বিএনপির জন্য ভাবনা by আবুল মোমেন
আমাদের
সমাজে নেই বলে রাজনৈতিক অঙ্গনেও আত্মবিশ্লেষণের অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। মনে
হচ্ছে, প্রতিকূল পরিস্থিতি উত্তরণের সনাতন পথগুলো অকার্যকর হওয়ার পরে
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবার আত্মবিশ্লেষণের কথা ভাবছে।
বিএনপির প্রধান শক্তি বিপুল জনসমর্থন, যাতে তারা প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের কাছাকাছি। তাদের প্রধান দুর্বলতা সংগঠন। এর কারণ বিএনপির জন্মের মধ্যেই নিহিত আছে। এটি একজন সামরিক শাসক মূলত আওয়ামী লীগ-বিরোধী লোকজন নিয়ে ক্ষমতায় বসে গঠন করেছিলেন। তখন তাঁর অগ্রাধিকার ছিল বৈধতা অর্জন ও ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা। তাই নিজের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন পড়েছিল। দলটি গঠনতান্ত্রিকভাবেই অগণতান্ত্রিক—সামরিক কর্তা তাঁর একক নেতৃত্ব কোনোভাবেই ভাগ করতে সাহস পাননি। ফলে দলের শাখা সংগঠন ও নানান অঙ্গসংগঠন তৈরি হলেও নেতৃত্বের কেন্দ্রিকতার ধরন পাল্টায়নি। তাতে দল সাংগঠনিকভাবে মজবুত হয়নি। এখানে এ আলোচনায় আওয়ামী লীগকেও একটু টানতে হবে। ক্ষমতাসীন এই দলের ইতিহাসের প্রায় সবটাজুড়েই গণতন্ত্রের সংগ্রামই মুখ্য হলেও কালে কালে আওয়ামী লীগও আজ এক নেত্রীকেন্দ্রিক দলে পরিণত হয়েছে এবং আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করছি সামাজিকভাবে বরাবর সক্রিয় সজীব একটি সংগঠন কীভাবে ক্ষমতার প্রশ্রয়ে থেকে নির্জীব ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। হয়তো এই সংগঠনের শিকড় অনেক গভীরে বলে এ অবস্থায়ও প্রয়োজনে আন্দোলন দাঁড় করাতে পারে এবং এখনো দেশের আনাচকানাচে দলের আদর্শে নিবেদিত অনেক কর্মী-সমর্থকও রয়েছেন, যাঁদের সত্তার গভীরে রাজনৈতিক বীজ প্রবাহিত হয়।
বিএনপির দ্বিতীয় দুর্বলতা হলো তাদের রাজনৈতিক আদর্শ। দেশে সিংহভাগ মানুষের চেতনার কথা বিচার করলে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের জায়গা বেশ বিস্তৃত। কিন্তু ধর্ম নিয়ে রাজনীতির নানামুখী বিপদ আছে এবং বিএনপিও এ থেকে বিপদে পড়েছে বলেই মনে হয়। মোটের ওপর দলটিকে রাজনীতি সাজাতে হয়েছে প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রধান অস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ এমন এক ভাবাবেগ, যা ঘাঁটাঘাঁটি করা সহজ নয়। কিন্তু সমর্থক ভোটারদের মান বিচার করলে দেশের রাজনীতিতে ভাবাবেগের প্রয়োজন পড়ে। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিরুত্তাপ থেকে ভাবাবেগের অস্ত্র হিসেবে নিয়েছে ইসলামকে। এই দুই ভাবাবেগ যদি দুটি ভরকেন্দ্র হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ঘিরে আরও সমমনা সমধর্মী দল, গোষ্ঠী, জনগণ জুটে যাবে—এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে একসময় দেশ বড় দুটি দলকে ঘিরে মোটামুটি দুটি মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে গেল।
এই পরিবর্তনের সময় রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগ কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছে এবং একটি প্রধান ক্ষেত্রে প্রায় প্রজ্ঞাপূর্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। সম্ভবত এটিই তাদের এগিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষের শক্তির প্রধান উৎস ভাবাবেগের ভান্ডারে ভাগ বসাতে সক্ষম হলো। তারা প্রমাণ করতে পারল যে মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম পরস্পরবিরোধী কোনো ভাবাদর্শ নয় এবং ভাবাবেগের দুটি পৃথক ভরকেন্দ্রও নয়। আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিক এবং নেতা-কর্মীদের ব্যক্তিগত সংস্কৃতিতে ইসলাম একটি বড় জায়গা জুড়ে আছে। এটা আরোপিতও নয়, বানানোও নয়, অতীতে ধর্মপ্রাণ মানুষ হয়েও অনেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনার পক্ষপাতী ছিলেন না। এখানে আমরা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে পার্থক্য দেখতে পাই।
বিরোধিতা ও প্রতিপক্ষতার চর্চা যত তীব্র, ব্যাপক ও দীর্ঘায়িত হয়েছে, বিএনপি ততই কট্টর ইসলামি দলগুলোর কাছাকাছি চলে এসেছে, দলের অভ্যন্তরে জামায়াতপন্থী অনেক নেতাই শক্ত অবস্থানে চলে এসেছেন। ফলে দেশের তরুণসমাজ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ভাবাবেগে জেগে উঠছে, তখনো বিএনপি তাদের প্রতি পক্ষপাত প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। আর এর চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল স্বয়ং বেগম জিয়ার মুখে, তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কথা ও মনোভাবই দলের বক্তব্য ও ভাবনা হিসেবে মানুষের কাছে প্রকাশ পায়। তাঁর এ বক্তব্য রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটা মারাত্মক ভুল বলেই প্রমাণিত হচ্ছে।
কোনো সচেতন মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদের মাথা গোনা সংখ্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না। যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ছয় কোটি মানুষের মৃত্যু বা লেনিনগ্রাদ (প্রাক্তন ও বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) রক্ষায় ২০০ রুশবাসীর শাহাদাত বরণ কিংবা নাৎসিদের হাতে ৬০ লাখ ইহুদি নিহত হওয়ার পরিসংখ্যান নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না। সবাই জানেন যে নিহত ও শহীদের সংখ্যা ছিল বেশুমার। প্রশ্নটা হচ্ছে, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা গণহত্যা চালিয়েছিল কি না, নারী নির্যাতন করেছিল কি না, জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছিল কি না। এরই ফাঁকে বেগম জিয়ার জ্ঞাতার্থে জানাই, একাত্তরের সেপ্টেম্বর নাগাদ শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে আসা মার্কিন সিনেটর প্রয়াত এডওয়ার্ড কেনেডি একটি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন যে শরণার্থী শিবিরগুলোতেই তখন পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ শিশু প্রাণ হারিয়েছে। এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের বলি। তাদের সে সম্মান দিতে হবে।
যা হোক, আমরা আগের কথায় ফিরে আসি। দল পুনর্গঠন বা সাংগঠনিকভাবে দলকে গুছিয়ে নেওয়ার আগে তাদের ভাবতে হবে মানুষকে উজ্জীবিত করার হাতিয়ার কী হবে? তারা কি এর জন্য মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকেই ধারণ করে এগোবে? এই মনোভাবের মানুষের সংখ্যা দেশে অনেক এবং বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে নতুনভাবে তরুণসমাজের মধ্যে মুসলিম পরিচয় তুলে ধরা ও প্রমাণ করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ দুটি কারণে বিএনপি তাদের সনাতন আদর্শেই অবিচল থাকতে পারে। এখানে তাদের জন্য বিপদ দেখতে পাই দুদিক থেকে। একদিকে হলো নতুন পরিস্থিতির কারণে মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতির, অন্তত কিছুকালের জন্য, চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিএনপির গায়ে জেএমবি-জামায়াত পৃষ্ঠপোষকতার দাগ রয়েছে, ফলে আবারও নতুন কোনো সম্পর্ক তাদের সমস্যায় ফেলতে পারে। বিপদের দ্বিতীয় দিকটি হলো, ইসলামে শান্তিপূর্ণ পথে মানুষের মন জয় ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করার শিক্ষা ও আদর্শ রয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় বৈশ্বিক পটভূমিতে আমরা মুসলিম আলেম-মনীষীদের মধ্যে ইসলামের এই ভাষ্য তুলে ধরা এবং তার ভিত্তিতে একটি সমঝোতা ও শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষ করছি। তা ছাড়া বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ধর্মভীরু মুসলিম হলেও সাংস্কৃতিক-সামাজিকভাবে তাদের মজ্জাগত প্রবণতা উদার মানবিক দিকে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতারা বিষয়টি ধরতে পারেননি। সে কারণেই শেষ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ও বর্তমান বাংলাদেশে মুসলিম লীগ অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। এ বিষয়গুলো বিএনপি নেতাদের মাথায় রেখে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
আজকের বাস্তবতায় বিএনপির পক্ষে প্রমাণ করা শক্ত যে তারা ইসলামচর্চায় আওয়ামী লীগের চেয়ে গুণগতভাবে বেশি আন্তরিক ও শ্রেয়তর। ইতিমধ্যে ছিটমহল বিনিময়, বিদ্যুৎ সরবরাহে উন্নতি ও অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতবিরোধিতার কার্ড রাজনীতিতে কোনো বাড়তি সুবিধা দেবে না।
বলা যায়, দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ভাবাদর্শিক ভ্রান্ত মোহে কেটেছে বিএনপির। দলের এই মোহ দীর্ঘায়িত হওয়ায় নানা রকম ভুলভ্রান্তি ঘটে চলেছে এবং বিপরীতে আওয়ামী লীগ একতরফা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু, সরকারে থাকায় সবটা জায়গাজুড়েই দলটি খেলছে। বিএনপি মাঠে নামার জায়গা পাচ্ছে না।
তবে স্থানীয় নির্বাচনগুলো তাদের জন্য সুযোগ নিয়ে আসছে এবং আশার কথা, বিএনপির নেতৃত্ব সেটা গ্রহণ করছেন। এর বাইরে তাদের জন্য আরেকটা বড় কাজ আছে বলে মনে হয়। তা হলো মানসিকতার পরিবর্তন। কাজটা সহজ নয়। কিন্তু বাংলাদেশে যেমন ধর্মকে একদম বাদ রেখে রাজনীতির কথা ভাবা যায় না, তেমনি অমোঘ আরেক বিষয় হলো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বা চেতনা বলতে একটা বিষয় আছে, তা হলো প্রকৃত গণতন্ত্র; যা অসাম্প্রদায়িক মানবতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়কে নিশ্চিত করে। স্থানীয় সরকারের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন, বিচার বিভাগের যথার্থ স্বাধীনতা, সরকার ও প্রশাসনের জবাবদিহিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও প্রকৃত গণতন্ত্রেই নিষ্পত্তি হবে। আর এখানেই বিএনপির জন্য রাজনীতির আদর্শ, ভাবাবেগ তৈরির খনি রয়েছে। কারণ ক্ষমতা সংহত করা বা পাকাপোক্ত করার দৌড়ে নেমে বর্তমান সরকার অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে এবং গণতান্ত্রিক অধিকারে অনেকটাই ঘাটতি তৈরি করছে। দুর্নীতি, বিচারহীনতা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেপরোয়া ক্ষমতা, গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ ইত্যাদি অনেকভাবেই গণতন্ত্র খর্ব হচ্ছে। কোনো কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে সাধারণত ক্ষমতাসীনদের এভাবে ক্ষমতামদমত্ত হয়ে ওঠার প্রবণতা বাড়তে থাকে। তার কিছু আলামত সমাজে রয়েছে। ফলে বিএনপির জন্য রাজনীতির সুযোগ কম, এ কথা ঠিক নয়। কেবল তাদের পুরোনো ধাঁচের চিন্তার বাইরে এসে নতুনভাবে ভাবতে হবে।
তাদের জন্য শেষ এবং শক্ত ফাঁড়া হলো দলের ভাবাদর্শিক নেতা জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর বিকল্প একজন ভাবার অভ্যাস পরিবর্তন। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, জেএমবি সম্পৃক্ততা ইত্যাদি যেমন খালেদা জিয়ার আমলে বিএনপির গায়ে বড় আঁচড়, তেমনি জিয়াউর রহমানের উত্থানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই এ দেশে স্বাধীনতাসংগ্রাম হয়েছে, তাঁর নামে স্লোগান দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদসহ চার নেতাই সরকার চালিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে জাতি এঁদের হত্যাকাণ্ডের কেবল বিচার নয়, সব রহস্য উদ্ঘাটন করতে চাইবে। এটা তাদের কর্তব্য ও অধিকার। ফলে এ নিয়ে বিরোধপূর্ণ মনোভাবের অবসান টানতে হবে।
তবে, এই বিপদ কীভাবে কাটাবেন, সেটা বেগম জিয়া ও তাঁর সহকর্মীদেরই আজ ভাবতে হবে। সে ভাবনার দায় কলামিস্টের নয়, তাঁদেরই।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
বিএনপির প্রধান শক্তি বিপুল জনসমর্থন, যাতে তারা প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের কাছাকাছি। তাদের প্রধান দুর্বলতা সংগঠন। এর কারণ বিএনপির জন্মের মধ্যেই নিহিত আছে। এটি একজন সামরিক শাসক মূলত আওয়ামী লীগ-বিরোধী লোকজন নিয়ে ক্ষমতায় বসে গঠন করেছিলেন। তখন তাঁর অগ্রাধিকার ছিল বৈধতা অর্জন ও ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা। তাই নিজের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন পড়েছিল। দলটি গঠনতান্ত্রিকভাবেই অগণতান্ত্রিক—সামরিক কর্তা তাঁর একক নেতৃত্ব কোনোভাবেই ভাগ করতে সাহস পাননি। ফলে দলের শাখা সংগঠন ও নানান অঙ্গসংগঠন তৈরি হলেও নেতৃত্বের কেন্দ্রিকতার ধরন পাল্টায়নি। তাতে দল সাংগঠনিকভাবে মজবুত হয়নি। এখানে এ আলোচনায় আওয়ামী লীগকেও একটু টানতে হবে। ক্ষমতাসীন এই দলের ইতিহাসের প্রায় সবটাজুড়েই গণতন্ত্রের সংগ্রামই মুখ্য হলেও কালে কালে আওয়ামী লীগও আজ এক নেত্রীকেন্দ্রিক দলে পরিণত হয়েছে এবং আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করছি সামাজিকভাবে বরাবর সক্রিয় সজীব একটি সংগঠন কীভাবে ক্ষমতার প্রশ্রয়ে থেকে নির্জীব ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। হয়তো এই সংগঠনের শিকড় অনেক গভীরে বলে এ অবস্থায়ও প্রয়োজনে আন্দোলন দাঁড় করাতে পারে এবং এখনো দেশের আনাচকানাচে দলের আদর্শে নিবেদিত অনেক কর্মী-সমর্থকও রয়েছেন, যাঁদের সত্তার গভীরে রাজনৈতিক বীজ প্রবাহিত হয়।
বিএনপির দ্বিতীয় দুর্বলতা হলো তাদের রাজনৈতিক আদর্শ। দেশে সিংহভাগ মানুষের চেতনার কথা বিচার করলে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের জায়গা বেশ বিস্তৃত। কিন্তু ধর্ম নিয়ে রাজনীতির নানামুখী বিপদ আছে এবং বিএনপিও এ থেকে বিপদে পড়েছে বলেই মনে হয়। মোটের ওপর দলটিকে রাজনীতি সাজাতে হয়েছে প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রধান অস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ এমন এক ভাবাবেগ, যা ঘাঁটাঘাঁটি করা সহজ নয়। কিন্তু সমর্থক ভোটারদের মান বিচার করলে দেশের রাজনীতিতে ভাবাবেগের প্রয়োজন পড়ে। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিরুত্তাপ থেকে ভাবাবেগের অস্ত্র হিসেবে নিয়েছে ইসলামকে। এই দুই ভাবাবেগ যদি দুটি ভরকেন্দ্র হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ঘিরে আরও সমমনা সমধর্মী দল, গোষ্ঠী, জনগণ জুটে যাবে—এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে একসময় দেশ বড় দুটি দলকে ঘিরে মোটামুটি দুটি মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে গেল।
এই পরিবর্তনের সময় রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগ কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছে এবং একটি প্রধান ক্ষেত্রে প্রায় প্রজ্ঞাপূর্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। সম্ভবত এটিই তাদের এগিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষের শক্তির প্রধান উৎস ভাবাবেগের ভান্ডারে ভাগ বসাতে সক্ষম হলো। তারা প্রমাণ করতে পারল যে মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম পরস্পরবিরোধী কোনো ভাবাদর্শ নয় এবং ভাবাবেগের দুটি পৃথক ভরকেন্দ্রও নয়। আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিক এবং নেতা-কর্মীদের ব্যক্তিগত সংস্কৃতিতে ইসলাম একটি বড় জায়গা জুড়ে আছে। এটা আরোপিতও নয়, বানানোও নয়, অতীতে ধর্মপ্রাণ মানুষ হয়েও অনেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনার পক্ষপাতী ছিলেন না। এখানে আমরা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে পার্থক্য দেখতে পাই।
বিরোধিতা ও প্রতিপক্ষতার চর্চা যত তীব্র, ব্যাপক ও দীর্ঘায়িত হয়েছে, বিএনপি ততই কট্টর ইসলামি দলগুলোর কাছাকাছি চলে এসেছে, দলের অভ্যন্তরে জামায়াতপন্থী অনেক নেতাই শক্ত অবস্থানে চলে এসেছেন। ফলে দেশের তরুণসমাজ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ভাবাবেগে জেগে উঠছে, তখনো বিএনপি তাদের প্রতি পক্ষপাত প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। আর এর চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল স্বয়ং বেগম জিয়ার মুখে, তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কথা ও মনোভাবই দলের বক্তব্য ও ভাবনা হিসেবে মানুষের কাছে প্রকাশ পায়। তাঁর এ বক্তব্য রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটা মারাত্মক ভুল বলেই প্রমাণিত হচ্ছে।
কোনো সচেতন মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদের মাথা গোনা সংখ্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না। যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ছয় কোটি মানুষের মৃত্যু বা লেনিনগ্রাদ (প্রাক্তন ও বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) রক্ষায় ২০০ রুশবাসীর শাহাদাত বরণ কিংবা নাৎসিদের হাতে ৬০ লাখ ইহুদি নিহত হওয়ার পরিসংখ্যান নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না। সবাই জানেন যে নিহত ও শহীদের সংখ্যা ছিল বেশুমার। প্রশ্নটা হচ্ছে, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা গণহত্যা চালিয়েছিল কি না, নারী নির্যাতন করেছিল কি না, জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছিল কি না। এরই ফাঁকে বেগম জিয়ার জ্ঞাতার্থে জানাই, একাত্তরের সেপ্টেম্বর নাগাদ শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে আসা মার্কিন সিনেটর প্রয়াত এডওয়ার্ড কেনেডি একটি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন যে শরণার্থী শিবিরগুলোতেই তখন পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ শিশু প্রাণ হারিয়েছে। এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের বলি। তাদের সে সম্মান দিতে হবে।
যা হোক, আমরা আগের কথায় ফিরে আসি। দল পুনর্গঠন বা সাংগঠনিকভাবে দলকে গুছিয়ে নেওয়ার আগে তাদের ভাবতে হবে মানুষকে উজ্জীবিত করার হাতিয়ার কী হবে? তারা কি এর জন্য মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকেই ধারণ করে এগোবে? এই মনোভাবের মানুষের সংখ্যা দেশে অনেক এবং বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে নতুনভাবে তরুণসমাজের মধ্যে মুসলিম পরিচয় তুলে ধরা ও প্রমাণ করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ দুটি কারণে বিএনপি তাদের সনাতন আদর্শেই অবিচল থাকতে পারে। এখানে তাদের জন্য বিপদ দেখতে পাই দুদিক থেকে। একদিকে হলো নতুন পরিস্থিতির কারণে মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতির, অন্তত কিছুকালের জন্য, চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিএনপির গায়ে জেএমবি-জামায়াত পৃষ্ঠপোষকতার দাগ রয়েছে, ফলে আবারও নতুন কোনো সম্পর্ক তাদের সমস্যায় ফেলতে পারে। বিপদের দ্বিতীয় দিকটি হলো, ইসলামে শান্তিপূর্ণ পথে মানুষের মন জয় ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করার শিক্ষা ও আদর্শ রয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় বৈশ্বিক পটভূমিতে আমরা মুসলিম আলেম-মনীষীদের মধ্যে ইসলামের এই ভাষ্য তুলে ধরা এবং তার ভিত্তিতে একটি সমঝোতা ও শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষ করছি। তা ছাড়া বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ধর্মভীরু মুসলিম হলেও সাংস্কৃতিক-সামাজিকভাবে তাদের মজ্জাগত প্রবণতা উদার মানবিক দিকে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতারা বিষয়টি ধরতে পারেননি। সে কারণেই শেষ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ও বর্তমান বাংলাদেশে মুসলিম লীগ অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। এ বিষয়গুলো বিএনপি নেতাদের মাথায় রেখে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
আজকের বাস্তবতায় বিএনপির পক্ষে প্রমাণ করা শক্ত যে তারা ইসলামচর্চায় আওয়ামী লীগের চেয়ে গুণগতভাবে বেশি আন্তরিক ও শ্রেয়তর। ইতিমধ্যে ছিটমহল বিনিময়, বিদ্যুৎ সরবরাহে উন্নতি ও অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতবিরোধিতার কার্ড রাজনীতিতে কোনো বাড়তি সুবিধা দেবে না।
বলা যায়, দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ভাবাদর্শিক ভ্রান্ত মোহে কেটেছে বিএনপির। দলের এই মোহ দীর্ঘায়িত হওয়ায় নানা রকম ভুলভ্রান্তি ঘটে চলেছে এবং বিপরীতে আওয়ামী লীগ একতরফা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু, সরকারে থাকায় সবটা জায়গাজুড়েই দলটি খেলছে। বিএনপি মাঠে নামার জায়গা পাচ্ছে না।
তবে স্থানীয় নির্বাচনগুলো তাদের জন্য সুযোগ নিয়ে আসছে এবং আশার কথা, বিএনপির নেতৃত্ব সেটা গ্রহণ করছেন। এর বাইরে তাদের জন্য আরেকটা বড় কাজ আছে বলে মনে হয়। তা হলো মানসিকতার পরিবর্তন। কাজটা সহজ নয়। কিন্তু বাংলাদেশে যেমন ধর্মকে একদম বাদ রেখে রাজনীতির কথা ভাবা যায় না, তেমনি অমোঘ আরেক বিষয় হলো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বা চেতনা বলতে একটা বিষয় আছে, তা হলো প্রকৃত গণতন্ত্র; যা অসাম্প্রদায়িক মানবতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়কে নিশ্চিত করে। স্থানীয় সরকারের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন, বিচার বিভাগের যথার্থ স্বাধীনতা, সরকার ও প্রশাসনের জবাবদিহিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও প্রকৃত গণতন্ত্রেই নিষ্পত্তি হবে। আর এখানেই বিএনপির জন্য রাজনীতির আদর্শ, ভাবাবেগ তৈরির খনি রয়েছে। কারণ ক্ষমতা সংহত করা বা পাকাপোক্ত করার দৌড়ে নেমে বর্তমান সরকার অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে এবং গণতান্ত্রিক অধিকারে অনেকটাই ঘাটতি তৈরি করছে। দুর্নীতি, বিচারহীনতা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেপরোয়া ক্ষমতা, গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ ইত্যাদি অনেকভাবেই গণতন্ত্র খর্ব হচ্ছে। কোনো কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে সাধারণত ক্ষমতাসীনদের এভাবে ক্ষমতামদমত্ত হয়ে ওঠার প্রবণতা বাড়তে থাকে। তার কিছু আলামত সমাজে রয়েছে। ফলে বিএনপির জন্য রাজনীতির সুযোগ কম, এ কথা ঠিক নয়। কেবল তাদের পুরোনো ধাঁচের চিন্তার বাইরে এসে নতুনভাবে ভাবতে হবে।
তাদের জন্য শেষ এবং শক্ত ফাঁড়া হলো দলের ভাবাদর্শিক নেতা জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর বিকল্প একজন ভাবার অভ্যাস পরিবর্তন। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, জেএমবি সম্পৃক্ততা ইত্যাদি যেমন খালেদা জিয়ার আমলে বিএনপির গায়ে বড় আঁচড়, তেমনি জিয়াউর রহমানের উত্থানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই এ দেশে স্বাধীনতাসংগ্রাম হয়েছে, তাঁর নামে স্লোগান দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদসহ চার নেতাই সরকার চালিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে জাতি এঁদের হত্যাকাণ্ডের কেবল বিচার নয়, সব রহস্য উদ্ঘাটন করতে চাইবে। এটা তাদের কর্তব্য ও অধিকার। ফলে এ নিয়ে বিরোধপূর্ণ মনোভাবের অবসান টানতে হবে।
তবে, এই বিপদ কীভাবে কাটাবেন, সেটা বেগম জিয়া ও তাঁর সহকর্মীদেরই আজ ভাবতে হবে। সে ভাবনার দায় কলামিস্টের নয়, তাঁদেরই।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments