কিসের নির্বাচন খুনি জিয়ার দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য -নিউ ইয়র্কে সাংবাদিকদের হাসিনা
মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা
সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সরকার
মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা ভাবছে কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে
কিছুটা রাগান্বিত ভঙ্গিতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, কিসের জন্য
মধ্যবর্তী নির্বাচন? খুনি জিয়ার দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য? যারা নির্বাচনে
অংশ নেয়নি, তাদের সঙ্গে কোন সংলাপ হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি।
শুক্রবার নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশ মিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা প্রবাসী
সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে
বলেন, আপনারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা তুলছেন কেন? আপনারা কি আবার ছেঁচা
খেতে চান? অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে চান? সে সব হবে না, দেশ চলবে
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর
রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান। সংবাদ সম্মেলনে আরও
উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
শাহরিয়ার আলম, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেন
প্রমুখ।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে নিউ ইয়র্ক সফর করছেন। নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সময় শনিবার সকাল ১০টায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বক্তৃতা করবেন তিনি। অন্যদিকে একই দিন ম্যানহাটনের সেন্ট্রাল পার্কে অনুষ্ঠেয় গ্লোবাল সিটিজেনস ফেস্টিভ্যালে শেখ হাসিনা অংশ নেবেন না বলে জানানো হয়েছে। তবে হঠাৎ কি কারণে তার এ কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে, সে ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। অথচ কিছুদিন ধরে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ ঘটা করেই প্রচার চালানো হয়েছিল, দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন।
দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে অর্থবহ সংলাপের জন্য জাতিসংঘের অব্যাহত তাগিদের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা তো সংসদের বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ করছিই। পার্লামেন্টারি রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিরোধী দলের সঙ্গেই সংলাপ হয়, অন্য কারও সঙ্গে নয়। কেউ ভুল করে থাকলে ভুলের খেসারত তাকেই দিতে হবে। তাদের ভুলের খেসারত আমরা দিতে যাবো কেন?
বেশির ভাগ আসনে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ না থাকায় ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে টিভি টকশোতে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন- এমন প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ ভোট দিতে না গেলে এটা তার ব্যর্থতা। আসলে অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় এলে এক ধরনের লোকের গুরুত্ব বাড়ে। তারা চেয়ার পায়। পয়সাপাতি কামানোরও সুযোগ পায়। এ জন্য তারা সব সময় অগণতান্ত্রিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু অগণতান্ত্রিক সরকার তো হাইকোর্ট বাতিল করে দিয়েছে। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল হাইকোর্টে অবৈধ হয়ে গেছে। জিয়াই তো এ দেশে সব অপকর্মের মূল। ’৫৮ সালে আইয়ুব যা করেছে ৭৫-৭৬-এ জিয়া তাই করেছে। জিয়া জামায়াতকে রাজনীতির সুযোগ করে দিয়েছে। পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে যারা চলে গিয়েছিল তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতির সুযোগ দিয়েছে জিয়া।
টকশোর আলোচকদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ থাকলে তারা নির্বাচনে আসেন না কেন? তাদের জায়গা তো বেসরকারি টেলিভিশন। কিন্তু তারা একবারও ভেবে দেখে না বেসরকারি টিভি কে দিয়েছে। আমিই আগেরবার ক্ষমতায় থাকতে বেসরকারি টিভি দিয়েছি। আমার সরকার খারাপ হলে তাদের উচিত বেসরকারি টিভি বর্জন করা। আবার এখন আমি বিদ্যুৎ দিয়েছি। সেই বিদ্যুৎ খরচ করে তারা টকশোতে কথা বলে। আমরা যদি এতই খারাপ তাহলে আমার দেয়া বিদ্যুৎ ব্যবহার না করলেই হয়। তিনি বলেন, আমরা সেবা করতে এসেছি। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক টাকা বন্ধ করে দেয়। আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম সেখানে কোন দুর্নীতি হয়নি। এখন সেটা প্রমাণ হয়েছে।
‘জনগণের রোষানল থেকে বাঁচতে হলে শেখ হাসিনাকে ভিসা রেডি করে রাখতে হবে’- খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি কেন ভিসা রেডি রাখবো? আমার জন্ম তো এ দেশেই, একদম টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। আর তিনি তো এসেছেন ভারতের শিলিগুড়ি চা বাগান থেকে, তার জন্ম সেখানে। কাউকে যদি ভিসা নিয়ে যেতে হয় তো খালেদা জিয়াকেই যেতে হবে। তিনি তো পোঁটলা বেঁধে সব সময় রেডিই থাকেন। জরুরি অবস্থার সময় তাকে যখন দেশ থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা চলেছে, আমি তখন এ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই তার প্রতিবাদ করেছি। একমাত্র আমি তার দেশত্যাগের বিরোধিতা করেছি। তিনি তো প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। শুধু শর্ত দিয়েছিলেন, তার দুই ছেলেকেও যেতে দিতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত হচ্ছে। প্রবাসীরা এখন ভাল কথা শোনেন। নেগেটিভ কথা শোনেন না। আমরা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছি। এসএসসিতে ৯২ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। যাতে ৯৮ ভাগ পাস করতে পারে আমি সে নির্দেশনা দিয়েছি। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সমস্যারও সমাধান করেছি। সব সম্পদ কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করেছি। ভারতের সঙ্গে ল্যান্ড বাউন্ডারি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। ফেনীতে ৬৫ একর জমি উদ্ধার করেছি। জিয়া, এরশাদ ও মিসেস জেনারেল ক্ষমতায় ছিলেন। কেউ তো এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেননি। আমরা এখন পানি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছি। পানি রিজার্ভ করার চিন্তা করছি। এ জন্য নদীতে ক্যাপিটাল ও মেইনটেনেন্স ড্রেজিং করবো।
জাতিসংঘের ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিতে গত ২২শে সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক সফরে আসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরকালে এ পর্যন্ত তিনি নরওয়ে, বেলারুশ ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী এবং কমনওয়েলথ মহাসচিবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। গত ২৩শে সেপ্টেম্বর জলবায়ু বিষয়ক এক সেমিনারে অংশ নেন তিনি। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা অংশ নেন। একই দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার আমন্ত্রণে বিশ্বনেতাদের এক নৈশভোজে যোগ দেন শেখ হাসিনা। গত শুক্রবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন তিনি। আজ শনিবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের কথা রয়েছে।
যুদ্ধমুক্ত বিশ্ব গড়ার আহ্বান: বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও সংঘাত বন্ধে মুখ্য ভূমিকা নেয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার নিউ ইয়র্কে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনের উপস্থিতিতে দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ ও সংঘাত বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আমি বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানাই। আমার প্রত্যাশা যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘ মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। আসুন আমরা যুদ্ধকে নাকচ করি এবং শান্তির জন্য কাজ করি। যুদ্ধমুক্ত বিশ্ব গড়তে বাংলাদেশ সবার সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের একটি অভিন্ন লক্ষ্য রয়েছে। আর তা হলো জনগণের ক্ষমতায়ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিশ্বকে নিরাপদ করা। এ সময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের আগামী দিনের কর্মকাণ্ডের একটি রূপরেখা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আগামী দিনগুলোতেও আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নে কাজ করার প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশ অবিচল থাকবে। “বিপদাপন্ন বেসামরিকদের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নেতৃত্বশীল ভূমিকা পালন করে যাবো আমরা। যুদ্ধ, সংঘাত ও সশস্ত্র সহিংতার ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে জাতিসংঘের সক্ষমতা বাড়াতে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করতে আমরা বদ্ধপরিকর।” জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ এজেন্ডা বাস্তবায়নে সামনের কাতারে থেকে কাজ করার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। পাশাপাশি তিনি বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াই এবং সহিংস উগ্রপন্থা, মানব-মাদক ও বন্যপ্রাণী পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যৌন নিপীড়ন ও গণহত্যার মতো অপরাধের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও কঠোর হওয়ার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশ সর্বদাই প্রস্তুত রয়েছে। বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতন রোধ, অটিস্টিকদের সহায়তাসহ সমাজে বিরাজমান নানা সমস্যা এবং এ থেকে উত্তরণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। এসব ক্ষেত্রে সব দেশকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ওপর আরও জোর দেয়ার পাশাপাশি ২০১৫ সাল পরবর্তী উন্নয়ন রূপরেখায় অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণে মতৈক্য গড়তে কাজ করার ঘোষণা দেন। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন, সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সুবিধা আদায়ে জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করার ঘোষণাও এসেছে। ১৯৭৪ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে সম্পৃক্ত হওয়ার ৫০ বছর পূর্তির আগে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে জাতিসংঘ ও সদস্য দেশগুলোকে পাশে থাকার আহ্বান জানান। এ সময় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সমর্থনের সন্ধানে থাকা বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জনে সহায়তার জন্য ভারত ও রুশ ফেডারেশনের কথাও স্মরণ করেন তিনি। “এ দুটি দেশই ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে এবং জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্যপদ লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।” এছাড়া, বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য যুক্তরাজ্য ও জার্মানিসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা।
শান্তিরক্ষায় নেতৃত্ব দিতে সক্ষম বাংলাদেশ: ওদিকে শুক্রবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শান্তি সম্মেলনে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এবং বিভিন্ন শান্তি মিশনে নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। ওই শান্তি সম্মেলনের কো-চেয়ার হিসেবে দেয়া বক্তৃতায় বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘকে দেয়া বাংলাদেশের সহযোগিতা অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। শান্তিরক্ষার পথে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী এবং জাতিসংঘের জন্যই এটি এখন অনেক বেশি জটিল এবং বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। নতুন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কর্মরত সৈন্য ও পুলিশ সদস্যদের ব্যয়বহুল ও সমন্বিত প্রশিক্ষণের দরকার। যে কোন জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে দ্রুততার সঙ্গে শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে বাংলাদেশ এ কাজে নির্ভরযোগ্য একটি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বে শান্তিরক্ষায় পরীক্ষিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। সহযোগীদের সঙ্গে মিলে শান্তিরক্ষীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও দক্ষ করে গড়ে তুলতেও আগ্রহী। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের যে কোন স্থানে স্বল্প সময়ের নোটিশে তার আকাশ শক্তি, হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমান মোতায়েনের পাশাপাশি প্রকৌশলী, চিকিৎসক দল, নৌসেনা ও কর্মী মোতায়েনে সক্ষম বলে জানান শেখ হাসিনা। এছাড়াও জাতিসংঘ সদর দপ্তর ও এর মাঠ পর্যায়ের মিশনে নেতৃত্ব দিতে বাংলাদেশ আগ্রহী জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আফ্রিকান পিসকিপিং র্যাপিড রেসপন্স পার্টনারশিপসহ বিভিন্ন মিশনে শান্তিরক্ষীদের জন্য সরঞ্জাম এবং সেবা সরবরাহ কাজের অংশ হতে চাই। শান্তিরক্ষীদের, বিশেষ করে নারীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে দক্ষ করে তুলতে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট ফর পিস সাপোর্ট অপারেশন্স অ্যান্ড ট্রেনিং (বিপসট)-কে বিশ্বমানে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার বক্তৃতায় বিভিন্ন সময় শান্তি মিশনে নিহত ১১৯ জন বাংলাদেশীর কথা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন।
বাংলাদেশ ও প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা: বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন। শুক্রবার নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ‘তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়েছে’ বলে প্রশংসা করেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ৪০ বছরপূর্তি উপলক্ষে নিউ ইয়র্কস্থ সদর দপ্তরে ওই অনুষ্ঠান হয়। সেখানে শেখ হাসিনার প্রশংসা করা ছাড়াও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেন মুন। অনুষ্ঠানে নবীন কূটনীতিক হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন এসাইমেন্টে দায়িত্ব পালনের অতীত অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন জাতিসংঘ মহাসচিব। অনুষ্ঠানে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এক সময় বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে সাহায্য চাইতো। এখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সমস্যা সমাধানে আমরা বাংলাদেশের সহযোগিতা চাই। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার আশা প্রকাশ করে নিশা দেশাই বিসওয়াল বলেন, “এটা শুধু সরকারের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক না। জনগণের সঙ্গে জনগণের, নাগরিকের সঙ্গে নাগরিকের এবং বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর সম্পর্ক।” অনুষ্ঠানে রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রী জেনাদি গাতিলভ বাংলাদেশের সঙ্গে তার দেশের গভীর সম্পর্কের কথা স্মরণ করেন। অনুষ্ঠানে মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের প্রশংসা করেন ইউএনডিপির প্রশাসক হেলেন ক্লার্ক। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা বলেন, ৪০ বছর আগে বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষণ রেখেছিলেন- মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে। আজ নারী ও শিশু শিক্ষায় বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। যুক্তরাষ্ট্রে বৃটিশ রাষ্ট্রদূত পিটার ওয়েস্টমেকট এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিনোদ কুমার অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ‘বাংলাদেশ ফরটি ইয়ারস্ ইন ইউনাইটেড নেশনস্’ নামে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন শেখ হাসিনা।
সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে জিরো টলারেন্স
সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা নির্মূলে সরকার কাজ করছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সকল ধর্মের মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের প্রতি সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। গতকাল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে দেয়া এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থা বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার সরকার সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ, সহিংস চরমপন্থা, উগ্রবাদ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী। এসময় প্রতিবেশী বা অন্যদের বিরুদ্ধে যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেয়ার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন তিনি। দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাষ্ট্রের প্রগতিশীল এবং উদার চরিত্রকে নস্যাৎ করতে সদা তৎপর রয়েছে এমন অভিযোগ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা সুযোগ পেলেই ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে ২০০১-০৬ পর্যন্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বোমা ও গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে অসংখ্য উদার রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যা করেছে।’ ওই হামলাগুলো তাকে দেশ থেকে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত তিন বছরে আমরা সংশোধিত সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০১৩ এবং অর্থ পাচার আইন ২০১২-সহ সর্বোচ্চ সন্ত্রাস বিরোধী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। শাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে তার সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ কারণে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশনকে শক্তিশালী করেছে সরকার। তার সরকার শান্তি ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখা এবং দণ্ড-অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাত্তরে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে গঠিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারকাজ সম্পন্ন করেছে দাবি করে তিনি জনগণের দীর্ঘদিনের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের পূর্ণ সমর্থন প্রত্যাশা কামনা করেন। বাংলাদেশ বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের বৈধ রক্ষক হিসেবে জাতিসংঘের ভূমিকার প্রতি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তির পক্ষে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সৈন্য ও পুলিশ সদস্য প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অবস্থান আবারও সুদৃঢ় হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা ৫৪টি মিশনে ১ লাখ ২৮ হাজার ১৩৩ জন শান্তিরক্ষী প্রেরণ করেছি। এছাড়া শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সংখ্যক মহিলা পুলিশ প্রেরণ করেছে। স্থায়ী শান্তি এবং নিরাপত্তা ব্যতিত আমরা টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব নয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়নে অস্থিতিশীল বৈশ্বিক নিরাপত্তা অবস্থা এখনও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, বিশ্বের যেকোন স্থানে শান্তি বিঘ্নিত হলে তা গোটা মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের নীতিগত অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারের বৈধ সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সংহতি ঘোষণা করছি। তিনি সমপ্রতি গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুসহ শত শত সাধারণ নাগরিক হত্যার তীব্র নিন্দা জানান। এবং ১৯৬৭-পূর্ব সীমানার ভিত্তিতে আল কুদস আল শরীফ-কে রাজধানী করে একটি স্বাধীন এবং স্থায়ী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে আমরা এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের টেকসই সমাধান প্রত্যাশা করেন।
No comments