প্যারিস চুক্তির ধোঁয়াশা ও বাংলাদেশের আশা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্ববাসীর আসলেই একটি চুক্তি দরকার ছিল। প্যারিসেই সেই চুক্তির দেখা মিলবে—এই পূর্বাভাস আগেই ছিল। অনেকের মতে, ১২ ডিসেম্বর প্যারিসের লা বুর্জেতে যা ঘটে গেল, সেটাই ওই বহু আকাঙ্ক্ষিত চুক্তি। যে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল ২০০৯ সালে, ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। ছয় বছর ধরে চলা একের পর এক সম্মেলন ও আলোচনার ফলাফল হিসেবে ৩২ পৃষ্ঠার একটি নথি অনুমোদন দিয়েছে বিশ্বের ১৯৫টি রাষ্ট্র। ওই নথিটিকেই বলা হচ্ছে প্যারিস চুক্তি। জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন সংস্থা থেকে শুরু করে বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্রই ওই নথি অনুমোদন দিয়ে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। যাহোক, যাঁর যাঁর দেশে গিয়ে অন্তত বলা যাবে কোনো ব্যর্থ সম্মেলন থেকে তাঁরা ফেরেননি। এখন ওই চুক্তিতে মুক্তি খোঁজার আহ্বান জানিয়ে ইতিমধ্যে বিশ্বের বহু সংস্থা বিবৃতি, বিশ্লেষণ ও তাদের বিবেচনা হাজির করছে। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জও উদ্ঘাটন শুরু হয়েছে। কিন্তু কী আছে ওই ৩২ পৃষ্ঠার নথিতে। প্যারিসের ২১তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের উদ্যোক্তা জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত কাঠামোর (ইউএনএফসিসিসি) ওয়েবসাইটে গিয়ে কেউ যদি প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্ট নামে নথিটি ডাউনলোড করে একটু চোখ বোলান, তাহলে অনেকেরই বিভ্রান্তি কাটতে পারে। কেননা, ওটি আসলে কোনো চুক্তি নয়। ৩২ পৃষ্ঠার ওই নথির ১৯ পৃষ্ঠা হচ্ছে প্যারিসে যা আলোচনা হয়েছে তার সারমর্ম। অর্থাৎ ১৪ দিনের আলোচনায় রাষ্ট্রগুলো যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, তা সেখানে তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে কোন দেশের কী দায়িত্ব, কীভাবে তা পালন হবে, কবে সেটা বাস্তবায়ন হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। প্যারিস সম্মেলনের আলোচনার ফলাফলের শেষে ২০ থেকে ৩২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে একটি পরিশিষ্ট বা অ্যানেক্স। ওই পরিশিষ্টের মধ্যে রয়েছে প্যারিস চুক্তির একটি চূড়ান্ত খসড়া।
ওই সিদ্ধান্তের শুরুতেই বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিলের মধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব উচ্চপর্যায়ের একটি সভার আয়োজন করে প্যারিস চুক্তিতে রাষ্ট্রপ্রধানদের স্বাক্ষর নেবেন। এখানেই শেষ নয়, এর পরে আবার রাষ্ট্রগুলোকে তার নিজ নিজ দেশের সংসদে বা রাষ্ট্রপ্রধানের নির্বাহী আদেশে ওই চুক্তিটি অনুমোদন দিতে হবে। ওই অনুমোদনের পর ২০২০ সাল থেকে চুক্তিটি বাস্তবায়ন শুরু হবে। এখন অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, এত প্রক্রিয়া শেষ করে যে চুক্তিটি বিশ্ববাসী পাবে, তা কি বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে কেউ যদি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অতীত আলোচনা ও চুক্তিকেন্দ্রিক বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে নেন, তাহলে অনেক উত্তর চলে আসবে। ২০১০ সালে কানকুন সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্যারিস চুক্তিতে জাতিসংঘের সবুজ জলবায়ু তহবিলে (জিসিএফ) কোন দেশ কত অর্থ দেবে, সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা থাকার কথা ছিল। মেক্সিকোর কানকুন শহরের ১৬তম জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২০ সাল পর্যন্ত শিল্পোন্নত বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি ডলার দেবে। প্যারিস সিদ্ধান্তের সংযুক্তি হিসেবে থাকা চুক্তির খসড়ায় কোন দেশ, কবে থেকে, কী পরিমাণে অর্থ দেবে তার কোনো রূপরেখা নেই। ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটো শহরে হওয়া জলবায়ু সম্মেলনে একটি প্রটোকল বা আইনি বাধ্যবাধকতাসহ চুক্তি হয়েছিল। তাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব দেশ স্বাক্ষর করেছিল। অ্যানেক্স-১ খ্যাত বিশ্বের ৩৭টি শিল্পোন্নত রাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে শিল্পবিপ্লবের পর থেকে তাদের কার্বন নিঃসরণ যে দায়ী, সেই দায় শিকার করে নিয়েছিল। বলেছিল, তারা ২০১২ সাল পর্যন্ত তাদের মোট কার্বন নিঃসরণের ৫ শতাংশ কমাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তাদের জাতীয় আয়ের ৭ শতাংশ সহায়তা হিসেবে দেবে। কিয়োটো প্রটোকল আইনি বাধ্যবাধকতাসহ চুক্তি ছিল। বলা ছিল বিশ্বের কোনো দেশ ওই চুক্তির বরখেলাপ করলে তার জবাবদিহি থাকবে। ইউরোপের দু-তিনটি দেশ বাদে ওই অঙ্গীকার কেউই বাস্তবায়ন করেনি। আর যুক্তরাষ্ট্র তো শেষ পর্যন্ত কিয়োটো প্রটোকল তাদের কংগ্রেসে অনুমোদন করাতে পারেনি। ফলে তারা ওই চুক্তির বাইরে ছিল। কিয়োটো প্রটোকেল বলা হয়েছিল, ২০১২ সাল থেকে শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো কী পরিমাণে কার্বন কমাবে, কত অর্থ জলবায়ু তহবিল হিসেবে দেবে, তা নির্ধারণ করে একটি চুক্তি হবে। প্যারিস চুক্তির সারবস্তু খেয়াল করলে বিশ্ব কিন্তু ১৯৯৭ সালের কিয়োটো চুক্তির চেয়েও পিছিয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে এমন আশা দিয়ে গেছে।
কিন্তু ওই চুক্তিতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়টি আর আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকল না। কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের হিসাবমতে, কার্বন নিঃসরণ কমানোর জাতীয় পরিকল্পনা বা (আইএনডিসি) বাস্তবায়ন করতে হলে রাষ্ট্রগুলোকে বছরে ব্যয় করতে হবে ১০ থেকে ২০ লাখ কোটি ডলার। বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গত এক যুগে এক হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে। ২০১৫ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হবে আরও চার হাজার কোটি ডলার। এই অর্থ কে দেবে, কবে দেবে তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত এর বড় অংশ হয়তো বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। তবে ওই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন হলেই বিশ্ব কি জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ থেকে নিরাপদ হয়ে গেল? খোদ জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) বিজ্ঞানীরা প্যারিস সম্মেলনের আগে ১৯৫টি দেশের কার্বন নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকারনামা নিয়ে একটি পর্যালোচনা হাজির করেছে। তাতে তারা দেখিয়েছে, ওই অঙ্গীকার শতভাগ বাস্তবায়ন হলেও এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা আরও তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়বে। যদি তাই হয় তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? সেই প্রশ্নের উত্তর প্যারিস চুক্তির আলোকেই খুঁজতে হবে। অন্যদিকে কিয়োটো প্রটোকল চুক্তিতে শিল্পোন্নত বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির যে দায় স্বীকার করে নিয়েছিল, প্যারিসে এসে তারা তা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল। সব মিলিয়ে আমরা হবু প্যারিস চুক্তির যদি সারসংক্ষেপ করি তাহলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, এই চুক্তিতে শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো কার্বন নিঃসরণ কমানো ও বাড়ানোর কাজটি স্বাধীনভাবে করবে। তারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থ দেওয়ার বিষয়টিও সুনির্দিষ্ট করল না। তবে যারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিন্তু এর জন্য দায়ী নয়, তাদের কার্বন নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকারের আওতায় নিয়ে এল। এতসব জেনে হয়তো অনেকে বলতে পারেন, তাহলে এই চুক্তি লইয়া আমরা কী করিব? ওই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাকল।
ইফতেখার মাহমুদ: সাংবাদিক।
ইফতেখার মাহমুদ: সাংবাদিক।
No comments