দুই প্রজন্মের আওয়ামী লীগ by আবুল মোমেন
অলংকরণ: মাসুক হেলাল |
আওয়ামী
লীগের জন্ম ১৯৪৯ সালে। মাত্র দুই বছর আগে জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ সব স্তরের
বাঙালি মুসলিমকে পরাধীনতা আর সামাজিক পশ্চাৎপদতার গ্লানি থেকে মুক্তির
স্বপ্নে বিভোর করেই ধর্মীয় জাতীয়তার রাজনীতিতে টেনে পাকিস্তান এনেছিল। তরুণ
শেখ মুজিবও ছিলেন মুসলিম লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। কিন্তু বাস্তবে
পাকিস্তান বাঙালির জন্য নতুন পরাধীনতা ও নতুনতর পশ্চাৎপদতা সৃষ্টি করেছিল।
প্রাচীনকাল থেকেই উত্তর-পশ্চিমের দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণের জাতগুলো অপেক্ষাকৃত
কৃশকায় শ্যামবর্ণের বাঙালিকে—কি মুসলমান, কি হিন্দু—হীন জাতি হিসেবে অবজ্ঞা
করে এসেছে। তা ছাড়া উপমহাদেশে ইসলামের একাডেমিক চর্চা হয়েছে উর্দুতে এবং
ব্রিটিশ শাসকেরা উত্তর-পূর্বের মুসলিমপ্রধান অঞ্চলের শিক্ষার মাধ্যম করে
দিয়েছিল উর্দু ভাষা। ফলে মুসলমানদের জন্য সৃষ্ট দেশের শ্রেয়তর নাগরিকের
দাবিতে মুসলিম লীগের অবাঙালি প্রভাবাধীন নেতৃত্ব বাঙালি-অধ্যুষিত
পূর্ববঙ্গকে উপনিবেশের দৃষ্টিতেই দেখেছে। তাদের জন্য কাজটা সহজ হয়েছে
বাঙালি অভিজাতদের হীনম্মন্যতা ও পরশ্রীকাতরতার কল্যাণে। হীনম্মন্য অভিজাত
ব্যক্তিরা ক্ষমতাধরদের তোষামোদ ও চাটুকারিতায় ভোলাতে চেয়েছেন এবং
আত্মসম্মানের বিনিময়ে নিজেদের জন্য ক্ষমতার কিছু প্রসাদ জুটিয়ে নিয়েছেন।
আবার মজ্জাগত পরশ্রীকাতরতার কারণে তাঁরা পরস্পর কলহে লিপ্ত থেকেছেন, ফলে এই
ক্ষয়িষ্ণু বাঙালি নেতারা কেন্দ্রে কখনো ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী ভূমিকা পালন
করতে পারেননি।
আমরা জানি, ঐতিহাসিক কাল থেকেই বাংলার নিম্নবর্গের মানুষ বারবার বিদ্রোহ করেছে, রাজা ও রাজন্যদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তান সৃষ্টির দুই বছরের মাথায় গঠিত দল আওয়ামী লীগকে বলা যায় সর্বসাধারণের রাজনৈতিক মঞ্চ। মাওলানা ভাসানী এ দলের সভাপতি হিসেবে যথার্থই ছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগের ত্যাগী অভিজাত ব্যক্তিদের নিয়ে দল প্রায়ই সমস্যায় পড়েছে। দলে সাধারণদের মুখপাত্র ছিলেন তরুণ সংগঠক মুজিব। পাল যুগে কৈবর্ত বিদ্রোহে যেমন বিদ্রোহী জেলেদের নেতা ছিলেন দিব্যক, ব্রিটিশ যুগে বিদ্রোহী চাষিদের নেতা ছিলেন নূর আল দীন বা তিতুমীর, তেমনি এই সময়ে মুজিব যেন বাংলার বঞ্চিত-নিপীড়িত-সাধারণের নেতা হয়ে ওঠার দীর্ঘ পথে যাত্রা শুরু করলেন। সাধারণের এই নেতা একপর্যায়ে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েছেন দলের অভিজাত নেতাদের নিয়ে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেÿ ক্ষুব্ধ নেতা লিখেছেন, ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনো দিন এক সাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ (পৃ.২৭৩)
২...
দুটি কারণে আওয়ামী লীগ এ দেশের উদীয়মান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নে এই শ্রেণি পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে উপযুক্ত রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন প্রত্যাশা করছিল এবং সব শ্রেণির অন্তর্ভুক্তিমূলক বঞ্চনামুক্ত সমাজের স্বপ্ন তাদের অধিকাংশকে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে উজ্জীবিত করেছিল। এই সচেতন দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি একটি জাতীয়তাবাদী জাগরণের জন্য উন্মুখ ছিল। তত দিনে পরিণত দূরদর্শী শেখ মুজিব এ দেশে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল প্রবক্তা এবং প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। জননায়ক শেখ মুজিবকে ঘিরে গণজোয়ার এমন প্রবল হয়ে উঠেছিল যে একসময় বামপন্থী দলগুলোর জন্য হয় তাঁর সহযাত্রী হওয়া, নয়তো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকল না।
সেদিনের পরিস্থিতিই গণতান্ত্রিক দলে ও গণতন্ত্রপ্রত্যাশী সমাজে একক নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তারই অনুষঙ্গ হয়ে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে। চুয়ান্নর নির্বাচনে ভরাডুবির পর থেকে এখানে মুসলিম লীগের সংগঠন ভেঙে পড়েছিল, তাকে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতার প্রসাদ দিয়ে টিকিয়ে রাখছিল মাত্র। ফলে বিরোধী দল হলেও তখন থেকেই আওয়ামী লীগ এ দেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের সবটা জুড়েই তৎপর ছিল। এটা রাষ্ট্রীয় না হলেও দলের সামাজিক ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। আর পূর্ববঙ্গে ষাটের দশকজুড়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংকুচিত ও সমাজের ক্ষমতা প্রসারিত হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ তখন থেকেই এ দেশের বড় দল, ক্ষমতাধর দল। দীর্ঘদিন এই অবস্থানে অভ্যস্ত দলের নেতা-কর্মীরা স্বভাবতই ক্ষমতাধরের মনস্তত্ত্বে আক্রান্ত হয়েছে। যার যার পরিসরে কর্তৃত্ব, মুরব্বিয়ানা এবং সেই সূত্রে নিজস্ব কায়েমি স্বার্থের ক্ষমতাবলয় তৈরির প্রবণতা দেখা দেওয়া বিচিত্র নয়। এ প্রবণতাকে ঠেকানোর অস্ত্র যে রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক শিক্ষা এবং গণতান্ত্রিক সাংগঠনিক কাঠামো, তাকে অকার্যকর করে রাখার বিষয়ে এ ধরনের নেতাদের মধ্যে যোগসাজশ ঘটবেই। এর বিষময় ফল আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পর থেকেই ভোগ করছে। হয়তো এখন তা আরও বেড়ে গেছে। আমরা সরাসরি দলের বর্তমান নেতৃত্বকে উদ্দেশ করে হয়তো বলতে পারি, দেশকে এই অগণতান্ত্রিকতার বৃত্ত থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব আপনাদেরই নিতে হবে।
৩...
গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকারের জন্য যারা প্রাণপাত করছি, তারা কেন এই ক্ষমতাধর দলের বিকল্পের—যদি শূন্যতা না–ও বলি—সংকট নিয়ে কথা বলছি না? ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি থেকে, অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টির পাঁচ মাসের মাথায় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে যে নতুন জাতির ভ্রূণ তৈরি হয়ে ধীরে ধীরে আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার কাঙ্ক্ষিত পরিণতি কি বিএনপি নিশ্চিত করতে পারে? বিএনপি আন্দোলনের প্রশ্নে জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। কিন্তু কেবল যুদ্ধাপরাধ নয়, এ দল তো আদতে গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না, ধর্ম ও লিঙ্গসমতাও তো মানে না, যা গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত? সেই দলকে সঙ্গে রেখে কী করে বায়ান্ন থেকে একাত্তরের লাখো শহীদের স্বপ্ন পূরণ হবে? যদি বিএনপির শক্তিশালী সক্রিয় সংগঠন থাকত, তাহলে জামায়াতকে ক্ষমতার অংশীদার করা নিয়ে ততটা আশঙ্কা থাকত না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিপুল সমর্থক আছে বিএনপির, আর সংগঠন রয়েছে জামায়াতের। ফলে ক্ষমতার ফায়দা তারাই অনেক বেশি উশুল করবে। আর আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামের নামে যেসব জঙ্গিগোষ্ঠী আজ মানবতাবিরোধী মারাত্মক সন্ত্রাস চালাচ্ছে, তার শাখা-প্রশাখা এই মুসলিমপ্রধান দেশেও তো ছড়াচ্ছে। জামায়াত-বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে তারা প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হবে, কারণ জোটের অগ্রাধিকার পাবে আওয়ামী লীগ ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে দুর্বল করার পাল্টা প্রতিশোধ।
দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকশিত করতে আওয়ামী লীগের বিকল্প দল চাই। সেই দল আওয়ামী লীগের চেয়েও এগিয়ে রাজনীতি করতে পারে, যদি তারা একদিকে রাজনীতিতে সমাজের নিম্নবর্গের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং অন্যদিকে ইরাক-আফগানিস্তান-লিবিয়ার বিপর্যয়কে মাথায় রেখে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তার আদর্শকে ধারণ করে। বলে রাখা দরকার, বিগত ৬৬ বছরের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে যে দলটি অত্যন্ত সজীব এবং বাস্তবতা অনুধাবনে দক্ষ, এমনকি প্রয়োজনে সৃজনশীল হতেও সক্ষম। এভাবে দলটি ষাটের দশকেই বামপন্থীদের প্রায় অকেজো করে ফেলেছিল, এখন ইসলামপন্থী রাজনীতির ঘরে হানা দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধুর এই দল শেখ হাসিনার নেতৃত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মর্যাদার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। আওয়ামী লীগ তার চেয়ে অগ্রসর রাজনৈতিক দলের জায়গা প্রায় পুরোপুরি দখল করে এখন তার চেয়ে পশ্চাৎপদ দলের জায়গায়ও দখল বাড়াচ্ছে। তা তাকে করতেই হচ্ছে, কারণ সেদিকে সমর্থক-ভোটারের সংখ্যা বেশি বৈ কম নয়। পাশাপাশি মুক্তবাজার অর্থনীতি আর জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে কঠোরতার মাধ্যমে ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনও ধরে রেখেছে। এটাই সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে অকৃতকার্য হয়েও আওয়ামী লীগের ক্ষমতা নিশ্চিত থাকার কারণ।
ফল হলো এই, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশ্রয়ে-আনুকূল্যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ক্ষমতা ভোগ করে যাওয়ার লাইসেন্স পেয়ে গেছে। ফলে আপাতত পাল্টা প্রশ্ন হলো, একা হাসিনা কি দলে ভিড়ে থাকা উচ্চাভিলাষী, ভাগ্যান্বেষী তরুণ বা পাতিনেতাদের সামলাতে পারবেন? মনে হয় না এটা সম্ভব। এদের হাতে দিনে দিনে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে এবং তাতে তিনি তো ভুগবেনই, ডুববে দেশ। এতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নেত্রী ক্ষমতা, অধিকতর ক্ষমতার নিশ্ছিদ্র সুরক্ষায় বন্দী হয়ে যাবেন, তার প্রতিক্রিয়ায় অন্যদের স্বাধীনতাও হ্রাস পাবে, গণতন্ত্র আরও সংকুচিত হবে। তা ছাড়া তলে তলে রাজনৈতিক সংকট গভীরতর হতে থাকবে।
তাহলে বাংলাদেশ কি আপাতত আওয়ামী লীগপন্থী ও আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে বিভক্ত হয়েই থাকবে? মনে হয় নাগরিক সমাজ এ ক্ষেত্রে কিছু করতে পারে। এক. আওয়ামী লীগের ওপর আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ও দল পরিচালনার প্রক্রিয়া প্রবর্তনের জন্য চাপ তৈরি করতে পারে। দুই. রাজনীতিকে আর্থিক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অস্ত্র ও কালোটাকা থেকে মুক্ত রাখার জন্যও চাপ তৈরি করা যায়। তিন. ইসলামের মানবিক সহনশীল রূপটি তুলে ধরে মুসলিম সমাজেও যে বহুমতের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যুগপৎ ইসলাম ও সুশাসন ভালোভাবেই বিকশিত হতে পারে, তার পক্ষে জনমত তৈরি করতে পারে। চার. পুরোনো সমাজব্যবস্থা ও ধ্যানধারণার অচলায়তন ভেঙে সমাজের নবায়ন ঘটিয়ে সত্যিকারের মানবিক বিকাশমান সমাজ কায়েমে কাজ করতে পারে। ইতিহাসের আলোকে গণতান্ত্রিক সমাজের বিকাশের ধারা এবং ধর্মান্ধ রক্ষণশীল সমাজের সংকটের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়গুলো বিচার-বিবেচনা করে দেখা উচিত।
কোনো সমাজ যথার্থভাবে গণতন্ত্রের উপযোগী হয়ে উঠলেই কেবল কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেতে পারে। এমনকি সে কাজ শেখ হাসিনাও করতে পারেন, যদি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বেড়াজাল তিনি ভাঙতে চান।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
আমরা জানি, ঐতিহাসিক কাল থেকেই বাংলার নিম্নবর্গের মানুষ বারবার বিদ্রোহ করেছে, রাজা ও রাজন্যদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তান সৃষ্টির দুই বছরের মাথায় গঠিত দল আওয়ামী লীগকে বলা যায় সর্বসাধারণের রাজনৈতিক মঞ্চ। মাওলানা ভাসানী এ দলের সভাপতি হিসেবে যথার্থই ছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগের ত্যাগী অভিজাত ব্যক্তিদের নিয়ে দল প্রায়ই সমস্যায় পড়েছে। দলে সাধারণদের মুখপাত্র ছিলেন তরুণ সংগঠক মুজিব। পাল যুগে কৈবর্ত বিদ্রোহে যেমন বিদ্রোহী জেলেদের নেতা ছিলেন দিব্যক, ব্রিটিশ যুগে বিদ্রোহী চাষিদের নেতা ছিলেন নূর আল দীন বা তিতুমীর, তেমনি এই সময়ে মুজিব যেন বাংলার বঞ্চিত-নিপীড়িত-সাধারণের নেতা হয়ে ওঠার দীর্ঘ পথে যাত্রা শুরু করলেন। সাধারণের এই নেতা একপর্যায়ে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েছেন দলের অভিজাত নেতাদের নিয়ে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেÿ ক্ষুব্ধ নেতা লিখেছেন, ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনো দিন এক সাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ (পৃ.২৭৩)
২...
দুটি কারণে আওয়ামী লীগ এ দেশের উদীয়মান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নে এই শ্রেণি পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে উপযুক্ত রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন প্রত্যাশা করছিল এবং সব শ্রেণির অন্তর্ভুক্তিমূলক বঞ্চনামুক্ত সমাজের স্বপ্ন তাদের অধিকাংশকে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে উজ্জীবিত করেছিল। এই সচেতন দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি একটি জাতীয়তাবাদী জাগরণের জন্য উন্মুখ ছিল। তত দিনে পরিণত দূরদর্শী শেখ মুজিব এ দেশে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল প্রবক্তা এবং প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। জননায়ক শেখ মুজিবকে ঘিরে গণজোয়ার এমন প্রবল হয়ে উঠেছিল যে একসময় বামপন্থী দলগুলোর জন্য হয় তাঁর সহযাত্রী হওয়া, নয়তো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকল না।
সেদিনের পরিস্থিতিই গণতান্ত্রিক দলে ও গণতন্ত্রপ্রত্যাশী সমাজে একক নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তারই অনুষঙ্গ হয়ে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে। চুয়ান্নর নির্বাচনে ভরাডুবির পর থেকে এখানে মুসলিম লীগের সংগঠন ভেঙে পড়েছিল, তাকে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতার প্রসাদ দিয়ে টিকিয়ে রাখছিল মাত্র। ফলে বিরোধী দল হলেও তখন থেকেই আওয়ামী লীগ এ দেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের সবটা জুড়েই তৎপর ছিল। এটা রাষ্ট্রীয় না হলেও দলের সামাজিক ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। আর পূর্ববঙ্গে ষাটের দশকজুড়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংকুচিত ও সমাজের ক্ষমতা প্রসারিত হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ তখন থেকেই এ দেশের বড় দল, ক্ষমতাধর দল। দীর্ঘদিন এই অবস্থানে অভ্যস্ত দলের নেতা-কর্মীরা স্বভাবতই ক্ষমতাধরের মনস্তত্ত্বে আক্রান্ত হয়েছে। যার যার পরিসরে কর্তৃত্ব, মুরব্বিয়ানা এবং সেই সূত্রে নিজস্ব কায়েমি স্বার্থের ক্ষমতাবলয় তৈরির প্রবণতা দেখা দেওয়া বিচিত্র নয়। এ প্রবণতাকে ঠেকানোর অস্ত্র যে রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক শিক্ষা এবং গণতান্ত্রিক সাংগঠনিক কাঠামো, তাকে অকার্যকর করে রাখার বিষয়ে এ ধরনের নেতাদের মধ্যে যোগসাজশ ঘটবেই। এর বিষময় ফল আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পর থেকেই ভোগ করছে। হয়তো এখন তা আরও বেড়ে গেছে। আমরা সরাসরি দলের বর্তমান নেতৃত্বকে উদ্দেশ করে হয়তো বলতে পারি, দেশকে এই অগণতান্ত্রিকতার বৃত্ত থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব আপনাদেরই নিতে হবে।
৩...
গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকারের জন্য যারা প্রাণপাত করছি, তারা কেন এই ক্ষমতাধর দলের বিকল্পের—যদি শূন্যতা না–ও বলি—সংকট নিয়ে কথা বলছি না? ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি থেকে, অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টির পাঁচ মাসের মাথায় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে যে নতুন জাতির ভ্রূণ তৈরি হয়ে ধীরে ধীরে আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার কাঙ্ক্ষিত পরিণতি কি বিএনপি নিশ্চিত করতে পারে? বিএনপি আন্দোলনের প্রশ্নে জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। কিন্তু কেবল যুদ্ধাপরাধ নয়, এ দল তো আদতে গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না, ধর্ম ও লিঙ্গসমতাও তো মানে না, যা গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত? সেই দলকে সঙ্গে রেখে কী করে বায়ান্ন থেকে একাত্তরের লাখো শহীদের স্বপ্ন পূরণ হবে? যদি বিএনপির শক্তিশালী সক্রিয় সংগঠন থাকত, তাহলে জামায়াতকে ক্ষমতার অংশীদার করা নিয়ে ততটা আশঙ্কা থাকত না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিপুল সমর্থক আছে বিএনপির, আর সংগঠন রয়েছে জামায়াতের। ফলে ক্ষমতার ফায়দা তারাই অনেক বেশি উশুল করবে। আর আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামের নামে যেসব জঙ্গিগোষ্ঠী আজ মানবতাবিরোধী মারাত্মক সন্ত্রাস চালাচ্ছে, তার শাখা-প্রশাখা এই মুসলিমপ্রধান দেশেও তো ছড়াচ্ছে। জামায়াত-বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে তারা প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হবে, কারণ জোটের অগ্রাধিকার পাবে আওয়ামী লীগ ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে দুর্বল করার পাল্টা প্রতিশোধ।
দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকশিত করতে আওয়ামী লীগের বিকল্প দল চাই। সেই দল আওয়ামী লীগের চেয়েও এগিয়ে রাজনীতি করতে পারে, যদি তারা একদিকে রাজনীতিতে সমাজের নিম্নবর্গের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং অন্যদিকে ইরাক-আফগানিস্তান-লিবিয়ার বিপর্যয়কে মাথায় রেখে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তার আদর্শকে ধারণ করে। বলে রাখা দরকার, বিগত ৬৬ বছরের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে যে দলটি অত্যন্ত সজীব এবং বাস্তবতা অনুধাবনে দক্ষ, এমনকি প্রয়োজনে সৃজনশীল হতেও সক্ষম। এভাবে দলটি ষাটের দশকেই বামপন্থীদের প্রায় অকেজো করে ফেলেছিল, এখন ইসলামপন্থী রাজনীতির ঘরে হানা দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধুর এই দল শেখ হাসিনার নেতৃত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মর্যাদার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। আওয়ামী লীগ তার চেয়ে অগ্রসর রাজনৈতিক দলের জায়গা প্রায় পুরোপুরি দখল করে এখন তার চেয়ে পশ্চাৎপদ দলের জায়গায়ও দখল বাড়াচ্ছে। তা তাকে করতেই হচ্ছে, কারণ সেদিকে সমর্থক-ভোটারের সংখ্যা বেশি বৈ কম নয়। পাশাপাশি মুক্তবাজার অর্থনীতি আর জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে কঠোরতার মাধ্যমে ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনও ধরে রেখেছে। এটাই সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে অকৃতকার্য হয়েও আওয়ামী লীগের ক্ষমতা নিশ্চিত থাকার কারণ।
ফল হলো এই, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশ্রয়ে-আনুকূল্যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ক্ষমতা ভোগ করে যাওয়ার লাইসেন্স পেয়ে গেছে। ফলে আপাতত পাল্টা প্রশ্ন হলো, একা হাসিনা কি দলে ভিড়ে থাকা উচ্চাভিলাষী, ভাগ্যান্বেষী তরুণ বা পাতিনেতাদের সামলাতে পারবেন? মনে হয় না এটা সম্ভব। এদের হাতে দিনে দিনে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে এবং তাতে তিনি তো ভুগবেনই, ডুববে দেশ। এতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নেত্রী ক্ষমতা, অধিকতর ক্ষমতার নিশ্ছিদ্র সুরক্ষায় বন্দী হয়ে যাবেন, তার প্রতিক্রিয়ায় অন্যদের স্বাধীনতাও হ্রাস পাবে, গণতন্ত্র আরও সংকুচিত হবে। তা ছাড়া তলে তলে রাজনৈতিক সংকট গভীরতর হতে থাকবে।
তাহলে বাংলাদেশ কি আপাতত আওয়ামী লীগপন্থী ও আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে বিভক্ত হয়েই থাকবে? মনে হয় নাগরিক সমাজ এ ক্ষেত্রে কিছু করতে পারে। এক. আওয়ামী লীগের ওপর আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ও দল পরিচালনার প্রক্রিয়া প্রবর্তনের জন্য চাপ তৈরি করতে পারে। দুই. রাজনীতিকে আর্থিক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অস্ত্র ও কালোটাকা থেকে মুক্ত রাখার জন্যও চাপ তৈরি করা যায়। তিন. ইসলামের মানবিক সহনশীল রূপটি তুলে ধরে মুসলিম সমাজেও যে বহুমতের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যুগপৎ ইসলাম ও সুশাসন ভালোভাবেই বিকশিত হতে পারে, তার পক্ষে জনমত তৈরি করতে পারে। চার. পুরোনো সমাজব্যবস্থা ও ধ্যানধারণার অচলায়তন ভেঙে সমাজের নবায়ন ঘটিয়ে সত্যিকারের মানবিক বিকাশমান সমাজ কায়েমে কাজ করতে পারে। ইতিহাসের আলোকে গণতান্ত্রিক সমাজের বিকাশের ধারা এবং ধর্মান্ধ রক্ষণশীল সমাজের সংকটের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়গুলো বিচার-বিবেচনা করে দেখা উচিত।
কোনো সমাজ যথার্থভাবে গণতন্ত্রের উপযোগী হয়ে উঠলেই কেবল কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেতে পারে। এমনকি সে কাজ শেখ হাসিনাও করতে পারেন, যদি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বেড়াজাল তিনি ভাঙতে চান।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments