গণতন্ত্র ও শক্তির ভারসাম্য by হায়দার আকবর খান রনো
এটা
খুবই ভালো এবং স্বস্তিকর সংবাদ যে ৫ জানুয়ারি দুই রাজনৈতিক
প্রতিদ্বন্দ্বী দল একই দিনে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন স্থানে জনসভা করতে পেরেছে।
খালেদা জিয়া সরকারের যথারীতি সমালোচনা করলেও তাঁর সুর ছিল নরম এবং তিনি
আলাপ-আলোচনা করে ‘নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে’ পথ
বের করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান রেখেছেন। এমনকি এ কথাও বলেছেন যে ‘এর
জন্য একসঙ্গে কাজ করতে চাই।’ এরকম সহনশীল ও ইতিবাচক ভূমিকা যদি তিনি ২০১৪
সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে রাখতে পারতেন, তাহলে বোধ হয় ঘটনাপ্রবাহ
অন্য রকম হতো।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও বিএনপি ও খালেদা জিয়ার সমালোচনা করলেও কড়া কথা বলেননি। অবশ্য সৈয়দ আশরাফুল আজেবাজে কথা খুব একটা বলেন না। ভদ্রোচিত তাঁর আচরণ ও বক্তব্য। তিনি খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান রেখে বলেছেন, ‘আসুন, আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যাই।’ এই যে ‘আমরা’ কথাটা ব্যবহার করেছেন, সেটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ‘উড়িয়ে দেব’, ‘গুঁড়িয়ে দেব’, ‘রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না’—এ ধরনের কথায় অভ্যস্ত সরকারি দলের অন্যান্য নেতার মতো তিনি নন। মির্জা আলমগীরও সৈয়দ আশরাফের মতো ভদ্রলোক এবং শিক্ষিত মানুষ। তিনি সংযত ও যুক্তিপূর্ণ কথা বলেন এবং তা ভদ্র ভাষায়। কিন্তু বিএনপির দুই নম্বর নেতা খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের সে ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। অর্বাচীনের মতো নানা অবান্তর কথা বলে তিনি প্রায়ই রাজনৈতিক পরিবেশকে নষ্ট করেন। তাতে তাঁর নিজের বা দলের কোনো লাভ অবশ্য হয়নি।
৫ জানুয়ারির চিত্র ২০১৫ ও ২১১৪ সালের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। শান্তিপূর্ণ ও স্বস্তিদায়ক। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এভাবে অগ্রসর হলে আমরা আশাবাদী হতে পারি। তবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এখনো চূড়ান্ত কথা বলার সময় আসেনি। মাত্র কিছুদিন আগে যে পৌরসভার নির্বাচন হয়ে গেল, তা কিন্তু সুস্থ পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক চর্চার ইঙ্গিত বহন করে না। উপজেলা নির্বাচন এবং ঢাকা-চট্টগ্রামের করপোরেশন নির্বাচনের প্যাটার্নে একই ধারাবাহিকতায় প্রহসনমূলক হয়েছে সদ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করলেও বিএনপি কিন্তু কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেনি। এমনকি যে সৌভাগ্যবান মাত্র ২২ জন পৌরসভায় জয়ী বলে ঘোষিত হয়েছেন, তাঁরা নির্বাচনের রায় মেনে নিয়ে কাজ করবেন। কেন্দ্রীয় নির্দেশও নেই পৌরসভার মেয়রের পদ প্রত্যাখ্যান করার জন্য। মোট কথা, বিএনপি এখন অনেক সুর নামিয়েছে। অবশ্য অনেক ঠেকে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে তাদের এই উপলব্ধি হয়েছে। ভবিষ্যতে এটা অব্যাহত থাকলেই ভালো আমাদের জন্য, দেশের জনগণের জন্য এবং দলটির নিজের জন্যও। বিএনপি নিজের ভালো চাইলে তাকে আরও কিছুটা ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। তার মধ্যে একটি হলো জামায়াতকে পরিত্যাগ করতে হবে। আরেকটি হলো সংযত কথা বলতে হবে, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোনো প্রকার খারাপ মন্তব্য থেকে বিরত থাকতে হবে। বলাই বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে শ্রদ্ধা রেখেই আচরণ করতে হবে। আমি জানি না, জামায়াতকে এখনই পরিত্যাগ করা খালেদা জিয়ার পক্ষে সম্ভব কি না।
এবার আসা যাক, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে। সৈয়দ আশরাফ একত্রে শান্তিপূর্ণ রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে আহ্বান রেখেছেন, সেটা কথার কথা না হয়ে বাস্তবে কার্যকর করতে হলে তো গণতান্ত্রিক চর্চাকে উৎসাহিত করতে হবে এবং বিএনপিসহ সবাইকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিতে হবে। গত বছর তো বিএনপিকে সভা বা মানববন্ধন—কোনো কিছুই করতে দেওয়া হয়নি। এবার যে জনসভা করার অধিকার পেল, এটা ভালো কথা। কিন্তু নির্বাচনও তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই একটি স্তম্ভ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর থেকে কোনো স্থানীয় নির্বাচন যথাযথ হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর এল উপজেলা নির্বাচন। উপজেলা নির্বাচন পাঁচ পর্বে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম দুই পর্বে দেখা গেল বিএনপির বিশাল বিজয়। পরবর্তী তিন দফায় উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল কারচুপির আশ্রয় নিল। ভোটকেন্দ্র দখল, পুলিশের সামনেই ব্যালট বাক্সে বেপরোয়া সিল মারার ঘটনা ঘটল। একই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল গত বছর ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে।
মাত্র কয়েক দিন আগে যে সারা দেশে পৌরসভা নির্বাচন হলো, সেখানেও একই চেহারা। ৬ জানুয়ারির প্রথম আলোর সংখ্যায় সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এক নিবন্ধে দাবি করেছেন, ‘৭৪ শতাংশ ভোটকে স্বাভাবিক বলা যাবে না।’ ১ জানুয়ারি প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে সংঘাতপূর্ণ পৌর নির্বাচনের জন্য দায়ী করা হয়েছে ‘নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকাতে’। সেখানে ‘নির্বাচন কমিশনের সময়োচিত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতাসীন দলের বাড়াবাড়ি’কে দায়ী করা হয়েছে এই নির্বাচনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার কারণ হিসেবে। এর পরদিন ২ জানুয়ারি প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘পরিবেশ দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ থাকলেও বহু স্থানে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের অনুপস্থিতি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।’ বিএনপি জোটের বাইরেও যেসব বিরোধী দল আছে, তারাও এই নির্বাচনের ফলাফলকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করছে না। কমিউনিস্ট পার্টি পৌর নির্বাচনকেও প্রহসন বলে আখ্যায়িত করেছে।
১ জানুয়ারির প্রথম আলোর সংখ্যায় মিজানুর রহমান খান একটা বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধ লিখেছেন, ‘কী বার্তা বয়ে আনল পৌর নির্বাচন’। ১৯৯১ সাল থেকে সব কটি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন আসনসংখ্যা যা-ই হোক, ‘দুই প্রধান দলের মধ্যে ভোটের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে।’ ২০০৮ সালে বিপর্যস্ত হওয়ার দুই বছরের মাথায় পৗর নির্বাচনে তারা অন্যতম শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছিল। তখনো তাদের সাংগঠনিক শক্তি ছিল না, তবে নীরব সমর্থক ছিল অনেক। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনসংখ্যা নিতান্ত কম হলেও মোট প্রাপ্ত ভোট খুব কম ছিল না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েরই একটা রিজার্ভ ভোটব্যাংক আছে। এবারের পৌর নির্বাচনে বিএনপি যে মাত্র ২২টি মেয়র পেয়েছে তাই-ই নয়, মোট ভোটসংখ্যাও অবিশ্বাস্য রকমের কম। এর কারণ, নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারেনি। বিএনপির দুর্বলতা ছিল এই যে তারা ভোটকেন্দ্র দখল, কারচুপি ইত্যাদি ঠেকাতে পারেনি। তাই ‘নির্বাচনী অনিয়মের বিরুদ্ধে কোথাও জোরালো কণ্ঠ শোনা যায়নি।’ কারণটাও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। বিএনপির ভোটার হলেও তাঁরা ‘কিসের জন্য ঝুঁকি নেবেন? বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের একটি বিশাল অংশ মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে আগে থেকেই কোণঠাসা, যা ২০১১ সালে ছিল না। তদুপরি বিএনপির কারচুপির অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলেও তার দলীয় স্বার্থ রক্ষায় মানুষ রাস্তায় নামবে না।’
বিএনপির এই পরিণতির জন্য আমারও দুঃখবোধ নেই। কারণ, বিএনপি কোনো আদর্শবাদী দল নয়। বরং যেটুকু মতাদর্শকে দলটি প্রতিনিধিত্ব করে, তা খুবই প্রতিক্রিয়াশীল—তারা হেফাজতকে সমর্থন করে এবং গণজাগরণ মঞ্চকে নাস্তিক বলে গালি দেয়। অথচ একসময় দলটি মধ্যমপন্থী বলে পরিচিতি ছিল। কিন্তু জামায়াতের ওপর নির্ভরশীলতা তাকে ক্রমাগত চরম দক্ষিণে নিয়ে গেছে।
তবে আমার উদ্বেগ অন্য জায়গায়। সরকার যেভাবে সর্বক্ষেত্রে একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাতে গণতন্ত্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক-সামাজিক ভারসাম্যও বিনষ্ট হয়েছে। প্রশাসন থেকে আরম্ভ করে সর্বক্ষেত্রে চলছে দলীয়করণ। ফলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ নিরপেক্ষতা হারিয়েছে।
রাস্তায়, প্রচারে, মাঠে, বিলবোর্ডে, অফিস-আদালতে, ব্যবসায়ে যদি কোনো দলের একক আধিপত্য থাকে, তাহলে তা যেমন কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত করে, তেমনি এরই ফলে সামাজিক ভারসাম্যও হারিয়ে যায়। এর ফলে শিশু হত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামালকে উদ্ধৃত করে প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে (৩ জানুয়ারি ২০১৬) বলা হয়েছে, ‘গুম, গুপ্তহত্যা ও ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে যোগ হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নানা ঘোষিত-অঘোষিত বিধিনিষেধ।’
অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। সে প্রসঙ্গে আজকের আলোচনায় যাচ্ছি না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে সামাজিক-রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হলে অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তা ছাড়া জাতীয় আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বিত্তবৈষম্য যে উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে একটা সীমা লঙ্ঘন করলে, সেখানেও ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। আমরা প্রায় সেই সীমা ছুঁয়ে গেছি। ভারসাম্য হারালে কোনো বস্তুই স্থিতিশীল হতে পারে না। এটা পদার্থবিজ্ঞানের কথা। একই কথা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ সম্পর্কেও প্রযোজ্য।
আজ ১২ জানুয়ারি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি। যদিও সেই নির্বাচনটিতে অধিকাংশ বিরোধী দল অংশ নেয়নি। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। অন্যথায় ভারসাম্য হারিয়ে যাবে এবং কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হবে অথবা ধর্মীয় সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এই দিকটি মনে রেখে সরকারের উচিত সবার জন্য গণতান্ত্রিক ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া এবং নিজেকেও গণতান্ত্রিক আচরণ করতে হবে। বিএনপিকেও সন্ত্রাস ও মৌলবাদ পরিত্যাগ করে সুস্থ গণতান্ত্রিক পথে আসতে হবে। এ দুই দলের বাইরেও মানুষ আছে। রাজনৈতিক দল আছে। বুদ্ধিজীবী আছেন, সমাজ নিয়ে ভাবেন এমন মানুষ আছেন। সবারই সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে গণতন্ত্রের পতাকা সমুন্নত রাখা যায়। এবারের ৫ জানুয়ারি একটা শুভ লক্ষণ মাত্র। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের তুলনায় তো বটেই। তবু বলব, এখনো অনেক দূর যেতে হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রধান দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদেরই। একই সঙ্গে জনগণের ভূমিকাও কম নয়।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও বিএনপি ও খালেদা জিয়ার সমালোচনা করলেও কড়া কথা বলেননি। অবশ্য সৈয়দ আশরাফুল আজেবাজে কথা খুব একটা বলেন না। ভদ্রোচিত তাঁর আচরণ ও বক্তব্য। তিনি খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান রেখে বলেছেন, ‘আসুন, আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যাই।’ এই যে ‘আমরা’ কথাটা ব্যবহার করেছেন, সেটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ‘উড়িয়ে দেব’, ‘গুঁড়িয়ে দেব’, ‘রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না’—এ ধরনের কথায় অভ্যস্ত সরকারি দলের অন্যান্য নেতার মতো তিনি নন। মির্জা আলমগীরও সৈয়দ আশরাফের মতো ভদ্রলোক এবং শিক্ষিত মানুষ। তিনি সংযত ও যুক্তিপূর্ণ কথা বলেন এবং তা ভদ্র ভাষায়। কিন্তু বিএনপির দুই নম্বর নেতা খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের সে ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। অর্বাচীনের মতো নানা অবান্তর কথা বলে তিনি প্রায়ই রাজনৈতিক পরিবেশকে নষ্ট করেন। তাতে তাঁর নিজের বা দলের কোনো লাভ অবশ্য হয়নি।
৫ জানুয়ারির চিত্র ২০১৫ ও ২১১৪ সালের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। শান্তিপূর্ণ ও স্বস্তিদায়ক। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এভাবে অগ্রসর হলে আমরা আশাবাদী হতে পারি। তবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এখনো চূড়ান্ত কথা বলার সময় আসেনি। মাত্র কিছুদিন আগে যে পৌরসভার নির্বাচন হয়ে গেল, তা কিন্তু সুস্থ পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক চর্চার ইঙ্গিত বহন করে না। উপজেলা নির্বাচন এবং ঢাকা-চট্টগ্রামের করপোরেশন নির্বাচনের প্যাটার্নে একই ধারাবাহিকতায় প্রহসনমূলক হয়েছে সদ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করলেও বিএনপি কিন্তু কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেনি। এমনকি যে সৌভাগ্যবান মাত্র ২২ জন পৌরসভায় জয়ী বলে ঘোষিত হয়েছেন, তাঁরা নির্বাচনের রায় মেনে নিয়ে কাজ করবেন। কেন্দ্রীয় নির্দেশও নেই পৌরসভার মেয়রের পদ প্রত্যাখ্যান করার জন্য। মোট কথা, বিএনপি এখন অনেক সুর নামিয়েছে। অবশ্য অনেক ঠেকে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে তাদের এই উপলব্ধি হয়েছে। ভবিষ্যতে এটা অব্যাহত থাকলেই ভালো আমাদের জন্য, দেশের জনগণের জন্য এবং দলটির নিজের জন্যও। বিএনপি নিজের ভালো চাইলে তাকে আরও কিছুটা ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। তার মধ্যে একটি হলো জামায়াতকে পরিত্যাগ করতে হবে। আরেকটি হলো সংযত কথা বলতে হবে, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোনো প্রকার খারাপ মন্তব্য থেকে বিরত থাকতে হবে। বলাই বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে শ্রদ্ধা রেখেই আচরণ করতে হবে। আমি জানি না, জামায়াতকে এখনই পরিত্যাগ করা খালেদা জিয়ার পক্ষে সম্ভব কি না।
এবার আসা যাক, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে। সৈয়দ আশরাফ একত্রে শান্তিপূর্ণ রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে আহ্বান রেখেছেন, সেটা কথার কথা না হয়ে বাস্তবে কার্যকর করতে হলে তো গণতান্ত্রিক চর্চাকে উৎসাহিত করতে হবে এবং বিএনপিসহ সবাইকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিতে হবে। গত বছর তো বিএনপিকে সভা বা মানববন্ধন—কোনো কিছুই করতে দেওয়া হয়নি। এবার যে জনসভা করার অধিকার পেল, এটা ভালো কথা। কিন্তু নির্বাচনও তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই একটি স্তম্ভ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর থেকে কোনো স্থানীয় নির্বাচন যথাযথ হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর এল উপজেলা নির্বাচন। উপজেলা নির্বাচন পাঁচ পর্বে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম দুই পর্বে দেখা গেল বিএনপির বিশাল বিজয়। পরবর্তী তিন দফায় উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল কারচুপির আশ্রয় নিল। ভোটকেন্দ্র দখল, পুলিশের সামনেই ব্যালট বাক্সে বেপরোয়া সিল মারার ঘটনা ঘটল। একই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল গত বছর ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে।
মাত্র কয়েক দিন আগে যে সারা দেশে পৌরসভা নির্বাচন হলো, সেখানেও একই চেহারা। ৬ জানুয়ারির প্রথম আলোর সংখ্যায় সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এক নিবন্ধে দাবি করেছেন, ‘৭৪ শতাংশ ভোটকে স্বাভাবিক বলা যাবে না।’ ১ জানুয়ারি প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে সংঘাতপূর্ণ পৌর নির্বাচনের জন্য দায়ী করা হয়েছে ‘নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকাতে’। সেখানে ‘নির্বাচন কমিশনের সময়োচিত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতাসীন দলের বাড়াবাড়ি’কে দায়ী করা হয়েছে এই নির্বাচনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার কারণ হিসেবে। এর পরদিন ২ জানুয়ারি প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘পরিবেশ দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ থাকলেও বহু স্থানে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের অনুপস্থিতি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।’ বিএনপি জোটের বাইরেও যেসব বিরোধী দল আছে, তারাও এই নির্বাচনের ফলাফলকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করছে না। কমিউনিস্ট পার্টি পৌর নির্বাচনকেও প্রহসন বলে আখ্যায়িত করেছে।
১ জানুয়ারির প্রথম আলোর সংখ্যায় মিজানুর রহমান খান একটা বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধ লিখেছেন, ‘কী বার্তা বয়ে আনল পৌর নির্বাচন’। ১৯৯১ সাল থেকে সব কটি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন আসনসংখ্যা যা-ই হোক, ‘দুই প্রধান দলের মধ্যে ভোটের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে।’ ২০০৮ সালে বিপর্যস্ত হওয়ার দুই বছরের মাথায় পৗর নির্বাচনে তারা অন্যতম শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছিল। তখনো তাদের সাংগঠনিক শক্তি ছিল না, তবে নীরব সমর্থক ছিল অনেক। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনসংখ্যা নিতান্ত কম হলেও মোট প্রাপ্ত ভোট খুব কম ছিল না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েরই একটা রিজার্ভ ভোটব্যাংক আছে। এবারের পৌর নির্বাচনে বিএনপি যে মাত্র ২২টি মেয়র পেয়েছে তাই-ই নয়, মোট ভোটসংখ্যাও অবিশ্বাস্য রকমের কম। এর কারণ, নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারেনি। বিএনপির দুর্বলতা ছিল এই যে তারা ভোটকেন্দ্র দখল, কারচুপি ইত্যাদি ঠেকাতে পারেনি। তাই ‘নির্বাচনী অনিয়মের বিরুদ্ধে কোথাও জোরালো কণ্ঠ শোনা যায়নি।’ কারণটাও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। বিএনপির ভোটার হলেও তাঁরা ‘কিসের জন্য ঝুঁকি নেবেন? বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের একটি বিশাল অংশ মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে আগে থেকেই কোণঠাসা, যা ২০১১ সালে ছিল না। তদুপরি বিএনপির কারচুপির অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলেও তার দলীয় স্বার্থ রক্ষায় মানুষ রাস্তায় নামবে না।’
বিএনপির এই পরিণতির জন্য আমারও দুঃখবোধ নেই। কারণ, বিএনপি কোনো আদর্শবাদী দল নয়। বরং যেটুকু মতাদর্শকে দলটি প্রতিনিধিত্ব করে, তা খুবই প্রতিক্রিয়াশীল—তারা হেফাজতকে সমর্থন করে এবং গণজাগরণ মঞ্চকে নাস্তিক বলে গালি দেয়। অথচ একসময় দলটি মধ্যমপন্থী বলে পরিচিতি ছিল। কিন্তু জামায়াতের ওপর নির্ভরশীলতা তাকে ক্রমাগত চরম দক্ষিণে নিয়ে গেছে।
তবে আমার উদ্বেগ অন্য জায়গায়। সরকার যেভাবে সর্বক্ষেত্রে একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাতে গণতন্ত্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক-সামাজিক ভারসাম্যও বিনষ্ট হয়েছে। প্রশাসন থেকে আরম্ভ করে সর্বক্ষেত্রে চলছে দলীয়করণ। ফলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ নিরপেক্ষতা হারিয়েছে।
রাস্তায়, প্রচারে, মাঠে, বিলবোর্ডে, অফিস-আদালতে, ব্যবসায়ে যদি কোনো দলের একক আধিপত্য থাকে, তাহলে তা যেমন কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত করে, তেমনি এরই ফলে সামাজিক ভারসাম্যও হারিয়ে যায়। এর ফলে শিশু হত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামালকে উদ্ধৃত করে প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে (৩ জানুয়ারি ২০১৬) বলা হয়েছে, ‘গুম, গুপ্তহত্যা ও ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে যোগ হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নানা ঘোষিত-অঘোষিত বিধিনিষেধ।’
অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। সে প্রসঙ্গে আজকের আলোচনায় যাচ্ছি না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে সামাজিক-রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হলে অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তা ছাড়া জাতীয় আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বিত্তবৈষম্য যে উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে একটা সীমা লঙ্ঘন করলে, সেখানেও ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। আমরা প্রায় সেই সীমা ছুঁয়ে গেছি। ভারসাম্য হারালে কোনো বস্তুই স্থিতিশীল হতে পারে না। এটা পদার্থবিজ্ঞানের কথা। একই কথা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ সম্পর্কেও প্রযোজ্য।
আজ ১২ জানুয়ারি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি। যদিও সেই নির্বাচনটিতে অধিকাংশ বিরোধী দল অংশ নেয়নি। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। অন্যথায় ভারসাম্য হারিয়ে যাবে এবং কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হবে অথবা ধর্মীয় সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এই দিকটি মনে রেখে সরকারের উচিত সবার জন্য গণতান্ত্রিক ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া এবং নিজেকেও গণতান্ত্রিক আচরণ করতে হবে। বিএনপিকেও সন্ত্রাস ও মৌলবাদ পরিত্যাগ করে সুস্থ গণতান্ত্রিক পথে আসতে হবে। এ দুই দলের বাইরেও মানুষ আছে। রাজনৈতিক দল আছে। বুদ্ধিজীবী আছেন, সমাজ নিয়ে ভাবেন এমন মানুষ আছেন। সবারই সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে গণতন্ত্রের পতাকা সমুন্নত রাখা যায়। এবারের ৫ জানুয়ারি একটা শুভ লক্ষণ মাত্র। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের তুলনায় তো বটেই। তবু বলব, এখনো অনেক দূর যেতে হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রধান দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদেরই। একই সঙ্গে জনগণের ভূমিকাও কম নয়।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
No comments