টিভিতে রাজনৈতিক দলের প্রচার by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
টেলিভিশন
একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম। বিভিন্ন দেশ এই মাধ্যম ব্যবহার করে বহু কিছু
করেছে। আমরা এখনো এই মাধ্যমকে বিনোদন ও তথ্যের (খবর ও টক শো) জন্যই ব্যবহার
করছি। বেশির ভাগ তথ্যই রাজনৈতিক। রাজনীতির বাইরে জ্ঞান-বিজ্ঞান, উন্নয়ন,
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ ও আরও নানা বিষয়ের তথ্যও যে এই মাধ্যমে
পরিকল্পিতভাবে প্রচার করার সুযোগ ছিল, তা আমরা করিনি। কয়েকটি বিষয়ে সামান্য
ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু জোর দিয়ে বলব, টিভি মাধ্যমটি পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার
হয়নি। শুধু শিক্ষার প্রসার নিয়েই টিভি মাধ্যমে অনেক কাজ করার সুযোগ ছিল।
কিন্তু না সরকার, না বেসরকারি খাত—কেউ এ ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি। আমাদের
ধারণা, শুধু শিক্ষা নিয়েই একটি সুপরিকল্পিত টিভি চ্যানেল জনপ্রিয় ও
ব্যবসায়িকভাবে সফল হতে পারে।
টেলিভিশনকে রাজনীতির কাজেও ভালোভাবে ব্যবহার করার সুযোগ ছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, সব টিভি চ্যানেলই তো দিন-রাত রাজনীতিই প্রচার করছে। তা আংশিক সত্য। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে রাজনীতি প্রচারিত হচ্ছে চ্যানেলের মালিক ও অনুষ্ঠান প্রযোজকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ যে যেভাবে দেখে বা বিশ্লেষণ করতে চায়, টিভি চ্যানেলে রাজনীতি সেভাবেই প্রচারিত হচ্ছে। কোনো দল তাদের বক্তব্য অসম্পাদিত বা অবিকৃতভাবে প্রচার করতে পারছে না। সংবাদপত্রের পাতাজুড়ে রাজনৈতিক দল বিভিন্ন উপলক্ষে তাদের বক্তব্য প্রচার করতে পারছে (ক্রোড়পত্র)। কিন্তু টিভি মাধ্যমে পারছে না। এটা বৈষম্য, সরকারের ভুল নীতি। এটা গণতন্ত্রচর্চার প্রতিবন্ধক।
২৯ ডিসেম্বর ২০১৫ প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটা খবর থেকে জানতে পেরেছি, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিএনপির একটি বিজ্ঞাপন প্রচারে সরকারের তরফ থেকে পরোক্ষভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে। সরকার অবশ্য কোনো চিঠি লিখে বাধা দেয়নি। চিঠি ছাড়াও সরকার যে নানাভাবে বাধা দিতে পারে (তা প্রমাণও করা যায় না), সেই অভিজ্ঞতা আমাদের বহু আগেই হয়েছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বিএনপির বিজ্ঞাপন প্রচারে অপারগতা জানিয়েছে। কেন অপারগতা জানিয়েছে, সেটা বোঝাও কঠিন নয়। কয়েক দিন আগে বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের লাইভ কভারেজও কোনো কোনো আগ্রহী টিভি চ্যানেলকে প্রচার করতে দেওয়া হয়নি। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এগুলো নিন্দনীয়। আমরা টিভি মাধ্যমের শক্তি ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না।
বিষয়টা শুধু বিএনপি বা আওয়ামী লীগের নয়। বিএনপি বা আওয়ামী লীগের জন্য কোনো পৃথক নীতি হতে পারে না। তথ্য মন্ত্রণালয় এমন একটি নীতিমালা করতে পারে, যার ভিত্তিতে যেকোনো রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান টিভি চ্যানেলের সময় কিনে নিয়ে তাদের বক্তব্য প্রচার করতে পারবে। তবে লাইভ প্রচারে যেহেতু নানা সমস্যা থাকে (যেমন প্রচারযোগ্য নয় এমন ভাষায় কথা বলা), সে জন্য প্রথম পর্যায়ে আগে ধারণকৃত বক্তব্য বা অনুষ্ঠান প্রচার করার সুযোগ থাকা উচিত। ধারণকৃত বক্তব্য প্রচারিত হলে দলের বা ব্যক্তির জন্যও ভালো। দল নেতাদের লাগামহীন বক্তৃতা সম্পাদনা করে বক্তব্য সুন্দরভাবে প্রচার করতে পারে। অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য ছেঁটে ফেলা যায়। সরাসরি সম্প্রচারে সেই সুযোগ থাকে না।
নীতিমালায় এ রকম কিছু শর্ত থাকতে পারে। কোনো টিভি চ্যানেল বিজ্ঞাপনের মতো টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করতে চাইলে সরকারের বাধা দেওয়া উচিত নয়। তবে টিভি চ্যানেলকে নিজস্ব সেন্সর নীতি রাখতে হবে। যে ভাষা জনসমক্ষে প্রচার করা যায় না, সে রকম ভাষার বক্তব্য, ব্যক্তিগত অভিযোগ, বিদ্বেষ, হিংসা প্রচার টিভি চ্যানেল স্বউদ্যোগে বাদ দেবে, এটাই প্রত্যাশিত।
আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন জনসভা, মিছিল ইত্যাদির নামে ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে এমন তুলকালাম যানজট বাধিয়ে বসে, যার কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের এসব কর্মসূচি দেখলে মনে হয়, এই শহরের মালিক কেবল তারাই। শহরে যে আরও মানুষ থাকে, তাদের নানা জরুরি কাজ থাকতে পারে, জনসভামুখী রাজনৈতিক কর্মীরা (অনেকে ভাড়াটে) তা গ্রাহ্য করেন না। জনসভা ও মিছিল শুধু সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস আগে করলেই তো হয়। বছরের বাকি সময় রাজনৈতিক দল টিভি, বেতার ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে পারে। বাস, ট্রাক ও লোক ভাড়া করে জনসভা আয়োজনের চেয়ে টিভি ও বেতারে একটা ‘বক্তৃতা অনুষ্ঠান’ করলে অনেক ভালো ফল পাওয়া যাবে। এখন তো শুধু ঢাকায় বড়জোর এক লাখ লোক রাজনৈতিক দলের জনসভা শুনতে আসে। টিভি ও বেতারে প্রচার হলে ১৬ কোটি লোক নেতাদের বক্তৃতা শুনতে পারবে। বিদেশেও শুনতে পারবে। মাঠে জনসভার বদলে একটি মিলনায়তনেও সভার আয়োজন করা যায়। এতে স্লোগান দেওয়ার সুবিধা থাকবে, ঝামেলাও অনেক কমে যাবে। সেই সভার বক্তব্য পরে সম্পাদনা করে টিভি ও বেতারে প্রচার করলে ব্যাপকসংখ্যক শ্রোতার কাছে তা পৌঁছানো সম্ভব।
বিভিন্ন টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে মাসে একটি ‘দলীয় অনুষ্ঠান’ করার সুযোগ দিতে পারে। এটা মাসিক ভিত্তিতে হবে। এই অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দল তাদের পরিকল্পনামতো সময়টা ব্যবহার করবে। ধরা যাক, এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান। রাজনৈতিক দল এই এক ঘণ্টায় কোনো ইস্যুতে তাদের বক্তব্য, ভিন্ন দল বা সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, দর্শকদের চিঠির (ই-মেইল) জবাব ইত্যাদি বলবে। মোটকথা, এখানে চ্যানেল মালিক, অনুষ্ঠান প্রযোজক, মডারেটর তাঁদের গুপ্ত রাজনৈতিক এজেন্ডা দিয়ে ওই অনুষ্ঠানকে প্রভাবিত করতে পারবেন না। তবে চ্যানেল কর্তৃপক্ষের সম্পাদকীয় নীতি রাজনৈতিক দলকে মেনে চলতে হবে। সর্বোপরি এটা হবে আগে ধারণকৃত অনুষ্ঠান। চূড়ান্ত সম্পাদনার দায়িত্ব চ্যানেল কর্তৃপক্ষের, তা করা হবে দুই পক্ষের সম্মতিতে।
বর্তমানে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ফাঁকা কথাসর্বস্ব অনেক টক শো প্রচারিত হয়। একই বক্তা প্রায় একই বক্তব্য অন্তত কয়েক শ বার টক শোতে বলেছেন। এ ধরনের টক শোর পরিবর্তে মাসে একটি অনুষ্ঠান রাজনৈতিক দলকে দিলে খুব খারাপ হতো না। এ ধরনের অনুষ্ঠান হলে রাজনৈতিক দলকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। মাঠে-ময়দানে অনেক দায়িত্বহীন কথা বলা যায় করতালির লোভে। কিন্তু টিভি মিডিয়ায় দায়িত্বহীন কথা বলতে অনেক নেতাই আগ্রহী হবেন না। সেদিক থেকেও রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান বা বিপক্ষ দলের সমালোচনার সময় রাজনৈতিক নেতাকে সচেতন হতে হবে।
রাজনৈতিক দলের বক্তব্য টিভি বা বেতারে প্রচার হওয়া দোষের কিছু নয়। আর এই সুযোগ তো শুধু বিএনপি পাবে না, আওয়ামী লীগ ও অন্য দলও পাবে। রাজনীতিই তো গণতন্ত্রের মূলকথা। সেই রাজনীতিকে উপেক্ষা করলে গণতন্ত্রের আর থাকে কী! তা ছাড়া কোনো দল বা নেতাকে ফ্রিস্টাইলে টিভি মাধ্যম ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। প্রত্যেকের বক্তব্য হতে হবে দায়িত্বশীল, গঠনমূলক ও রুচিশীল ভাষায়। যেহেতু প্রতিটি অনুষ্ঠান রেকর্ডেড হবে, সেহেতু টিভি কর্তৃপক্ষের নিজস্ব নীতিমালা প্রয়োগেরও সুযোগ থাকবে।
আশা করি, সরকার টিভি চ্যানেলগুলোকে এসব ব্যাপারে চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবসাকৌশল ও সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী যেকোনো রাজনৈতিক দলের জনসভা, সংবাদ সম্মেলন, সেমিনার প্রচার করতে পারে। এর মাঝখানে সরকার যেন বাধা না হয়। শুধু পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠান নয়, টিভিতে সরকার, সরকারি দল, বিরোধী দল তাদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, স্লোগান, আবেদন, ঘোষণা ইত্যাদি যেকোনো কিছু শোভন ভাষায় ‘বিজ্ঞাপন’ আকারে প্রচার করতে পারে। এটা প্রত্যেকের গণতান্ত্রিক অধিকার। বহুদলীয় রাজনীতি ও গণতন্ত্রচর্চার জন্য এই সুযোগ থাকা দরকার।
টিভি মিডিয়াকে আমরা খুব সীমিতভাবে ব্যবহার করছি। টিভির শক্তি অনেক। সরকার চাইলে শিক্ষা, উন্নয়ন ও ক্রীড়ার জন্য বিশেষায়িত টিভি চ্যানেল স্থাপনে নানা রকম আর্থিক ও কর সুবিধা দিতে পারে। কোনো প্রাইভেট কোম্পানি একটি শিক্ষা বা উন্নয়ন টিভি চ্যানেল স্থাপনের কথা চিন্তা করতে পারে। আমাদের আশা, এ ব্যাপারে সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করবে। যেহেতু এই ধরনের চ্যানেল ব্যবসায়িক স্পনসর কম পাবে, তাই সরকারের নানা প্রণোদনা প্রয়োজন হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
টেলিভিশনকে রাজনীতির কাজেও ভালোভাবে ব্যবহার করার সুযোগ ছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, সব টিভি চ্যানেলই তো দিন-রাত রাজনীতিই প্রচার করছে। তা আংশিক সত্য। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে রাজনীতি প্রচারিত হচ্ছে চ্যানেলের মালিক ও অনুষ্ঠান প্রযোজকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ যে যেভাবে দেখে বা বিশ্লেষণ করতে চায়, টিভি চ্যানেলে রাজনীতি সেভাবেই প্রচারিত হচ্ছে। কোনো দল তাদের বক্তব্য অসম্পাদিত বা অবিকৃতভাবে প্রচার করতে পারছে না। সংবাদপত্রের পাতাজুড়ে রাজনৈতিক দল বিভিন্ন উপলক্ষে তাদের বক্তব্য প্রচার করতে পারছে (ক্রোড়পত্র)। কিন্তু টিভি মাধ্যমে পারছে না। এটা বৈষম্য, সরকারের ভুল নীতি। এটা গণতন্ত্রচর্চার প্রতিবন্ধক।
২৯ ডিসেম্বর ২০১৫ প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটা খবর থেকে জানতে পেরেছি, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিএনপির একটি বিজ্ঞাপন প্রচারে সরকারের তরফ থেকে পরোক্ষভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে। সরকার অবশ্য কোনো চিঠি লিখে বাধা দেয়নি। চিঠি ছাড়াও সরকার যে নানাভাবে বাধা দিতে পারে (তা প্রমাণও করা যায় না), সেই অভিজ্ঞতা আমাদের বহু আগেই হয়েছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বিএনপির বিজ্ঞাপন প্রচারে অপারগতা জানিয়েছে। কেন অপারগতা জানিয়েছে, সেটা বোঝাও কঠিন নয়। কয়েক দিন আগে বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের লাইভ কভারেজও কোনো কোনো আগ্রহী টিভি চ্যানেলকে প্রচার করতে দেওয়া হয়নি। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এগুলো নিন্দনীয়। আমরা টিভি মাধ্যমের শক্তি ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না।
বিষয়টা শুধু বিএনপি বা আওয়ামী লীগের নয়। বিএনপি বা আওয়ামী লীগের জন্য কোনো পৃথক নীতি হতে পারে না। তথ্য মন্ত্রণালয় এমন একটি নীতিমালা করতে পারে, যার ভিত্তিতে যেকোনো রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান টিভি চ্যানেলের সময় কিনে নিয়ে তাদের বক্তব্য প্রচার করতে পারবে। তবে লাইভ প্রচারে যেহেতু নানা সমস্যা থাকে (যেমন প্রচারযোগ্য নয় এমন ভাষায় কথা বলা), সে জন্য প্রথম পর্যায়ে আগে ধারণকৃত বক্তব্য বা অনুষ্ঠান প্রচার করার সুযোগ থাকা উচিত। ধারণকৃত বক্তব্য প্রচারিত হলে দলের বা ব্যক্তির জন্যও ভালো। দল নেতাদের লাগামহীন বক্তৃতা সম্পাদনা করে বক্তব্য সুন্দরভাবে প্রচার করতে পারে। অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য ছেঁটে ফেলা যায়। সরাসরি সম্প্রচারে সেই সুযোগ থাকে না।
নীতিমালায় এ রকম কিছু শর্ত থাকতে পারে। কোনো টিভি চ্যানেল বিজ্ঞাপনের মতো টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করতে চাইলে সরকারের বাধা দেওয়া উচিত নয়। তবে টিভি চ্যানেলকে নিজস্ব সেন্সর নীতি রাখতে হবে। যে ভাষা জনসমক্ষে প্রচার করা যায় না, সে রকম ভাষার বক্তব্য, ব্যক্তিগত অভিযোগ, বিদ্বেষ, হিংসা প্রচার টিভি চ্যানেল স্বউদ্যোগে বাদ দেবে, এটাই প্রত্যাশিত।
আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন জনসভা, মিছিল ইত্যাদির নামে ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে এমন তুলকালাম যানজট বাধিয়ে বসে, যার কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের এসব কর্মসূচি দেখলে মনে হয়, এই শহরের মালিক কেবল তারাই। শহরে যে আরও মানুষ থাকে, তাদের নানা জরুরি কাজ থাকতে পারে, জনসভামুখী রাজনৈতিক কর্মীরা (অনেকে ভাড়াটে) তা গ্রাহ্য করেন না। জনসভা ও মিছিল শুধু সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস আগে করলেই তো হয়। বছরের বাকি সময় রাজনৈতিক দল টিভি, বেতার ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে পারে। বাস, ট্রাক ও লোক ভাড়া করে জনসভা আয়োজনের চেয়ে টিভি ও বেতারে একটা ‘বক্তৃতা অনুষ্ঠান’ করলে অনেক ভালো ফল পাওয়া যাবে। এখন তো শুধু ঢাকায় বড়জোর এক লাখ লোক রাজনৈতিক দলের জনসভা শুনতে আসে। টিভি ও বেতারে প্রচার হলে ১৬ কোটি লোক নেতাদের বক্তৃতা শুনতে পারবে। বিদেশেও শুনতে পারবে। মাঠে জনসভার বদলে একটি মিলনায়তনেও সভার আয়োজন করা যায়। এতে স্লোগান দেওয়ার সুবিধা থাকবে, ঝামেলাও অনেক কমে যাবে। সেই সভার বক্তব্য পরে সম্পাদনা করে টিভি ও বেতারে প্রচার করলে ব্যাপকসংখ্যক শ্রোতার কাছে তা পৌঁছানো সম্ভব।
বিভিন্ন টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে মাসে একটি ‘দলীয় অনুষ্ঠান’ করার সুযোগ দিতে পারে। এটা মাসিক ভিত্তিতে হবে। এই অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দল তাদের পরিকল্পনামতো সময়টা ব্যবহার করবে। ধরা যাক, এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান। রাজনৈতিক দল এই এক ঘণ্টায় কোনো ইস্যুতে তাদের বক্তব্য, ভিন্ন দল বা সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, দর্শকদের চিঠির (ই-মেইল) জবাব ইত্যাদি বলবে। মোটকথা, এখানে চ্যানেল মালিক, অনুষ্ঠান প্রযোজক, মডারেটর তাঁদের গুপ্ত রাজনৈতিক এজেন্ডা দিয়ে ওই অনুষ্ঠানকে প্রভাবিত করতে পারবেন না। তবে চ্যানেল কর্তৃপক্ষের সম্পাদকীয় নীতি রাজনৈতিক দলকে মেনে চলতে হবে। সর্বোপরি এটা হবে আগে ধারণকৃত অনুষ্ঠান। চূড়ান্ত সম্পাদনার দায়িত্ব চ্যানেল কর্তৃপক্ষের, তা করা হবে দুই পক্ষের সম্মতিতে।
বর্তমানে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ফাঁকা কথাসর্বস্ব অনেক টক শো প্রচারিত হয়। একই বক্তা প্রায় একই বক্তব্য অন্তত কয়েক শ বার টক শোতে বলেছেন। এ ধরনের টক শোর পরিবর্তে মাসে একটি অনুষ্ঠান রাজনৈতিক দলকে দিলে খুব খারাপ হতো না। এ ধরনের অনুষ্ঠান হলে রাজনৈতিক দলকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। মাঠে-ময়দানে অনেক দায়িত্বহীন কথা বলা যায় করতালির লোভে। কিন্তু টিভি মিডিয়ায় দায়িত্বহীন কথা বলতে অনেক নেতাই আগ্রহী হবেন না। সেদিক থেকেও রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান বা বিপক্ষ দলের সমালোচনার সময় রাজনৈতিক নেতাকে সচেতন হতে হবে।
রাজনৈতিক দলের বক্তব্য টিভি বা বেতারে প্রচার হওয়া দোষের কিছু নয়। আর এই সুযোগ তো শুধু বিএনপি পাবে না, আওয়ামী লীগ ও অন্য দলও পাবে। রাজনীতিই তো গণতন্ত্রের মূলকথা। সেই রাজনীতিকে উপেক্ষা করলে গণতন্ত্রের আর থাকে কী! তা ছাড়া কোনো দল বা নেতাকে ফ্রিস্টাইলে টিভি মাধ্যম ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। প্রত্যেকের বক্তব্য হতে হবে দায়িত্বশীল, গঠনমূলক ও রুচিশীল ভাষায়। যেহেতু প্রতিটি অনুষ্ঠান রেকর্ডেড হবে, সেহেতু টিভি কর্তৃপক্ষের নিজস্ব নীতিমালা প্রয়োগেরও সুযোগ থাকবে।
আশা করি, সরকার টিভি চ্যানেলগুলোকে এসব ব্যাপারে চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবসাকৌশল ও সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী যেকোনো রাজনৈতিক দলের জনসভা, সংবাদ সম্মেলন, সেমিনার প্রচার করতে পারে। এর মাঝখানে সরকার যেন বাধা না হয়। শুধু পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠান নয়, টিভিতে সরকার, সরকারি দল, বিরোধী দল তাদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, স্লোগান, আবেদন, ঘোষণা ইত্যাদি যেকোনো কিছু শোভন ভাষায় ‘বিজ্ঞাপন’ আকারে প্রচার করতে পারে। এটা প্রত্যেকের গণতান্ত্রিক অধিকার। বহুদলীয় রাজনীতি ও গণতন্ত্রচর্চার জন্য এই সুযোগ থাকা দরকার।
টিভি মিডিয়াকে আমরা খুব সীমিতভাবে ব্যবহার করছি। টিভির শক্তি অনেক। সরকার চাইলে শিক্ষা, উন্নয়ন ও ক্রীড়ার জন্য বিশেষায়িত টিভি চ্যানেল স্থাপনে নানা রকম আর্থিক ও কর সুবিধা দিতে পারে। কোনো প্রাইভেট কোম্পানি একটি শিক্ষা বা উন্নয়ন টিভি চ্যানেল স্থাপনের কথা চিন্তা করতে পারে। আমাদের আশা, এ ব্যাপারে সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করবে। যেহেতু এই ধরনের চ্যানেল ব্যবসায়িক স্পনসর কম পাবে, তাই সরকারের নানা প্রণোদনা প্রয়োজন হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments