মোদি পর্বের শুরু ও শেখ হাসিনার আগাম বার্তা
ভারতের ১৬তম লোকসভা নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সব জল্পনা-কল্পনা আর পূর্বাভাস ভুল প্রমাণ করে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। দলটির অন্যতম প্রধান নেতা নরেন্দ্র মোদিই প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন৷ ভারতের ১৬তম লোকসভা নানা দিক থেকেই রেকর্ড তৈরি করেছে। ৬১ জন নারী লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছেন, যা পূর্ববর্তী সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ভারতের ইতিহাসে এটাই আবার প্রবীণতম সদস্যদের ক্লাবে পরিণত হয়েছে, যেখানে ৪৭ শতাংশ সদস্যের বয়স ৫৫ বছরের বেশি। মাধ্যমিক পাস করতে পারেননি—এমন সদস্য আছেন ১৩ শতাংশ; যা গত লোকসভার চেয়ে চার গুণেরও বেশি। অন্যদিকে পিএইচডি আছে—এমন সদস্য ৬ শতাংশ, যা গত লোকসভার দ্বিগুণ। পেশাগতভাবে যদিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য (২৭ শতাংশ) হচ্ছেন কৃষিজীবী; ব্যবসায়ী সদস্য আছেন ২০ শতাংশ, যা এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। প্রথম লোকসভায় (১৯৫২) আইনজীবীদের সংখ্যা যেখানে ছিল ৩৬ শতাংশ, কমতে কমতে তা এখন ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাবেক সিভিল-মিলিটারি আমলা আছেন ২ শতাংশ। এসবই হচ্ছে পরিসংখ্যানের টুকিটাকি। ভারতীয়দের সামনে এখন পরিবর্তিত ভারত বা মোডিফায়েড ইন্ডিয়ার প্রবল বন্যা। প্রতিবেশী বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমার ভাবনা, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক মোদি সরকারের আমলে কেমন থাকবে?
নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে আমাদের দেশে অনেকেরই অনেক শঙ্কা। তাঁর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক উসকানি বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। মোদির সমালোচক ভারতেও আছেন অনেকেই। সেখানে একাডেমিক বিতর্ক হয় বিস্তর, বাংলাদেশে একাডেমিক বিতর্ক তেমন নেই। ২০০০-০১ সালে গুজরাটে দাঙ্গায় দুই হাজারের বেশি মুসলমান সংখ্যালঘু নিহত হয়েছেন। অভিযোগের তির মোদির দিকে। কেননা, তিনি তখন গুজরাটে ক্ষমতায় ছিলেন। দাঙ্গা প্রতিরোধে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে তখন তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। দাঙ্গার পরপর তিনি আরও সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গুজরাটে সরকার গঠন করেন এবং তার পর থেকে গুজরাট রাজ্যে বিজেপির নিশান উড্ডীন রয়েছে। আমাদের দেশে অবশ্য অনেকেই মনে করেন, কংগ্রেস একটি সেক্যুলার দল। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা আততায়ীর হাতে নিহত হলে দিল্লিতে শিখবিরোধী দাঙ্গা হয়েছিল। নিহত হয়েছিলেন আরও বেশি শিখ। সংখ্যাটা তিন হাজারের বেশি। দাঙ্গাকারীরা কংগ্রেসের লোক ছিলেন বলে ভারতের আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ অবশ্য ভারতে শিখদের মারলে মাথা ঘামান না। মুসলমান মরলে উত্তেজিত হন। সব ধরনের দাঙ্গাই অমানবিক, নৃশংস। কিন্তু যেহেতু আমরা একধরনের ‘আইডেন্টিটি পলিটিকস’ করি, আমরা কোনো কোনো ব্যাপারে সরব, আবার কোনো কোনো বিষয়ে নীরব।
এই অঞ্চলের নেতাদের মধ্যে নানা বিষয়ে অদ্ভুত মিল দেখা যায়। খালেদা জিয়া সচরাচর শাহজালালের মাজার জিয়ারত করে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। তিনি ঘোরতর ‘জাতীয়তাবাদী’। শেখ হাসিনা একই কাজ করেন অন্য কোনো মাজার জিয়ারত করে। তিনি আপাদমস্তক ‘সেক্যুলার’। নরেন্দ্র মোদি এবার হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থক্ষেত্র বেনারস গিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি এসেছেন ‘মা গঙ্গার’ আহ্বানে। তাই তিনি হলেন ‘সাম্প্রদায়িক’। আমি তিনজনের কথা বললাম। তিনজনই সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ভোট পেতে চান। ভারতের একদিকে পাকিস্তান একটি ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’। অমুসলমানরা যেখানে প্রায় বিলীয়মান প্রজাতি। তার পরও ইসলামি জোশ ও জজবা আসমান ছাড়িয়ে যায় নির্বাচনের সময়। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে বাদ পড়েছিল ১৯৭৬ সালে একটি সামরিক ফরমানের বলে। ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। সম্প্রতি ‘সেক্যুলার’ ভাবনা সংবিধানে পুনঃপ্রবেশ করলেও রাষ্ট্রধর্ম আছে বহাল তবিয়তে। দুই পাশে দুই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রবল প্রতাপে বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও ভারতের সংবিধান এখনো সেক্যুলার। আর আমরা যা-ই করি না কেন, ভারতীয়দের কেমন থাকতে হবে, এ ব্যাপারে আমাদের প্রেসক্রিপশন খুবই সরল। ওদের সেক্যুলার থাকতেই হবে। তবে ভোটের রাজনীতিতে তা নিতান্তই অবাস্তব, বিশেষত আমাদের অঞ্চলের বাস্তবতায়। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে এসে ‘বাংলাদেিশ অবৈধ অভিবাসী’ নিয়ে মাঠ গরম করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তৃণমূলের নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে একহাত নিয়েছেন। এখানেও সাম্প্রদায়িক বিভাজন। মোদির লক্ষ্য ‘হিন্দু’ ভোট আর মমতার লক্ষ্য ‘মুসলমান’ ভোট। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা প্রথমে কংগ্রেস, তারপর বামদের ভোট দিত। এখন দেয় তৃণমূলকে। বামদের হয়তো আর কিছুদিন পর খুঁজেও পাওয়া যাবে না৷
বাংলাদেশ থেকে ভারতে মানুষ যাচ্ছে কি যাচ্ছে না, এ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলার লোকের অভাব নেই। বাংলাদেশ থেকে দুই ধরনের মানুষ ভারতে যায়। ‘মুসলমানরা’ যায় রুটি-রুজির জন্য, আর ‘হিন্দুরা’ যায় নিরাপত্তার জন্য। আমরা এখানে বসে যতই হম্বিতম্বি করে বলি না কেন, এ দেশে চমৎকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে, যারা দেশত্যাগ করছে, তাঁদের ভাষ্যটা জানা খুবই জরুরি। মোদির কথায় আমি অবাক হই না। অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের যদি সৌদি আরব, মালয়েশিয়া কিংবা ডেনমার্ক থেকে বের করে দেওয়া হয়, তাহলে এ দেশে কেউ তাদের গালি দেয় না। ভারতে কেউ এ কথা বললে আমাদের রক্ত মাথায় উঠে যায়। কেন? এখানেও সাম্প্রদায়িকতা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাবে তার ইচ্ছ অনুযায়ী, যখন খুশি তখন। পঁুজি যদি এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবাধে যেতে পারে, তাহলে ‘শ্রম’ কেন পারবে না। বিশ্বব্যবস্থা তাই শ্রমিকের অনুকূল হওয়া উচিত। এ ধরনের একটি ক্লোজ দক্ষিণ এশীয় সোশ্যাল চার্টারে আছে, যা সার্ক কর্তৃক অনুমোদিত। আমরা এটার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। তবে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কাউকে ভিটেমাটি থেকে তাড়ানো নিতান্তই বর্বরতা। নানা কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে এই প্রবণতা আড়াল করার চেষ্টা নিন্দনীয়। আমরা এটা করে থাকি। নরেন্দ্র মোদি যখন বলেন, অবৈধ বাংলাদেশিদের বাক্স-পেটরাসমেত বিদায় করা হবে, তিনি আসলে তর্জনী তোলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। আবার আমাদের আপসহীন নেত্রী যখন বলেন, নৌকায় ভোট দিলে মসজিদে উলুধ্বনি হবে, তখন তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কে অপমান করেন। এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে সৎ প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করতে হলে সবাইকে আরও বেশি সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল হতে হবে। শুধু জাতীয় পর্যায়ে এটা অর্জন করা সম্ভব নয়। এর মীমাংসা হতে হবে আঞ্চলিকভাবে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেকগুলো বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এগুলোর সুরাহা হওয়া দরকার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় বলেছেন, তিস্তা চুক্তি হতে পারেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির জন্য। তিনি আরও বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সব সমস্যার সমাধান হবে আলোচনার মাধ্যমে। এ কথা বলে তিনি নরেন্দ্র মোদিকে একটি আগাম বার্তা দিতে চেয়েছেন, বাংলাদেশ ভবিষ্যতের মোদি সরকারের সঙ্গে খোলা মনে আলোচনা চালিয়ে যেতে আগ্রহী। একই সঙ্গে তিনি মমতার নাম উল্লেখ করে হয়তো বা মোদি-মমতা দ্বন্দ্বের সুযোগ নিতে চেয়েছেন। আমার কাছে শেখ হাসিনার এই বক্তব্য সময়োপযোগী ও রাষ্ট্রনায়কোচিত বলে মনে হয়েছে। তবে এটাও সত্য, মমতার অবস্থান পশ্চিমবঙ্গে আরও শক্তিশালী হয়েছে। আস্থায় নিতে হবে তাঁকেও। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমস্যা শুধু তিস্তা নিয়ে নয়; আরও অনেক সমস্যা আছে। প্রধান সমস্যাটি হলো মনস্তাত্ত্বিক। আমরা এখনো ১৯৪৭ সালের বিভাজনের ঋণ বা লিগেসি বয়ে বেড়াচ্ছি। এই উপলব্ধি থেকেই আমাদের বসতে হবে খোলা মন নিয়ে। সে জন্য দরকার কুশলী কূটনীতিকের। এখন যাঁরা এ দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁদের ব্যর্থতার দায় বইতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে। ভারতের অবস্থাও একই রকম। সাউথ ব্লকের রক্ষণশীল আমলারা একের পর এক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে চলেছেন। যদি সামনের দিকে এগোতে হয়, নরেন্দ্র মোদিকেও এই অচলায়তন ভাঙতে হবে। আমি আশাবাদী।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক৷
mohi2005@gmail.com
নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে আমাদের দেশে অনেকেরই অনেক শঙ্কা। তাঁর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক উসকানি বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। মোদির সমালোচক ভারতেও আছেন অনেকেই। সেখানে একাডেমিক বিতর্ক হয় বিস্তর, বাংলাদেশে একাডেমিক বিতর্ক তেমন নেই। ২০০০-০১ সালে গুজরাটে দাঙ্গায় দুই হাজারের বেশি মুসলমান সংখ্যালঘু নিহত হয়েছেন। অভিযোগের তির মোদির দিকে। কেননা, তিনি তখন গুজরাটে ক্ষমতায় ছিলেন। দাঙ্গা প্রতিরোধে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে তখন তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। দাঙ্গার পরপর তিনি আরও সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গুজরাটে সরকার গঠন করেন এবং তার পর থেকে গুজরাট রাজ্যে বিজেপির নিশান উড্ডীন রয়েছে। আমাদের দেশে অবশ্য অনেকেই মনে করেন, কংগ্রেস একটি সেক্যুলার দল। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা আততায়ীর হাতে নিহত হলে দিল্লিতে শিখবিরোধী দাঙ্গা হয়েছিল। নিহত হয়েছিলেন আরও বেশি শিখ। সংখ্যাটা তিন হাজারের বেশি। দাঙ্গাকারীরা কংগ্রেসের লোক ছিলেন বলে ভারতের আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ অবশ্য ভারতে শিখদের মারলে মাথা ঘামান না। মুসলমান মরলে উত্তেজিত হন। সব ধরনের দাঙ্গাই অমানবিক, নৃশংস। কিন্তু যেহেতু আমরা একধরনের ‘আইডেন্টিটি পলিটিকস’ করি, আমরা কোনো কোনো ব্যাপারে সরব, আবার কোনো কোনো বিষয়ে নীরব।
এই অঞ্চলের নেতাদের মধ্যে নানা বিষয়ে অদ্ভুত মিল দেখা যায়। খালেদা জিয়া সচরাচর শাহজালালের মাজার জিয়ারত করে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। তিনি ঘোরতর ‘জাতীয়তাবাদী’। শেখ হাসিনা একই কাজ করেন অন্য কোনো মাজার জিয়ারত করে। তিনি আপাদমস্তক ‘সেক্যুলার’। নরেন্দ্র মোদি এবার হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থক্ষেত্র বেনারস গিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি এসেছেন ‘মা গঙ্গার’ আহ্বানে। তাই তিনি হলেন ‘সাম্প্রদায়িক’। আমি তিনজনের কথা বললাম। তিনজনই সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ভোট পেতে চান। ভারতের একদিকে পাকিস্তান একটি ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’। অমুসলমানরা যেখানে প্রায় বিলীয়মান প্রজাতি। তার পরও ইসলামি জোশ ও জজবা আসমান ছাড়িয়ে যায় নির্বাচনের সময়। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে বাদ পড়েছিল ১৯৭৬ সালে একটি সামরিক ফরমানের বলে। ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। সম্প্রতি ‘সেক্যুলার’ ভাবনা সংবিধানে পুনঃপ্রবেশ করলেও রাষ্ট্রধর্ম আছে বহাল তবিয়তে। দুই পাশে দুই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রবল প্রতাপে বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও ভারতের সংবিধান এখনো সেক্যুলার। আর আমরা যা-ই করি না কেন, ভারতীয়দের কেমন থাকতে হবে, এ ব্যাপারে আমাদের প্রেসক্রিপশন খুবই সরল। ওদের সেক্যুলার থাকতেই হবে। তবে ভোটের রাজনীতিতে তা নিতান্তই অবাস্তব, বিশেষত আমাদের অঞ্চলের বাস্তবতায়। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে এসে ‘বাংলাদেিশ অবৈধ অভিবাসী’ নিয়ে মাঠ গরম করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তৃণমূলের নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে একহাত নিয়েছেন। এখানেও সাম্প্রদায়িক বিভাজন। মোদির লক্ষ্য ‘হিন্দু’ ভোট আর মমতার লক্ষ্য ‘মুসলমান’ ভোট। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা প্রথমে কংগ্রেস, তারপর বামদের ভোট দিত। এখন দেয় তৃণমূলকে। বামদের হয়তো আর কিছুদিন পর খুঁজেও পাওয়া যাবে না৷
বাংলাদেশ থেকে ভারতে মানুষ যাচ্ছে কি যাচ্ছে না, এ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলার লোকের অভাব নেই। বাংলাদেশ থেকে দুই ধরনের মানুষ ভারতে যায়। ‘মুসলমানরা’ যায় রুটি-রুজির জন্য, আর ‘হিন্দুরা’ যায় নিরাপত্তার জন্য। আমরা এখানে বসে যতই হম্বিতম্বি করে বলি না কেন, এ দেশে চমৎকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে, যারা দেশত্যাগ করছে, তাঁদের ভাষ্যটা জানা খুবই জরুরি। মোদির কথায় আমি অবাক হই না। অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের যদি সৌদি আরব, মালয়েশিয়া কিংবা ডেনমার্ক থেকে বের করে দেওয়া হয়, তাহলে এ দেশে কেউ তাদের গালি দেয় না। ভারতে কেউ এ কথা বললে আমাদের রক্ত মাথায় উঠে যায়। কেন? এখানেও সাম্প্রদায়িকতা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাবে তার ইচ্ছ অনুযায়ী, যখন খুশি তখন। পঁুজি যদি এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবাধে যেতে পারে, তাহলে ‘শ্রম’ কেন পারবে না। বিশ্বব্যবস্থা তাই শ্রমিকের অনুকূল হওয়া উচিত। এ ধরনের একটি ক্লোজ দক্ষিণ এশীয় সোশ্যাল চার্টারে আছে, যা সার্ক কর্তৃক অনুমোদিত। আমরা এটার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। তবে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কাউকে ভিটেমাটি থেকে তাড়ানো নিতান্তই বর্বরতা। নানা কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে এই প্রবণতা আড়াল করার চেষ্টা নিন্দনীয়। আমরা এটা করে থাকি। নরেন্দ্র মোদি যখন বলেন, অবৈধ বাংলাদেশিদের বাক্স-পেটরাসমেত বিদায় করা হবে, তিনি আসলে তর্জনী তোলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। আবার আমাদের আপসহীন নেত্রী যখন বলেন, নৌকায় ভোট দিলে মসজিদে উলুধ্বনি হবে, তখন তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কে অপমান করেন। এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে সৎ প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করতে হলে সবাইকে আরও বেশি সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল হতে হবে। শুধু জাতীয় পর্যায়ে এটা অর্জন করা সম্ভব নয়। এর মীমাংসা হতে হবে আঞ্চলিকভাবে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেকগুলো বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এগুলোর সুরাহা হওয়া দরকার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় বলেছেন, তিস্তা চুক্তি হতে পারেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির জন্য। তিনি আরও বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সব সমস্যার সমাধান হবে আলোচনার মাধ্যমে। এ কথা বলে তিনি নরেন্দ্র মোদিকে একটি আগাম বার্তা দিতে চেয়েছেন, বাংলাদেশ ভবিষ্যতের মোদি সরকারের সঙ্গে খোলা মনে আলোচনা চালিয়ে যেতে আগ্রহী। একই সঙ্গে তিনি মমতার নাম উল্লেখ করে হয়তো বা মোদি-মমতা দ্বন্দ্বের সুযোগ নিতে চেয়েছেন। আমার কাছে শেখ হাসিনার এই বক্তব্য সময়োপযোগী ও রাষ্ট্রনায়কোচিত বলে মনে হয়েছে। তবে এটাও সত্য, মমতার অবস্থান পশ্চিমবঙ্গে আরও শক্তিশালী হয়েছে। আস্থায় নিতে হবে তাঁকেও। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমস্যা শুধু তিস্তা নিয়ে নয়; আরও অনেক সমস্যা আছে। প্রধান সমস্যাটি হলো মনস্তাত্ত্বিক। আমরা এখনো ১৯৪৭ সালের বিভাজনের ঋণ বা লিগেসি বয়ে বেড়াচ্ছি। এই উপলব্ধি থেকেই আমাদের বসতে হবে খোলা মন নিয়ে। সে জন্য দরকার কুশলী কূটনীতিকের। এখন যাঁরা এ দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁদের ব্যর্থতার দায় বইতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে। ভারতের অবস্থাও একই রকম। সাউথ ব্লকের রক্ষণশীল আমলারা একের পর এক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে চলেছেন। যদি সামনের দিকে এগোতে হয়, নরেন্দ্র মোদিকেও এই অচলায়তন ভাঙতে হবে। আমি আশাবাদী।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক৷
mohi2005@gmail.com
No comments