সুখের লাগি by অভীক সোবহান
মাত্র দু-তিন মাসের ঘটনা পরম্পরায় এই তেতাল্লিশে এসে মানুষ হিসেবে নিজেকে এত তুচ্ছ মনে হবে, তা ভুলেও কখনো ভাবিনি। আর ভাববই বা কেন? আমি তো মিস্টার হাইড নই, অথচ আজ নিজের কাছে নিজের আইডেনটিটি প্রশ্নবিদ্ধ। জটিল নগরজীবনে সচেতনভাবেই দ্বৈত সত্তার ওপর ভর করে বেঁচে থাকতে হয়। নাহ্, একে হিপোক্রেসি বলা মুশকিল, ঘরে-বাইরে নানা রঙের মুখোশ পরে সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা কে না করছে? এ হলো আধুনিক মানুষের কপালের ফের! সে যাই হোক, রীতিমতো সপ্তাহ হয়ে গেল, ডক্টর জেকিলের মতো এক অপরাধবোধ আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। আফসোস, কগনিটিভ সায়েন্সের ছাত্র হওয়ায় অন্যদের মতো কারও ওপর দায় চাপিয়ে হালকাও হতে পারছি না। ঘটনাটার শুরু পাশের ফ্ল্যাটের রাকিব সাহেবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। যদিও তার এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় আমার কোনো হাত নেই। রাকিব গেল সপ্তাহে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের দু-পরিবারের মধ্যে কোনো মনোমালিন্য ছিল না, অথচ কী এক অজানা অপরাধবোধ আমাকে ঘিরে ধরেছে। আমার পেশেন্টরা প্রায়ই এ ধরনের মানসিক জটিলতা নিয়ে উপস্থিত হন, খামাখাই ভাবেন চারপাশে ঘটে যাওয়া সব অনর্থের জন্য তাঁরাই দায়ী। বলে রাখা ভালো, পেশায় আমি চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। যা বলছিলাম, পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হলে কয়েক মাস আগে যেতে হবে। রাকিব রহমান আমার থেকে বয়সে বছর দশেকের ছোট হবে। কী এক রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে ছিল।
মার্কেটিংয়ের চাকরি, প্লট বিক্রির ব্যাপার-স্যাপার। কথায় কথায় জমি কেনার প্রস্তাবও দিয়েছিল একবার। ওসব চাকরিতে ইনসেনটিভ, পার্সেন্টেজ ইত্যাদি বিষয় থাকে, তাই আয়-রোজগার নেহাত মন্দ ছিল না। সে বলেছিল, হ্যাঁ তার কাছ থেকেই জানা, দেশের বাড়ি ময়মনসিংহের কোনো এক গ্রামে। গ্রামে হলে কী হবে, তার বাবা বেশ পয়সাওয়ালা আর প্রভাবশালী ব্যক্তি। বোনদের ভালো ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে। তার মাকে গ্রামের সবাই নাকি দারোগা নামে ডাকে, এমন ডাকসাইটে মহিলা! আমাদের এ এলাকায় আসার আগে কল্যাণপুরে কলিগদের সঙ্গে মেসে থাকত রাকিব। বিয়ের পর আজিমপুর আসা, ছয়তলা অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলার দুটি মুখোমুখি ফ্ল্যাটে আমরা থাকতাম। আমার ফ্ল্যাটটা কেনা, ওরা ভাড়া থাকত। রাকিবেরা এ ফ্ল্যাটে উঠেছিল মাস চারেক আগে। সব মিলিয়ে তার সঙ্গে আমার কম হলেও বিশ-বাইশবার দেখা হয়েছে। এই নগরে আমরা যখন ব্যক্তিগত ধান্দায় ব্যতিব্যস্ত, তখন বহুতল বাসা-বাড়িতে স্বল্প সময়ে এতবার দেখা কম নয়। আংশিক হলেও এর কারণটা আমি নিজে; আর আজ কড়ায়গন্ডায় তার খেসারত দিচ্ছি। রাকিবেরা আমার বাসায় কখনো আসেনি, তবে দারুণ মিশুক ছিল। আগ বাড়িয়ে নিজেই এমনভাবে কথা বলত যে কার সাধ্য তাকে উপেক্ষা করে। বেশির ভাগ সময়ই দেখা হতো সিঁড়িতে, অফিস যাওয়ার সময়। ওখানে দাঁড়িয়েই যত কথা। আমি মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার সময় সাধারণত বাসা থেকে বের হতো রাকিব। হাতে সময় অল্প থাকলেও প্রায়ই চার-পাঁচ মিনিট চলত সে আলাপ। আর হ্যাঁ, বিষয়টা পারস্পরিক কথোপকথন বলা যাবে না, মূলত সে একতরফা কথা বলে যেত। পেশাগত কারণে কথা না বলে ব্লাইন্ডলি শুনে যাওয়ায় আমি অভ্যস্ত, ফ্রি অ্যাসোসিয়েশনের সময় রোগীদের ক্ষেত্রে এটা সাইকিয়াট্রিস্টদের প্রায়ই করতে হয়। তবে রাকিবের গল্পে একটি বিষয় বারবার এসেছিল—সেটা তার এমএ-পড়ুয়া স্ত্রীর রূপ বর্ণনা আর আটপৌরে কাজের গুণকীর্তন। নববিবাহিত পুরুষদের বউকে নিয়ে এমন অবসেশন অস্বাভাবিক কিছু নয়,
এ আমি হরহামেশাই দেখেছি, কিন্তু বিপত্তিটা ঘটল তার নয়, আমার! হঠাৎ একসময় লক্ষ করলাম, রাকিবের সঙ্গে দেখা হলে আমি ওই বিশেষ বিষয়ে বলা কথাগুলোর জন্যই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। বিশেষত, না চাইতেই সে বিবাহিত জীবন যে কত মোহময় সে কথা জানাত। ওদিকে আমি রোগীদের মানসিক যন্ত্রণার কথা শুনে শুনে খানিকটা ক্লান্তই ছিলাম। তাই নিজের কথায় নিজেই হো হো করে হেসে ওঠা রাকিবের উচ্ছ্বাস, তার সুখী সুখী মুখখানা; নিঃসন্দেহে উপভোগ করতাম। যে কথা বলছিলাম, স্বল্প সময়ের সেসব আলাপচারিতার বড় অংশজুড়েই ছিল তার স্ত্রী—সোনালির কথা। খানিকটা রক্ষণশীল, কিছুটা পোড় খাওয়া বনেদি ঘরে বেড়ে ওঠা মেয়েরা যেমন চৌকস হয়, সোনালি ঠিক তাই। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এই শহুরে আমরা এমন নারীদের যথেষ্ট এনলাইটেড ভাবি না। তাই প্রেমিকা বা পাত্রী খোঁজার সময় এরা দ্বিতীয় সারিতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত বিয়ে করি চাকরিজীবী, ঘরকন্নায় চলনসই কোনো নারীকে। তবু গণ্ডির বাইরে সোনালিরা গথিক আর্টের রহস্যময়, কিছুটা ভয়সঞ্চারী রমণীদের মতো মর্ষকাম নিয়ে তাকিয়ে আছে বলে ভুল হয়। তাই কৌতূহলের শেষ থাকে না, রাকিব যখন জানায়, সোনালির রান্নার দারুণ হাতের পাশাপাশি পতিভক্তিও প্রচণ্ড, যা নাকি টিভি সিরিয়ালের বউদেরও হার মানায়; তবুও সবকিছু ছাপিয়ে আমার কানে তার প্রথম দিন বলা কথাগুলোই আজও বেজে যায়, ‘বড় ভাই, আপনি মনের ডাক্তার, আপনারে বলা যায়, সোনালি খানিক শ্যামলা হলে কী হবে, পরির মতো সুন্দর! আল্লাহ তাআলা যে তার সঙ্গে আমার ঠিক করে রাখছিল, এ আমার সৌভাগ্য।’ সোনালি মেয়েটা বাসা থেকে খুব একটা বের হতো না। যত দূর জেনেছিলাম, মাস্টার্সের চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিল, কলেজে খুব একটা যেত না। তা ছাড়া আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢাকা থাকায় প্রথম দিকে তাকে লক্ষই করিনি। ঢাকা শহরের এসব অ্যাপার্টমেন্টে কত জনই তো ওঠা-নামা করে। বিল্ডিংটায় লিফটের ব্যবস্থা নেই, থাকলে অবশ্য বাক্সে বন্দী মুহূর্তগুলো মরা মাছের মতো চোখ করে কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো সবাইকে—যেন একাই আছি। কিছুদিন যেতে বুঝে নিয়েছিলাম এটাই রাকিবের সেই ‘পারফেক্ট ওয়াইফ’। এর মধ্যে একেবারে পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হিসেবে হয়তো সোনালিদের বাসায় যাওয়া হতো।
কিন্তু আমার স্ত্রী রুবিনা নিজের মতো থাকতে ভালোবাসে। নিজের স্বামী-সন্তান, বড়জোর অফিসের দু-চারজন অন্তরঙ্গ সহকর্মী নিয়েই তার জগৎ। আমার বিশ্বাস, ওর যেসব সহকর্মীর সঙ্গে আমার ওঠা-বসা আছে, সেটাও হয়তো তাদের স্বার্থেই নতুবা রুবিনার প্রয়োজনে। কর্মক্ষেত্রে এমন কৌশলগত সম্পর্ক তো কিছু থাকেই। আর রুবিনা ভীষণ ব্যস্তও বটে, সচরাচর এনজিও কর্মীদের যে হাল হয় আরিক। তাই যোগাযোগটা রাকিব সাহেব আর আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল। এক জুমার দিন তার সঙ্গে গলির মুখে দেখা। কথায় কথায় সোনালির প্রসঙ্গ আসতেই সুযোগমতো বলেই ফেললাম, ‘আপনার স্ত্রীর মতো একজন গুণবতী প্রতিবেশী আছে আমাদের, তো ভাবিকে নিয়ে বাসায় আসুন না, চায়ের নিমন্ত্রণ রইল।’ গেলে রুবিনাও খুব খুশি হবে—এ কথাও যোগ করে দিলাম। মিথ্যা কিছু বলিনি, রুবিনা খানিক আত্মকেন্দ্রিক হলেও অসামাজিক তো নয়ই, বরং অতিথিপরায়ণ। তবে নিজ থেকে আগবাড়িয়ে কোথাও যেতে চায় না, অন্যের বিষয়ে কৌতূহলও খুব কম। আমার কথা শুনেই রাকিব বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘আমি কয় দিন আগেও সোনুকে বলছিলাম, চল ভাইদের বাসায় যাই। কিন্তু ও একটু বেশিই লাজুক; আর জানেন তো খুব পর্দা করে। তবে নিজে থেকেই বলেছে, মাস্টার্স ফাইনালটা হয়ে গেলে আপনাদের একদিন দাওয়াত করে খাওয়াবে, তখন কিন্তু আসতেই হবে। সত্যি বড় ভাই ওর হাতের কই-পাতুড়ি আর গরুভুনা না খেলে কিন্তু মিস করবেন।’ এসব কথা বলার সময় ভদ্রলোকের চোখে রাজ্যের স্বপ্ন চকমকিয়ে উঠেছিল। সে চোখ এত স্বচ্ছ, তা পড়তে মনোবিজ্ঞানীদের মতো মাইন্ড রিডিং-ফিডিং জানার প্রয়োজন হয় না। রাকিব-সোনালি দম্পতির জীবন বাদশাহি মখমলের বিছানার মতো মনোরম আর সুগিন্ধযুক্ত,
তা যে কেউ ঠাওর করতে পারত। এভাবেই চলে গেল প্রথম আড়াই কী তিন মাস। স্বাভাবিক কৌতূহল নাকি শহুরে সতর্কতা জানি না, তবে কানে শোনা অথচ চোখে না দেখা সোনালি ওরফে সোনু ভাবিকে দেখার জন্য পাশের বাসার সদর দরজার দিকে নজর রাখলাম। বিশেষত রাকিব আর আমি যেসব দিন একই সঙ্গে বাসা থেকে বের হতাম, কুশল বিনিময়ের ফাঁকে ওদের দরজার দিকে কায়দা করে তাকিয়েছি। লাভ হয়নি, দিনের বেলায়ও এসব বাড়ির সিঁড়িঘর যথেষ্ট আলোহীন। তবে এটা নিশ্চিত যে স্বামী সিঁড়ি দিয়ে না নেমে যাওয়া পর্যন্ত সোনালি দরজা আংশিক ভেজিয়ে দাঁড়িয়েই থাকত। তাই রাকিব সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামার পথে একাধিকবার অদৃশ্য স্ত্রীর উদ্দেশে বলত, ‘সোনু, সাবধানে থেকো, দরজাটা ঠিক করে আটকায় রােখা, অফিসে গিয়ে ফোন দেব’ ইত্যাদি ইত্যাদি। গেল এক মাসে আমি যা করেছি তা সচেতনভাবে করিনি বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, আবার খুব পরিকল্পিতও নয়। হয়তো মিডল-এজ পাড়ি দেওয়ার লক্ষণ। পুরোপুরি লিবিডো নিয়ন্ত্রিত বলাটা নিজের প্রতি অবিচার হবে, কেননা সভ্য-সামাজিক মানুষের মনটাই শক্তিশালী, প্রবৃত্তি নয়। রাকিব যতটা বলেছে হয়তো মেয়েটা তেমন ডানাকাটা পরি না হলেও যথেষ্ট লাবণ্যময়ী আর তথাকথিত সাংসারিক খুঁটিনাটি কাজে জবরদস্ত, সেটা সত্য। ষোলোকলায় পূর্ণ হয়তো সে নয়, তবে পঞ্চমীর চাঁদ িক কম মোহময়! মোটিভেশন যাই হোক,
আমি গত এক মাস প্রায় দিনই প্রতিবেশী পরিবারটির ভেসে আসা অস্পষ্ট কথোপকথন অনুসরণ করে ঘর থেকে বেরিয়েছি। উদ্দেশ্য সহজ, রাকিব ফ্রন্টডোর খুলতেই তার সঙ্গে দেখা হওয়া। বলতে দ্বিধা নেই কিংবা আছে তবু বলছি, মাঝে একটা পুরো সপ্তাহ সে বের হচ্ছে জেনেও আমি ভেতর থেকে দরজার পিপ-হোলের কাচে চোখ রেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকেছি। আশপাশে কেউ নেই ভেবে যদি সোনালি স্বামীকে বিদায় জানাতে সিঁড়ির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়! এমনকি দারোয়ান ভোরে কমন স্পেসের লাইট বন্ধ করে যাওয়ার পর চোরের মতো আবার তা জ্বালিয়েও রেখেছি। কিন্তু কোনোভাবেই লাভ হয়নি। ভূতের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে এসব পিপিংটম আর সম্ভব হচ্ছিল না। আমার বয়স আর বিবেচনায় এতটা রীতিমতো অনৈতিক ঠেকছিল। তাই রাকিব যখন বের হয়, সে সময় আমিও আবার বের হতে শুরু করলাম আর কড়া নজর রাখলাম ওপাশের দরজার ওপর। কথায় আছে মানুষ পরিকল্পনা করে আর তা দেখে নাকি ঈশ্বর হাসেন। তো, এর বিপরীতও ঘটে হয়তো। একদিন মেয়েকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যখন চেম্বারের উদ্দেশে বের হচ্ছি, দেখি সিঁড়ি দিয়ে নামছে সোনালি। আমি সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কথা বলেছিলাম, ‘জি ভাবি ভালো আছেন, আপনার কথা রাকিব সাহেবের মুখে শুনে শুনে ক্লান্ত অথচ দেখা-সাক্ষাৎ নেই! আসুন না একদিন আমাদের বাসায়।’ সোনালি দাঁড়াল না, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে সালাম ঠুকে বিদায় হলো। দিন দশেক আগে একই সময়ে আরও একবার দেখা হয়েছিল। হয়তো খানিকটা ডেসপারেট ছিলাম, আগ বাড়িয়ে এবারও আমিই কথা বললাম,
‘কই বাসায় এলেন না তো? রাস্তাঘাটে দেখা হলেও তো চিনতে পারব না আপনাকে? অথচ রাকিব সাহেব তো আপনার প্রশংসায়—কী আর বলব!’ সোনালি কেমন জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সম্পূর্ণ নেকাবে আবৃত হলেও চোখের জায়গাটা উন্মুক্ত। সেই প্রথম সেই শেষ, ঠিক বুঝতে পারিনি, তবে অপরূপ সেই চোখে সন্দেহ আর শঙ্কা একাকার। আমার বাড়তি কৌতূহলটা তার বোঝার কথা নয়, বয়সে আমি ওর অনেক বড়। তবু আমার কথাগুলোতে একটু খেলভাব, খানিকটা ফ্ল্যাটারির সুর ছিল আর সেটা সে ধরতে পেরেছিল হয়তো। সোনালি কোনো উত্তর না দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যায়। তার এভাবে চলে যাওয়ার পেছনে হাজারটা কারণ থাকতে পারে—এই পরিসর, দুজনের চেনাজানার মাত্রা, তার অন্তর্মুখিতা; সব মিলিয়ে খুব অস্বাভাবিক নয়। তবু আমার কেন যেন এটাকে একধরনের অহংবোধ বা অহংকার বলে মনে হয়েছিল। মানুষের মন আমি গলার স্বর শুনেও খোলা বইয়ের মতো পড়তে সক্ষম—এ অহংকার হয়তো মেয়েটির রূপের কিংবা গুণের। এই গটগটিয়ে চলে যাওয়া আমার খানিকটা বিরক্তির উদ্রেক করেছিল। পরমুহূর্তে নিজের বাড়াবাড়ি বুঝতে পেরে একধরনের অপ্রস্তুতই হলাম। গত কয়েকটা দিন একটা সেমিনার নিয়ে এত ব্যস্ততায় কেটেছে, বলার নয়। খুব ভোরে বের হয়েছি, ফিরেছি রাত করে। তা সত্ত্বেও রাকিবের সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল, সেটাই শেষ দেখা। ভদ্রলোক কথা বলতে শুরু করলেও আমি সময় দিইনি। ব্যস্ততা ছিল আর তাকে দেখে কেন যেন আগের মতো খুশিও হতে পারছিলাম না। সেটা হয়তো সোনালির কাছে আমি যে ধরা পড়ে গেছি, তাই পালাবার মতো সস্তা ডিফেন্স ম্যাকানিজম।
পেশাগত কারণে মানুষের মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা দুঃসহ স্মৃতি, কত ভয়ংকর সব গল্প প্রায়ই আমাকে শুনতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টে সাতাশ বছরের হাসিখুশি রাকিবের মৃত্যুর সংবাদটা মেনে নেওয়া ছিল খুব মুশকিল। আজকাল মার্কেটিংয়ের চাকরি আর মোটরবাইক একেবারে সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর তারই লেজ ধরে ছোট-বড় যত সব দুর্ঘটনা। থানা-হাসপাতাল করে বিকেল নাগাদ রাকিবের নিথর দেহটা যখন তার অফিসের কলিগরা নিয়ে এল, তারও বেশ খানিক পর আমি যেসব সত্য জানতে পারলাম তা কল্পনাতীত! অ্যাপার্টমেন্টের অনেকের সঙ্গে নিচে নেমে অপেক্ষায় ছিলাম, লাশটা আসতেই ঘরে ফিরে আসি। এমন প্রাণচঞ্চল একটা মানুষ, বিষয়টা অকল্পনীয় লাগছিল। ঘণ্টা খানেক বাদে আমার স্ত্রী ফিরে এল, সম্ভবত পাশের বাসা থেকে। রুবিনা অফিস থেকে দুপুরে ফিরেই ওখানে গিয়েছিল। সোনালির কী অবস্থা, জানার ইচ্ছা তো খুব স্বাভাবিক, সেই সঙ্গে পুরো পরিস্থিতিটা কী দাঁড়াল, তা জানা দরকার। আমি জানতে চাইলাম, রাকিবের আত্মীয়স্বজন এসেছে কি না। উত্তরে রুবি যা বলল আমি তার জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিলাম। রুবিনা হতাশা মেশানো কণ্ঠে বলল, ‘গ্রাম থেকে ওনার বাবা এসেছেন। কেমন মলিন কাপড়–জামা গায়ে। বয়োবৃদ্ধ, খুব সাদাসিধে গোছের লোক। রাকিবই চালাত তার বাবা-মাকে। তুমি তো বলেছিলে ওর ফ্যামিলি ফিন্যান্সিয়ালি বেশ ফ্লেসি?’ আমি একটু অবাক হলেও বললাম, ‘তাই তো জানতাম! ওর মা আসেননি আর সোনালি ভাবির কী খবর?
রুবিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ওর মা নাকি খুব অসুস্থ, অনেক দিন ধরে ঘরে পড়া, আই মিন প্যারালাইজড আর সোনালির কথা চিন্তা করতেও খারাপ লাগছে। বেচারির আপন কেউ নেই। রাকিবদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। সে সূত্রে ওদের বাসায়ই মানুষ। বাকি জীবনটা কী যে করবে মেয়েটা।’ মনে মনে ভাবলাম, সত্যিই মুহূর্তে কী ঘটে গেল। রুবির উদ্দেশে বললাম, ‘হু, তবু বয়স কম আর যেহেতু বেশ সুন্দরী আজ হোক কাল হোক, হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’ আমি সোনালির এমএ ফাইনালের সম্ভাবনার কথাও বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল রুবিনা। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সে প্রশ্ন করল, ‘তুমি মেয়েটাকে দেখেছ?’ আমি না-সূচক মাথা নাড়ালাম। রুবি কথা কনটিনিউ করল, ‘রাকিব ওর দ্বিতীয় স্বামী। প্রথম হাজব্যান্ড একটা অমানুষ ছিল। সোনালি ওখান থেকে পালিয়ে আসে বছর তিনেক আগে। তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। মেয়েটার মুখের একটা পাশ সম্পূর্ণ অ্যাসিডে পোড়া। পরে রাকিবই তাকে বিয়ে করে দ্বিতীয়বার বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। এখন সব শেষ!’ হতবাক আমি কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। রাকিবের মুখে শোনা তার গ্রামের বাড়ির বিত্ত-বৈভব, স্ত্রীকে নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার; রাকিব এসব কী বলেছিল! প্রকৃত বাস্তবতা আগে জানলে রাকিবকে করুণা করতাম কি না, জানি না। তবে অসম্ভব সুখী এক মানুষ ভাবার মতো উদারতা আমার ছিল না। হঠাৎ নিজেকে রাকিব নামের ছেলেটার কাছে, তার স্ত্রী সোনালির কাছে হেরে যাওয়া, সম্পূর্ণ পরাস্ত একজন অসুখী মানুষ মনে হলো। শুধু কী তাই, প্রফেশনাল জীবনেও িক চূড়ান্ত ব্যর্থ এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নই আমি? যে এত দিনের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা সত্ত্বেও দিনের পর দিন একটি মানুষের কথা শুনে, তাকে দেখে সম্পূর্ণ মিসরিড করেছি!
No comments