রিপাবলিকানে বিবেকবান প্রার্থী নেই : ডান দিকে ঝুঁকছে ডেমোক্র্যাটরা -মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে চমস্কি
ইনস্টিটিউট
ফর পাবলিক একিউরেসির পক্ষ থেকে অ্যাবে মার্টিন সম্প্রতি মার্কিন
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ক্যামব্রিজের এমআইটিতে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ও
ভাষাতত্ত্ববিদ নোয়াম চমস্কির একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তার এই সাক্ষাতকারের
চৌম্বক অংশটি নয়া দিগন্তের পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হলো। সাক্ষাৎকারটি
অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ খায়রুল বাশার।
প্রশ্ন : এখন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দৃশ্যপট যেমন চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তেমনি সেখানে এখনো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে সবার মধ্যে একটি সম্পূর্ণ মিল দেখা যাচ্ছে। যেমন- ল্যাটিন আমেরিকার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু যুদ্ধের বিরোধিতার ব্যাপারে একটি জন ঐকমত্য থাকা সত্ত্বেও সেখানে সত্যিকার অর্থে যুদ্ধবিরোধী কোনো প্রার্থী নেই। কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীই কেন বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন না?
নোয়াম চমস্কি : দৃশ্যপটটা অস্বাভাবিক বড়। এই দৃশ্যপটটি মূলত চরম ডানদের একটি কেন্দ্র। রিপাবলিকান পার্টি একটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ২০ বছর আগে মৌলিকভাবে যেকোনো পূর্ব-উত্তেজনা পরিত্যাগ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ডানপন্থী থিংক ট্যাংক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের নরম্যান অর্নেস্টিনের মতো প্রসিদ্ধ ভাষ্যকারেরা রিপাবলিকান পার্টিকে রেডিক্যাল ইনসারজেন্সি তথা সহজাত বিদ্রোহী হিসেবে বর্ণনা করেছেন- যারা পার্লামেন্টারি রাজনীতিকে পরিত্যাগ করেছিল। কোনো কিছু ঘটুক তা তারা চায় না, তাদের একমাত্র নীতি হচ্ছে ‘কোনো কিছু কোরো না।’ ওটা কোনো রাজনৈতিক দল নয়। যা ঘটেছে তা হচ্ছে নিউ লিবারেলের পুরো সময় দলটি এবং উভয় দলই ডান দিকে স্থান পরিবর্তন করেছে। বিশ্বের সর্বত্র এটা ঘটেছে। রিপাবলিকানেরা দৃশ্যপট থেকে সরে যায়। তারা বিপুল সম্পদের মালিক এবং ক্ষমতাশালী হওয়ার জন্য এতই পাগলপারা হয়ে যায় যে, তারা নিজস্ব অবস্থানে থেকে ভোট পায়নি। তাই তাদের অন্য নির্বাচনী এলাকায় যেতে হয়। সেখানে অন্য নির্বাচনী এলাকা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো কখনো রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ছিল না। খ্রিশ্চিয়ান ইভেনজেলিক্যালস তথা ঈশ্বরে বিশ্বাসই একমাত্র পথ এই মতাবলম্বী প্রটেস্টাইন সম্প্রদায়, মানুষের সহজাত ধারণা যারা পোষণ করে এবং যারা ‘আমাদের দেশকে আমাদের কাছ থেকে তারা নিয়ে যাবে’ এই ধারণা পোষণ করে ভয় পেয়ে যায়। যেসব লোক ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কফিশপে বন্দুক সাথে নিয়ে প্রবেশ করে অথচ ওটা তাদের অত্যাবশ্যকীয় ঘাঁটি। আপনি প্রাইমারিগুলোর দিকে তাকালে যুক্তিবাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তথা বিবেকবান প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেখতে পাবেন না। সুতরাং এটাই হচ্ছে রিপাবলিকানদের অবস্থা। ডেমোক্র্যাটরাও তাদের কৌশল পরিবর্তন করে ডান দিকে ঝুঁকেছে।
আজকের ডেমোক্র্যাটদের প্রধান ধারাটি বেশ সুন্দর, যেটাকে মডারেট রিপাবলিকান্স বা উদার রিপাবলিকান বলা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ আইজেন হাওয়ারের মতো কাউকে না কাউকে বামপন্থীদের জন্য অপ্রচলিত প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সুতরাং উদাহরণের জন্য আইজেন হাওয়ার দৃঢ়তার সাথে এটা স্পষ্ট করেছেন যে, নতুন চুক্তির কর্মসূচির ব্যাপারে যিনি প্রশ্ন করেন তিনি আমেরিকান রাজনৈতিক জীবনের অংশ হবেন না। ভালো, এখন এটা একটি বামপন্থী কর্মসূচি। এটা মৌলিকভাবে বার্নিসেন্ডারের কর্মসূচি। তিনি হচ্ছেন আইজেন হাওয়ার। সুতরাং দৃশ্যপট যে বড় তা সত্য। কিন্তু এটা একটা অত্যন্ত অদ্ভুত অনুভূতি।
যতদূর জানা যায়, যুদ্ধবিরোধী প্রার্থীরা উদ্বিগ্ন। আপনি এর অর্থ কী তা জিজ্ঞেস করতে পারেন। সুতরাং উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ওবামাকে একজন যুদ্ধবিরোধী প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ইরাক যুদ্ধকে একটি ভুল, একটি কৌশলগত সাংঘাতিক ভুল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ১৯৮০-এর দশকের প্রথমাংশে আফগানিস্তানের রুশ জেনারেলরা আফগান আগ্রাসনকে কৌশলগত একটি মারাত্মক ভুল বলে সমালোচনা করেছিলেন। ওটা যুদ্ধের সমালোচনা ছিল না। ওই সমালোচনায় বলা হয়েছে, আপনি ভুল করছেন। ওবামা প্রশাসন বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, সে ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী এই কর্মসূচিকে ড্রোন কর্মসূচির আগে তেমন একটা বিবেচনা করা হয়নি। সম্প্রতি বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় এর বিস্তৃতি বা ব্যাপকতা আলোচনায় উঠে এসেছে। কিন্তু যে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে তা অতিবিজ্ঞ জেরেমি স্কাহিল অথবা গ্লিন গ্রিনওয়ালসের নয়।
কিন্তু এটা সম্পর্কে যারা কথা বলেছেন তাদের বেশির ভাগই বলেছেন, ‘আপনি কি অনেক বেসামরিক লোককে হত্যা করছেন?’ যেসব লোককে গোপনে হত্যা করেছেন, তাতে কী হলো? কারণ আপনি মনে করেন, একদিন তারা হয়তো আপনার ক্ষতি করতে চাইতে পারে। উদাহরণস্বরূপ মনে করুন- ইরান যুক্তরাষ্ট্রের লোকদের খুন করছে? কারণ তারা মনে করে, কিছু কারণে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) হয়তো ইরানের ক্ষতি করতে চাইতে পারে। উদাহরণস্বরূপ দি নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদকেরা ইরানে বোমা হামলা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাই মনে করুন তারা বললেন যে, এটা একটা হুমকি দেয়া হয়েছে। চলুন তাদের হত্যা করি। এ ধরনের বক্তব্য কী আমরা গ্রহণ করব? মনে করুন, আমাদের শক্তি প্রয়োগ করার এবং সহিংসতা করার অধিকার আছে। কিন্তু এটা কি সবাই ভালোভাবে মেনে নেবে? যেমন- ইরান নিয়ে আলোচনার কথাই ধরুন। প্রকৃতপক্ষে, প্রেসিডেন্ট, রাজনৈতিক নেতারা, পত্রপত্রিকার ভাষ্যকার ও বিশ্লেষক প্রত্যেকেই সর্বজনীনভাবে বলেন, আমরা যদি একতরফাভাবে চিহ্নিত করি, চিহ্নিত থাকার জন্য চিন্তাভাবনা করি, কিছুসংখ্যক ইরানি নাগরিক চুক্তি লঙ্ঘন করছে। তাই তাদের ওপর হামলা করার জন্য আমাদের সামরিক বাহিনী ব্যবহার করার অধিকার আছে। এর অর্থ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন ও এর প্রয়োগ বা বাস্তবতা অনুযায়ী এটা অস্বাভাবিক। কিন্তু এটা সর্বজনীন, প্রকৃতপক্ষে সর্বজনীন।
প্রশ্ন : এসব প্রার্থীর কোনো একজনের পক্ষ থেকেও গুপ্তহত্যা কর্মসূচি অথবা এমনকি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে মৃদু সমালোচনাও করা হয়নি। প্রত্যেক চার বছর আমরা এই বিরাট ভূমিকা পালনের জন্য তাদের নির্বাচিত করি। এসব নেতাকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক অনুশীলন করে আমাদের দেশকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য আমরা ভোট দেই। আমাদের সমাজে ক্ষমতা সত্যিকার অর্থে কিভাবে কাজ করে?
নোয়াম চমস্কি : মূলধারার রাজনৈতিক বিজ্ঞানে এসংক্রান্ত ভালো গবেষণা হয়েছে। অ্যাকাডেমিক রাজনীতিবিজ্ঞানে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সরকারি নীতির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। এটা সুন্দর ও সরাসরি গবেষণা বা সমীক্ষা। সরকারি নীতির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়- ভোটদানের একটি ভালো প্রমাণ রয়েছে। মানুষ যেভাবে চিন্তা করে সেভাবে তারা তা কার্যকর করতে পারে। সুতরাং ৪০ বছরের উদাহরণ হলো জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে, ধনীদের কর বাড়ানো উচিত। জনগণের অপর একটি বড় অংশ মনে করে, আমাদের একটি জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি থাকা উচিত। কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যখন পত্রপত্রিকায় আলোচনা করা হয় তখন বলা হয়, রাজনৈতিকভাবে এটা অসম্ভব। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এটা গ্রহণ করবে না। ... ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং মূলত ৭০ শতাংশ মানুষের মতামতের বিষয়টিকে বলা হয়, তারা আয় বিবেচনায় সর্বনিম্ন পর্যায়ের। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের নিজস্ব প্রতিনিধিদের নীতির ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। সর্বোচ্চপর্যায়ে যারা আছে শুধু তাদের জন্যই কি নীতি তৈরি হবে? সর্বোচ্চ পর্যায়ে ১ শতাংশ লোক আছে, তা হলে এটা তো গণতন্ত্রের মোড়কে পলিটুক্র্যাসি অর্থাৎ ধনীদের শাসন। আমি মনে করি, এখন নির্বাচন একটি কৌতুকে পরিণত হয়েছে। তবে সবসময় এটা সত্য যে, নির্বাচনী প্রচারের জন্য অর্থ ব্যয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১০০ বছর আগে গ্রেট ক্যাম্পেইন ম্যানেজার মার্ক হান্নানকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- নির্বাচনী প্রচারণায় কোন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ? তিনি বলেন, তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম হচ্ছে : অর্থ, দ্বিতীয়টিও হচ্ছে অর্থ এবং তৃতীয়টি কি তা আমি ভুলে গেছি। এটাই হলো সত্য। বর্তমানে নির্বাচনী প্রচারণায় শত শত কোটি ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল সুপ্রিম কোর্ট তা দেখেও দেখছে না।
প্রশ্ন : কয়েক সপ্তাহ আগে মার্কিন সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের কুন্দুজে একটি হাসপাতালে বোমা হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাকেই যথেষ্ট হয়েছে বলে মনে করেছে। মার্কিন সিদ্ধান্তকে সঠিক হয়েছে বলে সাফাই গাওয়ার লোকের অভাব নেই। তালেবান জুজুর ভয় দেখিয়েও এটাকে তারা জায়েজ করার চেষ্টা করছে। ইসরাইল যেভাবে যুক্তি দেখায়- তাদের বক্তব্যও একই রকম। তা হলে আমেরিকা যে ব্যতিক্রমধর্মী বলে প্রচার করে এই সুনির্দিষ্ট ঘটনায় তার প্রমাণ কী?
নোয়াম চমস্কি : ভালো, আমাদের ‘আমেরিকান ব্যতিক্রমধর্মী’ বিষয়ক শব্দ চয়নের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। একটা বিষয় হলো এটা ব্যতিক্রমধর্মী কিছু নয়। প্রত্যেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একইভাবে জনগণের সাথে তাদের আচার-আচরণ ও ভাবভঙ্গি প্রকাশ করে থাকে। কোনো কোনো সময় তারা আরো খারাপ আচরণ করে। সুতরাং এটা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বাভাবিক প্র্যাকটিস। ব্রিটিশেরা যখন বিশ্বকে ধ্বংস করছিল তখন তারা মনে করেছিল তারা নিশ্চিতভাবে সর্বোচ্চ আদর্শ নিয়ে কাজ করছে। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী নেতারা ইংল্যান্ডকে একটি এনজেলিক দেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কুন্দুজ হাসপাতালের ক্ষেত্রে আমি সবকিছু আমাদের সামনে এসেছে বলে মনে করি না। তারা তালেবান নেতাদের হত্যা করার চেষ্টা করছে। হাসপাতালে হামলা করে তারা অন্যদেরও হত্যা করছে। অন্যদের হত্যা করায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। আমরা যাদের পছন্দ করি না- অন্যান্য দেশে আমরা তাদের হত্যা করছি। আমি তালেবানদের পছন্দ করি না। তার অর্থ কি আমরা তাদের হত্যা করার অধিকারী? আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তারা আমাদের পছন্দ না করলে আমাদের হত্যা করার অধিকার কি তাদের আছে? একটি হাসপাতালে হামলা করে, হাসপাতালের কর্মচারী ও রোগীদের হত্যা করাকে আমরা কী বলব? আর এ ধরনের ঘটনা একবারই নয়- বহুবার ঘটেছে। ফালুজা বিজয় হচ্ছে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর অন্যতম প্রশংসনীয় জয়। ২০০৪ সালের নভেম্বরে মার্কিন সৈন্যরা ফালুজা দখল করেছিল। আমরা ফালুজা হামলার সময়কার নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটু দৃষ্টিপাত করতে চাই। হামলার প্রথম দিন পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল মেরিন সেনারা ফালুজার জেনারেল হাসপাতালে হামলা চালাচ্ছে। তারা রোগীদের টেনেহিঁচড়ে বেড থেকে নিচে ফেলে দিচ্ছে। চিকিৎসকদের প্রহার করে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে তাদের হাত পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। হাসপাতালে হামলা আন্তর্জাতিক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন। তারা হাসপাতালে কেন হামলা করছে জিজ্ঞেস করলে তাদের জবাব ছিল : এটা বিদ্রোহীদের প্রোপাগান্ডা এজেন্সি। কিভাবে, জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, হাসপাতাল কত মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে তা জানিয়ে দিচ্ছিল। ইরাক আগ্রাসন হচ্ছে শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ। এই আগ্রাসনের ফলে গোটা অঞ্চলে এখন গোষ্ঠীগত সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। মনে করুন, আগ্রাসন চালিয়ে ইরাককে শান্ত করা গেছে। সেখানে কোনো বিপর্যয় নেই। তা হলেও এটা একটা বড় অপরাধ। অন্য একটি দেশে আগ্রাসন চালানোর অধিকার আমাদের কে দিয়েছে? আপনি যদি পেছনে ফিরে তাকান যেখানে অন্য অপরাধ হয়েছে, যা কখনো আলোচনা করা হয়নি।
১৯৯০-এর দশকে ইরাকের ওপর যে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে তাতে সেখানকার সমাজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। জাতিসঙ্ঘ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিকেরা এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছিল। সে সময় দায়িত্ব পালনরত আন্তর্জাতিক কূটনীতিক ড্যানিস হালিডে, হ্যান্সভন স্পোনেক উভয়ে এই নিষেধাজ্ঞাকে গণহত্যার শামিল আখ্যা দিয়ে এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন। এটা তাদের উক্তি আমার নয়। তারা বলেছিলেন, এই নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে গণহত্যা। নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তারা সমাজকে ধ্বংস করছে এবং স্বৈরশাসককে শক্তিশালী করছে। জনগণকে তার ওপর নির্ভর করতে তারা বাধ্য করছে। এভাবে একের পর এক স্বৈরশাসকেরা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯০-এর দশকে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ওটাকে কোনো সমস্যা মনে করা হয়নি।
ওটা হচ্ছে লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের কাণ্ড। আমি বুশ এবং ব্লেয়ারের শাসনকালকে বোঝাচ্ছি। তারা ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছে। ওই সমাজকে তারা প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। সেখানে একটি ভঙ্গুর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এখন তার মারাত্মক নেতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। আগ্রাসন চালিয়ে অন্য দেশ দখল করা ফৌজদারি অপরাধ।
প্রশ্ন : সঠিক
নোয়াম চমস্কি : ওবামার প্রশংসা করা যায়। কারণ তিনি ইরাক আগ্রাসনকে ভুল বলেছেন। তিনি কি এটাকে অপরাধ বলেছেন? কেউ কি বলেছেন?
প্রশ্ন : ওটাকে কি ‘ডাম্ব ওয়ার’ বলা সঠিক হবে?
নোয়াম চমস্কি : ডাম্ব ওয়ার বা বোবাযুদ্ধ। আমাদের এটা করা উচিত নয়। আমরা স্মার্ট বিষয় নিয়ে কাজ করব।
প্রশ্ন : হ্যাঁ, আমরা ‘স্মার্টযুদ্ধ’ করব।
নোয়াম চমস্কি : স্ট্যালিন গ্রাফের পর জার্মান জেনারেলরা যা করেছিল তার মতোই ওটা। তারা বলেছিল দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করা সত্যিই বোকামি। আমাদের প্রথমেই ইংল্যান্ডকে ধ্বংস করা উচিত।
প্রশ্ন : আমি সবসময় চিন্তা করি মানুষ ডব্লিউএমডি তথা মারাত্মক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র পেলেই কোনো দেশে আগ্রাসন চালানোকে যৌক্তিক মনে করে, এটা কেমন কথা? এই যুক্তি দেখিয়ে কোনো দেশে আক্রমণ চালিয়ে কি দেশ দখল করা যায়? এটা তো কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ।
নোয়াম চমস্কি : অবশ্যই না। মারাত্মক ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের ব্যাপারে উদ্বেগ থাকলে তার সমাধানও রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ পরিদর্শকেরা এ ব্যাপারে চমৎকারভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইরানের পরমাণু চুক্তির বিষয়েও একই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, ইরান বিশ্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ওটা হচ্ছে আমেরিকান ও ইসরাইলি বদ্ধ সংস্কার। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখছে না। ধরুন ইরান হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তাহলে আপনি কী করবেন? সত্যিকার অর্থে এরও একটা পথ আছে। খুব পপুলার একটা পথ আছে। সবচেয়ে ভালো বা সর্বোত্তম পথ হলো ওই এলাকায় একটি পরমাণু অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য কাজ করা। গোটা বিশ্বই ওটার প্রতি সমর্থন দেবে। ইরানও এই উদ্যোগের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেবে।
প্রশ্ন : ইসরাইল এতে থাকবে কিনা সেটাতো আপনি জানাচ্ছেন না?
নোয়াম চমস্কি : ওটা হচ্ছে একটা সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্র তার অনুমতি দেবে না। কারণ তারা চায় না ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র পরিদর্শনের জন্য খুলে দেয়া হোক। প্রত্যেক পাঁচ বছর পর পরমাণু বিস্তাররোধ চুক্তি পর্যালোচনা সম্মেলন হবে। ২০ বছর আগে এই চুক্তি হয়েছে। ওটাই হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ চুক্তি। ওই চুক্তি ব্যর্থ হলে আমরা চলে যাবো। প্রত্যেকের পরমাণু অস্ত্র থাকবে এবং তারা তা ব্যবহার করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র রক্ষা করার ব্যাপারে এতটাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, তারা অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিকে বিপন্ন করতে চায়। অপর দিকে, তারা ইরানকে পরমাণু অস্ত্র লাভের সুযোগ দিতে চায় না।
প্রশ্ন : এখন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দৃশ্যপট যেমন চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তেমনি সেখানে এখনো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে সবার মধ্যে একটি সম্পূর্ণ মিল দেখা যাচ্ছে। যেমন- ল্যাটিন আমেরিকার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু যুদ্ধের বিরোধিতার ব্যাপারে একটি জন ঐকমত্য থাকা সত্ত্বেও সেখানে সত্যিকার অর্থে যুদ্ধবিরোধী কোনো প্রার্থী নেই। কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীই কেন বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন না?
নোয়াম চমস্কি : দৃশ্যপটটা অস্বাভাবিক বড়। এই দৃশ্যপটটি মূলত চরম ডানদের একটি কেন্দ্র। রিপাবলিকান পার্টি একটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ২০ বছর আগে মৌলিকভাবে যেকোনো পূর্ব-উত্তেজনা পরিত্যাগ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ডানপন্থী থিংক ট্যাংক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের নরম্যান অর্নেস্টিনের মতো প্রসিদ্ধ ভাষ্যকারেরা রিপাবলিকান পার্টিকে রেডিক্যাল ইনসারজেন্সি তথা সহজাত বিদ্রোহী হিসেবে বর্ণনা করেছেন- যারা পার্লামেন্টারি রাজনীতিকে পরিত্যাগ করেছিল। কোনো কিছু ঘটুক তা তারা চায় না, তাদের একমাত্র নীতি হচ্ছে ‘কোনো কিছু কোরো না।’ ওটা কোনো রাজনৈতিক দল নয়। যা ঘটেছে তা হচ্ছে নিউ লিবারেলের পুরো সময় দলটি এবং উভয় দলই ডান দিকে স্থান পরিবর্তন করেছে। বিশ্বের সর্বত্র এটা ঘটেছে। রিপাবলিকানেরা দৃশ্যপট থেকে সরে যায়। তারা বিপুল সম্পদের মালিক এবং ক্ষমতাশালী হওয়ার জন্য এতই পাগলপারা হয়ে যায় যে, তারা নিজস্ব অবস্থানে থেকে ভোট পায়নি। তাই তাদের অন্য নির্বাচনী এলাকায় যেতে হয়। সেখানে অন্য নির্বাচনী এলাকা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো কখনো রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ছিল না। খ্রিশ্চিয়ান ইভেনজেলিক্যালস তথা ঈশ্বরে বিশ্বাসই একমাত্র পথ এই মতাবলম্বী প্রটেস্টাইন সম্প্রদায়, মানুষের সহজাত ধারণা যারা পোষণ করে এবং যারা ‘আমাদের দেশকে আমাদের কাছ থেকে তারা নিয়ে যাবে’ এই ধারণা পোষণ করে ভয় পেয়ে যায়। যেসব লোক ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কফিশপে বন্দুক সাথে নিয়ে প্রবেশ করে অথচ ওটা তাদের অত্যাবশ্যকীয় ঘাঁটি। আপনি প্রাইমারিগুলোর দিকে তাকালে যুক্তিবাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তথা বিবেকবান প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেখতে পাবেন না। সুতরাং এটাই হচ্ছে রিপাবলিকানদের অবস্থা। ডেমোক্র্যাটরাও তাদের কৌশল পরিবর্তন করে ডান দিকে ঝুঁকেছে।
আজকের ডেমোক্র্যাটদের প্রধান ধারাটি বেশ সুন্দর, যেটাকে মডারেট রিপাবলিকান্স বা উদার রিপাবলিকান বলা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ আইজেন হাওয়ারের মতো কাউকে না কাউকে বামপন্থীদের জন্য অপ্রচলিত প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সুতরাং উদাহরণের জন্য আইজেন হাওয়ার দৃঢ়তার সাথে এটা স্পষ্ট করেছেন যে, নতুন চুক্তির কর্মসূচির ব্যাপারে যিনি প্রশ্ন করেন তিনি আমেরিকান রাজনৈতিক জীবনের অংশ হবেন না। ভালো, এখন এটা একটি বামপন্থী কর্মসূচি। এটা মৌলিকভাবে বার্নিসেন্ডারের কর্মসূচি। তিনি হচ্ছেন আইজেন হাওয়ার। সুতরাং দৃশ্যপট যে বড় তা সত্য। কিন্তু এটা একটা অত্যন্ত অদ্ভুত অনুভূতি।
যতদূর জানা যায়, যুদ্ধবিরোধী প্রার্থীরা উদ্বিগ্ন। আপনি এর অর্থ কী তা জিজ্ঞেস করতে পারেন। সুতরাং উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ওবামাকে একজন যুদ্ধবিরোধী প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ইরাক যুদ্ধকে একটি ভুল, একটি কৌশলগত সাংঘাতিক ভুল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ১৯৮০-এর দশকের প্রথমাংশে আফগানিস্তানের রুশ জেনারেলরা আফগান আগ্রাসনকে কৌশলগত একটি মারাত্মক ভুল বলে সমালোচনা করেছিলেন। ওটা যুদ্ধের সমালোচনা ছিল না। ওই সমালোচনায় বলা হয়েছে, আপনি ভুল করছেন। ওবামা প্রশাসন বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, সে ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী এই কর্মসূচিকে ড্রোন কর্মসূচির আগে তেমন একটা বিবেচনা করা হয়নি। সম্প্রতি বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় এর বিস্তৃতি বা ব্যাপকতা আলোচনায় উঠে এসেছে। কিন্তু যে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে তা অতিবিজ্ঞ জেরেমি স্কাহিল অথবা গ্লিন গ্রিনওয়ালসের নয়।
কিন্তু এটা সম্পর্কে যারা কথা বলেছেন তাদের বেশির ভাগই বলেছেন, ‘আপনি কি অনেক বেসামরিক লোককে হত্যা করছেন?’ যেসব লোককে গোপনে হত্যা করেছেন, তাতে কী হলো? কারণ আপনি মনে করেন, একদিন তারা হয়তো আপনার ক্ষতি করতে চাইতে পারে। উদাহরণস্বরূপ মনে করুন- ইরান যুক্তরাষ্ট্রের লোকদের খুন করছে? কারণ তারা মনে করে, কিছু কারণে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) হয়তো ইরানের ক্ষতি করতে চাইতে পারে। উদাহরণস্বরূপ দি নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদকেরা ইরানে বোমা হামলা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাই মনে করুন তারা বললেন যে, এটা একটা হুমকি দেয়া হয়েছে। চলুন তাদের হত্যা করি। এ ধরনের বক্তব্য কী আমরা গ্রহণ করব? মনে করুন, আমাদের শক্তি প্রয়োগ করার এবং সহিংসতা করার অধিকার আছে। কিন্তু এটা কি সবাই ভালোভাবে মেনে নেবে? যেমন- ইরান নিয়ে আলোচনার কথাই ধরুন। প্রকৃতপক্ষে, প্রেসিডেন্ট, রাজনৈতিক নেতারা, পত্রপত্রিকার ভাষ্যকার ও বিশ্লেষক প্রত্যেকেই সর্বজনীনভাবে বলেন, আমরা যদি একতরফাভাবে চিহ্নিত করি, চিহ্নিত থাকার জন্য চিন্তাভাবনা করি, কিছুসংখ্যক ইরানি নাগরিক চুক্তি লঙ্ঘন করছে। তাই তাদের ওপর হামলা করার জন্য আমাদের সামরিক বাহিনী ব্যবহার করার অধিকার আছে। এর অর্থ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন ও এর প্রয়োগ বা বাস্তবতা অনুযায়ী এটা অস্বাভাবিক। কিন্তু এটা সর্বজনীন, প্রকৃতপক্ষে সর্বজনীন।
প্রশ্ন : এসব প্রার্থীর কোনো একজনের পক্ষ থেকেও গুপ্তহত্যা কর্মসূচি অথবা এমনকি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে মৃদু সমালোচনাও করা হয়নি। প্রত্যেক চার বছর আমরা এই বিরাট ভূমিকা পালনের জন্য তাদের নির্বাচিত করি। এসব নেতাকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক অনুশীলন করে আমাদের দেশকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য আমরা ভোট দেই। আমাদের সমাজে ক্ষমতা সত্যিকার অর্থে কিভাবে কাজ করে?
নোয়াম চমস্কি : মূলধারার রাজনৈতিক বিজ্ঞানে এসংক্রান্ত ভালো গবেষণা হয়েছে। অ্যাকাডেমিক রাজনীতিবিজ্ঞানে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সরকারি নীতির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। এটা সুন্দর ও সরাসরি গবেষণা বা সমীক্ষা। সরকারি নীতির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়- ভোটদানের একটি ভালো প্রমাণ রয়েছে। মানুষ যেভাবে চিন্তা করে সেভাবে তারা তা কার্যকর করতে পারে। সুতরাং ৪০ বছরের উদাহরণ হলো জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে, ধনীদের কর বাড়ানো উচিত। জনগণের অপর একটি বড় অংশ মনে করে, আমাদের একটি জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি থাকা উচিত। কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যখন পত্রপত্রিকায় আলোচনা করা হয় তখন বলা হয়, রাজনৈতিকভাবে এটা অসম্ভব। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এটা গ্রহণ করবে না। ... ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং মূলত ৭০ শতাংশ মানুষের মতামতের বিষয়টিকে বলা হয়, তারা আয় বিবেচনায় সর্বনিম্ন পর্যায়ের। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের নিজস্ব প্রতিনিধিদের নীতির ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। সর্বোচ্চপর্যায়ে যারা আছে শুধু তাদের জন্যই কি নীতি তৈরি হবে? সর্বোচ্চ পর্যায়ে ১ শতাংশ লোক আছে, তা হলে এটা তো গণতন্ত্রের মোড়কে পলিটুক্র্যাসি অর্থাৎ ধনীদের শাসন। আমি মনে করি, এখন নির্বাচন একটি কৌতুকে পরিণত হয়েছে। তবে সবসময় এটা সত্য যে, নির্বাচনী প্রচারের জন্য অর্থ ব্যয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১০০ বছর আগে গ্রেট ক্যাম্পেইন ম্যানেজার মার্ক হান্নানকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- নির্বাচনী প্রচারণায় কোন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ? তিনি বলেন, তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম হচ্ছে : অর্থ, দ্বিতীয়টিও হচ্ছে অর্থ এবং তৃতীয়টি কি তা আমি ভুলে গেছি। এটাই হলো সত্য। বর্তমানে নির্বাচনী প্রচারণায় শত শত কোটি ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল সুপ্রিম কোর্ট তা দেখেও দেখছে না।
প্রশ্ন : কয়েক সপ্তাহ আগে মার্কিন সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের কুন্দুজে একটি হাসপাতালে বোমা হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাকেই যথেষ্ট হয়েছে বলে মনে করেছে। মার্কিন সিদ্ধান্তকে সঠিক হয়েছে বলে সাফাই গাওয়ার লোকের অভাব নেই। তালেবান জুজুর ভয় দেখিয়েও এটাকে তারা জায়েজ করার চেষ্টা করছে। ইসরাইল যেভাবে যুক্তি দেখায়- তাদের বক্তব্যও একই রকম। তা হলে আমেরিকা যে ব্যতিক্রমধর্মী বলে প্রচার করে এই সুনির্দিষ্ট ঘটনায় তার প্রমাণ কী?
নোয়াম চমস্কি : ভালো, আমাদের ‘আমেরিকান ব্যতিক্রমধর্মী’ বিষয়ক শব্দ চয়নের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। একটা বিষয় হলো এটা ব্যতিক্রমধর্মী কিছু নয়। প্রত্যেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একইভাবে জনগণের সাথে তাদের আচার-আচরণ ও ভাবভঙ্গি প্রকাশ করে থাকে। কোনো কোনো সময় তারা আরো খারাপ আচরণ করে। সুতরাং এটা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বাভাবিক প্র্যাকটিস। ব্রিটিশেরা যখন বিশ্বকে ধ্বংস করছিল তখন তারা মনে করেছিল তারা নিশ্চিতভাবে সর্বোচ্চ আদর্শ নিয়ে কাজ করছে। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী নেতারা ইংল্যান্ডকে একটি এনজেলিক দেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কুন্দুজ হাসপাতালের ক্ষেত্রে আমি সবকিছু আমাদের সামনে এসেছে বলে মনে করি না। তারা তালেবান নেতাদের হত্যা করার চেষ্টা করছে। হাসপাতালে হামলা করে তারা অন্যদেরও হত্যা করছে। অন্যদের হত্যা করায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। আমরা যাদের পছন্দ করি না- অন্যান্য দেশে আমরা তাদের হত্যা করছি। আমি তালেবানদের পছন্দ করি না। তার অর্থ কি আমরা তাদের হত্যা করার অধিকারী? আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তারা আমাদের পছন্দ না করলে আমাদের হত্যা করার অধিকার কি তাদের আছে? একটি হাসপাতালে হামলা করে, হাসপাতালের কর্মচারী ও রোগীদের হত্যা করাকে আমরা কী বলব? আর এ ধরনের ঘটনা একবারই নয়- বহুবার ঘটেছে। ফালুজা বিজয় হচ্ছে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর অন্যতম প্রশংসনীয় জয়। ২০০৪ সালের নভেম্বরে মার্কিন সৈন্যরা ফালুজা দখল করেছিল। আমরা ফালুজা হামলার সময়কার নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটু দৃষ্টিপাত করতে চাই। হামলার প্রথম দিন পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল মেরিন সেনারা ফালুজার জেনারেল হাসপাতালে হামলা চালাচ্ছে। তারা রোগীদের টেনেহিঁচড়ে বেড থেকে নিচে ফেলে দিচ্ছে। চিকিৎসকদের প্রহার করে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে তাদের হাত পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। হাসপাতালে হামলা আন্তর্জাতিক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন। তারা হাসপাতালে কেন হামলা করছে জিজ্ঞেস করলে তাদের জবাব ছিল : এটা বিদ্রোহীদের প্রোপাগান্ডা এজেন্সি। কিভাবে, জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, হাসপাতাল কত মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে তা জানিয়ে দিচ্ছিল। ইরাক আগ্রাসন হচ্ছে শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ। এই আগ্রাসনের ফলে গোটা অঞ্চলে এখন গোষ্ঠীগত সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। মনে করুন, আগ্রাসন চালিয়ে ইরাককে শান্ত করা গেছে। সেখানে কোনো বিপর্যয় নেই। তা হলেও এটা একটা বড় অপরাধ। অন্য একটি দেশে আগ্রাসন চালানোর অধিকার আমাদের কে দিয়েছে? আপনি যদি পেছনে ফিরে তাকান যেখানে অন্য অপরাধ হয়েছে, যা কখনো আলোচনা করা হয়নি।
১৯৯০-এর দশকে ইরাকের ওপর যে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে তাতে সেখানকার সমাজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। জাতিসঙ্ঘ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিকেরা এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছিল। সে সময় দায়িত্ব পালনরত আন্তর্জাতিক কূটনীতিক ড্যানিস হালিডে, হ্যান্সভন স্পোনেক উভয়ে এই নিষেধাজ্ঞাকে গণহত্যার শামিল আখ্যা দিয়ে এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন। এটা তাদের উক্তি আমার নয়। তারা বলেছিলেন, এই নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে গণহত্যা। নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তারা সমাজকে ধ্বংস করছে এবং স্বৈরশাসককে শক্তিশালী করছে। জনগণকে তার ওপর নির্ভর করতে তারা বাধ্য করছে। এভাবে একের পর এক স্বৈরশাসকেরা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯০-এর দশকে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ওটাকে কোনো সমস্যা মনে করা হয়নি।
ওটা হচ্ছে লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের কাণ্ড। আমি বুশ এবং ব্লেয়ারের শাসনকালকে বোঝাচ্ছি। তারা ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছে। ওই সমাজকে তারা প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। সেখানে একটি ভঙ্গুর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এখন তার মারাত্মক নেতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। আগ্রাসন চালিয়ে অন্য দেশ দখল করা ফৌজদারি অপরাধ।
প্রশ্ন : সঠিক
নোয়াম চমস্কি : ওবামার প্রশংসা করা যায়। কারণ তিনি ইরাক আগ্রাসনকে ভুল বলেছেন। তিনি কি এটাকে অপরাধ বলেছেন? কেউ কি বলেছেন?
প্রশ্ন : ওটাকে কি ‘ডাম্ব ওয়ার’ বলা সঠিক হবে?
নোয়াম চমস্কি : ডাম্ব ওয়ার বা বোবাযুদ্ধ। আমাদের এটা করা উচিত নয়। আমরা স্মার্ট বিষয় নিয়ে কাজ করব।
প্রশ্ন : হ্যাঁ, আমরা ‘স্মার্টযুদ্ধ’ করব।
নোয়াম চমস্কি : স্ট্যালিন গ্রাফের পর জার্মান জেনারেলরা যা করেছিল তার মতোই ওটা। তারা বলেছিল দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করা সত্যিই বোকামি। আমাদের প্রথমেই ইংল্যান্ডকে ধ্বংস করা উচিত।
প্রশ্ন : আমি সবসময় চিন্তা করি মানুষ ডব্লিউএমডি তথা মারাত্মক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র পেলেই কোনো দেশে আগ্রাসন চালানোকে যৌক্তিক মনে করে, এটা কেমন কথা? এই যুক্তি দেখিয়ে কোনো দেশে আক্রমণ চালিয়ে কি দেশ দখল করা যায়? এটা তো কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ।
নোয়াম চমস্কি : অবশ্যই না। মারাত্মক ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের ব্যাপারে উদ্বেগ থাকলে তার সমাধানও রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ পরিদর্শকেরা এ ব্যাপারে চমৎকারভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইরানের পরমাণু চুক্তির বিষয়েও একই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, ইরান বিশ্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ওটা হচ্ছে আমেরিকান ও ইসরাইলি বদ্ধ সংস্কার। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখছে না। ধরুন ইরান হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তাহলে আপনি কী করবেন? সত্যিকার অর্থে এরও একটা পথ আছে। খুব পপুলার একটা পথ আছে। সবচেয়ে ভালো বা সর্বোত্তম পথ হলো ওই এলাকায় একটি পরমাণু অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য কাজ করা। গোটা বিশ্বই ওটার প্রতি সমর্থন দেবে। ইরানও এই উদ্যোগের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেবে।
প্রশ্ন : ইসরাইল এতে থাকবে কিনা সেটাতো আপনি জানাচ্ছেন না?
নোয়াম চমস্কি : ওটা হচ্ছে একটা সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্র তার অনুমতি দেবে না। কারণ তারা চায় না ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র পরিদর্শনের জন্য খুলে দেয়া হোক। প্রত্যেক পাঁচ বছর পর পরমাণু বিস্তাররোধ চুক্তি পর্যালোচনা সম্মেলন হবে। ২০ বছর আগে এই চুক্তি হয়েছে। ওটাই হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ চুক্তি। ওই চুক্তি ব্যর্থ হলে আমরা চলে যাবো। প্রত্যেকের পরমাণু অস্ত্র থাকবে এবং তারা তা ব্যবহার করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র রক্ষা করার ব্যাপারে এতটাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, তারা অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিকে বিপন্ন করতে চায়। অপর দিকে, তারা ইরানকে পরমাণু অস্ত্র লাভের সুযোগ দিতে চায় না।
No comments