দিকে জায়গা পেয়ে তুলনামূলকভাবে কম চাহিদার একটি বিষয় পড়ে শিক্ষক হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে গিয়ে সেখানে শিক্ষকতা করছে।
দেশের সুষম উন্নয়নে প্রতিটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। ক বিষয়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্র এবং খ বিষয়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্রের মধ্যে তুলনা করতে নেই। কিন্তু তারপরও আমরা জানি, অন্তত একাডেমিক অনুশীলনীর জন্য আমাদের যথেষ্ট তথ্য রয়েছে, যা দিয়ে তুলনা করা সম্ভব। অন্তত গড়ে তো বলা যাবে সাধারণ ছাত্রদের কাছে কোন বিষয় আকর্ষণীয় এবং কোন বিষয়ে অধিকতর মেধাবী ছাত্ররা ভর্তি হয়ে থাকেন। এখন আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যাবুলেশনের কম্পিউটারাইজড করা হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে প্রতি বিষয়ের, প্রতি বিষয়ের চাকরিজীবীর, তিনি প্রকৌশলী হোন, ব্যবস্থাপক হোন, চিকিৎসক হোন আর সচিব হোন, বিভিন্ন পরিসংখ্যান বের করতে পারি, তা বিশ্লেষণ করতে পারি, তাঁর থেকে জ্ঞান উদ্ধার করতে পারি এবং জাতীয় পরিকল্পনায় তা ব্যবহার করতে পারি, এমনকি পে–স্কেল তৈরিতে তা কাজে লাগাতে পারি। তবে এ কাজটি করতে চাইলে এখনই করতে হবে। কারণ, কিছুদিনের মধ্যেই কেরানি থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত সবাই জিপিএ-৫ প্রাপ্ত হবেন।
আমাদের পড়ালেখার নানা স্তরে মেধাবী স্নাতকদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করা সুকঠিন। এর মধ্যেও কেন জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করেন, অনেক সময় অনেক গুণ বেশি বেতনের চাকরি বাদ দিয়ে হলেও। মেধাবী স্নাতকদের ধন্যবাদ। এখন অবশ্য চিকিৎসক, প্রকৌশলীদের কেউ কেউ পাঁচ-ছয় বছরের পড়ালেখাকে শূন্য ধরে ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দিচ্ছেন। সরকার যে তাঁর পেছনে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে প্রকৌশলী কিংবা চিকিৎসক হিসেবে শিক্ষা দিল, দেশ তাঁর ওই সেবা থেকে বঞ্চিত হলো।
যিনি পদার্থবিজ্ঞানের সৌন্দর্য উপলব্ধি করেছেন, কিংবা রসায়নের তত্ত্ব, প্রকৌশলের কঠিন বিষয় যিনি আয়ত্ত করতে পেরেছেন, অথবা মানবদেহের জটিল রহস্য, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়ে এসব জ্ঞান–বুদ্ধিকে বিকশিত করা দূরে থাক, তা ভুলে গিয়ে শুধু শ্রেয়তর জীবনযাপনের জন্য অন্য পেশায় চলে যাবেন, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। যদিও আমাদের মতো সীমিত সম্পদের দেশে এটাই কঠিন বাস্তবতা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা খুবই তাত্ত্বিক এবং আনাড়ি বলেই সম্ভবত এই পেশায় নাম লেখান। আমার বিভাগে সবাই ভালো ছাত্র। এদের মধ্যে যারা পড়ালেখায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে, কেউই এখন পর্যন্ত নিজের ক্ষেত্র ছেড়ে অন্য ক্ষেত্রে চাকরি করছে বলে শুনিনি। নানা বিষয়ে চাকরির প্রণোদনা এমন হওয়া উচিত, যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জিত জ্ঞান জনকল্যাণে ব্যবহার করা যায়। বিশ্বায়নের যুগে এবং আমাদের বিদেশপীড়িতের প্রেক্ষাপটে একজন স্নাতকের বহির্বিশ্বে মূল্যও আমরা বিবেচনায় আনতে পারি।
দেশের সিংহভাগ মানুষ কোনো বেতন স্কেলে উপার্জন করেন না। বেতন বৃদ্ধির ফলে নিত্যপণ্যের সম্ভাব্য ঊর্ধ্বমুখী মূল্যে তাঁদের মধ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তবে জাতীয় পে–স্কেলে বেতন না পাওয়া মানুষের সংখ্যা বেতনভুকদের থেকে অনেক বেশি। এদের সিংহভাগ যথেষ্ট শক্তিহীন আর অন্য অংশের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যবসায়ীরা অধিকতর হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে বেতন বৃদ্ধির ফায়দা লোটেন, যার ফলে বেতন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কোনো সংগ্রাম, আন্দোলন নেই; পে–স্কেল নির্ধারণে এই বিষয়টিও আমলে নেওয়া উচিত।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments