বাংলাদেশ চায় রাষ্ট্রনায়ক by এমাজউদ্দীন আহমদ
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাষ্ট্রনায়কের (Statesman), রাজনীতিকের (Politician) নয়। রাজনীতিকেরা দল ভাঙেন, রাষ্ট্রনায়কেরা দল গড়ে তোলেন, শুধু বর্তমানের জন্য নয়, ভবিষ্যৎকে সামনে রেখেও। রাজনীতিকেরা বিতর্ক সৃষ্টি করেন, রাষ্ট্রনায়কেরা কিন্তু বিতর্কিত হয়েও ভবিষ্যৎ বিতর্কের শত ছিদ্র বন্ধ করেন। রাজনীতিকেরা জাতিকে বিভক্ত করেন এবং জাতীয় বিভক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সদা ব্যগ্র। রাষ্ট্রনায়ক কিন্তু জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সঙ্কল্পবদ্ধ এবং নিজের জীবন বিপন্ন করেও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। রাজনীতিকেরা বর্তমানকেই মুখ্যজ্ঞান করে বর্তমানেই বসবাস করতে চান। রাষ্ট্রনায়ক কিন্তু বর্তমানে বসবাস করেও অতীতকে ভোলেন না এবং ভবিষ্যৎকে দৃষ্টিতে রাখেন। রাজনীতিকেরা রাজনৈতিক দলকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, রাষ্ট্রনায়ক কিন্তু রাজনৈতিক দলকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে দলের ঊর্ধ্বে যে জনগণ এবং জাতি তার প্রতিই হন অধিক আকৃষ্ট। রাজনীতিকদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রক্ষমতাই প্রধান। এ ক্ষমতাকে তারা উপভোগ করেন তাদের প্রভাব, বৈভব ও প্রতিপত্তির মাধ্যম হিসেবে। রাষ্ট্রনায়কের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রক্ষমতা উপায় বটে, কিন্তু তা জনকল্যাণ এবং রাষ্ট্রীয় অগ্রগতির লক্ষ্যে কোনো সময়ে উপেয় নয়।
রাজনীতিকেরা বাংলাদেশে রাজনীতিকে অসুস্থ করে তুলেছেন। জাতি আজ বিভক্ত। ধনী-দরিদ্র, গ্রামবাসী-নগরবাসী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত পর্যায়ে যে বিভক্তি ছিল আজ তার ওপর এসেছে রাজনৈতিক বিভাজন। চুয়াল্লিশ বছর আগের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আজো কেউ স্বাধীনতার পক্ষের, কেউ বা নতুনভাবে চিহ্নিত হচ্ছেন স্বাধীনতাবিরোধী রূপে। তা ছাড়াও শুরু হয়েছে নতুনভাবে জাতীয়তার প্রশ্নের বিভাজন। কেউ কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। কেউ প্রচার করছেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা। সব মিলিয়ে জাতির একাংশ হয়েছে আওয়ামীপন্থী এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। অন্য অংশটি জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশী জাতীয়তায় বিশ্বাসী। এই বিভাজন এমন প্রকট হয়ে উঠেছে যে, দুই-এর মধ্যে নেই কোনো যোগসূত্র, নেই কোনো ‘হাইফেন’। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার এই যে, এই বিভাজন প্রতিদিন যেমন দৃঢ়তর হচ্ছে, তেমনি সমাজ জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে তা পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, শ্রমিক সংগঠনে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে, এমনকি প্রশাসনেও এর দীর্ঘ ছায়া সব কিছুকে মলিন করে তুলেছে। এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুধু জাতীয় ঐক্য নয়, জাতীয় অগ্রগতির গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং করবেও।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে বাংলাদেশ অগ্রগতির কোন স্তরে উপনীত হবে, রোগব্যাধি-কুসংস্কার-দারিদ্র্যের ওপর কতটুকু বিজয় অর্জন করবে, শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে উন্নতির স্পর্শ কতটুকু লাভ করবে এ সম্পর্কে রাজনীতিকেরা এতটুকু ভাবেননি। বাংলাদেশের জনশক্তিকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তরের কোনো চিন্তাভাবনা তাদের নেই। দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত প্রান্তিক বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ার একটি অগ্রগামী রাষ্ট্র হিসেবে কিভাবে তারা দেখতে চান, এ বিষয়েও তাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। প্রস্তুতি নেই আগামী শতাব্দীতে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তর উন্নয়ন সমারোহে কিভাবে সংশ্লিষ্ট হবে সে সম্পর্কেও। তাই বলি, বাংলাদেশ অনেক রাজনীতিক দেখেছে। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অচ্ছেদ্য গ্রন্থিতে আবদ্ধ হয়ে শ্বাসকষ্ট ভোগ করছে দীর্ঘ দিন। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে স্বাধীনতার পতাকা ছিনিয়ে এনেছে। আপন গৌরবে সার্বভৌমত্বের আশীর্বাদ লাভ করে বিজয়তিলক কপালে পরেছে। ওইসব সঙ্কটময় মুহূর্তে রাজনীতিকেরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, এ দেশের সাদামাটা নিরক্ষর দরিদ্র জনসাধারণ তথা ছাত্র-শ্রমিকেরা তারচেয়ে কোনো অংশে কম গৌরবময় ভূমিকা পালন করেননি। রাজনীতিকদের স্বপ্ন জনগণকে যতটুকু প্রভাবিত করেছে, জনগণের অগ্রগামী পদক্ষেপ রাজনীতিকদের তার চেয়ে অনেক বেশি প্রেরণা জুগিয়েছে।
রাজনীতিকেরা ব্যক্তিস্বার্থে, কোনো কোনো সময় দলীয় স্বার্থে, এমনকি কখনো পারিবারিক স্বার্থে, রাজনীতি পরিচালনা করছেন। জনগণের কথা বলেছেন বটে, কিন্তু তাদের কর্মপ্রচেষ্টায় জনগণ কোনো দিন মুখ্য হয়ে ওঠেনি। রাজনীতি হয়নি জনকল্যাণমূলক সুসংহত উদ্যোগ। নিজেরা দলাদলি করেছেন। নিজেরা দল ভেঙেছেন। ভেঙেছেন পরের ঘরও। কখনো কিন্তু এ কারণে লজ্জায় তাদের মুখ লাল হয়ে ওঠেনি। সংসদে তারা যা বলেন এবং যেভাবে ও ভাষায় বলেন, কোনো দিন কেউ ভেবে দেখেননি যাদের জন্য এসব কথা, তারা কিভাবে তা গ্রহণ করবেন অথবা বক্তাদের সম্বন্ধে তারা কী ধারণা পোষণ করবেন। গাঁয়ের ঝগড়া গাঁয়ে মানায়। গ্রাম্য মুড়লিও গ্রামবাসীর জন্য। জাতি কিন্তু চায় উন্নতমানের বিতর্ক, সৃজনশীল ধারণার প্রকাশ। জাতি উত্তম কথা শুনতে চায়। অন্য দেশে যা ঘটে এবং যেভাবে, তার প্রতিফলন দেখতে চায় নিজেদের সমাজে। দেখতে চায় তুলনামূলক সৌকর্য, কৃতিত্বের অভিব্যক্তি, সুরুচিসম্পন্ন আলোচনা-পর্যালোচনা। মেঠো বাচালতায় তারা ক্লান্ত। নিম্নমানের ঝগড়াটে কথাবার্তায় তাদের তীব্র অনীহা। কোন নেতা কখন কী স্বপ্ন দেখলেন, সে সম্পর্কে জনগণের তেমন আগ্রহ নেই। তারা আগ্রহী মানবেতর জীবন থেকে কিভাবে রেহাই পাবেন। অশিক্ষা ও নিরক্ষরতার কবল থেকে কখন তারা মুক্ত হবেন। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে কিভাবে তারা বেরিয়ে আসবেন। এসব বিষয়ে জনগণ আগ্রহী। সম্প্রতি অনেক নেতানেত্রী একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কথা বলে থাকেন। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সবার আগে রাজনীতিকদের চিন্তা-ভাবনা, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, রুচিশীলতা-আন্তরিকতায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে হবে। যে দৈন্যদশায় এখন রাজনীতিকেরা প্রপীড়িত, তার হাত থেকে তাদের অব্যাহতি পেতে হবে। নিজেদের মান উন্নত করতে হবে তাদের। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে, দলীয় স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থে রূপান্তরিত করতে হবে। জাতীয় স্বার্থ কিভাবে সমুন্নত রাখতে হবে, সে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। অন্তত পঞ্চাশ বছর সামনে দৃষ্টি দিতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপে সে লক্ষ্য যেন বাস্তবায়ন হয় তা চিন্তায় রাখা প্রয়োজন। বিরোধী দলের অবস্থানে যা বলেছি, ক্ষমতাসীন দলে তার আর প্রয়োজন নেই- এ মানসিকতা বলদর্পীর। ক্ষমতাসীন থেকে যা করেছি, বিরোধী দলে এসে তা ভুলে যাওয়া এক ধরনের হীনম্মন্যতা। দুই-এর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করাই রাষ্ট্রনায়কোচিত কাজ। বাংলাদেশে এখন তাই প্রয়োজন রাষ্ট্রনায়কের। রাজনীতিকেরা রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণে বিভূষিত না হলে শুকনো পাতার মতো তারা ঝরে পড়বেন বাংলাদেশ রাজনীতির আধমরা গাছ থেকে। তারা তখন এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলার জন্য কাউকে পাবেন না। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস তা-ই বলে।
রাষ্ট্রনায়ক মাটিতে অবস্থান গ্রহণ করেও আকাশচারণ করেন। বর্তমানকে অবহেলা না করেও ভবিষ্যৎ দর্শন করেন। অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেন। অনেকটা ওয়ার্ডসওয়ার্থের (Wordsworth) ভরত পাখির (Skylark) মতো, পা রয়েছে মাটিতে, কিন্তু অপূর্ব সুরের ঝঙ্কারে আকাশ-বাতাস মুখরিত করছে। দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত থেকেও সমগ্র জাতিকে আহ্বান করছেন ভবিষ্যতের স্বপ্নসাধ মেটানোর জন্য। জাতীয় ধী এবং মনীষার সৌধ নির্মাণে। সব সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্যের চিরন্তন বাণী নিয়ে সবার মনে সৃষ্টিশীল প্রয়াসের ঐকতান সৃষ্টি করতে। প্রতিহিংসার স্পৃহা ত্যাগ করে আকাশের উদারতায় সবাইকে জাতীয় প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের আহ্বান। এটি রাজনীতিকদের নয়, রাষ্ট্রনায়কের ভাষা। আজ বাংলাদেশে তাই প্রয়োজন রাষ্ট্রনায়কের। সঙ্কীর্ণমনা, হিংসুটে, প্রতিহিংসাপরায়ণ, ঝগড়াটে, স্থূলবুদ্ধির রাজনীতিকের নয়। বাংলাদেশ চায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, উদার হৃদয় বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক, কোন্দলপ্রিয় রাজনীতিক নয়।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনীতিকেরা বাংলাদেশে রাজনীতিকে অসুস্থ করে তুলেছেন। জাতি আজ বিভক্ত। ধনী-দরিদ্র, গ্রামবাসী-নগরবাসী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত পর্যায়ে যে বিভক্তি ছিল আজ তার ওপর এসেছে রাজনৈতিক বিভাজন। চুয়াল্লিশ বছর আগের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আজো কেউ স্বাধীনতার পক্ষের, কেউ বা নতুনভাবে চিহ্নিত হচ্ছেন স্বাধীনতাবিরোধী রূপে। তা ছাড়াও শুরু হয়েছে নতুনভাবে জাতীয়তার প্রশ্নের বিভাজন। কেউ কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। কেউ প্রচার করছেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা। সব মিলিয়ে জাতির একাংশ হয়েছে আওয়ামীপন্থী এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। অন্য অংশটি জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশী জাতীয়তায় বিশ্বাসী। এই বিভাজন এমন প্রকট হয়ে উঠেছে যে, দুই-এর মধ্যে নেই কোনো যোগসূত্র, নেই কোনো ‘হাইফেন’। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার এই যে, এই বিভাজন প্রতিদিন যেমন দৃঢ়তর হচ্ছে, তেমনি সমাজ জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে তা পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, শ্রমিক সংগঠনে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে, এমনকি প্রশাসনেও এর দীর্ঘ ছায়া সব কিছুকে মলিন করে তুলেছে। এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুধু জাতীয় ঐক্য নয়, জাতীয় অগ্রগতির গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং করবেও।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে বাংলাদেশ অগ্রগতির কোন স্তরে উপনীত হবে, রোগব্যাধি-কুসংস্কার-দারিদ্র্যের ওপর কতটুকু বিজয় অর্জন করবে, শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে উন্নতির স্পর্শ কতটুকু লাভ করবে এ সম্পর্কে রাজনীতিকেরা এতটুকু ভাবেননি। বাংলাদেশের জনশক্তিকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তরের কোনো চিন্তাভাবনা তাদের নেই। দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত প্রান্তিক বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ার একটি অগ্রগামী রাষ্ট্র হিসেবে কিভাবে তারা দেখতে চান, এ বিষয়েও তাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। প্রস্তুতি নেই আগামী শতাব্দীতে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তর উন্নয়ন সমারোহে কিভাবে সংশ্লিষ্ট হবে সে সম্পর্কেও। তাই বলি, বাংলাদেশ অনেক রাজনীতিক দেখেছে। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অচ্ছেদ্য গ্রন্থিতে আবদ্ধ হয়ে শ্বাসকষ্ট ভোগ করছে দীর্ঘ দিন। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে স্বাধীনতার পতাকা ছিনিয়ে এনেছে। আপন গৌরবে সার্বভৌমত্বের আশীর্বাদ লাভ করে বিজয়তিলক কপালে পরেছে। ওইসব সঙ্কটময় মুহূর্তে রাজনীতিকেরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, এ দেশের সাদামাটা নিরক্ষর দরিদ্র জনসাধারণ তথা ছাত্র-শ্রমিকেরা তারচেয়ে কোনো অংশে কম গৌরবময় ভূমিকা পালন করেননি। রাজনীতিকদের স্বপ্ন জনগণকে যতটুকু প্রভাবিত করেছে, জনগণের অগ্রগামী পদক্ষেপ রাজনীতিকদের তার চেয়ে অনেক বেশি প্রেরণা জুগিয়েছে।
রাজনীতিকেরা ব্যক্তিস্বার্থে, কোনো কোনো সময় দলীয় স্বার্থে, এমনকি কখনো পারিবারিক স্বার্থে, রাজনীতি পরিচালনা করছেন। জনগণের কথা বলেছেন বটে, কিন্তু তাদের কর্মপ্রচেষ্টায় জনগণ কোনো দিন মুখ্য হয়ে ওঠেনি। রাজনীতি হয়নি জনকল্যাণমূলক সুসংহত উদ্যোগ। নিজেরা দলাদলি করেছেন। নিজেরা দল ভেঙেছেন। ভেঙেছেন পরের ঘরও। কখনো কিন্তু এ কারণে লজ্জায় তাদের মুখ লাল হয়ে ওঠেনি। সংসদে তারা যা বলেন এবং যেভাবে ও ভাষায় বলেন, কোনো দিন কেউ ভেবে দেখেননি যাদের জন্য এসব কথা, তারা কিভাবে তা গ্রহণ করবেন অথবা বক্তাদের সম্বন্ধে তারা কী ধারণা পোষণ করবেন। গাঁয়ের ঝগড়া গাঁয়ে মানায়। গ্রাম্য মুড়লিও গ্রামবাসীর জন্য। জাতি কিন্তু চায় উন্নতমানের বিতর্ক, সৃজনশীল ধারণার প্রকাশ। জাতি উত্তম কথা শুনতে চায়। অন্য দেশে যা ঘটে এবং যেভাবে, তার প্রতিফলন দেখতে চায় নিজেদের সমাজে। দেখতে চায় তুলনামূলক সৌকর্য, কৃতিত্বের অভিব্যক্তি, সুরুচিসম্পন্ন আলোচনা-পর্যালোচনা। মেঠো বাচালতায় তারা ক্লান্ত। নিম্নমানের ঝগড়াটে কথাবার্তায় তাদের তীব্র অনীহা। কোন নেতা কখন কী স্বপ্ন দেখলেন, সে সম্পর্কে জনগণের তেমন আগ্রহ নেই। তারা আগ্রহী মানবেতর জীবন থেকে কিভাবে রেহাই পাবেন। অশিক্ষা ও নিরক্ষরতার কবল থেকে কখন তারা মুক্ত হবেন। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে কিভাবে তারা বেরিয়ে আসবেন। এসব বিষয়ে জনগণ আগ্রহী। সম্প্রতি অনেক নেতানেত্রী একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কথা বলে থাকেন। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সবার আগে রাজনীতিকদের চিন্তা-ভাবনা, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, রুচিশীলতা-আন্তরিকতায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে হবে। যে দৈন্যদশায় এখন রাজনীতিকেরা প্রপীড়িত, তার হাত থেকে তাদের অব্যাহতি পেতে হবে। নিজেদের মান উন্নত করতে হবে তাদের। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে, দলীয় স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থে রূপান্তরিত করতে হবে। জাতীয় স্বার্থ কিভাবে সমুন্নত রাখতে হবে, সে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। অন্তত পঞ্চাশ বছর সামনে দৃষ্টি দিতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপে সে লক্ষ্য যেন বাস্তবায়ন হয় তা চিন্তায় রাখা প্রয়োজন। বিরোধী দলের অবস্থানে যা বলেছি, ক্ষমতাসীন দলে তার আর প্রয়োজন নেই- এ মানসিকতা বলদর্পীর। ক্ষমতাসীন থেকে যা করেছি, বিরোধী দলে এসে তা ভুলে যাওয়া এক ধরনের হীনম্মন্যতা। দুই-এর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করাই রাষ্ট্রনায়কোচিত কাজ। বাংলাদেশে এখন তাই প্রয়োজন রাষ্ট্রনায়কের। রাজনীতিকেরা রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণে বিভূষিত না হলে শুকনো পাতার মতো তারা ঝরে পড়বেন বাংলাদেশ রাজনীতির আধমরা গাছ থেকে। তারা তখন এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলার জন্য কাউকে পাবেন না। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস তা-ই বলে।
রাষ্ট্রনায়ক মাটিতে অবস্থান গ্রহণ করেও আকাশচারণ করেন। বর্তমানকে অবহেলা না করেও ভবিষ্যৎ দর্শন করেন। অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেন। অনেকটা ওয়ার্ডসওয়ার্থের (Wordsworth) ভরত পাখির (Skylark) মতো, পা রয়েছে মাটিতে, কিন্তু অপূর্ব সুরের ঝঙ্কারে আকাশ-বাতাস মুখরিত করছে। দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত থেকেও সমগ্র জাতিকে আহ্বান করছেন ভবিষ্যতের স্বপ্নসাধ মেটানোর জন্য। জাতীয় ধী এবং মনীষার সৌধ নির্মাণে। সব সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্যের চিরন্তন বাণী নিয়ে সবার মনে সৃষ্টিশীল প্রয়াসের ঐকতান সৃষ্টি করতে। প্রতিহিংসার স্পৃহা ত্যাগ করে আকাশের উদারতায় সবাইকে জাতীয় প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের আহ্বান। এটি রাজনীতিকদের নয়, রাষ্ট্রনায়কের ভাষা। আজ বাংলাদেশে তাই প্রয়োজন রাষ্ট্রনায়কের। সঙ্কীর্ণমনা, হিংসুটে, প্রতিহিংসাপরায়ণ, ঝগড়াটে, স্থূলবুদ্ধির রাজনীতিকের নয়। বাংলাদেশ চায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, উদার হৃদয় বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক, কোন্দলপ্রিয় রাজনীতিক নয়।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments