আন্দোলন নয়, প্রয়োজন আলোচনা by আলী ইমাম মজুমদার
চলছে শিক্ষক কর্মবিরতি। ক্লাসরুম ফাঁকা। মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছবিটি তোলা |
অষ্টম
জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার পর থেকে বেশ কিছু বাদ-প্রতিবাদ চলমান রয়েছে।
ধীরে ধীরে বাড়ছে এর তীব্রতা। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। সরকার এবার
উদারভাবে বেতন বৃদ্ধি করেছে। বাড়িয়েছে ভাতাদি ও পেনশনের সুবিধা। নতুন
স্কেলে এ বছর শুধু মূল বেতনই দেওয়া হবে। আর তাতেই সরকারের অতিরিক্ত ব্যয়
হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই উদারতার প্রশংসা করা উচিত সংশ্লিষ্ট সবার। অথচ
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর বিপরীতটাই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে।
প্রকৃচি আর বিসিএস সমন্বয় পরিষদ সুস্পষ্টভাবে কিছু দাবি রেখেছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদেরও কিছু মৌলিক দাবি আছে। এ দাবি আদায়ের আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাঁরা কর্মবিরতি পালন করছেন। অবশ্যই পরীক্ষাগুলো নিচ্ছেন যথারীতি। কর্মবিরতিতেও তাঁরা না গেলে ভালো করতেন। এ দাবিগুলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা যায় না এমন নয়। বেশ কিছু আলোচনা হয়েছেও। এখন ব্যাপারটি নেতিবাচক ভিন্ন মাত্রা পেলেও আলোচনার মাধ্যমেই এর নিষ্পত্তি করতে হবে। তা হবেও। প্রকৃচি আর বিসিএস সমন্বয় পরিষদের সঙ্গে তো মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে কয়েকজন সচিবের একটি সভা হয়ে গেল। আশা করা যায়, এটিও সবার কাছে গ্রহণযোগ্যভাবে শেষ হবে।
শিক্ষার প্রসারে স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের সবগুলো সরকার অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সীমিত সম্পদের একটি বড় অংশই ব্যয় হয় এ খাতে। বর্তমান সরকারও সেই প্রচেষ্টাকে জোরদারই করেছে। এর সুফলও ভোগ করছে জাতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের তথ্যানুযায়ী, দেশে শিক্ষার হার ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ। অনুমান করা যায়, এখন এটা ৭০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আর এ অর্জন সম্ভব হয়েছে সরকারের সর্বমুখী প্রচেষ্টার জন্য। শুধু লিখিত লোকের সংখ্যা নয়, এর গুণগত মান বৃদ্ধিতেও বেশ কিছু কর্মসূচি চলছে। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, এ কর্মকাণ্ডের প্রথম সারির সৈনিক আমাদের শিক্ষকেরা। তাঁরা মানুষ গড়ার কারিগররূপেই সমাজে যুগ যুগ ধরে পরিচিত। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ তার জীবনের পূর্ণতা পায় শিক্ষার মাধ্যমে। আর সেই শিক্ষা দেন শিক্ষক। তাঁদের মানমর্যাদা সবার কাছে বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
এবারের মূল বিতর্কটি বেতন-ভাতার পরিমাণ নিয়ে নয়। বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে যেটুকু বিতর্ক, তা পারস্পরিক অবস্থান নিয়ে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অসন্তোষের কারণও অনেকটা তা–ই। এই জটিলতার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড উঠিয়ে দেওয়া আর নবাগত নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্যাডার কর্মকর্তার চেয়ে এক ধাপ নিচে রাখায়। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের পরিবর্তে অষ্টম বেতন স্কেলে ভিন্ন একটি ব্যবস্থা রয়েছে। এটা যদি ব্যাপকভাবে সমর্থিত না হয়, তাহলে পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া কি অসম্ভব? নতুন ব্যবস্থায় লাভ বেশি হবে বলে কেউ কেউ বলছেন। বেশির পরিবর্তে কম নিয়েই যদি কেউ সন্তুষ্ট থাকেন, তবে ‘অকারণ’ বেশি দিতে যাবেন কেন? প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের বিবেচনায় এতে ওপরের গ্রেডে যেতে সুবিধা বেশি হবে। দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যবস্থা থেকে হঠাৎ করে বিপরীত দিকে গিয়ে ভুল বোঝার কারণ কেন আমরা ঘটাই? এ বিষয়টির সমাধানও কঠিন কিছু নয়। আর নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্যাডার পদের এক ধাপ নিচে সূচনা স্তরে রাখার খোঁড়া যুক্তিও দেওয়া যাবে না। বিজ্ঞানী, গবেষক, ব্যাংকারসহ অনেকেই নন-ক্যাডার পদে রয়েছেন। তাঁদের অবমূল্যায়ন যথার্থ নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল-সংক্রান্ত বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর পর্যায়ে রয়েছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বেশ কিছুকাল ধরেই তাঁদের অধ্যাপক পদটি ছিল বেতন স্কেলের তৃতীয় ধাপে। এর শতকরা ২৫ শতাংশ পদ প্রথম গ্রেডে উন্নীত করার বিধানও ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই শূন্য পদের ভিত্তিতে বিভিন্ন মানদণ্ড ধরে তা করত। এবার প্রথমে এরূপ কিছুরই উল্লেখ ছিল না। পরে একটি আদেশ করে প্রথম গ্রেডে মানোন্নয়নের দায়িত্ব ইউজিসিকে দেওয়া হয়। শর্ত থাকে বেশ কিছু। এটাও কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতি থেকে বিচ্যুতি এবং অনেকটাই অকারণ। যে ব্যবস্থা ছিল, তা থাকতে আপত্তির কারণটি দুর্বোধ্য।
আরেকটি দাবি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের রয়েছে। তা হলো বছর দু-তিন আগে সৃষ্ট সিনিয়র সচিবের বেতনের সমান কিছুসংখ্যক পদ। এই স্তরে আটজন সচিব ছাড়াও সশস্ত্র বাহিনীতে লে. জেনারেল ও সমমানের কর্মকর্তা আর পুলিশের আইজি পদটি রয়েছে। যেখানে সাধারণত মেধাবী ছাত্ররা কাজ করছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ স্তরে কিছু পদের দাবিকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। আর একটি বিভ্রান্তির এখানে অবসান দরকার। প্রথম গ্রেড কিংবা সিনিয়র সচিবের সমান বেতন পাওয়া কিন্তু কারও সচিব হওয়া বোঝায় না। প্রত্যেকের পদের পরিচিতি তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক পদের বিবেচনায়। সচিব সচিবালয়ের পদ। এর সৃজন ও ক্ষমতার উৎস রুলস অব বিজনেস। সচিবেরা ছাড়াও প্রথম গ্রেডে কিছু রাষ্ট্রদূত, সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক, মেজর জেনারেলসহ অনেক সংস্থার প্রধানই থাকছেন। তাই বলে সচিব যেমন নিজকে সচিব ও রাষ্ট্রদূত বলতে পারেন না, তেমনি রাষ্ট্রদূতেরাও পররাষ্ট্রসচিব না হলে রাষ্ট্রদূত ও সচিব লেখা অসংগত। তেমনি সব ক্ষেত্রের জন্যই এটা প্রযোজ্য। ঠিক একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকেরাও সচিব হয়ে গেলেন এমনটা কারও মনে করা ঠিক নয়। তাঁরা অধ্যাপক রূপেই পরিচিত ও সম্মানিত।
এটাও নির্জলা সত্য যে সচিব সৃষ্টি করেন শিক্ষকেরাই। আর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকেরা এ দাবি সংগতভাবেই করতে পারেন। তেমনি সচিবেরাও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরিতে এসে বিভিন্ন ঘাট পেরিয়ে অনেক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের পর এ পদ লাভ করেছেন। সরকারি প্রশাসনে রয়েছে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এঁদের সবাই না হলেও অনেকেরই শিক্ষার মান যথেষ্ট উঁচুতে। আর অবক্ষয়ের যে কথা আসছে, তা শুধু জনপ্রশাসনেই নয়, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এটা ঠাঁই করেছে। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ও একই মানের নয়। সমান নয় সব শিক্ষকের মানও। তা সত্ত্বেও সবচেয়ে মেধাবীদের প্রধান আকর্ষণ নামকরা গুটি কয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিই থাকে, এটা অনস্বীকার্য। তাই তাঁদের দাবির ন্যায্যতা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। সংশয় থাকে দাবি আদায়ের প্রক্রিয়া নিয়ে।
খুব কম দেশেই পারস্পরিক মানমর্যাদা শুধু বেতন স্কেল দিয়ে নির্ধারিত হয়। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রধান নির্বাহীর বেতন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কয়েক গুণ। আমাদের দেশেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরূপ দৃষ্টান্ত রয়েছে। বাংলাদেশ বিমানের পাইলট এবং শিপিং করপোরেশনের জাহাজে কর্মরত কর্মকর্তারা অনেক বেশি বেতন পান। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বেতনও অনেক বেশি। এই নিবন্ধকারকে ২৪ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে থাকাকালে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করতে হয়েছিল। দায়িত্ব ভাতা ছিল মাসে পাঁচ হাজার টাকা। তখন সেই ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসিক বেতন পেতেন ১০ লাখ টাকা। এতে কোনো বিভ্রাট ঘটেনি। এরূপ দৃষ্টান্ত একেবারেই কম নয়। তা সত্ত্বেও এটা বলা যাবে না যে বেতন স্কেলের ধাপগুলো একেবারেই গুরুত্বহীন। তবে এটাও ঠিক নয় যে স্কেলই মানমর্যাদার একমাত্র পরিমাপক। যাঁরা সরকারি চাকরি করেন না, তাঁরাও কেউ কেউ সরকারি অনুষ্ঠানাদিতে আমন্ত্রিত হন। সেখানে তাঁদের অবস্থান বেশ কিছু ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মকর্তাদের ঊর্ধ্বে থাকতে দেখা যায়। আর তা থাকে সংগত কারণেই।
বর্তমানে বিষয়টি যে পর্যায়ে রয়েছে, তা মীমাংসার অযোগ্য মোটেই নয়। সরকার যে কারণে এত ব্যয় সাপেক্ষ স্কেলটি দিলেন, তা নিয়ে সামান্য কিছু অসংগতির জন্য বিভ্রাট হবে, এটা ভাবতেও কষ্ট হয়। যেটুকু জট তা দ্রুতই দূর করা যায়। এর জন্য সরকার ও যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের এগিয়ে আসতে হবে। কোনো পক্ষই অনড় অবস্থানে থাকলে চলবে না। আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। জরাজীর্ণ অতীত আর সমস্যা সংকুল বর্তমানকে পেছনে ফেলে উদার ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিষয়গুলো মীমাংসিত হোক এটা সবাই চায়। এমনকি চান আন্দোলনকারীরাও। আর অবশ্যই সবচেয়ে বেশি চায় সরকার। সমস্যা থাকলে সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে, এমনটা সেদিনও বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
প্রকৃচি আর বিসিএস সমন্বয় পরিষদ সুস্পষ্টভাবে কিছু দাবি রেখেছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদেরও কিছু মৌলিক দাবি আছে। এ দাবি আদায়ের আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাঁরা কর্মবিরতি পালন করছেন। অবশ্যই পরীক্ষাগুলো নিচ্ছেন যথারীতি। কর্মবিরতিতেও তাঁরা না গেলে ভালো করতেন। এ দাবিগুলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা যায় না এমন নয়। বেশ কিছু আলোচনা হয়েছেও। এখন ব্যাপারটি নেতিবাচক ভিন্ন মাত্রা পেলেও আলোচনার মাধ্যমেই এর নিষ্পত্তি করতে হবে। তা হবেও। প্রকৃচি আর বিসিএস সমন্বয় পরিষদের সঙ্গে তো মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে কয়েকজন সচিবের একটি সভা হয়ে গেল। আশা করা যায়, এটিও সবার কাছে গ্রহণযোগ্যভাবে শেষ হবে।
শিক্ষার প্রসারে স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের সবগুলো সরকার অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সীমিত সম্পদের একটি বড় অংশই ব্যয় হয় এ খাতে। বর্তমান সরকারও সেই প্রচেষ্টাকে জোরদারই করেছে। এর সুফলও ভোগ করছে জাতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের তথ্যানুযায়ী, দেশে শিক্ষার হার ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ। অনুমান করা যায়, এখন এটা ৭০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আর এ অর্জন সম্ভব হয়েছে সরকারের সর্বমুখী প্রচেষ্টার জন্য। শুধু লিখিত লোকের সংখ্যা নয়, এর গুণগত মান বৃদ্ধিতেও বেশ কিছু কর্মসূচি চলছে। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, এ কর্মকাণ্ডের প্রথম সারির সৈনিক আমাদের শিক্ষকেরা। তাঁরা মানুষ গড়ার কারিগররূপেই সমাজে যুগ যুগ ধরে পরিচিত। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ তার জীবনের পূর্ণতা পায় শিক্ষার মাধ্যমে। আর সেই শিক্ষা দেন শিক্ষক। তাঁদের মানমর্যাদা সবার কাছে বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
এবারের মূল বিতর্কটি বেতন-ভাতার পরিমাণ নিয়ে নয়। বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে যেটুকু বিতর্ক, তা পারস্পরিক অবস্থান নিয়ে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অসন্তোষের কারণও অনেকটা তা–ই। এই জটিলতার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড উঠিয়ে দেওয়া আর নবাগত নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্যাডার কর্মকর্তার চেয়ে এক ধাপ নিচে রাখায়। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের পরিবর্তে অষ্টম বেতন স্কেলে ভিন্ন একটি ব্যবস্থা রয়েছে। এটা যদি ব্যাপকভাবে সমর্থিত না হয়, তাহলে পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া কি অসম্ভব? নতুন ব্যবস্থায় লাভ বেশি হবে বলে কেউ কেউ বলছেন। বেশির পরিবর্তে কম নিয়েই যদি কেউ সন্তুষ্ট থাকেন, তবে ‘অকারণ’ বেশি দিতে যাবেন কেন? প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের বিবেচনায় এতে ওপরের গ্রেডে যেতে সুবিধা বেশি হবে। দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যবস্থা থেকে হঠাৎ করে বিপরীত দিকে গিয়ে ভুল বোঝার কারণ কেন আমরা ঘটাই? এ বিষয়টির সমাধানও কঠিন কিছু নয়। আর নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্যাডার পদের এক ধাপ নিচে সূচনা স্তরে রাখার খোঁড়া যুক্তিও দেওয়া যাবে না। বিজ্ঞানী, গবেষক, ব্যাংকারসহ অনেকেই নন-ক্যাডার পদে রয়েছেন। তাঁদের অবমূল্যায়ন যথার্থ নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল-সংক্রান্ত বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর পর্যায়ে রয়েছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বেশ কিছুকাল ধরেই তাঁদের অধ্যাপক পদটি ছিল বেতন স্কেলের তৃতীয় ধাপে। এর শতকরা ২৫ শতাংশ পদ প্রথম গ্রেডে উন্নীত করার বিধানও ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই শূন্য পদের ভিত্তিতে বিভিন্ন মানদণ্ড ধরে তা করত। এবার প্রথমে এরূপ কিছুরই উল্লেখ ছিল না। পরে একটি আদেশ করে প্রথম গ্রেডে মানোন্নয়নের দায়িত্ব ইউজিসিকে দেওয়া হয়। শর্ত থাকে বেশ কিছু। এটাও কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতি থেকে বিচ্যুতি এবং অনেকটাই অকারণ। যে ব্যবস্থা ছিল, তা থাকতে আপত্তির কারণটি দুর্বোধ্য।
আরেকটি দাবি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের রয়েছে। তা হলো বছর দু-তিন আগে সৃষ্ট সিনিয়র সচিবের বেতনের সমান কিছুসংখ্যক পদ। এই স্তরে আটজন সচিব ছাড়াও সশস্ত্র বাহিনীতে লে. জেনারেল ও সমমানের কর্মকর্তা আর পুলিশের আইজি পদটি রয়েছে। যেখানে সাধারণত মেধাবী ছাত্ররা কাজ করছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ স্তরে কিছু পদের দাবিকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। আর একটি বিভ্রান্তির এখানে অবসান দরকার। প্রথম গ্রেড কিংবা সিনিয়র সচিবের সমান বেতন পাওয়া কিন্তু কারও সচিব হওয়া বোঝায় না। প্রত্যেকের পদের পরিচিতি তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক পদের বিবেচনায়। সচিব সচিবালয়ের পদ। এর সৃজন ও ক্ষমতার উৎস রুলস অব বিজনেস। সচিবেরা ছাড়াও প্রথম গ্রেডে কিছু রাষ্ট্রদূত, সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক, মেজর জেনারেলসহ অনেক সংস্থার প্রধানই থাকছেন। তাই বলে সচিব যেমন নিজকে সচিব ও রাষ্ট্রদূত বলতে পারেন না, তেমনি রাষ্ট্রদূতেরাও পররাষ্ট্রসচিব না হলে রাষ্ট্রদূত ও সচিব লেখা অসংগত। তেমনি সব ক্ষেত্রের জন্যই এটা প্রযোজ্য। ঠিক একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকেরাও সচিব হয়ে গেলেন এমনটা কারও মনে করা ঠিক নয়। তাঁরা অধ্যাপক রূপেই পরিচিত ও সম্মানিত।
এটাও নির্জলা সত্য যে সচিব সৃষ্টি করেন শিক্ষকেরাই। আর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকেরা এ দাবি সংগতভাবেই করতে পারেন। তেমনি সচিবেরাও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরিতে এসে বিভিন্ন ঘাট পেরিয়ে অনেক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের পর এ পদ লাভ করেছেন। সরকারি প্রশাসনে রয়েছে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এঁদের সবাই না হলেও অনেকেরই শিক্ষার মান যথেষ্ট উঁচুতে। আর অবক্ষয়ের যে কথা আসছে, তা শুধু জনপ্রশাসনেই নয়, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এটা ঠাঁই করেছে। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ও একই মানের নয়। সমান নয় সব শিক্ষকের মানও। তা সত্ত্বেও সবচেয়ে মেধাবীদের প্রধান আকর্ষণ নামকরা গুটি কয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিই থাকে, এটা অনস্বীকার্য। তাই তাঁদের দাবির ন্যায্যতা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। সংশয় থাকে দাবি আদায়ের প্রক্রিয়া নিয়ে।
খুব কম দেশেই পারস্পরিক মানমর্যাদা শুধু বেতন স্কেল দিয়ে নির্ধারিত হয়। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রধান নির্বাহীর বেতন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কয়েক গুণ। আমাদের দেশেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরূপ দৃষ্টান্ত রয়েছে। বাংলাদেশ বিমানের পাইলট এবং শিপিং করপোরেশনের জাহাজে কর্মরত কর্মকর্তারা অনেক বেশি বেতন পান। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বেতনও অনেক বেশি। এই নিবন্ধকারকে ২৪ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে থাকাকালে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করতে হয়েছিল। দায়িত্ব ভাতা ছিল মাসে পাঁচ হাজার টাকা। তখন সেই ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসিক বেতন পেতেন ১০ লাখ টাকা। এতে কোনো বিভ্রাট ঘটেনি। এরূপ দৃষ্টান্ত একেবারেই কম নয়। তা সত্ত্বেও এটা বলা যাবে না যে বেতন স্কেলের ধাপগুলো একেবারেই গুরুত্বহীন। তবে এটাও ঠিক নয় যে স্কেলই মানমর্যাদার একমাত্র পরিমাপক। যাঁরা সরকারি চাকরি করেন না, তাঁরাও কেউ কেউ সরকারি অনুষ্ঠানাদিতে আমন্ত্রিত হন। সেখানে তাঁদের অবস্থান বেশ কিছু ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মকর্তাদের ঊর্ধ্বে থাকতে দেখা যায়। আর তা থাকে সংগত কারণেই।
বর্তমানে বিষয়টি যে পর্যায়ে রয়েছে, তা মীমাংসার অযোগ্য মোটেই নয়। সরকার যে কারণে এত ব্যয় সাপেক্ষ স্কেলটি দিলেন, তা নিয়ে সামান্য কিছু অসংগতির জন্য বিভ্রাট হবে, এটা ভাবতেও কষ্ট হয়। যেটুকু জট তা দ্রুতই দূর করা যায়। এর জন্য সরকার ও যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের এগিয়ে আসতে হবে। কোনো পক্ষই অনড় অবস্থানে থাকলে চলবে না। আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। জরাজীর্ণ অতীত আর সমস্যা সংকুল বর্তমানকে পেছনে ফেলে উদার ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিষয়গুলো মীমাংসিত হোক এটা সবাই চায়। এমনকি চান আন্দোলনকারীরাও। আর অবশ্যই সবচেয়ে বেশি চায় সরকার। সমস্যা থাকলে সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে, এমনটা সেদিনও বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments