হিজড়া বানানোর ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
ছেলেটির
নাম ছিল জাহাঙ্গীর হোসেন। বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার দোনাইল
গ্রামে। দেখতে সুন্দর। হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যায় জাহাঙ্গীর। পরিবারের সবাই
দিশাহারা হয়ে পড়ে ছেলের খোঁজে। সব আত্মীয়স্বজনের বাসায় খোঁজা হলো। কিন্তু
কোথাও খোঁজ মিললো না তার। এক মাস পর হঠাৎ বাড়ি ফিরে কান্না জুড়ে দিল
জাহাঙ্গীর। তার কান্না থামতেই চায় না। অনেক বুঝানোর পর সে জানায়, হিজড়াদের
একটি চক্র তাকে ফুসলিয়ে খুলনার ফুলতলায় নিয়ে যায়। সেখানে একটি ক্লিনিকে
নিয়ে জোর করে তার পুরুষাঙ্গ কেটে তাকে বানানো হয়েছে হিজড়া। তারা তার নাম
রেখেছে রত্মা। সেদিনের জাহাঙ্গীর আর আজকের রত্মা মানবজমিন-এর কাছে বর্ণনা
করেছেন তার জীবনের হৃদয় বিদারক অভিজ্ঞতা।
জাহাঙ্গীর হোসেন একা নন। হিজড়া বানানোর ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে এমন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অনেকের জীবন। রাজধানী এবং এর আশপাশে বিভিন্ন ক্লিনিকে পুরুষের যৌনাঙ্গ কেটে বানানো হচ্ছে হিজড়া। এর মাধ্যমে হিজড়া সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সরকারি চাকরির প্রলোভন আর হিজড়া সরদারদের আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা- এ দুইয়ের মারপ্যাচে দেশে বাড়ছে হিজড়াদের সংখ্যা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে হিজড়া সরদারদের বা গুরুদের বিলাসী জীবনের চাঞ্চল্যকর তথ্য। হিজড়া সরদারদের কারও কারও মাসিক আয় দেড় থেকে তিন লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালের মাধ্যমে পুরুষদের ক্লিনিকে আনা হয়। অনেক সময় তাদের চাকরি দেয়ার কথা বলা হয়। হিজড়া সরদাররা তাদের নিয়ে যায় ক্লিনিকে। অপারেশনের মাধ্যমে তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে নারী যৌনাঙ্গে রূপান্তরিত করে দেয়া হয়। পুরুষ থেকে হিজড়ায় রূপান্তরিত একাধিক হিজড়া জানিয়েছেন, এতে খরচ বাবদ ক্লিনিক প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার ও দালালরা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা নেয়। ধামরাই, উত্তরা, খুলনার ফুলতলায় এই ধরনের ক্লিনিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। সরজমিনে দেখা যায়, ধামরাই থানা বাসস্ট্যান্ডে থেকে ৫০ গজ দূরে মানিকগঞ্জ-ঢাকা প্রধান সড়কের পাশেই রোম আমেরিকান হাসপাতাল। এ হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন ধরেই হিজড়া বানানোর কাজ চলে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে থানা রোডে এ হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন ডা. গোলাম রহমান শাহজাহান। মূলত লিঙ্গ কেটে হিজড়া তৈরিই ওই হাসপাতালের মূল কাজ বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। অভিযোগের বিষয়ে রোম আমেরিকান হাসপাতালের কর্ণধার ডা. গোলাম রহমান শাহজাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, অনেক আগে এই কাজ করেছি। এখন করছি না। আমি তো জোর করে কারও পুংলিঙ্গ কাটিনি। ছেলেরা ইচ্ছাকৃতভাবেই এসে পুরুষাঙ্গ কাটাতো বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রতিমাসে ৩-৪ জনকে অপারেশন করাতেন তিনি।
ওদিকে, হিজড়া নামের আড়ালে লিঙ্গ কর্তন করা হাজার হাজার পুরুষ ঢাকাসহ সারা দেশে চাঁদাবাজি, রাস্তায় মানুষকে ব্ল্যাক মেইল, মাদক ব্যবসা, খুন-খারাবিসহ বিভিন্ন পার্কে রাতের আঁধারে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু হিজড়াদের সঙ্গে অপরাধীদেরও যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি আশুলিয়ার দক্ষিণ গাজীরচটের রশিদ মার্কেট এলাকায় এ ধরনের একটি চক্র জনতার হাতে ধরা পড়ে। হিজড়া সেজে চাঁদাবাজিকালে স্থানীয়রা তিন পুরুষকে আটক করে গণপিটুনি দেয়। এসময় তারা স্বীকার করে তারা পুরুষ। পরে নয়নতারা নামে হিজড়া সরদারের হস্তক্ষেপে তাদের পুলিশে না দিয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এলাকাবাসী। ওই দিন আটক ভুয়া হিজড়ারা ছিলেন- আতিকুর রহমান (৩০) ওরফে সাজেদা, মমিন উদ্দিন (২৬) ওরফে মাহি এবং মো. অন্তর (২১) ওরফে অন্তরা।
ভুয়া হিজড়াদের একজন বলেছেন, সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থেকে কাজের সন্ধানে তিনি আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকার কাঁচাবাজারের আড়তে আসেন। এরপর থেকেই নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে হিজড়া সরদার নয়নতারা তাকে এই পেশায় আসতে বাধ্য করেন। স্থানীয় এক হিজড়া জানান, গাজীরচটের বটতলা এলাকার হিজড়াদের সরদার আবদুল ওরফে রাশেদা ও নয়নতারা অনেক দিন আগে নিজেরাই পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে এই পেশায় ঢুকেছেন। রাশেদার দলে শতাধিক হিজড়া আর নয়নতারার দলে সাত জন রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তাদের ‘ছল্লাই’ বা ‘বাধাই’ তোলার (চাঁদা) টাকায় রাশেদা ও নয়নতারা ইতিমধ্যে নিজ এলাকায় ফ্ল্যাট বাড়ির মালিক হয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে নয়নতারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
কেইস স্টাডি-১: ধামরাই পৌরসভার তালতলায় থাকেন নোলক হিজড়া। আট নম্বর ওয়ার্ডের ১০৩ হোল্ডিংয়ে তার বাসার অবস্থান। বাসার ওয়ালে বড় অক্ষরে লিখা হিজড়া বাড়ি। সুন্দর পরিপাটি বাড়িটি তার নিজেরই। বাবা-মার দেয়া তার নাম ছিল রাফি। রাফি থেকে নোলক। যাত্রাবাড়ীতে তাদের বাড়ি। সম্প্রতি তার বাসায় গেলে নোলক হিজড়া জানান, তার জীবনের কাহিনী। বলেন, ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ছোটবেলায় পড়ালেখা করেছেন তিনি। তার দুই ভাই রয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের পদে বাবা চাকরি করেন। ১০ বছর বয়সে বুঝতে পারি আমি হিজড়া। এরপর বাড়ি থেকে চলে আসি। ১৫ থেকে ১৬ বছর আগে ধামরাই আসেন তিনি। একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন। সাতক্ষীরা, বগুড়া, দিনাজপুর ও মানিকগঞ্জের জেলার হিজড়া রয়েছে তার সঙ্গে। এই মুহূর্তে তার নেতৃত্বে দলটিতে ৩০ জন হিজড়া রয়েছে। প্রত্যেকই ‘মেয়ে’ হিজড়া বলে নোলক দাবি করেন। নোলক জানান, তিনি ভারতের দিল্লি ওলম্যাক প্লাস্টিক সার্জারি থেকে নিজের স্তনকে স্লিকন সার্জারি এবং যৌনাঙ্গকে থাই সার্জারি করেছেন। এতে বাংলাদেশী টাকায় সাড়ে ৩ লাখ টাকার উপরে খরচ হয়েছে। মাঝে মধ্যে ভারতে যান তিনি। গত তিন-চার মাস আগেও চার মেয়েকে একই কায়দায় সার্জারি করে হিজড়া বানিয়ে এনেছেন নোলক। তারা হলেন- মোমেন, রিনা, বিশাখা ও বিপাশা।
তিনি জানান, যারা পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া হয় তারা রাতে ছিনতাই করে। মানুষকে ব্ল্যাক মেইল করে টাকা আয় করে। আর পৃথিবীতে যারা হিড়জা হয়ে এসেছেন তারা এসব করতে পারে না। ধামরাইয়ের রোম আমেরিকান হাসপাতালে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো হয়। গত ৫-৬ মাস আগেও ভুয়া হিজড়াদের লিঙ্গ কেটে হিজড়া বানানোর খবর পেয়ে তারা হাসপাতালটিতে গিয়ে ভুয়াদের ধরে মারধর দিয়ে পুলিশকে দিয়েছেন। তার দলের একজন ছোট (নতুন) হিজড়া দৈনিক কমপক্ষে ৫০০ টাকা এবং মোটামুটি সিনিয়র পর্যায়ের হিজড়া ২০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। সরকার আপনাদের পুলিশে নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছে। এমন বক্তব্যের উত্তরে তিনি বলেন, সরকারের চাকরি দেয়ার সিদ্ধান্তে তারা রাজি নন। কারণ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কত টাকা বেতন দেবে সরকার। আড়াই লাখ দেবে? আমরা খেয়ে পরে অনেক ভাল আছি। সিনিয়র পর্যায়ে যারা রয়েছেন তাদের ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা রয়েছে বলে জানান নোলক। অনেকের বাড়ি ও প্লট রয়েছে। যারা চাকরির কথা বলছেন তারা সামাজিকতা ঠিক রাখার জন্য বলেন। আসলে তারা মনে-প্রাণে চান না বলে তিনি মন্তব্য করেন। নোলক জানান, বাইর থেকে তাদের নামে ফান্ড আসলেও তাতে তেমন লাভ হয় না। বছরে ৪০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকার ফান্ডও আমেরিকা থেকে আসে। ‘সুস্থ জীবন’ ও ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ নামের সংগঠনের নামে এসব টাকা আসে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বাড়ি যান কিনা জানতে চাইলে তিনি নেতিবাচক উত্তর দেন। আশপাশের কেউ বিপদে পড়লে টাকাপয়সা দিয়ে তার দল ও নিজে সাহায্য করেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কোন গরিব মেয়ে বিয়ে দিতে পারছে না, আমাদের কাছে আসলে সহযোগিতা করি। পাড়া-মহল্লার মসজিদ-মাদরাসায় সাহায্য-সহযোগিতা করার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
কেইস স্টাডি-২: জাহাঙ্গীর হোসেনকে যখন ফুলতলার একটি ক্লিনিকে ঢোকানো হয় তখন চিকিৎসকের হাতে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি। জাহাঙ্গীর আঁতকে ওঠেন। তাকে উলঙ্গ করে অস্ত্রোপচার বেডে চিৎ করে শোয়ানো হয়। জাহাঙ্গীর বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ডাক্তারের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করেন। কিন্তু হিজড়া বাহিনী পিছু ছাড়ছে না। তারা চাপ দেয় ডাক্তারকে। তাকে অচেতন অবস্থায় করে লিঙ্গ কেটে ফেলে। জ্ঞান ফেরার পর তাকে কিছুদিন চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর তার নামকরণ করা হয় রত্না। সেই থেকে সে রত্না হিজড়া নামে পরিচিত। জাহাঙ্গীরসহ তারা ছয় ভাই। চার ভাই ঢাকার ফকিরাপুলে নিজস্ব প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করেন। সমপ্রতি ফকিরাপুলের ছাপাখানায় জাহাঙ্গীরের বড় ভাই আসলাম মিয়ার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীরের বয়স যখন ১৮ থেকে ১৯ বছর তখন সে একটি চক্রের খপ্পরে পড়ে হিজড়াদের খাতায় নাম লেখায়। চার-পাঁচ বছর আগেই তার গোপন অঙ্গ কাটা হয় বলে তিনি জানান। আসলাম বলেন, তারা যখন বুঝতে পারেন তারা ভাই হিজড়া তখন ঢাকায় চিকিৎসাও করিয়েছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। আমাদের ভাইদের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। সবার আদরের। কিন্তু তার লিঙ্গ কেটে হিজড়া হওয়ার পর হিজড়াদের সঙ্গেই থাকে। তার বয়স এখন ২৫ থেকে ২৬ হবে। সে নাগরপুরে সুমি হিজড়াদের দলে থাকে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আসলাম মিয়া আরও জানান, সে সুন্দর নাচতে পারতো। ফলে দ্রুত অন্য হিজড়াদের নজরে আসে তার ভাই। মাঝে মাঝে বাড়িতে আসে। বাবা নেই। মাকে এক নজর দেখে আবার চলে যায়। মন চাইলে কয়দিন থাকেও। এ বিষয়ে রত্নার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি মানবজমিনকে জানান, খুলনায় নিয়ে হিজড়ারা তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে। এ কারণে আমার এই জীবনের আর কোন মূল্য নেই। জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। গডফাদার হিজড়াদের বিচার চান তিনি। নাম উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ঢাকায় মুন্না হিজড়া, আবুল হিজড়া, আবদুল হিজড়া কোটি কোটি টাকার মালিক। গাড়িতে চড়ে চলাচল করেন। অসহায় হিজড়াদের এভাবে লিঙ্গ কেটে তাদের দলে নিয়ে আসে। সরকারি চাকরিতে যেতে রাজি আছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সমাজবিজ্ঞানীরা যা বলেন: পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানানোর তৎপরতা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, হিজড়াদের সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। সমাজ ধ্বংসের পথে চলছে। সমাজের অবক্ষয় হয়েছে এবং মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। গরিব অসহায় মানুষকে ধোকায় ফেলে এই কাজ করছে কিছু অসাধু লোক। চাকরি বা টাকার লোভে হিজড়া হলে পরবর্তীকালে পুরুষের কী হবে তা ভাবতে হবে? পুরুষের অস্তিত্ব নষ্ট করা উচিত নয়। প্রশাসনকেও এদিকে নজর দিতে হবে।
হিজড়াদের সংখ্যা: বাংলাদেশে সরকারিভাবে হিজড়াদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। আদম শুমারির সময় তৃতীয় লিঙ্গের অপশন না থাকায় হিজড়াদের গণনা করা হয়নি। সর্বশেষ ২০১৩ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১০ হাজার। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী এ সংখ্যা ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার। শুধু ঢাকা শহরে হিজড়ার সংখ্যা ১০ হাজারের ওপর বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
জাহাঙ্গীর হোসেন একা নন। হিজড়া বানানোর ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে এমন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অনেকের জীবন। রাজধানী এবং এর আশপাশে বিভিন্ন ক্লিনিকে পুরুষের যৌনাঙ্গ কেটে বানানো হচ্ছে হিজড়া। এর মাধ্যমে হিজড়া সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সরকারি চাকরির প্রলোভন আর হিজড়া সরদারদের আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা- এ দুইয়ের মারপ্যাচে দেশে বাড়ছে হিজড়াদের সংখ্যা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে হিজড়া সরদারদের বা গুরুদের বিলাসী জীবনের চাঞ্চল্যকর তথ্য। হিজড়া সরদারদের কারও কারও মাসিক আয় দেড় থেকে তিন লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালের মাধ্যমে পুরুষদের ক্লিনিকে আনা হয়। অনেক সময় তাদের চাকরি দেয়ার কথা বলা হয়। হিজড়া সরদাররা তাদের নিয়ে যায় ক্লিনিকে। অপারেশনের মাধ্যমে তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে নারী যৌনাঙ্গে রূপান্তরিত করে দেয়া হয়। পুরুষ থেকে হিজড়ায় রূপান্তরিত একাধিক হিজড়া জানিয়েছেন, এতে খরচ বাবদ ক্লিনিক প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার ও দালালরা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা নেয়। ধামরাই, উত্তরা, খুলনার ফুলতলায় এই ধরনের ক্লিনিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। সরজমিনে দেখা যায়, ধামরাই থানা বাসস্ট্যান্ডে থেকে ৫০ গজ দূরে মানিকগঞ্জ-ঢাকা প্রধান সড়কের পাশেই রোম আমেরিকান হাসপাতাল। এ হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন ধরেই হিজড়া বানানোর কাজ চলে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে থানা রোডে এ হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন ডা. গোলাম রহমান শাহজাহান। মূলত লিঙ্গ কেটে হিজড়া তৈরিই ওই হাসপাতালের মূল কাজ বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। অভিযোগের বিষয়ে রোম আমেরিকান হাসপাতালের কর্ণধার ডা. গোলাম রহমান শাহজাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, অনেক আগে এই কাজ করেছি। এখন করছি না। আমি তো জোর করে কারও পুংলিঙ্গ কাটিনি। ছেলেরা ইচ্ছাকৃতভাবেই এসে পুরুষাঙ্গ কাটাতো বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রতিমাসে ৩-৪ জনকে অপারেশন করাতেন তিনি।
ওদিকে, হিজড়া নামের আড়ালে লিঙ্গ কর্তন করা হাজার হাজার পুরুষ ঢাকাসহ সারা দেশে চাঁদাবাজি, রাস্তায় মানুষকে ব্ল্যাক মেইল, মাদক ব্যবসা, খুন-খারাবিসহ বিভিন্ন পার্কে রাতের আঁধারে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু হিজড়াদের সঙ্গে অপরাধীদেরও যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি আশুলিয়ার দক্ষিণ গাজীরচটের রশিদ মার্কেট এলাকায় এ ধরনের একটি চক্র জনতার হাতে ধরা পড়ে। হিজড়া সেজে চাঁদাবাজিকালে স্থানীয়রা তিন পুরুষকে আটক করে গণপিটুনি দেয়। এসময় তারা স্বীকার করে তারা পুরুষ। পরে নয়নতারা নামে হিজড়া সরদারের হস্তক্ষেপে তাদের পুলিশে না দিয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এলাকাবাসী। ওই দিন আটক ভুয়া হিজড়ারা ছিলেন- আতিকুর রহমান (৩০) ওরফে সাজেদা, মমিন উদ্দিন (২৬) ওরফে মাহি এবং মো. অন্তর (২১) ওরফে অন্তরা।
ভুয়া হিজড়াদের একজন বলেছেন, সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থেকে কাজের সন্ধানে তিনি আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকার কাঁচাবাজারের আড়তে আসেন। এরপর থেকেই নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে হিজড়া সরদার নয়নতারা তাকে এই পেশায় আসতে বাধ্য করেন। স্থানীয় এক হিজড়া জানান, গাজীরচটের বটতলা এলাকার হিজড়াদের সরদার আবদুল ওরফে রাশেদা ও নয়নতারা অনেক দিন আগে নিজেরাই পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে এই পেশায় ঢুকেছেন। রাশেদার দলে শতাধিক হিজড়া আর নয়নতারার দলে সাত জন রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তাদের ‘ছল্লাই’ বা ‘বাধাই’ তোলার (চাঁদা) টাকায় রাশেদা ও নয়নতারা ইতিমধ্যে নিজ এলাকায় ফ্ল্যাট বাড়ির মালিক হয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে নয়নতারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
কেইস স্টাডি-১: ধামরাই পৌরসভার তালতলায় থাকেন নোলক হিজড়া। আট নম্বর ওয়ার্ডের ১০৩ হোল্ডিংয়ে তার বাসার অবস্থান। বাসার ওয়ালে বড় অক্ষরে লিখা হিজড়া বাড়ি। সুন্দর পরিপাটি বাড়িটি তার নিজেরই। বাবা-মার দেয়া তার নাম ছিল রাফি। রাফি থেকে নোলক। যাত্রাবাড়ীতে তাদের বাড়ি। সম্প্রতি তার বাসায় গেলে নোলক হিজড়া জানান, তার জীবনের কাহিনী। বলেন, ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ছোটবেলায় পড়ালেখা করেছেন তিনি। তার দুই ভাই রয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের পদে বাবা চাকরি করেন। ১০ বছর বয়সে বুঝতে পারি আমি হিজড়া। এরপর বাড়ি থেকে চলে আসি। ১৫ থেকে ১৬ বছর আগে ধামরাই আসেন তিনি। একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন। সাতক্ষীরা, বগুড়া, দিনাজপুর ও মানিকগঞ্জের জেলার হিজড়া রয়েছে তার সঙ্গে। এই মুহূর্তে তার নেতৃত্বে দলটিতে ৩০ জন হিজড়া রয়েছে। প্রত্যেকই ‘মেয়ে’ হিজড়া বলে নোলক দাবি করেন। নোলক জানান, তিনি ভারতের দিল্লি ওলম্যাক প্লাস্টিক সার্জারি থেকে নিজের স্তনকে স্লিকন সার্জারি এবং যৌনাঙ্গকে থাই সার্জারি করেছেন। এতে বাংলাদেশী টাকায় সাড়ে ৩ লাখ টাকার উপরে খরচ হয়েছে। মাঝে মধ্যে ভারতে যান তিনি। গত তিন-চার মাস আগেও চার মেয়েকে একই কায়দায় সার্জারি করে হিজড়া বানিয়ে এনেছেন নোলক। তারা হলেন- মোমেন, রিনা, বিশাখা ও বিপাশা।
তিনি জানান, যারা পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া হয় তারা রাতে ছিনতাই করে। মানুষকে ব্ল্যাক মেইল করে টাকা আয় করে। আর পৃথিবীতে যারা হিড়জা হয়ে এসেছেন তারা এসব করতে পারে না। ধামরাইয়ের রোম আমেরিকান হাসপাতালে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো হয়। গত ৫-৬ মাস আগেও ভুয়া হিজড়াদের লিঙ্গ কেটে হিজড়া বানানোর খবর পেয়ে তারা হাসপাতালটিতে গিয়ে ভুয়াদের ধরে মারধর দিয়ে পুলিশকে দিয়েছেন। তার দলের একজন ছোট (নতুন) হিজড়া দৈনিক কমপক্ষে ৫০০ টাকা এবং মোটামুটি সিনিয়র পর্যায়ের হিজড়া ২০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। সরকার আপনাদের পুলিশে নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছে। এমন বক্তব্যের উত্তরে তিনি বলেন, সরকারের চাকরি দেয়ার সিদ্ধান্তে তারা রাজি নন। কারণ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কত টাকা বেতন দেবে সরকার। আড়াই লাখ দেবে? আমরা খেয়ে পরে অনেক ভাল আছি। সিনিয়র পর্যায়ে যারা রয়েছেন তাদের ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা রয়েছে বলে জানান নোলক। অনেকের বাড়ি ও প্লট রয়েছে। যারা চাকরির কথা বলছেন তারা সামাজিকতা ঠিক রাখার জন্য বলেন। আসলে তারা মনে-প্রাণে চান না বলে তিনি মন্তব্য করেন। নোলক জানান, বাইর থেকে তাদের নামে ফান্ড আসলেও তাতে তেমন লাভ হয় না। বছরে ৪০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকার ফান্ডও আমেরিকা থেকে আসে। ‘সুস্থ জীবন’ ও ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ নামের সংগঠনের নামে এসব টাকা আসে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বাড়ি যান কিনা জানতে চাইলে তিনি নেতিবাচক উত্তর দেন। আশপাশের কেউ বিপদে পড়লে টাকাপয়সা দিয়ে তার দল ও নিজে সাহায্য করেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কোন গরিব মেয়ে বিয়ে দিতে পারছে না, আমাদের কাছে আসলে সহযোগিতা করি। পাড়া-মহল্লার মসজিদ-মাদরাসায় সাহায্য-সহযোগিতা করার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
কেইস স্টাডি-২: জাহাঙ্গীর হোসেনকে যখন ফুলতলার একটি ক্লিনিকে ঢোকানো হয় তখন চিকিৎসকের হাতে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি। জাহাঙ্গীর আঁতকে ওঠেন। তাকে উলঙ্গ করে অস্ত্রোপচার বেডে চিৎ করে শোয়ানো হয়। জাহাঙ্গীর বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ডাক্তারের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করেন। কিন্তু হিজড়া বাহিনী পিছু ছাড়ছে না। তারা চাপ দেয় ডাক্তারকে। তাকে অচেতন অবস্থায় করে লিঙ্গ কেটে ফেলে। জ্ঞান ফেরার পর তাকে কিছুদিন চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর তার নামকরণ করা হয় রত্না। সেই থেকে সে রত্না হিজড়া নামে পরিচিত। জাহাঙ্গীরসহ তারা ছয় ভাই। চার ভাই ঢাকার ফকিরাপুলে নিজস্ব প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করেন। সমপ্রতি ফকিরাপুলের ছাপাখানায় জাহাঙ্গীরের বড় ভাই আসলাম মিয়ার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীরের বয়স যখন ১৮ থেকে ১৯ বছর তখন সে একটি চক্রের খপ্পরে পড়ে হিজড়াদের খাতায় নাম লেখায়। চার-পাঁচ বছর আগেই তার গোপন অঙ্গ কাটা হয় বলে তিনি জানান। আসলাম বলেন, তারা যখন বুঝতে পারেন তারা ভাই হিজড়া তখন ঢাকায় চিকিৎসাও করিয়েছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। আমাদের ভাইদের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। সবার আদরের। কিন্তু তার লিঙ্গ কেটে হিজড়া হওয়ার পর হিজড়াদের সঙ্গেই থাকে। তার বয়স এখন ২৫ থেকে ২৬ হবে। সে নাগরপুরে সুমি হিজড়াদের দলে থাকে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আসলাম মিয়া আরও জানান, সে সুন্দর নাচতে পারতো। ফলে দ্রুত অন্য হিজড়াদের নজরে আসে তার ভাই। মাঝে মাঝে বাড়িতে আসে। বাবা নেই। মাকে এক নজর দেখে আবার চলে যায়। মন চাইলে কয়দিন থাকেও। এ বিষয়ে রত্নার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি মানবজমিনকে জানান, খুলনায় নিয়ে হিজড়ারা তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে। এ কারণে আমার এই জীবনের আর কোন মূল্য নেই। জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। গডফাদার হিজড়াদের বিচার চান তিনি। নাম উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ঢাকায় মুন্না হিজড়া, আবুল হিজড়া, আবদুল হিজড়া কোটি কোটি টাকার মালিক। গাড়িতে চড়ে চলাচল করেন। অসহায় হিজড়াদের এভাবে লিঙ্গ কেটে তাদের দলে নিয়ে আসে। সরকারি চাকরিতে যেতে রাজি আছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সমাজবিজ্ঞানীরা যা বলেন: পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানানোর তৎপরতা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, হিজড়াদের সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। সমাজ ধ্বংসের পথে চলছে। সমাজের অবক্ষয় হয়েছে এবং মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। গরিব অসহায় মানুষকে ধোকায় ফেলে এই কাজ করছে কিছু অসাধু লোক। চাকরি বা টাকার লোভে হিজড়া হলে পরবর্তীকালে পুরুষের কী হবে তা ভাবতে হবে? পুরুষের অস্তিত্ব নষ্ট করা উচিত নয়। প্রশাসনকেও এদিকে নজর দিতে হবে।
হিজড়াদের সংখ্যা: বাংলাদেশে সরকারিভাবে হিজড়াদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। আদম শুমারির সময় তৃতীয় লিঙ্গের অপশন না থাকায় হিজড়াদের গণনা করা হয়নি। সর্বশেষ ২০১৩ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১০ হাজার। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী এ সংখ্যা ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার। শুধু ঢাকা শহরে হিজড়ার সংখ্যা ১০ হাজারের ওপর বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
No comments