সুরুচির সবুজ নায়ক by আখতার হুসেন
এখলাস
ভাই একবার কী প্রসঙ্গে যেন কথা বলতে গিয়ে একটু গর্ব-মেশানো সুরে, অবশ্যই
কৌতুক করে বলেছিলেন, ‘শোনো, আমার যদি কোনো কিছুই না থাকে, এই সুন্দর
সুঠাম মানুষটা তো আছি।’
সত্যি কথাই বলেছিলেন। যেখানেই যেতেন, সভা কিংবা সমিতিতে, ঘরোয়া কিংবা আড়ম্বরপূর্ণ কোনো অনুষ্ঠানে, এখলাস ভাইয়ের অমন চেহারা ও সুন্দর দেহসৌষ্ঠব সহজেই যে কারও চোখে পড়ত। সেই এখলাস ভাই শেষের দিকে নিজেকে একেবারে গুটিয়েই নিয়েছিলেন। কিছুটা শারীরিক কারণে, মূলত অকস্মাৎ চাকরি হারানোর অভিমানে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বাসায় গেলে সে কথাই বলতেন।
কিন্তু এখলাস ভাইয়ের জীবনের শেষ দিকের কথা এখন থাক। আমরা আসল মানুষটার কাছে ফিরে যাই। এখলাস ভাই মূলত পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। এ দেশে এসেছিলেন বিংশ শতকের ছয়ের দশকের প্রায় গোড়ার দিকে। পশ্চিমবঙ্গে থাকতে বামপন্থার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে আসার পর কেমন-কেমন করে যেন তাঁর সঙ্গে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে চট্টগ্রামের বইঘরের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মোহাম্মদ সফির। আমি তাঁদের পরিচয় ও সম্পর্কগত এই বন্ধনকে বরাবর অভিহিত করেছি আমাদের সাহিত্যজগতের একটা ঐতিহাসিক বন্ধন বলে।
সত্যিই তো তাই! যখন আমাদের প্রকাশনা জগতে রীতিমতো অনুর্বরতা চলছে, চলছে নিষ্ফলতার কাল, নতুন কিছু করার প্রবণতা রহিত, তখন চট্টগ্রামের বইঘর থেকে যেসব বই বের হচ্ছে বিংশ শতকের ছয়ের দশকজুড়ে, তার মূলে আর কেউ নন, এখলাস উদ্দিন আহমদ। কবি আল মাহমুদকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাচ্ছেন গ্রন্থ-সম্পাদক হিসেবে তিনিই। আর ঢাকায় বসে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করছেন এখলাস উদ্দিন আহমদ। ঘুরছেন লেখক-কবিদের দরজা থেকে দরজায়। আর প্রকাশিত বই, কি মুদ্রণ পরিপাট্যে, কি শিল্প-সৌকর্যে, যাকে বলে ‘ব্রেকথ্রো’ ব্যাপার। অবশ্য এ কথা না বললেই নয়, বইঘর থেকে প্রকাশিত যে বইটি প্রথম দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল, সেটির নাম ছড়ায় ছড়ায় ছন্দ (১৯৬৫)। দুই বাংলার ছড়াকারদের লেখায় সমৃদ্ধ সেই সংকলন। সম্পাদক এখলাস উদ্দিন আহমদ। ছড়ার সঙ্গে অলংকরণ করেছিলেন শিল্পী হাশেম খান। তুলনারহিত সেসব ছবি। আর প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তারপর বের হয় টাপুর টুপুর সংকলন। আর্ট পেপারে ছাপা। বোর্ড বাঁধাই। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে যে অনুষ্ঠান হয়, তা–ও স্মরণীয় হয়ে আছে অনেকের স্মৃতিতে। তারপর এখলাস উদ্দিন আহমদের সম্পাদনায় বের হয় আমাদের শিশুসাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাসে যে পত্রিকার অবদান অপরিসীম, সেই মাসিক টাপুর টুপুর। এই পত্রিকাটিকে ঘিরে জড়ো হয়েছিলেন কত যে শিশুসাহিত্যিক, সাহিত্যিক, শিল্পী—তার ইয়ত্তা নেই। কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবীদের পরপরই আছেন আবুল বারক আলভী ও আসেম আনসারী। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ছোটদের জন্য প্রথম উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে লিখছেন এই টাপুর টুপুর-এ। লিখছেন শওকত আলী। আমাদের যৌবনকালে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম পত্রিকাটির জন্য।
এ পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে একবার এখলাস ভাইকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খানের ধমক নাকি শুনতে হয়েছিল। কারণ আর কিছু নয়, ছড়াকার প্রণব চৌধুরীর ‘লাট সাহেবের জুতো’ শিরোনামে ছড়া প্রকাশ করার জন্য। তাতে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল বাঙালিপুঙ্গব ওই গভর্নরকে, তবে লাট সাহেবের প্রতীকে।
আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, বিশেষত আটষট্টি থেকে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, এমনকি অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও আমরা এখলাস ভাইকে শুধু আইয়ুবকে চটকানো ছড়া লিখতেই দেখিনি, তাঁকে সক্রিয়ভাবে রাজপথেও দেখেছি। লেখক-শিল্পীদের কাতারে শামিল। স্লোগান দিচ্ছেন।
এখলাস ভাই এত কিছু করার পাশাপাশি নিজের লেখালেখিও চালিয়ে গেছেন সমান তালে। তাঁর বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। সম্পাদিত সংকলনের সংখ্যাও অনেক। সাহিত্য-কৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি, একুশে পদকসহ আরও অনেক দেশি-বিদেশি পুরস্কার ও সম্মাননা।
সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে, অমন জীবন্ত, সুঠামদেহী মানুষটির হঠাৎ করে চলে যাওয়া। তাঁদের চারজনের একটা জুটি ছিল—হাশেম ভাই, নবী ভাই, এখলাস ভাই ও শাহাদত চৌধুরী। এই চারজনের জুটির মাথায় নানা প্ল্যান-প্রোগ্রাম গিজগিজ করত। হাসিখুশি থাকতেন সব সময়। সেই জুটির মধ্যমণি এখলাস ভাই নেই, নেই শাহাদত চৌধুরীও। বেঁচে আছেন কেবল হাশেম ভাই ও নবী ভাই। এই তো জীবন!
দেখতে দেখতে এখলাস ভাইয়ের চিরপ্রয়াণের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ২৪ ডিসেম্বর। ২০১৪ সালের এই দিনেই তো তিনি আমাদের কাঁদিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
আখতার হুসেন: শিশুসাহিত্যিক।
সত্যি কথাই বলেছিলেন। যেখানেই যেতেন, সভা কিংবা সমিতিতে, ঘরোয়া কিংবা আড়ম্বরপূর্ণ কোনো অনুষ্ঠানে, এখলাস ভাইয়ের অমন চেহারা ও সুন্দর দেহসৌষ্ঠব সহজেই যে কারও চোখে পড়ত। সেই এখলাস ভাই শেষের দিকে নিজেকে একেবারে গুটিয়েই নিয়েছিলেন। কিছুটা শারীরিক কারণে, মূলত অকস্মাৎ চাকরি হারানোর অভিমানে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বাসায় গেলে সে কথাই বলতেন।
কিন্তু এখলাস ভাইয়ের জীবনের শেষ দিকের কথা এখন থাক। আমরা আসল মানুষটার কাছে ফিরে যাই। এখলাস ভাই মূলত পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। এ দেশে এসেছিলেন বিংশ শতকের ছয়ের দশকের প্রায় গোড়ার দিকে। পশ্চিমবঙ্গে থাকতে বামপন্থার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে আসার পর কেমন-কেমন করে যেন তাঁর সঙ্গে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে চট্টগ্রামের বইঘরের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মোহাম্মদ সফির। আমি তাঁদের পরিচয় ও সম্পর্কগত এই বন্ধনকে বরাবর অভিহিত করেছি আমাদের সাহিত্যজগতের একটা ঐতিহাসিক বন্ধন বলে।
সত্যিই তো তাই! যখন আমাদের প্রকাশনা জগতে রীতিমতো অনুর্বরতা চলছে, চলছে নিষ্ফলতার কাল, নতুন কিছু করার প্রবণতা রহিত, তখন চট্টগ্রামের বইঘর থেকে যেসব বই বের হচ্ছে বিংশ শতকের ছয়ের দশকজুড়ে, তার মূলে আর কেউ নন, এখলাস উদ্দিন আহমদ। কবি আল মাহমুদকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাচ্ছেন গ্রন্থ-সম্পাদক হিসেবে তিনিই। আর ঢাকায় বসে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করছেন এখলাস উদ্দিন আহমদ। ঘুরছেন লেখক-কবিদের দরজা থেকে দরজায়। আর প্রকাশিত বই, কি মুদ্রণ পরিপাট্যে, কি শিল্প-সৌকর্যে, যাকে বলে ‘ব্রেকথ্রো’ ব্যাপার। অবশ্য এ কথা না বললেই নয়, বইঘর থেকে প্রকাশিত যে বইটি প্রথম দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল, সেটির নাম ছড়ায় ছড়ায় ছন্দ (১৯৬৫)। দুই বাংলার ছড়াকারদের লেখায় সমৃদ্ধ সেই সংকলন। সম্পাদক এখলাস উদ্দিন আহমদ। ছড়ার সঙ্গে অলংকরণ করেছিলেন শিল্পী হাশেম খান। তুলনারহিত সেসব ছবি। আর প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তারপর বের হয় টাপুর টুপুর সংকলন। আর্ট পেপারে ছাপা। বোর্ড বাঁধাই। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে যে অনুষ্ঠান হয়, তা–ও স্মরণীয় হয়ে আছে অনেকের স্মৃতিতে। তারপর এখলাস উদ্দিন আহমদের সম্পাদনায় বের হয় আমাদের শিশুসাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাসে যে পত্রিকার অবদান অপরিসীম, সেই মাসিক টাপুর টুপুর। এই পত্রিকাটিকে ঘিরে জড়ো হয়েছিলেন কত যে শিশুসাহিত্যিক, সাহিত্যিক, শিল্পী—তার ইয়ত্তা নেই। কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবীদের পরপরই আছেন আবুল বারক আলভী ও আসেম আনসারী। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ছোটদের জন্য প্রথম উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে লিখছেন এই টাপুর টুপুর-এ। লিখছেন শওকত আলী। আমাদের যৌবনকালে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম পত্রিকাটির জন্য।
এ পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে একবার এখলাস ভাইকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খানের ধমক নাকি শুনতে হয়েছিল। কারণ আর কিছু নয়, ছড়াকার প্রণব চৌধুরীর ‘লাট সাহেবের জুতো’ শিরোনামে ছড়া প্রকাশ করার জন্য। তাতে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল বাঙালিপুঙ্গব ওই গভর্নরকে, তবে লাট সাহেবের প্রতীকে।
আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, বিশেষত আটষট্টি থেকে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, এমনকি অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও আমরা এখলাস ভাইকে শুধু আইয়ুবকে চটকানো ছড়া লিখতেই দেখিনি, তাঁকে সক্রিয়ভাবে রাজপথেও দেখেছি। লেখক-শিল্পীদের কাতারে শামিল। স্লোগান দিচ্ছেন।
এখলাস ভাই এত কিছু করার পাশাপাশি নিজের লেখালেখিও চালিয়ে গেছেন সমান তালে। তাঁর বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। সম্পাদিত সংকলনের সংখ্যাও অনেক। সাহিত্য-কৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি, একুশে পদকসহ আরও অনেক দেশি-বিদেশি পুরস্কার ও সম্মাননা।
সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে, অমন জীবন্ত, সুঠামদেহী মানুষটির হঠাৎ করে চলে যাওয়া। তাঁদের চারজনের একটা জুটি ছিল—হাশেম ভাই, নবী ভাই, এখলাস ভাই ও শাহাদত চৌধুরী। এই চারজনের জুটির মাথায় নানা প্ল্যান-প্রোগ্রাম গিজগিজ করত। হাসিখুশি থাকতেন সব সময়। সেই জুটির মধ্যমণি এখলাস ভাই নেই, নেই শাহাদত চৌধুরীও। বেঁচে আছেন কেবল হাশেম ভাই ও নবী ভাই। এই তো জীবন!
দেখতে দেখতে এখলাস ভাইয়ের চিরপ্রয়াণের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ২৪ ডিসেম্বর। ২০১৪ সালের এই দিনেই তো তিনি আমাদের কাঁদিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
আখতার হুসেন: শিশুসাহিত্যিক।
No comments