ইসলামী আন্দোলন: তুরস্ক প্রসঙ্গ
ইতিহাস
সাক্ষ্য দেয়, দীর্ঘকাল যাবৎ আরব ও তুর্কী শাসকরা পারস্পারিক সহমর্মিতার
ভিত্তিতে মুসলিম খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেছে। তুর্কী খলিফার দরবারে অনেক
আরব আলেম ও পণ্ডিতদের প্রাধান্য ছিল; তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো বিরোধ বা
হীনমন্যতা পরিলক্ষিত হয়নি। ইউরোপের খ্রিস্টান ও ইহুদী বুদ্ধিজীবীরা অত্যন্ত
সুকৌশলে আরব ও তুর্কী মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার
বিষবাষ্প অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়। প্রাচ্য ইতিহাস বিশারদ বার্নার্ড লুইস
লিখেছেন, তিনজন ইউরোপীয় ইহুদী তুর্কীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধ্যান-ধারণার
লেলিহান শিখা ছড়িয়ে দিয়েছিল। ইংরেজ ইহুদী অর্থার লুমলে ডেভিড (১৮১১-১৮৩২)
ইংল্যান্ড থেকে তুরস্কে এসে প্রিলিমিনাইরি ডিসকোর্স নামে একটি বই লিখেন;
এতে তিনি তুর্কী জাতিকে আরবদের চেয়ে উন্নত ও স্বাধীনচেতা হিসেবে তুলে ধরেন।
বইটি তরুণ তুর্কীদের মধ্যে সাড়া জাগায়। বইটি তুর্কী ভাষায় অনুবাদ করে
ছড়িয়ে দেয়া হয়। ডিভিড লিয়ন কোহন নামের আরেকজন ফরাসী ইহুদী ১৮৯৯ সালে তুর্কী
জাতীয়তাবাদের পক্ষে একটি বই লিখেন। এতে তিনি তুর্কীদের অতীত গৌরব তুলে
ধরেন। বইটি তুর্কী ভাষায় অনুবাদ করে অসংখ্য কপি বিতরণ করা হয়। ‘ইয়ং তুর্ক’
নামে খলিফার বিরোধী একটি গ্রুপকে কাজে লাগানো হয় এবং এদের সমর্থকদের নিয়ে
প্যারিস ও মিশরে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এরাই তুর্কী জাতীয়তাবাদের পক্ষে
প্রচারণা চালাতে থাকে। তৃতীয় ইহুদী ব্যক্তিটি ছিল হাঙ্গেরীয় আরমিনিয়াম
ভ্যাম্বারী (১৮৩২-১৯১৮)। তিনি তুর্কী ভাষা, সাহিত্য ও জাতীয় ঐতিহ্যকে
দেশপ্রেমের সাথে সম্পৃক্ত করে তুলে ধরেন। তিনি সমাজের উচু স্তরের
রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন
এবং ক্রমান্বয়ে তাদেরকে তুর্কী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন।
প্রকৃতপক্ষে ইহুদীদের লক্ষ্য ছিল তাদের কাক্সিক্ষত ভূমি প্যালেস্টাইন পুনরুদ্ধার করা। এ জন্য তাদের প্রাথমিক কৌশল ছিল তুর্কী খিলাফতকে ধ্বংস করে দিয়ে প্যালেস্টাইনের দিকে অগ্রসর হওয়া। তাদের দৃষ্টিতে এ কাজটি সহজ করার জন্য প্রয়োজন ছিল আরব ও তুর্কী মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী বিভেদ জাগিয়ে তোলা। এদের চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে নামেক কামাল, জিয়া পাশা ও জোয়াদাত পাশার মতো জাতীয়তাবাদী নেতারা বিষয়টিকে উগ্রতার পর্যায়ে নিয়ে যান। অপরদিকে আরবদের মধ্যে কোনো তুর্কী বিদ্বেষ ছিল না। কিন্তু তুর্কীদের মধ্যে আরব বিদ্বেষ তীব্র হয়ে উঠলে আরবরাও তাদের জাতীয় ঐতিহ্যকে রক্ষার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠে। এরূপ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ইহুদী ও খ্রিস্টানরা। বৃটিশরা আরবের খ্রিস্টান মিশনারি ও পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে আরব জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শানিত করে তোলে। প্রথমে তারা সফল হয় মিশর, সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডানে। বৃটেন ও ফ্রান্সের এজেন্ট নাজীব আজৌরি ১৯০৪ সালে প্যারিস থেকে আরব জাতীয়তাবাদের পক্ষে লি রেভেল ডি লা নেশন আরব নামক এক বই লিখেন এবং প্যারিসভিত্তিক আরব জাতীয়তাবাদী সমিতি গড়ে তোলেন। তিনি একটি ম্যাগাজিনও প্রকাশ করেন।
১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে বৃটিশরা ১৯১৬ সালে তুর্কীদের বিরুদ্ধে জর্ডানের শরীফ হোসেনকে (বাদশা হোসেনের দাদা) যুদ্ধে প্ররোচিত করে এবং সর্বাত্মক সহায়তা দেয়। শরীফ হোসেন ছিল বৃটিশ এজেন্ট। তার ছেলে আবদুল্লাহ (বাদশা হোসেনের বাবা) বৃটিশ জেনারেল চিনারের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন। শরীফ হোসেন তুর্কী খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বৃটিশ সরকারি কর্মকর্তা টি.ই. লরেন্স ও প্যালেস্টাইনে নিযুক্ত বৃটিশ কমান্ডার জেনারেল এলেনবী তুর্কীদের বিরুদ্ধে আরবদের পক্ষে নেতৃত্ব দেয়। পাশ্চাত্যের ইহুদী ও খ্রিস্টানদের প্ররোচনায় আরব ও তুর্কী মুসলমানরা ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। শরীফ হোসেন ও কয়েকটি আরব গুপ্ত সংগঠন বৃটিশদের সাথে চক্রান্ত করে আরব বিশ্বকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। এর ফলশ্রুতিতে প্রথমেই প্রতিষ্ঠিত হয় প্যালেস্টাইনের বুকের উপর অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র। বৃটিশরা দখলে নেয় মিশর, সাইপ্রাস, এডেন, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও পারস্য উপসাগরীয় শেখ শাসিত রাজ্যগুলো। ফ্রান্স দখল করে আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কো। রাশিয়া দখলে নেয় আর্মেনিয়া। ইটালি উপনিবেশ স্থাপন করে লিবিয়ায়। তুর্কী খিলাফত একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিশাল সাম্রাজ্য ইস্তাম্বুল ও আনাতোলিয়ার একাংশে সীমিত হয়ে পড়ে।
১৯২২ সালে তুর্কী জাতীয়তাবাদীরা গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলিতে সমবেত হয়ে সুলতানের পদ বিলোপ করে। ১৯২৩ সালে তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কামাল পাশা দেশের প্রেসিডেন্ট হন। তিনি তুরস্কের ইসলামী ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও জীবনধারা চালু করার পদক্ষেপ নেন। আরবি ভাষাকে অফিস-আদালত ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বিদায় দেন। তিনি দেশে পূর্ণ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন এবং তাঁর দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিল। কামাল পাশঅ তুরস্কক একটি সেক্যুলার (লায়েকিজম) রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তবে ইসলামী আইন-কানুন তুর্কী সমাজে এমন শক্তভাবে শেকড় গেড়েছিল যে তা সহজে উপড়ে ফেলার উপায় ছিল না। এটা উপলব্ধি করে কামাল পাশা কতিপয় ইসলামী আইন-কানুনকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসেন। তিনি ‘দিয়ানেত’ নামক রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত একটি ধর্মীয় সংস্থা গঠন করন। ১৯৩৭ সালে দেশটির পার্লামেন্ট যে সংবিধান অনুমোদন করে তাতে সেক্যুলারিজমকে (লায়েকিজম) রাষ্ট্রীয় নীতিহিসেবে গ্রহন করা হয়। সে নীতি এখনও বহাল আছে। দেশটির সেনাবাহিনী ও সাংবিধানিক আদালত এ নীতি বহাল রাখার পক্ষে অত্যন্ত শক্ত ভূমিকা নিয়ে থাকে।
কামাল পাশা ও তার দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ একদলীয় ব্যবস্থায় তুরস্কের ক্ষমতার ছিল। ১৯৪৬ সালে দেশটিতে বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৫০ সালে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ২৪টি দলের মধ্যে অন্তত ৭টি দল রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামের ভূমিকা থাকার পক্ষে অবস্থান নেয়। এই নির্বাচনে মেন্দারেসের নেতৃত্বে ডেমোক্রেটিক পার্টি জয়লাভ করে। আদনান মেন্দারেস প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ইসলামী মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য মসজিদ নির্মাণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মেন্দারেসের ইসলামপ্রীতি সেনাবাহিনী ও কামালপন্থীরা ভালো চোখে দেখেনি। কামালপন্থী ও কম্যুনিস্টরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬০ সালে দেশটির সেনাবাহিনী এক অভ্যুত্থান ঘটায় এবং মেন্দারেসের সরকারকে উৎখাত করে। মেন্দারেসকে সেক্যুলারিজমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করায় মৃত্যুদ- দেয়া হয়। তার দল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব বহাল রাখতে ‘জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল’ গঠন করা হয়। সেই থেকে তুরস্কের সংবিধান তথা কামালতন্ত্র ও পররাষ্ট্রনীতির সংরক্ষক হিসেবে সামরিক বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা নিশ্চিত করা হয়।
ষাটের দশকে সামরিক সরকারের অধিকতর পাশ্চাত্যপ্রীতি তুর্কী জনগণ ভালো চোখে নেয়নি। এ সময় মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বেড়ে গেলে সরকারবিরোধী মনোভাব প্রবল হতে থাকে। রাজনীতিবিদরা তাদের জাতীয় স্বকীয়তা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকেন। লেখকরাও ইসলামী রাজনীতির পক্ষে লিখতে থাকেন। এরূপ ক্রান্তিকালে নাজমুদ্দিন আরবাকান নামের একজন প্রকৌশলী ইসলামী রাজনীতির প্রবক্তা হিসেবে আবির্ভুত হন। তিনি প্রথমে ক্ষমতাসীন জাস্টিস পার্টিতে যোগ দেন। ঐ দলে নেতৃত্বের লড়াইয়ে টিকতে না পেরে তিনি ১৯৭০ সালে মিল্লি নিজাম পার্টি (ন্যাশনাল অর্ডার পার্টি) গঠন করেন। এ সময় বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করে।
১৯৭১ সালে দেশটিতে দ্বিতীয় দফা সামরিক শাসন জারি হয়। সামরিক সরকার সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এক বছর পরে আরবাকান মিল্লি সালামত পার্টি (ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টি) নামে নতুন দল গঠন করেন। ১৯৭৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এ দলটি অপ্রত্যাশিতভাবে প্রায় ১ ভাগ ভোট পেয়ে পার্লামেন্টে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কোন দলই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে কোয়ালিশন সরকার ছিল অবধারিত। এ সময় একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটলো। আরবাকানের মিল্লি সালামত পার্টি ও ইসলামের প্রতি উদার সুলেমান ডেমরেলের এপি পার্টির মধ্যে সমঝোতা হলো না। বরং কামালপন্থী বুলেন্দ এসিভিটের রিপাবলিকান পার্টি আরবাকানকে সরকার গঠনে সমর্থন দেন। আরবাকানের সরকার ১৯৭৪ সালে ১১ মাস ক্ষমতায় ছিল। আরবাকান পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যবিরোধী অবস্থান নেন। মেন্দারেসের মতো তিনিও ইসলামী মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য মসজিদ নির্মাণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তুরস্কে বার বার ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। পুরো সত্তর দশক জুড়ে তুরস্কে ডানপন্থী, বামপন্থী ও ইসলামপন্থীদের মধ্যে মারাত্মক কলহ-বিবাদের ফলশ্রুতিতে ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালেই প্রায় ৩ হাজার রাজনৈতিক হত্যাকা- ঘটে। এ সুযোগে সামরিক বাহিনী ১৯৮০ সালে আবার ক্ষমতা দখল করে। সামরিক সরকার পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয় এবং সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে। প্রায় ৬ লক্ষ ৫০ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং ৫১৭ জনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ৩ লক্ষ ৮৮ হাজার লোককে বিদেশ যেতে বাধা দেয়া হয়। অপরদিকে ৩০ হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে তুরস্ক থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৪ হাজার তুর্কী নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। হাজার হাজার সরকারী কর্মচারীর চাকরিহরণ করা হয়। ৬ শতাধিক ক্লাব/সমিতি বন্ধ করে দেয়া হয়।
সামরিক সরকার চরম নির্যাতনের পর নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হয়। ১৯৮৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে তুরগুর ওজালের নেতৃত্বে মাদারল্যান্ড পার্টি ৪৫ ভাগ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। তিনি ইসলামের প্রতি উদার ছিলেন। প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর তিনি হচ্ছেন তুরস্কের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ১৯৮৮ সালে মক্কায় গমন করে পবিত্র হজ্জ সম্পাদন করেন। তার আমলে ইসলামী মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। তিনি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী এবং এরপর ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ থাকলেও আরবাকান ১৯৮৩ সালে গোপনে রাফাহ পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করে রেখেছিলেন। ১৯৮৭ সালে এক রেফারেন্ডামের ফলে রাজনৈতিক দলগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়। এ সময় (১৯৮৭) অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তুরগুত ওজালের মাদারল্যান্ড পার্টি ৩৬ ভাগ ভোট পেয়ে পুনরায় জয়লাভ করে। ১৯৮৩ সালে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাফাহ পার্টি বেশ ভালো ফল করে। আরবাকানের পার্টি নতুন আত্মবিশ্বাসে এগুতে থাকে। সত্তর দশকে আরবাকানের পার্টি ছিল অনেকটা প্রাদেশিক ধাঁচের; কিন্তু নব্বই দশকে সে দলটি একটি আধুনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাতীয় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দলটি গতানুগতিক ইসলামী নীতির পরিবর্তে জাস্ট অর্ডার’ স্লোগান দিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষন করে। ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রাফাহ পার্টি ২১.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৫৮টি আসনে (৫৫০টির মধ্যে) জয়লাভ করে। রাফাহ পার্টির এরূপ জয়লাভের পেছনে কারণ কী? বিশ্লেষকদের মতে, কুর্দী সমস্যা সমাধানে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের নীতি গ্রহণ, নারী সমাজের ব্যাপক সমর্থন, শহুরে দরিদ্রদের পুনর্বাসনের আশ্বাস ও সমাজসেবামূলক কাজ ইত্যাদি কারণে দলটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তারা সততা ও নৈতিকতার প্রতি জোর দেয়। এছাড়া ইস্তাম্বুল ও আস্কারা নগরীর নির্বাচিত মেয়রদ্বয় ছিলেন এ দলের। যারা ব্যাপক নাগরিক সুযোগ সুবিধামূলক কর্মকা- দ্বারা বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
রাফাহ পার্টির প্রাপ্ত ১৫৮টি আসন সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তানসু সেলারের ট্রু পাথ পার্টির সমর্থন নিয়ে ১৯৯৬ সালে আরবাকান সরকার গঠন করেন। কিন্তু সিলারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ ছিল। আরবাকান নির্বাচনের আগে অধিকতর ইসলামীকরণের কথা বললেও ক্ষমতায় গিয়ে উদার নীতি গ্রহণ করেন। তথাপি তিনি অনেক ক্ষেত্রে ইসলামীকরণের কাজ হাতে নেন। কিন্তু তা দলের নেতাকর্মীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তারা বিভিন্ন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ আনে। ক্ষমতায় আরোহণের কয়েক মাসের মাথায় আরবাকানের সরকার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার তানসু সিলারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তের বিষয়টি পার্লামেন্টারি কমিটি বার বার আটকে দিচ্ছিল। বিরোধী দল এর কঠোর সমালোচনা করে। আরবাকান নিজ দলের মধ্যেও সমালোচনার সম্মুখীন হন। ১৯৯৭ সালের দিকে দলের নেতাকর্মীরা ইরানী স্টাইলে বিপ্লবের দাবি জানায়। বিষয়টি সামরিক বাহিনী, প্রেসিডেন্ট ও সিভিল সোসাইটি এই তিন শক্তিকে উত্তেজিত করে তোলে। সামরিক বাহিনী আরবাকানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের জন্য চাপ দিতে থাকে। সেনাবাহিনীর চাপে ট্রু পাথ পার্টির সদস্যরা পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করে। ফলে রাবাকান সরকার পার্লামেন্টের আস্থা হারান এবং পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন আরবাকানের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটে। ১৯৯৮ সালে তুর্কী সাংবিধানিক আদালত রাফাহ পার্টিকে সেক্যুলার নীতি ভঙ্গের দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। রাফাহ পার্টির নেতা-কর্মীরা বিকল্প পথে ভারচু পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে। তারা ১৯৯৯ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৫.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান দখল করে এবং পার্লামেন্টে বিরোধী দলের আসনে বসে। রাফাহ পার্টির নবতর সংস্করণ হচ্ছে ভারচু পার্টি- এ অভিযোগে ২০০১ সালে এ দলটিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
নানা কারণে আরবাকান সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি বার বার দল নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে দলের কৌশল গ্রহণ প্রশ্নে মতবিরোধ দেখা দেয়। আরবাকান ক্রমান্বয়ে দলে কোনঠাসা হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে দলে বিভক্তি দেখা দেয়। আরবাকান সমর্থক পুরানো ধাঁচের নেতৃত্ব সংঘবদ্ধ হয়ে গঠন করে ফেলিসিটি পার্টি এবং সংস্কারবাদীরা গড়ে তোলে জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি)। পার্লামেন্টে রাফাহ পার্টির ৪৮ জন ফেলিসিটি পার্টিতে এবং ৫৩ জন একে পার্টিতে যোগ দেন। ইস্তাম্বুলের মেয়র রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান একে পার্টির নেতা নির্বাচিত হন।
একে পার্টি নতুন উদ্যেমে যাত্রা শুরু করে। তারা তুর্কী সেক্যুলার নীতি, পাশ্চাত্যমুখী পররাষ্ট্র নীতি, ইইউ ও ন্যাটো জোটে অংশগ্রহণ ও মুক্তবাজার নীতি অনুসরণের ঘোষণা দেয়। তাদের নতুন কৌশল বেশ কাজ দিল। ১৯৯৯ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলটি ৩৪.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। তারা পার্লামেন্টের ৫৫০টি আসনের মধ্যে ৩৬৩টি আসন লাভ করে যা দুই-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি। আরবাকানের ফেলিসিটি পার্টি মাত্র ২.৫ শতাংশ ভোট পায়। এ সময় বিরোধী দলের সম্মিলিত ভোট ছিল প্রায় ৫৩.৪ শতাংশ। তারা এরদোগান সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে আন্দোলন করলেও ২০০২ সালে নির্বঅচনে জনগণ পুনরায় একে পার্টিকে বিজয়ী করে। বিরোধী দলের সম্মিলিত ভোট করে দাঁড়ায় ১৪.৬ শতাংশে। নতুন ও তরুণ ভোটার, গরীব জনগোষ্ঠী ও কুর্দীরা একে পার্টিকে ভোট দেয়।
নোট: লেখাটি ‘কামারুজ্জামানের চিঠি এবং জামায়াতের সংস্কার প্রসঙ্গ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া।
প্রকৃতপক্ষে ইহুদীদের লক্ষ্য ছিল তাদের কাক্সিক্ষত ভূমি প্যালেস্টাইন পুনরুদ্ধার করা। এ জন্য তাদের প্রাথমিক কৌশল ছিল তুর্কী খিলাফতকে ধ্বংস করে দিয়ে প্যালেস্টাইনের দিকে অগ্রসর হওয়া। তাদের দৃষ্টিতে এ কাজটি সহজ করার জন্য প্রয়োজন ছিল আরব ও তুর্কী মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী বিভেদ জাগিয়ে তোলা। এদের চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে নামেক কামাল, জিয়া পাশা ও জোয়াদাত পাশার মতো জাতীয়তাবাদী নেতারা বিষয়টিকে উগ্রতার পর্যায়ে নিয়ে যান। অপরদিকে আরবদের মধ্যে কোনো তুর্কী বিদ্বেষ ছিল না। কিন্তু তুর্কীদের মধ্যে আরব বিদ্বেষ তীব্র হয়ে উঠলে আরবরাও তাদের জাতীয় ঐতিহ্যকে রক্ষার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠে। এরূপ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ইহুদী ও খ্রিস্টানরা। বৃটিশরা আরবের খ্রিস্টান মিশনারি ও পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে আরব জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শানিত করে তোলে। প্রথমে তারা সফল হয় মিশর, সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডানে। বৃটেন ও ফ্রান্সের এজেন্ট নাজীব আজৌরি ১৯০৪ সালে প্যারিস থেকে আরব জাতীয়তাবাদের পক্ষে লি রেভেল ডি লা নেশন আরব নামক এক বই লিখেন এবং প্যারিসভিত্তিক আরব জাতীয়তাবাদী সমিতি গড়ে তোলেন। তিনি একটি ম্যাগাজিনও প্রকাশ করেন।
১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে বৃটিশরা ১৯১৬ সালে তুর্কীদের বিরুদ্ধে জর্ডানের শরীফ হোসেনকে (বাদশা হোসেনের দাদা) যুদ্ধে প্ররোচিত করে এবং সর্বাত্মক সহায়তা দেয়। শরীফ হোসেন ছিল বৃটিশ এজেন্ট। তার ছেলে আবদুল্লাহ (বাদশা হোসেনের বাবা) বৃটিশ জেনারেল চিনারের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন। শরীফ হোসেন তুর্কী খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বৃটিশ সরকারি কর্মকর্তা টি.ই. লরেন্স ও প্যালেস্টাইনে নিযুক্ত বৃটিশ কমান্ডার জেনারেল এলেনবী তুর্কীদের বিরুদ্ধে আরবদের পক্ষে নেতৃত্ব দেয়। পাশ্চাত্যের ইহুদী ও খ্রিস্টানদের প্ররোচনায় আরব ও তুর্কী মুসলমানরা ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। শরীফ হোসেন ও কয়েকটি আরব গুপ্ত সংগঠন বৃটিশদের সাথে চক্রান্ত করে আরব বিশ্বকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। এর ফলশ্রুতিতে প্রথমেই প্রতিষ্ঠিত হয় প্যালেস্টাইনের বুকের উপর অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র। বৃটিশরা দখলে নেয় মিশর, সাইপ্রাস, এডেন, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও পারস্য উপসাগরীয় শেখ শাসিত রাজ্যগুলো। ফ্রান্স দখল করে আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কো। রাশিয়া দখলে নেয় আর্মেনিয়া। ইটালি উপনিবেশ স্থাপন করে লিবিয়ায়। তুর্কী খিলাফত একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিশাল সাম্রাজ্য ইস্তাম্বুল ও আনাতোলিয়ার একাংশে সীমিত হয়ে পড়ে।
১৯২২ সালে তুর্কী জাতীয়তাবাদীরা গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলিতে সমবেত হয়ে সুলতানের পদ বিলোপ করে। ১৯২৩ সালে তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কামাল পাশা দেশের প্রেসিডেন্ট হন। তিনি তুরস্কের ইসলামী ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও জীবনধারা চালু করার পদক্ষেপ নেন। আরবি ভাষাকে অফিস-আদালত ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বিদায় দেন। তিনি দেশে পূর্ণ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন এবং তাঁর দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিল। কামাল পাশঅ তুরস্কক একটি সেক্যুলার (লায়েকিজম) রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তবে ইসলামী আইন-কানুন তুর্কী সমাজে এমন শক্তভাবে শেকড় গেড়েছিল যে তা সহজে উপড়ে ফেলার উপায় ছিল না। এটা উপলব্ধি করে কামাল পাশা কতিপয় ইসলামী আইন-কানুনকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসেন। তিনি ‘দিয়ানেত’ নামক রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত একটি ধর্মীয় সংস্থা গঠন করন। ১৯৩৭ সালে দেশটির পার্লামেন্ট যে সংবিধান অনুমোদন করে তাতে সেক্যুলারিজমকে (লায়েকিজম) রাষ্ট্রীয় নীতিহিসেবে গ্রহন করা হয়। সে নীতি এখনও বহাল আছে। দেশটির সেনাবাহিনী ও সাংবিধানিক আদালত এ নীতি বহাল রাখার পক্ষে অত্যন্ত শক্ত ভূমিকা নিয়ে থাকে।
কামাল পাশা ও তার দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ একদলীয় ব্যবস্থায় তুরস্কের ক্ষমতার ছিল। ১৯৪৬ সালে দেশটিতে বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৫০ সালে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ২৪টি দলের মধ্যে অন্তত ৭টি দল রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামের ভূমিকা থাকার পক্ষে অবস্থান নেয়। এই নির্বাচনে মেন্দারেসের নেতৃত্বে ডেমোক্রেটিক পার্টি জয়লাভ করে। আদনান মেন্দারেস প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ইসলামী মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য মসজিদ নির্মাণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মেন্দারেসের ইসলামপ্রীতি সেনাবাহিনী ও কামালপন্থীরা ভালো চোখে দেখেনি। কামালপন্থী ও কম্যুনিস্টরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬০ সালে দেশটির সেনাবাহিনী এক অভ্যুত্থান ঘটায় এবং মেন্দারেসের সরকারকে উৎখাত করে। মেন্দারেসকে সেক্যুলারিজমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করায় মৃত্যুদ- দেয়া হয়। তার দল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব বহাল রাখতে ‘জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল’ গঠন করা হয়। সেই থেকে তুরস্কের সংবিধান তথা কামালতন্ত্র ও পররাষ্ট্রনীতির সংরক্ষক হিসেবে সামরিক বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা নিশ্চিত করা হয়।
ষাটের দশকে সামরিক সরকারের অধিকতর পাশ্চাত্যপ্রীতি তুর্কী জনগণ ভালো চোখে নেয়নি। এ সময় মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বেড়ে গেলে সরকারবিরোধী মনোভাব প্রবল হতে থাকে। রাজনীতিবিদরা তাদের জাতীয় স্বকীয়তা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকেন। লেখকরাও ইসলামী রাজনীতির পক্ষে লিখতে থাকেন। এরূপ ক্রান্তিকালে নাজমুদ্দিন আরবাকান নামের একজন প্রকৌশলী ইসলামী রাজনীতির প্রবক্তা হিসেবে আবির্ভুত হন। তিনি প্রথমে ক্ষমতাসীন জাস্টিস পার্টিতে যোগ দেন। ঐ দলে নেতৃত্বের লড়াইয়ে টিকতে না পেরে তিনি ১৯৭০ সালে মিল্লি নিজাম পার্টি (ন্যাশনাল অর্ডার পার্টি) গঠন করেন। এ সময় বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করে।
১৯৭১ সালে দেশটিতে দ্বিতীয় দফা সামরিক শাসন জারি হয়। সামরিক সরকার সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এক বছর পরে আরবাকান মিল্লি সালামত পার্টি (ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টি) নামে নতুন দল গঠন করেন। ১৯৭৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এ দলটি অপ্রত্যাশিতভাবে প্রায় ১ ভাগ ভোট পেয়ে পার্লামেন্টে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কোন দলই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে কোয়ালিশন সরকার ছিল অবধারিত। এ সময় একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটলো। আরবাকানের মিল্লি সালামত পার্টি ও ইসলামের প্রতি উদার সুলেমান ডেমরেলের এপি পার্টির মধ্যে সমঝোতা হলো না। বরং কামালপন্থী বুলেন্দ এসিভিটের রিপাবলিকান পার্টি আরবাকানকে সরকার গঠনে সমর্থন দেন। আরবাকানের সরকার ১৯৭৪ সালে ১১ মাস ক্ষমতায় ছিল। আরবাকান পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যবিরোধী অবস্থান নেন। মেন্দারেসের মতো তিনিও ইসলামী মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য মসজিদ নির্মাণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তুরস্কে বার বার ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। পুরো সত্তর দশক জুড়ে তুরস্কে ডানপন্থী, বামপন্থী ও ইসলামপন্থীদের মধ্যে মারাত্মক কলহ-বিবাদের ফলশ্রুতিতে ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালেই প্রায় ৩ হাজার রাজনৈতিক হত্যাকা- ঘটে। এ সুযোগে সামরিক বাহিনী ১৯৮০ সালে আবার ক্ষমতা দখল করে। সামরিক সরকার পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয় এবং সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে। প্রায় ৬ লক্ষ ৫০ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং ৫১৭ জনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ৩ লক্ষ ৮৮ হাজার লোককে বিদেশ যেতে বাধা দেয়া হয়। অপরদিকে ৩০ হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে তুরস্ক থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৪ হাজার তুর্কী নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। হাজার হাজার সরকারী কর্মচারীর চাকরিহরণ করা হয়। ৬ শতাধিক ক্লাব/সমিতি বন্ধ করে দেয়া হয়।
সামরিক সরকার চরম নির্যাতনের পর নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হয়। ১৯৮৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে তুরগুর ওজালের নেতৃত্বে মাদারল্যান্ড পার্টি ৪৫ ভাগ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। তিনি ইসলামের প্রতি উদার ছিলেন। প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর তিনি হচ্ছেন তুরস্কের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ১৯৮৮ সালে মক্কায় গমন করে পবিত্র হজ্জ সম্পাদন করেন। তার আমলে ইসলামী মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। তিনি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী এবং এরপর ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ থাকলেও আরবাকান ১৯৮৩ সালে গোপনে রাফাহ পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করে রেখেছিলেন। ১৯৮৭ সালে এক রেফারেন্ডামের ফলে রাজনৈতিক দলগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়। এ সময় (১৯৮৭) অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তুরগুত ওজালের মাদারল্যান্ড পার্টি ৩৬ ভাগ ভোট পেয়ে পুনরায় জয়লাভ করে। ১৯৮৩ সালে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাফাহ পার্টি বেশ ভালো ফল করে। আরবাকানের পার্টি নতুন আত্মবিশ্বাসে এগুতে থাকে। সত্তর দশকে আরবাকানের পার্টি ছিল অনেকটা প্রাদেশিক ধাঁচের; কিন্তু নব্বই দশকে সে দলটি একটি আধুনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাতীয় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দলটি গতানুগতিক ইসলামী নীতির পরিবর্তে জাস্ট অর্ডার’ স্লোগান দিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষন করে। ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রাফাহ পার্টি ২১.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৫৮টি আসনে (৫৫০টির মধ্যে) জয়লাভ করে। রাফাহ পার্টির এরূপ জয়লাভের পেছনে কারণ কী? বিশ্লেষকদের মতে, কুর্দী সমস্যা সমাধানে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের নীতি গ্রহণ, নারী সমাজের ব্যাপক সমর্থন, শহুরে দরিদ্রদের পুনর্বাসনের আশ্বাস ও সমাজসেবামূলক কাজ ইত্যাদি কারণে দলটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তারা সততা ও নৈতিকতার প্রতি জোর দেয়। এছাড়া ইস্তাম্বুল ও আস্কারা নগরীর নির্বাচিত মেয়রদ্বয় ছিলেন এ দলের। যারা ব্যাপক নাগরিক সুযোগ সুবিধামূলক কর্মকা- দ্বারা বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
রাফাহ পার্টির প্রাপ্ত ১৫৮টি আসন সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তানসু সেলারের ট্রু পাথ পার্টির সমর্থন নিয়ে ১৯৯৬ সালে আরবাকান সরকার গঠন করেন। কিন্তু সিলারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ ছিল। আরবাকান নির্বাচনের আগে অধিকতর ইসলামীকরণের কথা বললেও ক্ষমতায় গিয়ে উদার নীতি গ্রহণ করেন। তথাপি তিনি অনেক ক্ষেত্রে ইসলামীকরণের কাজ হাতে নেন। কিন্তু তা দলের নেতাকর্মীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তারা বিভিন্ন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ আনে। ক্ষমতায় আরোহণের কয়েক মাসের মাথায় আরবাকানের সরকার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার তানসু সিলারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তের বিষয়টি পার্লামেন্টারি কমিটি বার বার আটকে দিচ্ছিল। বিরোধী দল এর কঠোর সমালোচনা করে। আরবাকান নিজ দলের মধ্যেও সমালোচনার সম্মুখীন হন। ১৯৯৭ সালের দিকে দলের নেতাকর্মীরা ইরানী স্টাইলে বিপ্লবের দাবি জানায়। বিষয়টি সামরিক বাহিনী, প্রেসিডেন্ট ও সিভিল সোসাইটি এই তিন শক্তিকে উত্তেজিত করে তোলে। সামরিক বাহিনী আরবাকানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের জন্য চাপ দিতে থাকে। সেনাবাহিনীর চাপে ট্রু পাথ পার্টির সদস্যরা পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করে। ফলে রাবাকান সরকার পার্লামেন্টের আস্থা হারান এবং পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন আরবাকানের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটে। ১৯৯৮ সালে তুর্কী সাংবিধানিক আদালত রাফাহ পার্টিকে সেক্যুলার নীতি ভঙ্গের দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। রাফাহ পার্টির নেতা-কর্মীরা বিকল্প পথে ভারচু পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে। তারা ১৯৯৯ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৫.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান দখল করে এবং পার্লামেন্টে বিরোধী দলের আসনে বসে। রাফাহ পার্টির নবতর সংস্করণ হচ্ছে ভারচু পার্টি- এ অভিযোগে ২০০১ সালে এ দলটিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
নানা কারণে আরবাকান সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি বার বার দল নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে দলের কৌশল গ্রহণ প্রশ্নে মতবিরোধ দেখা দেয়। আরবাকান ক্রমান্বয়ে দলে কোনঠাসা হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে দলে বিভক্তি দেখা দেয়। আরবাকান সমর্থক পুরানো ধাঁচের নেতৃত্ব সংঘবদ্ধ হয়ে গঠন করে ফেলিসিটি পার্টি এবং সংস্কারবাদীরা গড়ে তোলে জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি)। পার্লামেন্টে রাফাহ পার্টির ৪৮ জন ফেলিসিটি পার্টিতে এবং ৫৩ জন একে পার্টিতে যোগ দেন। ইস্তাম্বুলের মেয়র রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান একে পার্টির নেতা নির্বাচিত হন।
একে পার্টি নতুন উদ্যেমে যাত্রা শুরু করে। তারা তুর্কী সেক্যুলার নীতি, পাশ্চাত্যমুখী পররাষ্ট্র নীতি, ইইউ ও ন্যাটো জোটে অংশগ্রহণ ও মুক্তবাজার নীতি অনুসরণের ঘোষণা দেয়। তাদের নতুন কৌশল বেশ কাজ দিল। ১৯৯৯ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলটি ৩৪.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। তারা পার্লামেন্টের ৫৫০টি আসনের মধ্যে ৩৬৩টি আসন লাভ করে যা দুই-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি। আরবাকানের ফেলিসিটি পার্টি মাত্র ২.৫ শতাংশ ভোট পায়। এ সময় বিরোধী দলের সম্মিলিত ভোট ছিল প্রায় ৫৩.৪ শতাংশ। তারা এরদোগান সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে আন্দোলন করলেও ২০০২ সালে নির্বঅচনে জনগণ পুনরায় একে পার্টিকে বিজয়ী করে। বিরোধী দলের সম্মিলিত ভোট করে দাঁড়ায় ১৪.৬ শতাংশে। নতুন ও তরুণ ভোটার, গরীব জনগোষ্ঠী ও কুর্দীরা একে পার্টিকে ভোট দেয়।
নোট: লেখাটি ‘কামারুজ্জামানের চিঠি এবং জামায়াতের সংস্কার প্রসঙ্গ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া।
No comments