জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা: সাক্ষ্যগ্রহণকে কেন্দ্র করে বিশেষ আদালতে তুমুল হট্টগোল
পুরান ঢাকার বকশিবাজার বিশেষ আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ার সময় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে শুভেচ্ছা জানান বেগম খালেদা জিয়া : নয়া দিগন্ত |
জিয়া
চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় নিয়মবহির্ভূতভাবে সাক্ষ্যগ্রহণকে কেন্দ্র করে
আদালতে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে তুমুল হট্টগোল ও বাগি¦তণ্ডার ঘটনা
ঘটেছে। একপর্যায়ে উত্তেজিত আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থান নেন। খালেদা জিয়ার
আইনজীবীদের যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে এক সাক্ষীর সাক্ষ্য পুনর্লিখন (রি-রাইট)
করেন বিচারক। এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা
জিয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার জিয়া চ্যারিটেবল মামলার তিনজন সাক্ষীকে জেরা
করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। তারা হলেন পূবালী ব্যাংক কর্মকর্তা এইচ এম
ইসমাঈল, জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা মকবুল আহমেদ ও ফাহমিদা রহমান। এ ছাড়া এই
মামলার অষ্টম সাক্ষী সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ হাফিজুর রহমানের
সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় এ দিন। এরপর আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর মামলার পরবর্তী
তারিখ ধার্য করেন বিচারক আবু আহমেদ জমাদার।
মামলাটির বিচারকাজ চলছে ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ আদালতে। রাজধানীর বকশিবাজারে কারা অধিদফতরের মাঠে স্থাপিত এই বিশেষ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে মামলাটি পরিচালনা করছেন বিচারক আবু আহমেদ জমাদার। দুদকের দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাও চলছে একই আদালতে।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বিচারকাজ শুরু হয়। সাক্ষী পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তা এইচ এম ইসমাঈলকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে জেরা করেন সিনিয়র আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক খান ও অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম। তার জেরা চলাকালে বেলা ১১টায় আদালতে আসেন বেগম খালেদা জিয়া। বিচার চলাকালে প্রায় তিন ঘণ্টা আদালতে উপস্থিত ছিলেন তিনি। তার উপস্থিতিতেই বাকি সাক্ষীদের জেরা ও জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। ক্রিম কালারের প্রিন্টের একটি শাড়ি পরে আদালতে এসেছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। বিচার চলাকালে তাকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল।
খালেদা জিয়া আদালতে যাওয়ায় কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আদালতের ভেতরে ও বাইরে পুলিশ ও র্যাবের কয়েক শ’ সদস্য এই দায়িত্বে ছিলেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনকে তথ্য প্রদানকারী ব্যাংক কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জব্দ তালিকার একটি বিবরণ উপস্থাপন করতে শুরু করলে তা নিয়মবহির্ভূত বলে শুরুতে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। কিন্তু বিচারক তার বক্তব্য আমলে না নিয়ে জবানবন্দী গ্রহণ করে যাচ্ছিলেন। পরে তাতে আরেক দফা আপত্তি জানান, সিনিয়র আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক খান। কিন্তু তাতেও কোনো ফল আসেনি। উভয়পক্ষের আইনজীবীরা এ সময় তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হন। তাদের মধ্যে তুমুল হট্টগোল ও বাগি¦তণ্ডা শুরু হয়। এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন মাইক হাতে নিয়ে আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, ১/১১-র সময় ক্যাঙারু কোর্টে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবীরা যেভাবে আচরণ করেছেন, এখানেও তারা সেভাবে আচরণ করছেন। এটা কোনো ক্যাঙারু কোর্ট নয়, এটা সাংবিধানিক কোর্ট। আমরা আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই না। আমি ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের বিচারপ্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। আমি দুই ঘণ্টা ধরে বিচারকাজ দেখছি। এখানে নিয়মানুযায়ী কিছু হচ্ছে না। জব্দ তালিকার একজন সাক্ষী কী কী ডকুমেন্ট দিয়েছেন, কেবল তার তালিকাটুকুই তিনি বলবেন। তার অন্য কোনো কথা গ্রহণযোগ্য হবে না।
এরপর ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন আদালত ত্যাগ করে চলে যাওয়ার কথা বলে উল্লেখ করেন, এখানে আইন অনুযায়ী বিচার হচ্ছে না। যদি আইন অনুযায়ী বিচার না হয়, তাহলে আমরা আইনজীবীরা এবং বেগম খালেদা জিয়া এই বিচারপ্রক্রিয়া বর্জন করব, আদালত ছেড়ে চলে যাবো। তিনি সাক্ষী হাফিজুর রহমানের দেয়া বিভিন্ন তথ্য বাদ দিতে দাবি জানান। ডিফেন্স আইনজীবীদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক সাক্ষী হাফিজুর রহমানের সাক্ষ্য পুনর্লিখন করেন।
পূবালী ব্যাংক কর্মকর্তা এইচ এম ইসমাঈলকে আইনজীবী আমিনুল ইসলামের করা জেরার অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা হলো :
প্রশ্ন : দুদককে কাগজপত্র দেয়ার নির্দেশ কত তারিখে পেয়েছেন?
উত্তর : ২৫-৯-২০১১ইং তারিখে।
প্রশ্ন : আপনি দুদকের কোনো চিঠি পেয়েছেন?
উত্তর : আমার কাছে কোনো চিঠি আসেনি, চিঠি এসেছে ব্যাংকের কাছে।
প্রশ্ন : ব্যাংকের কাছে আসা দুদকের চিঠি কি আপনি দেখেছেন কখনো?
উত্তর : ২৫-৯-২০১১ইং তারিখে দেখেছি।
প্রশ্ন : আপনার কাছে কি এই মুহূর্তে চিঠিটা আছে?
উত্তর : নাই।
প্রশ্ন : তার মানে দুদকের চিঠিটা আপনি এখন আদালতে দেখাতে পারবেন না।
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ওই চিঠিতে কী লেখা তা-ও বলতে পারবেন না।
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি তখন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন। আপনি তত দিনে ব্যাংক বিষয়ে বিভিন্ন ট্রেনিং নিয়েছেন। ব্যাংকের কোনো ডকুমেন্ট কাউকে দিতে হলে সার্টিফাইড কপি দেয়ার নিয়ম আছে, অরিজিনাল কপি দেয়ার নিয়ম নাই। জানেন কি?
উত্তর : জানি।
প্রশ্ন : মূল কাগজগুলো আপনি নিজেই নিয়ে গেছেন দুদক অফিসে?
উত্তর : জি, আমি নিজেই নিয়ে গেছি।
প্রশ্ন : এর আগে দুদকের কোনো কর্মকর্তা ইন্সপেকশনের জন্য ব্যাংকে এসেছিল?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি যখন ডকুমেন্ট নিয়ে গেলেন, তখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আপনাকে একটা অফিস আদেশ দিয়েছিল, সেটা বের করুন।
উত্তর : এই মুহূর্তে নেই। (পরে আইনজীবীদের সহায়তায় বের করা হয়।)
প্রশ্ন : এটা তো অফিস আদেশ?
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : অফিস আদেশ ‘পূবালী/নয়াপল্টন/বিবিধ/৬২৩৭/২০১১’, তারিখ : ২১-৯-১১ এই স্মারকবলে আপনি ডকুমেন্টগুলোর মূল কপি দুদক কার্যালয়ে নিয়ে যান?
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : আপনি যে চিঠি নিয়ে যান, এটা কি সেই চিঠি (চিঠির কপি দেখিয়ে)?
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : এই চিঠির নিচে প্রাপ্তি স্বীকারের জন্য অনুরোধ করা আছে এবং কার্য সম্পাদনের পর মূল কপি ফেরত দেয়ার জন্য বলা আছে?
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : এই স্মারক নম্বরে দুদকের কোনো কর্মকর্তার প্রাপ্তি স্বীকার আছে?
উত্তর : নাই।
প্রশ্ন : ডকুমেন্টগুলোর মূল কপি রাখা হয়েছে বা ফেরত দেয়া হয়েছে, সেটাও লেখা নাই?
উত্তর : নাই।
প্রশ্ন : এই অফিস আদেশে আপনার (এইচ এম ইসমাঈল) কোনো নাম উল্লেখ আছে?
উত্তর : না, নাই।
প্রশ্ন : এই আদেশে ব্যাংক কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরের নিচে কোনো তারিখ বা সিলমোহর আছে?
উত্তর : না, নাই।
প্রশ্ন : এই চিঠিতে একটি সঞ্চয়ী ও একটি চলতি হিসাবের কথা আছে। দু’টিতেই হিসাবের পূর্ণ ডিজিটগুলো নাই।
উত্তর : না, নাই।
প্রশ্ন : এই আদেশে দুদকের একটি পত্রের কথা উল্লেখ আছে? পত্রে দুদক কী কী কাগজ চেয়েছে তার কোনো উল্লেখ আপনাকে দেয়া অফিস আদেশে নাই?
উত্তর : না, নাই।
প্রশ্ন : এই কাগজগুলো আপনি যখন দুদক অফিসে নিয়ে যান, তখন বা তার আগে আপনি কি সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টধারীদের জানিয়েছিলেন বা তাদের চিঠি দিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : কাগজ সরবরাহের সময় সেশন জজের আদেশের কথা বলেছেন জবানবন্দীতে। সেই আদেশের সাথে দুদকের বিবরণ ছিল। সেই বিবরণের ‘ছ’ ক্রমিকে আছে যে, চেকের মূল কপি ও ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ‘রেকর্ডগুলো’ দিতে হবে। এই ‘রেকর্ডগুলো’ বলতে কী চেয়েছিল দুদক, তা পরিষ্কার করতে কোনো চিঠি পেয়েছিলেন?
উত্তর : না, পাইনি।
প্রশ্ন : চিঠিতে ইন্সপেকশন করা, কোনো ডকুমেন্ট উপস্থাপন করা বা কোনো রেকর্ডের সার্টিফাইড কপি দেয়ার কথা স্পষ্ট করে বলা নেই?
উত্তর : না, নাই।
প্রশ্ন : আদেশের শেষ লাইনে বলা আছে, বর্ণিত আলামত জব্দ করার অনুমতি দেয়া হলো।
উত্তর : আছে।
প্রশ্ন : এই অফিস আদেশ বেআইনি ছিল। আপনারা বেআইনি আদেশ বলে বেআইনি কাজ করেছেন এবং গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করেছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
এ সময় আইনজীবী বলেন, শতভাগ সত্য।
প্রশ্ন : জব্দকৃত রেকর্ডের মধ্যে প্রদর্শনী ৫-এ সঞ্চয়ী হিসাব হলো- ২৪৩৮১০১০৪৪৭৪। কিন্তু আপনার অফিস আদেশে হিসাব নম্বর হলো- ৪৪০৭। অর্থাৎ জব্দতালিকার হিসাব নম্বর ও আপনার অফিস আদেশের হিসাব নম্বর এক নয়।
উত্তর : সত্য নয়।
এ সময় আইনজীবী বলেন, সত্য নয়তো কী? এটা তো রেকর্ডে আছে।
প্রশ্ন : আপনি দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অবৈধ আদেশে ভীত হয়ে ব্যাংকের গ্রাহকের গচ্ছিত ডকুমেন্ট ও তথ্য গ্রাহকের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করে দুদককে সরবরাহ করেছেন।
উত্তর : ইহা সত্য নহে।
প্রশ্ন : গ্রাহক সম্পর্কে মিথ্যা ও ভুল তথ্য সরবরাহ করেছেন।
উত্তর : ইহা সত্য নহে।
প্রশ্ন : এই হিসাব নম্বরের তথ্য সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের অনুমতি ছাড়া দেয়ার আইনগত অধিকার আপনার ছিল না।
উত্তর : ইহা সত্য নহে।
প্রশ্ন : আপনি কোনো কারণ ছাড়া সংশ্লিষ্ট হিসাবের তথ্য দুদককে সরবরাহ করেছেন।
উত্তর : ইহা সত্য নহে।
প্রশ্ন : আপনি যে অফিস আদেশের বলে দুদককে তথ্য দিয়েছেন সেই আদেশে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন দু’জন কর্মকর্তার অনুমোদন ছিল। আজ যে আপনি সাক্ষী দিতে এসেছেন, এখন কি তাদের অনুমতি নিয়েছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি অসত্য স্যা দিয়েছেন।
উত্তর : ইহা সত্য নহে।
এ দিকে আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার অনুলিপি না পাওয়ার কথা বলে সময়ের আবেদন করলে বিচারক তা নথিভুক্ত করে রাখেন। এ ছাড়া বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন বলে জানানো হলে বিচারক বলেন, বেগম খালেদা জিয়া দেশের বাইরে যেতে পারেন। তবে তার পক্ষে আইনজীবীরা প্রতিনিধিত্ব করবেন।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে জমি কেনা প্রশ্নে অবৈধভাবে ৬ কোটি ৫২ লাখ ৭ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি। মামলায় ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
মামলাটির বিচারকাজ চলছে ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ আদালতে। রাজধানীর বকশিবাজারে কারা অধিদফতরের মাঠে স্থাপিত এই বিশেষ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে মামলাটি পরিচালনা করছেন বিচারক আবু আহমেদ জমাদার। দুদকের দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাও চলছে একই আদালতে।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বিচারকাজ শুরু হয়। সাক্ষী পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তা এইচ এম ইসমাঈলকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে জেরা করেন সিনিয়র আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক খান ও অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম। তার জেরা চলাকালে বেলা ১১টায় আদালতে আসেন বেগম খালেদা জিয়া। বিচার চলাকালে প্রায় তিন ঘণ্টা আদালতে উপস্থিত ছিলেন তিনি। তার উপস্থিতিতেই বাকি সাক্ষীদের জেরা ও জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। ক্রিম কালারের প্রিন্টের একটি শাড়ি পরে আদালতে এসেছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। বিচার চলাকালে তাকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল।
খালেদা জিয়া আদালতে যাওয়ায় কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আদালতের ভেতরে ও বাইরে পুলিশ ও র্যাবের কয়েক শ’ সদস্য এই দায়িত্বে ছিলেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনকে তথ্য প্রদানকারী ব্যাংক কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জব্দ তালিকার একটি বিবরণ উপস্থাপন করতে শুরু করলে তা নিয়মবহির্ভূত বলে শুরুতে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। কিন্তু বিচারক তার বক্তব্য আমলে না নিয়ে জবানবন্দী গ্রহণ করে যাচ্ছিলেন। পরে তাতে আরেক দফা আপত্তি জানান, সিনিয়র আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক খান। কিন্তু তাতেও কোনো ফল আসেনি। উভয়পক্ষের আইনজীবীরা এ সময় তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হন। তাদের মধ্যে তুমুল হট্টগোল ও বাগি¦তণ্ডা শুরু হয়। এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন মাইক হাতে নিয়ে আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, ১/১১-র সময় ক্যাঙারু কোর্টে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবীরা যেভাবে আচরণ করেছেন, এখানেও তারা সেভাবে আচরণ করছেন। এটা কোনো ক্যাঙারু কোর্ট নয়, এটা সাংবিধানিক কোর্ট। আমরা আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই না। আমি ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের বিচারপ্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। আমি দুই ঘণ্টা ধরে বিচারকাজ দেখছি। এখানে নিয়মানুযায়ী কিছু হচ্ছে না। জব্দ তালিকার একজন সাক্ষী কী কী ডকুমেন্ট দিয়েছেন, কেবল তার তালিকাটুকুই তিনি বলবেন। তার অন্য কোনো কথা গ্রহণযোগ্য হবে না।
এরপর ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন আদালত ত্যাগ করে চলে যাওয়ার কথা বলে উল্লেখ করেন, এখানে আইন অনুযায়ী বিচার হচ্ছে না। যদি আইন অনুযায়ী বিচার না হয়, তাহলে আমরা আইনজীবীরা এবং বেগম খালেদা জিয়া এই বিচারপ্রক্রিয়া বর্জন করব, আদালত ছেড়ে চলে যাবো। তিনি সাক্ষী হাফিজুর রহমানের দেয়া বিভিন্ন তথ্য বাদ দিতে দাবি জানান। ডিফেন্স আইনজীবীদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক সাক্ষী হাফিজুর রহমানের সাক্ষ্য পুনর্লিখন করেন।
পূবালী ব্যাংক কর্মকর্তা এইচ এম ইসমাঈলকে আইনজীবী আমিনুল ইসলামের করা জেরার অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা হলো :
প্রশ্ন : দুদককে কাগজপত্র দেয়ার নির্দেশ কত তারিখে পেয়েছেন?
উত্তর : ২৫-৯-২০১১ইং তারিখে।
প্রশ্ন : আপনি দুদকের কোনো চিঠি পেয়েছেন?
উত্তর : আমার কাছে কোনো চিঠি আসেনি, চিঠি এসেছে ব্যাংকের কাছে।
প্রশ্ন : ব্যাংকের কাছে আসা দুদকের চিঠি কি আপনি দেখেছেন কখনো?
উত্তর : ২৫-৯-২০১১ইং তারিখে দেখেছি।
প্রশ্ন : আপনার কাছে কি এই মুহূর্তে চিঠিটা আছে?
উত্তর : নাই।
প্রশ্ন : তার মানে দুদকের চিঠিটা আপনি এখন আদালতে দেখাতে পারবেন না।
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ওই চিঠিতে কী লেখা তা-ও বলতে পারবেন না।
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি তখন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন। আপনি তত দিনে ব্যাংক বিষয়ে বিভিন্ন ট্রেনিং নিয়েছেন। ব্যাংকের কোনো ডকুমেন্ট কাউকে দিতে হলে সার্টিফাইড কপি দেয়ার নিয়ম আছে, অরিজিনাল কপি দেয়ার নিয়ম নাই। জানেন কি?
উত্তর : জানি।
প্রশ্ন : মূল কাগজগুলো আপনি নিজেই নিয়ে গেছেন দুদক অফিসে?
উত্তর : জি, আমি নিজেই নিয়ে গেছি।
প্রশ্ন : এর আগে দুদকের কোনো কর্মকর্তা ইন্সপেকশনের জন্য ব্যাংকে এসেছিল?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি যখন ডকুমেন্ট নিয়ে গেলেন, তখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আপনাকে একটা অফিস আদেশ দিয়েছিল, সেটা বের করুন।
উত্তর : এই মুহূর্তে নেই। (পরে আইনজীবীদের সহায়তায় বের করা হয়।)
প্রশ্ন : এটা তো অফিস আদেশ?
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : অফিস আদেশ ‘পূবালী/নয়াপল্টন/বিবিধ/৬২৩৭/২০১১’, তারিখ : ২১-৯-১১ এই স্মারকবলে আপনি ডকুমেন্টগুলোর মূল কপি দুদক কার্যালয়ে নিয়ে যান?
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : আপনি যে চিঠি নিয়ে যান, এটা কি সেই চিঠি (চিঠির কপি দেখিয়ে)?
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : এই চিঠির নিচে প্রাপ্তি স্বীকারের জন্য অনুরোধ করা আছে এবং কার্য সম্পাদনের পর মূল কপি ফেরত দেয়ার জন্য বলা আছে?
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : এই স্মারক নম্বরে দুদকের কোনো কর্মকর্তার প্রাপ্তি স্বীকার আছে?
উত্তর : নাই।
প্রশ্ন : ডকুমেন্টগুলোর মূল কপি রাখা হয়েছে বা ফেরত দেয়া হয়েছে, সেটাও লেখা নাই?
উত্তর : নাই।
প্রশ্ন : এই অফিস আদেশে আপনার (এইচ এম ইসমাঈল) কোনো নাম উল্লেখ আছে?
উত্তর : না, নাই।
প্রশ্ন : এই আদেশে ব্যাংক কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরের নিচে কোনো তারিখ বা সিলমোহর আছে?
উত্তর : না, নাই।
প্রশ্ন : এই চিঠিতে একটি সঞ্চয়ী ও একটি চলতি হিসাবের কথা আছে। দু’টিতেই হিসাবের পূর্ণ ডিজিটগুলো নাই।
উত্তর : না, নাই।
প্রশ্ন : এই আদেশে দুদকের একটি পত্রের কথা উল্লেখ আছে? পত্রে দুদক কী কী কাগজ চেয়েছে তার কোনো উল্লেখ আপনাকে দেয়া অফিস আদেশে নাই?
উত্তর : না, নাই।
প্রশ্ন : এই কাগজগুলো আপনি যখন দুদক অফিসে নিয়ে যান, তখন বা তার আগে আপনি কি সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টধারীদের জানিয়েছিলেন বা তাদের চিঠি দিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : কাগজ সরবরাহের সময় সেশন জজের আদেশের কথা বলেছেন জবানবন্দীতে। সেই আদেশের সাথে দুদকের বিবরণ ছিল। সেই বিবরণের ‘ছ’ ক্রমিকে আছে যে, চেকের মূল কপি ও ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ‘রেকর্ডগুলো’ দিতে হবে। এই ‘রেকর্ডগুলো’ বলতে কী চেয়েছিল দুদক, তা পরিষ্কার করতে কোনো চিঠি পেয়েছিলেন?
উত্তর : না, পাইনি।
প্রশ্ন : চিঠিতে ইন্সপেকশন করা, কোনো ডকুমেন্ট উপস্থাপন করা বা কোনো রেকর্ডের সার্টিফাইড কপি দেয়ার কথা স্পষ্ট করে বলা নেই?
উত্তর : না, নাই।
প্রশ্ন : আদেশের শেষ লাইনে বলা আছে, বর্ণিত আলামত জব্দ করার অনুমতি দেয়া হলো।
উত্তর : আছে।
প্রশ্ন : এই অফিস আদেশ বেআইনি ছিল। আপনারা বেআইনি আদেশ বলে বেআইনি কাজ করেছেন এবং গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করেছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
এ সময় আইনজীবী বলেন, শতভাগ সত্য।
প্রশ্ন : জব্দকৃত রেকর্ডের মধ্যে প্রদর্শনী ৫-এ সঞ্চয়ী হিসাব হলো- ২৪৩৮১০১০৪৪৭৪। কিন্তু আপনার অফিস আদেশে হিসাব নম্বর হলো- ৪৪০৭। অর্থাৎ জব্দতালিকার হিসাব নম্বর ও আপনার অফিস আদেশের হিসাব নম্বর এক নয়।
উত্তর : সত্য নয়।
এ সময় আইনজীবী বলেন, সত্য নয়তো কী? এটা তো রেকর্ডে আছে।
প্রশ্ন : আপনি দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অবৈধ আদেশে ভীত হয়ে ব্যাংকের গ্রাহকের গচ্ছিত ডকুমেন্ট ও তথ্য গ্রাহকের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করে দুদককে সরবরাহ করেছেন।
উত্তর : ইহা সত্য নহে।
প্রশ্ন : গ্রাহক সম্পর্কে মিথ্যা ও ভুল তথ্য সরবরাহ করেছেন।
উত্তর : ইহা সত্য নহে।
প্রশ্ন : এই হিসাব নম্বরের তথ্য সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের অনুমতি ছাড়া দেয়ার আইনগত অধিকার আপনার ছিল না।
উত্তর : ইহা সত্য নহে।
প্রশ্ন : আপনি কোনো কারণ ছাড়া সংশ্লিষ্ট হিসাবের তথ্য দুদককে সরবরাহ করেছেন।
উত্তর : ইহা সত্য নহে।
প্রশ্ন : আপনি যে অফিস আদেশের বলে দুদককে তথ্য দিয়েছেন সেই আদেশে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন দু’জন কর্মকর্তার অনুমোদন ছিল। আজ যে আপনি সাক্ষী দিতে এসেছেন, এখন কি তাদের অনুমতি নিয়েছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি অসত্য স্যা দিয়েছেন।
উত্তর : ইহা সত্য নহে।
এ দিকে আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার অনুলিপি না পাওয়ার কথা বলে সময়ের আবেদন করলে বিচারক তা নথিভুক্ত করে রাখেন। এ ছাড়া বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন বলে জানানো হলে বিচারক বলেন, বেগম খালেদা জিয়া দেশের বাইরে যেতে পারেন। তবে তার পক্ষে আইনজীবীরা প্রতিনিধিত্ব করবেন।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে জমি কেনা প্রশ্নে অবৈধভাবে ৬ কোটি ৫২ লাখ ৭ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি। মামলায় ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
No comments