চরম সংকটে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা by এম সাখাওয়াত হোসেন
ভেবেছিলাম,
এ পর্যায়ে নির্বাচন নিয়ে লেখার পর্ব শেষ। কারণ, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫-এর পৌর
নির্বাচনের পর ওই নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা, আলোচনা আর অনেক বিশ্লেষণ
হয়েছে। বারবার মনে হয়েছে, আমাদের দেশে মোটামুটি একটি সুস্থধারার
নির্বাচনের যে প্রয়াস গত দুই দশকে কমবেশি দেখা গিয়েছিল, তা ২০১৪ সালের
শুরুতে যে হোঁচট খেয়েছিল, সেখান থেকে আর বের হতে পারেনি। তারপরও অনেকে আশা
করেছিলেন এ অবস্থা থেকে হয়তো বের হওয়া যাবে। তবে আমি একমত হতে পারছিলাম
না। অনেকে বলেছিলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ২০১৪ সালের পরের অন্যান্য
নির্বাচন থেকে অন্তত ভালো ছিল। সেখানেও আমার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, এখনো
আছে। অন্তত ১২ জানুয়ারি, ২০১৬ সালে পূর্বতন নির্বাচনে স্থগিত হওয়া মাধবদী
পৌরসভার পূর্ণাঙ্গ এবং আরও বেশ কিছু স্থগিত বিভিন্ন পৌরসভার বিচ্ছিন্ন
কেন্দ্রগুলোর ঘটনাবহুল পুনর্নির্বাচন তেমনটাই বলে।
কয়েকটি পত্রিকার বিস্তারিত তথ্য বিবরণে (প্রথম আলো, আমাদের সময়; ১৩ জানুয়ারি, ২০১৬) এবং দু-একটি বেসরকারি টেলিভিশনে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা সত্যিই হতাশাজনক। কারণ, মূল নির্বাচনে যা-ই হয়ে থাক না বা হয় না কেন, অতীতে ওই সব বিচ্যুতি ইতিপূর্বে স্থগিত নির্বাচনগুলোতে দেখা যায়নি। স্থগিত বা পুনর্নির্বাচন সাধারণত এমনভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়, যেখানে ফাঁকফোকর যেমন থাকে না, তেমনি নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করায় কোনো সমস্যাই থাকে না। হাতে গোনা কয়েকটি এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা আমাদের নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনো বড় ঘটনা হওয়ার কথা নয়। অতীতে এ ধরনের নির্বাচন নিয়ে সংবাদপত্র বা অন্যান্য মিডিয়ায় এতখানি জায়গা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বলেও মনে হয় না।
অন্যান্য স্থগিত কেন্দ্রের বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোটের মহোৎসব হয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। তবে মাধবদী পৌরসভার সম্পূর্ণ ১২টি কেন্দ্রের যে বিস্তারিত তথ্য ১৩ জানুয়ারি, ২০১৬-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা নির্বাচন বিষয়ে যাঁরা গবেষণা করার ইচ্ছা রাখেন, তাঁদের জন্য একটি ‘কেস স্টাডি’ হতে পারে। ওই উপনির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীই জয়ী হয়েছেন, হয়তো সুষ্ঠু ভোট হলেও তিনিই নির্বাচিত হতেন। এসব নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের এত বড় ব্যবস্থাপনার মধ্যে কেন এমন হবে, তা গবেষণার বিষয় হতে পারে।
প্রকাশিত তথ্যমতে, মাধবদী নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য প্রায় শতাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং ১২টি কেন্দ্রের জন্য আটজন নির্বাচনী কর্মকর্তাকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অভিজ্ঞতার আলোকে ধারণা করা যায় যে এসব কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এমতাবস্থায় এমন কারচুপি, জাল ভোট আর কেন্দ্র দখল কেন এবং কীভাবে হতে পারে? এতসংখ্যক সদস্য থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন কি একেবারেই অন্ধকারে ছিল? তথ্যে প্রকাশ যে ওই পৌরসভার ভোট গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করার জন্য নির্বাচন কমিশনের একজন অতি অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি কী দেখেছিলেন এবং নির্বাচন কমিশনে কী তথ্য দিয়েছিলেন, তাও জানা যায়নি। এত বেষ্টনীর মধ্যেও দুটি কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণের পর প্রকাশ্যে দখল করা হয়েছিল। ওই কেন্দ্রগুলো স্থগিত করা হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এত কিছুর পরেও কেন এই নির্বাচনকে বৈধ করতে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করলেন? তিনি কি এ অরাজকতার খবর পাননি? এমতাবস্থায় নির্বাচন কমিশনের কী করণীয় ছিল বা করতে পারত? এতসব কাণ্ড যখন চলছিল তখন নির্বাচন কমিশনে কী ধরনের তথ্য আসছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর নির্বাচন কমিশনই দিতে পারবে। তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন কমিশনের না জানার কথা নয়। মাধবদী ঢাকা থেকে তেমন দূরেও নয়।
মাধবদীর নির্বাচন পর্যালোচনায় বেশ কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে, যার দু-একটির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার দাবি রাখে। প্রথমই প্রশ্ন ওঠে যে সরকারি দলের প্রার্থী, যাঁদের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এগিয়ে থাকার কথা, তাঁদের পক্ষে কেন নির্বাচনে তথ্যমতে কারচুপির পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে? সরকারি দলের বিপক্ষে মূলত যে দলটি রয়েছে, তাদের সাংগঠনিক অবস্থা দৃশ্যত দুর্বল এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে প্রায় প্রতিদিন সরকারি দলের মুখপাত্ররা বলে থাকেন। এমনকি ইদানীং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেফাঁস অহেতুক মন্তব্যও তাদের বিপক্ষে গেছে বলে মনে করা হয়। তথাপি সরকারি দলের প্রার্থীকে এমন অবস্থায় কেন যেতে হলো?
কারচুপি নানাবিধ কারণে হয়ে থাকে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। এলবার্টো সিম্পস তাঁর গবেষণা পুস্তক হোয়াই গভর্নমেন্টস অ্যান্ড পার্টিস ম্যানিপুলেট ইলেকশনস (Why Governments and Parties Manipulate Elections) উল্লেখ করেন যে মূলত দুটি কারণে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে কারচুপির আশ্রয় নেয়। প্রথমত, প্রধানত রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় নেয়। অবশ্য যদি প্রতিপক্ষ দুর্বল এবং প্রতিহত করার মতো অবস্থায় না থাকে। যদিও এখানে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা সংস্থার কার্যকারিতার উল্লেখ করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, প্রার্থী পর্যায়ে কারচুপির আশ্রয় নেওয়ারও বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য বিজয় নিশ্চিত করার বিষয়টি যেমন থাকে, তেমনি বিপক্ষকে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের বিষয়টিও থাকে। অনেক সময় অনেক শক্তিশালী প্রার্থী, যাঁর বিজয় নিশ্চিত, এমন ক্ষেত্রেও ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় নিয়ে থাকেন ওপরে উল্লেখিত কারণে এবং তিনি যে ব্যাপক জনপ্রিয় তার প্রমাণ দিতে। হয়তো এসবের প্রয়োজন হয় না, তথাপি কারচুপির আশ্রয় নেওয়া হয়। অবশ্য এসব গবেষণা আমাদের মতো আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে করা হয়েছে। এই গবেষক মনে করেন যে এভাবে যারা বা যে দল বিজয়ী হয়, তাদের এ জয় জনসমর্থিত বা বৈধ না হলেও প্রতিপক্ষকে দুর্বল প্রমাণ করা এবং জনগণকে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়ে থাকে।
উপরিউক্ত গবেষণায় অনেক ফাঁকফোকর থাকলেও এমন কারচুপির নজির এন্তার। আমরা ইদানীং নির্বাচনে যে ধরনের কারচুপির উদাহরণ দেখছি, তা বিশ্লেষণ করলেও এমনই বিষয় দৃশ্যমান হয়। বিশেষ করে স্থানীয় নির্বাচন যদি সরকারি দলের জনপ্রিয়তার এবং প্রতিপক্ষকে আরও দুর্বল করার বিষয়টি যুক্ত থাকে। অবস্থাদৃষ্টে তেমনই মনে হচ্ছে। সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থীদের সিংহভাগ হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনে জয়ী হতেন বলে অনেকেই মনে করেন। এ ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারি দল কতখানি লাভবান হয়েছে, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।
আমি যে গবেষণার কথা বলেছি তা তাত্ত্বিক হলেও এর প্রতিফলন অনেক দেশের নির্বাচন পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে। এমতাবস্থায় নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্থার করণীয় তেমন আলোচনায় আসেনি। নির্বাচন যাতে ব্যাপক কারচুপির মুখে না পড়ে, সে কারণে আমাদের মতো দেশে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন সংবিধান দ্বারা গঠিত হয়েছে। সংবিধানের আওতায় প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য করার জন্য। বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হতে হলে নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করতেই হবে। বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান ক্ষমতা দিয়েছে।
বিদ্যমান নির্বাচনী আইন মোতাবেক নির্বাচন চলাকালীন যেকোনো সময়ে যদি প্রতীয়মান হয় যে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য বা অবাধ হচ্ছে না, কমিশন তার ক্ষমতা বলে আংশিক অথবা সম্পূর্ণ নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। অপরদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা বেসরকারিভাবে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের কাছে আইনানুগ কতখানি ক্ষমতা রয়েছে তা তেমনভাবে উল্লেখ না থাকলেও সংবিধানের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, যদি কমিশন সে ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে দৃঢ় মনোভাব পোষণ করে। অবশ্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে, যদি সে ধরনের দৃঢ়চেতা কমিশন কার্যকর থাকে। মাধবদী একটি উদাহরণ হয়ে থাকত যদি নির্বাচন কমিশন পুনরায় স্থগিত করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিত। হয়তো উচ্চ আদালতে এখতিয়ার নিয়ে চ্যালেঞ্জ হতে পারত, তাতে বিপরীত সিদ্ধান্ত হলেও নৈতিকভাবে নির্বাচন কমিশন জয়ী হতো।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে আমাদের মতো দেশের এহেন পরিস্থিতিতে কারচুপি ঠেকাতেই এত আইন এবং যজ্ঞ করতে হয়, যার উদাহরণ মাধবদী। তথাপি কারচুপি ঠেকানো যায়নি কেন? কেনই-বা নির্বাচন চলাকালীন কমিশন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি, তার উত্তর নির্বাচন কমিশনই দিতে পারবে।
নির্বাচন কমিশনের হাতকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকেই বলে থাকেন। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, এখানে যে ফাঁকফোকর রয়েছে তার প্রতিকারে আইনের মাধ্যমে রিটার্নিং কর্মকর্তার বেসরকারিভাবে ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ করার নিশ্চিত ক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে আইনে উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। তবে যত আইনই থাকুক বা সংযোজন করা হোক না কেন, তা প্রয়োগ না করলে দৃশ্যমান কারচুপি ঠেকানো সম্ভব নয়। এ আলোচনা শেষ করব মাও সেতুংয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে। ‘ইট ইজ নট দ্য গান বাট মেন বিহাইন্ড দ্য গান মেটারস’ (কামান নয়, কামানের পেছনের মানুষই গুরুত্বপূর্ণ) অর্থাৎ আইন প্রয়োগ না করলে আরও শত আইন করেও লাভ হবে না। আইন প্রয়োগকারীরা যদি তা প্রয়োগ না করেন বা করতে উৎসাহী না হন তবে আইন থেকেও কোনো লাভ নেই। মাধবদীর পুনর্নির্বাচন এমনই একটি উদাহরণ।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
কয়েকটি পত্রিকার বিস্তারিত তথ্য বিবরণে (প্রথম আলো, আমাদের সময়; ১৩ জানুয়ারি, ২০১৬) এবং দু-একটি বেসরকারি টেলিভিশনে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা সত্যিই হতাশাজনক। কারণ, মূল নির্বাচনে যা-ই হয়ে থাক না বা হয় না কেন, অতীতে ওই সব বিচ্যুতি ইতিপূর্বে স্থগিত নির্বাচনগুলোতে দেখা যায়নি। স্থগিত বা পুনর্নির্বাচন সাধারণত এমনভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়, যেখানে ফাঁকফোকর যেমন থাকে না, তেমনি নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করায় কোনো সমস্যাই থাকে না। হাতে গোনা কয়েকটি এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা আমাদের নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনো বড় ঘটনা হওয়ার কথা নয়। অতীতে এ ধরনের নির্বাচন নিয়ে সংবাদপত্র বা অন্যান্য মিডিয়ায় এতখানি জায়গা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বলেও মনে হয় না।
অন্যান্য স্থগিত কেন্দ্রের বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোটের মহোৎসব হয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। তবে মাধবদী পৌরসভার সম্পূর্ণ ১২টি কেন্দ্রের যে বিস্তারিত তথ্য ১৩ জানুয়ারি, ২০১৬-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা নির্বাচন বিষয়ে যাঁরা গবেষণা করার ইচ্ছা রাখেন, তাঁদের জন্য একটি ‘কেস স্টাডি’ হতে পারে। ওই উপনির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীই জয়ী হয়েছেন, হয়তো সুষ্ঠু ভোট হলেও তিনিই নির্বাচিত হতেন। এসব নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের এত বড় ব্যবস্থাপনার মধ্যে কেন এমন হবে, তা গবেষণার বিষয় হতে পারে।
প্রকাশিত তথ্যমতে, মাধবদী নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য প্রায় শতাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং ১২টি কেন্দ্রের জন্য আটজন নির্বাচনী কর্মকর্তাকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অভিজ্ঞতার আলোকে ধারণা করা যায় যে এসব কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এমতাবস্থায় এমন কারচুপি, জাল ভোট আর কেন্দ্র দখল কেন এবং কীভাবে হতে পারে? এতসংখ্যক সদস্য থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন কি একেবারেই অন্ধকারে ছিল? তথ্যে প্রকাশ যে ওই পৌরসভার ভোট গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করার জন্য নির্বাচন কমিশনের একজন অতি অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি কী দেখেছিলেন এবং নির্বাচন কমিশনে কী তথ্য দিয়েছিলেন, তাও জানা যায়নি। এত বেষ্টনীর মধ্যেও দুটি কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণের পর প্রকাশ্যে দখল করা হয়েছিল। ওই কেন্দ্রগুলো স্থগিত করা হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এত কিছুর পরেও কেন এই নির্বাচনকে বৈধ করতে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করলেন? তিনি কি এ অরাজকতার খবর পাননি? এমতাবস্থায় নির্বাচন কমিশনের কী করণীয় ছিল বা করতে পারত? এতসব কাণ্ড যখন চলছিল তখন নির্বাচন কমিশনে কী ধরনের তথ্য আসছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর নির্বাচন কমিশনই দিতে পারবে। তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন কমিশনের না জানার কথা নয়। মাধবদী ঢাকা থেকে তেমন দূরেও নয়।
মাধবদীর নির্বাচন পর্যালোচনায় বেশ কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে, যার দু-একটির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার দাবি রাখে। প্রথমই প্রশ্ন ওঠে যে সরকারি দলের প্রার্থী, যাঁদের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এগিয়ে থাকার কথা, তাঁদের পক্ষে কেন নির্বাচনে তথ্যমতে কারচুপির পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে? সরকারি দলের বিপক্ষে মূলত যে দলটি রয়েছে, তাদের সাংগঠনিক অবস্থা দৃশ্যত দুর্বল এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে প্রায় প্রতিদিন সরকারি দলের মুখপাত্ররা বলে থাকেন। এমনকি ইদানীং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেফাঁস অহেতুক মন্তব্যও তাদের বিপক্ষে গেছে বলে মনে করা হয়। তথাপি সরকারি দলের প্রার্থীকে এমন অবস্থায় কেন যেতে হলো?
কারচুপি নানাবিধ কারণে হয়ে থাকে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। এলবার্টো সিম্পস তাঁর গবেষণা পুস্তক হোয়াই গভর্নমেন্টস অ্যান্ড পার্টিস ম্যানিপুলেট ইলেকশনস (Why Governments and Parties Manipulate Elections) উল্লেখ করেন যে মূলত দুটি কারণে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে কারচুপির আশ্রয় নেয়। প্রথমত, প্রধানত রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় নেয়। অবশ্য যদি প্রতিপক্ষ দুর্বল এবং প্রতিহত করার মতো অবস্থায় না থাকে। যদিও এখানে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা সংস্থার কার্যকারিতার উল্লেখ করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, প্রার্থী পর্যায়ে কারচুপির আশ্রয় নেওয়ারও বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য বিজয় নিশ্চিত করার বিষয়টি যেমন থাকে, তেমনি বিপক্ষকে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের বিষয়টিও থাকে। অনেক সময় অনেক শক্তিশালী প্রার্থী, যাঁর বিজয় নিশ্চিত, এমন ক্ষেত্রেও ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় নিয়ে থাকেন ওপরে উল্লেখিত কারণে এবং তিনি যে ব্যাপক জনপ্রিয় তার প্রমাণ দিতে। হয়তো এসবের প্রয়োজন হয় না, তথাপি কারচুপির আশ্রয় নেওয়া হয়। অবশ্য এসব গবেষণা আমাদের মতো আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে করা হয়েছে। এই গবেষক মনে করেন যে এভাবে যারা বা যে দল বিজয়ী হয়, তাদের এ জয় জনসমর্থিত বা বৈধ না হলেও প্রতিপক্ষকে দুর্বল প্রমাণ করা এবং জনগণকে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়ে থাকে।
উপরিউক্ত গবেষণায় অনেক ফাঁকফোকর থাকলেও এমন কারচুপির নজির এন্তার। আমরা ইদানীং নির্বাচনে যে ধরনের কারচুপির উদাহরণ দেখছি, তা বিশ্লেষণ করলেও এমনই বিষয় দৃশ্যমান হয়। বিশেষ করে স্থানীয় নির্বাচন যদি সরকারি দলের জনপ্রিয়তার এবং প্রতিপক্ষকে আরও দুর্বল করার বিষয়টি যুক্ত থাকে। অবস্থাদৃষ্টে তেমনই মনে হচ্ছে। সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থীদের সিংহভাগ হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনে জয়ী হতেন বলে অনেকেই মনে করেন। এ ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারি দল কতখানি লাভবান হয়েছে, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।
আমি যে গবেষণার কথা বলেছি তা তাত্ত্বিক হলেও এর প্রতিফলন অনেক দেশের নির্বাচন পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে। এমতাবস্থায় নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্থার করণীয় তেমন আলোচনায় আসেনি। নির্বাচন যাতে ব্যাপক কারচুপির মুখে না পড়ে, সে কারণে আমাদের মতো দেশে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন সংবিধান দ্বারা গঠিত হয়েছে। সংবিধানের আওতায় প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য করার জন্য। বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হতে হলে নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করতেই হবে। বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান ক্ষমতা দিয়েছে।
বিদ্যমান নির্বাচনী আইন মোতাবেক নির্বাচন চলাকালীন যেকোনো সময়ে যদি প্রতীয়মান হয় যে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য বা অবাধ হচ্ছে না, কমিশন তার ক্ষমতা বলে আংশিক অথবা সম্পূর্ণ নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। অপরদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা বেসরকারিভাবে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের কাছে আইনানুগ কতখানি ক্ষমতা রয়েছে তা তেমনভাবে উল্লেখ না থাকলেও সংবিধানের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, যদি কমিশন সে ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে দৃঢ় মনোভাব পোষণ করে। অবশ্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে, যদি সে ধরনের দৃঢ়চেতা কমিশন কার্যকর থাকে। মাধবদী একটি উদাহরণ হয়ে থাকত যদি নির্বাচন কমিশন পুনরায় স্থগিত করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিত। হয়তো উচ্চ আদালতে এখতিয়ার নিয়ে চ্যালেঞ্জ হতে পারত, তাতে বিপরীত সিদ্ধান্ত হলেও নৈতিকভাবে নির্বাচন কমিশন জয়ী হতো।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে আমাদের মতো দেশের এহেন পরিস্থিতিতে কারচুপি ঠেকাতেই এত আইন এবং যজ্ঞ করতে হয়, যার উদাহরণ মাধবদী। তথাপি কারচুপি ঠেকানো যায়নি কেন? কেনই-বা নির্বাচন চলাকালীন কমিশন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি, তার উত্তর নির্বাচন কমিশনই দিতে পারবে।
নির্বাচন কমিশনের হাতকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকেই বলে থাকেন। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, এখানে যে ফাঁকফোকর রয়েছে তার প্রতিকারে আইনের মাধ্যমে রিটার্নিং কর্মকর্তার বেসরকারিভাবে ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ করার নিশ্চিত ক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে আইনে উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। তবে যত আইনই থাকুক বা সংযোজন করা হোক না কেন, তা প্রয়োগ না করলে দৃশ্যমান কারচুপি ঠেকানো সম্ভব নয়। এ আলোচনা শেষ করব মাও সেতুংয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে। ‘ইট ইজ নট দ্য গান বাট মেন বিহাইন্ড দ্য গান মেটারস’ (কামান নয়, কামানের পেছনের মানুষই গুরুত্বপূর্ণ) অর্থাৎ আইন প্রয়োগ না করলে আরও শত আইন করেও লাভ হবে না। আইন প্রয়োগকারীরা যদি তা প্রয়োগ না করেন বা করতে উৎসাহী না হন তবে আইন থেকেও কোনো লাভ নেই। মাধবদীর পুনর্নির্বাচন এমনই একটি উদাহরণ।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments