আমার ভয় কি ভিত্তিহীন? by নন্দিতা দাস
ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার
নির্বাচিত হওয়া একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া৷ এটা এক বিশাল গণতান্ত্রিক
কর্মযজ্ঞ৷ ফলে জনগণের রায় নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে আমাদের এর প্রতি
শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত৷ আগেভাগে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক থাকাও
উচিত৷ অন্যদিকে এটাও সত্য যে, আমাদের অনেকের জন্য ভীত হওয়ার কারণও আছে৷
>>নিন্দতা দাস: ভারতীয় অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্র পরিচালক৷
শুরু
করা যাক বহুকথিত ও প্রতিশ্রুত ‘উন্নয়নের’ মডেল নিয়ে৷ অভিজাত ও
মধ্যবিত্তদের মধ্যে ‘গুজরাট মডেল’ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে৷
বিষয়টি মাথায় রাখার জন্য বলছি, এই রাজ্যটি ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর তুলনায়
উদ্যোগবান্ধব, সমৃদ্ধও বটে৷ বিগত দশকে অর্থনীতির সাধারণ সূচকেই
মহারাষ্ট্র, বিহার ও তামিলনাড়ু গুজরাটের তুলনায় ভালো করেছে৷
যা-ই হোক, অর্থনৈতিক অগ্রগতিই সফলতার একমাত্র মাপকাঠি নয়৷ ভারতের বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশের মূল স্রোতের বাইরে অবস্থান করে৷ নানাভাবেই তারা দুর্গতি ভোগ করে৷ করপোরেট নীতি দ্বারা পরিচালিত অর্থনৈতিক মডেলে কি এই মানুষগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণ হবে? সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কি কোনো সামাজিক কর্মসূচি থাকবে? উন্নয়ন কি সবার কপালে জুটবে?
আমাদের ২০০২ সালের দাঙ্গার ভয়াল স্মৃতি ঝেড়ে ফেলতে বলা হলেও দেশভাগের বা তারও আগে বাবরের যুগের স্মৃতিচারণা করতে কোনো সমস্যা নেই৷ আমার ভয় হচ্ছে, ২০০২ সালের দাঙ্গার ব্যাপারে কোনো অনুশোচনা তো দেখা যাচ্ছে না, উপরন্তু এ-বিষয়ক একধরনের পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব এবং এমনকি এটাকে বৈধতা দেওয়ারও চেষ্টা চলছে৷ নির্বাচনে প্রচারাভিযানের সময় একধরনের উগ্র ধর্মীয় আবেগ জাগানোর চেষ্টা স্পষ্টতই লক্ষ করা গেছে৷
এই ‘উন্নয়নের’ গল্পের ভেতরে এক বিভাজনের রাজনীতি আছে৷ মুজাফফরনগরে অমিত শাহর বক্তব্য, মোদির কিস্তি টুপি (মুসলমানদের ব্যবহৃত টুপি) পরতে অস্বীকৃতি—যদিও তিনি আর অন্য সব টুপি–পাগড়ি পরতে দ্বিধা করেননি৷ প্রাভিন টোগাডিয়ার তো মুসলমানদের ‘হিন্দু এলাকা’ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে বিভাজনের রাজনীতিকে আরও উসকে দিয়েছে৷ এগুলো নমুনা মাত্র, আরও অনেক রয়েছে৷
কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় তাৎক্ষণিক ভীতি হচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ হতে পারে৷ গণতন্ত্র ভিন্নমতকে প্রকাশের সুযোগ দেয়৷ এ কারণে জনগণ তাদের মত পরিবর্তন করতে পারে, সরকারও পরিবর্তন করতে পারে৷ গণতান্ত্রিক ও সভ্য পন্থায় তাঁদের অসন্তুষ্টির কথা বলতে পারে৷ বিজেপি ও তার সমর্থকেরা সব সময় সমালোচনা স্তব্ধ করে দিতে চায়৷ তা হোক সেন্সরশিপ আরোপ বা বল প্রয়োগ করে, যখন যেটা সুবিধাজনক৷ কিন্তু আমি কখনোই দেখিনি যে ধর্মনিরপেক্ষ দলকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানালেও মোদি সমর্থকদের আক্রোশের শিকার হতে হয়৷ আজ আমার ভিন্নমত ধারণকারী একটি টুইটবার্তার প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, ‘বাচ্চাদের নিয়ে পাকিস্তান চলে যান!’ এর ভেতরের অর্থ ভয়ংকর৷
২০০৮ সালে আমি ফিরাক নামে একটি ছবি নির্মাণ করি৷ এর বিষয়বস্তু ছিল গুজরাট দাঙ্গার পর মানুষ কীভাবে এর পরিণাম ভোগ করে৷ ছবিতে কারও প্রতি অভিযোগের আঙুল তোলা হয়নি৷ তবে সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল পরিষ্কার৷ ছবিটি বেশ প্রশংসিত হয়৷ যাঁরা খোলা মন নিয়ে ছবিটি দেখতে পারেননি, তাঁরা এর সমালোচনাও করেন৷ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর খুব একটা ব্যবসা করতে পারেনি৷ নির্বাচন কাছাকাছি চলে আসার কারণে এমনটা হয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়৷
কিন্তু আজ যদি ছবিটি মুক্তি দিতে হতো, তাহলে বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়তে হতো, এমনকি নির্বাচন ও এনডিএর বিজয় দেখানো হলেও৷ শিল্পী হিসেবে আমি বিপন্নবোধ করছি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায়৷ এই প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ কী জিনিস, আমি তা বুঝতে পারছি৷ নিজেকে বিপদমুক্ত রাখার জন্য গণমাধ্যম এ কাজ করছে৷ এ থেকে বোঝা যায়, সামনের দিনগুলোতে কী ঘটতে পারে৷
এই নীরবতা ভীষণ রকম কান ফাটানো৷ ভিন্নমতের মানুষের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যাবে৷ তাই আজ আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, আমার ভয়গুলো কি ভিত্তিহীন?
ভারতের দি আউটলুক ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
নিন্দতা দাস: ভারতীয় অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্র পরিচালক৷
যা-ই হোক, অর্থনৈতিক অগ্রগতিই সফলতার একমাত্র মাপকাঠি নয়৷ ভারতের বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশের মূল স্রোতের বাইরে অবস্থান করে৷ নানাভাবেই তারা দুর্গতি ভোগ করে৷ করপোরেট নীতি দ্বারা পরিচালিত অর্থনৈতিক মডেলে কি এই মানুষগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণ হবে? সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কি কোনো সামাজিক কর্মসূচি থাকবে? উন্নয়ন কি সবার কপালে জুটবে?
আমাদের ২০০২ সালের দাঙ্গার ভয়াল স্মৃতি ঝেড়ে ফেলতে বলা হলেও দেশভাগের বা তারও আগে বাবরের যুগের স্মৃতিচারণা করতে কোনো সমস্যা নেই৷ আমার ভয় হচ্ছে, ২০০২ সালের দাঙ্গার ব্যাপারে কোনো অনুশোচনা তো দেখা যাচ্ছে না, উপরন্তু এ-বিষয়ক একধরনের পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব এবং এমনকি এটাকে বৈধতা দেওয়ারও চেষ্টা চলছে৷ নির্বাচনে প্রচারাভিযানের সময় একধরনের উগ্র ধর্মীয় আবেগ জাগানোর চেষ্টা স্পষ্টতই লক্ষ করা গেছে৷
এই ‘উন্নয়নের’ গল্পের ভেতরে এক বিভাজনের রাজনীতি আছে৷ মুজাফফরনগরে অমিত শাহর বক্তব্য, মোদির কিস্তি টুপি (মুসলমানদের ব্যবহৃত টুপি) পরতে অস্বীকৃতি—যদিও তিনি আর অন্য সব টুপি–পাগড়ি পরতে দ্বিধা করেননি৷ প্রাভিন টোগাডিয়ার তো মুসলমানদের ‘হিন্দু এলাকা’ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে বিভাজনের রাজনীতিকে আরও উসকে দিয়েছে৷ এগুলো নমুনা মাত্র, আরও অনেক রয়েছে৷
কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় তাৎক্ষণিক ভীতি হচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ হতে পারে৷ গণতন্ত্র ভিন্নমতকে প্রকাশের সুযোগ দেয়৷ এ কারণে জনগণ তাদের মত পরিবর্তন করতে পারে, সরকারও পরিবর্তন করতে পারে৷ গণতান্ত্রিক ও সভ্য পন্থায় তাঁদের অসন্তুষ্টির কথা বলতে পারে৷ বিজেপি ও তার সমর্থকেরা সব সময় সমালোচনা স্তব্ধ করে দিতে চায়৷ তা হোক সেন্সরশিপ আরোপ বা বল প্রয়োগ করে, যখন যেটা সুবিধাজনক৷ কিন্তু আমি কখনোই দেখিনি যে ধর্মনিরপেক্ষ দলকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানালেও মোদি সমর্থকদের আক্রোশের শিকার হতে হয়৷ আজ আমার ভিন্নমত ধারণকারী একটি টুইটবার্তার প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, ‘বাচ্চাদের নিয়ে পাকিস্তান চলে যান!’ এর ভেতরের অর্থ ভয়ংকর৷
২০০৮ সালে আমি ফিরাক নামে একটি ছবি নির্মাণ করি৷ এর বিষয়বস্তু ছিল গুজরাট দাঙ্গার পর মানুষ কীভাবে এর পরিণাম ভোগ করে৷ ছবিতে কারও প্রতি অভিযোগের আঙুল তোলা হয়নি৷ তবে সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল পরিষ্কার৷ ছবিটি বেশ প্রশংসিত হয়৷ যাঁরা খোলা মন নিয়ে ছবিটি দেখতে পারেননি, তাঁরা এর সমালোচনাও করেন৷ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর খুব একটা ব্যবসা করতে পারেনি৷ নির্বাচন কাছাকাছি চলে আসার কারণে এমনটা হয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়৷
কিন্তু আজ যদি ছবিটি মুক্তি দিতে হতো, তাহলে বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়তে হতো, এমনকি নির্বাচন ও এনডিএর বিজয় দেখানো হলেও৷ শিল্পী হিসেবে আমি বিপন্নবোধ করছি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায়৷ এই প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ কী জিনিস, আমি তা বুঝতে পারছি৷ নিজেকে বিপদমুক্ত রাখার জন্য গণমাধ্যম এ কাজ করছে৷ এ থেকে বোঝা যায়, সামনের দিনগুলোতে কী ঘটতে পারে৷
এই নীরবতা ভীষণ রকম কান ফাটানো৷ ভিন্নমতের মানুষের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যাবে৷ তাই আজ আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, আমার ভয়গুলো কি ভিত্তিহীন?
ভারতের দি আউটলুক ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
নিন্দতা দাস: ভারতীয় অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্র পরিচালক৷
No comments