বাংলাদেশকে তুলে ধরার প্রশংসনীয় উদ্যোগ
বিদেশে বাংলাদেশকে সঠিকভাবে তুলে ধরার নানা রকম উদ্যোগ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আজকাল প্রায় নিয়মিতভাবে নেওয়া হচ্ছে। তবে এসব উদ্যোগ ঠিক কতটা ফলপ্রসূ, তা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়নি। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের নানা রকম অগ্রগতি সত্ত্বেও খুব একটা ইতিবাচকভাবে যে বাংলাদেশকে আমরা বিদেশিদের কাছে নিয়ে যেতে পারছি, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশকে দেখা হয় সমস্যাসংকুল এমন এক দেশ হিসেবে, যে দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও অন্ধকারাচ্ছন্ন। ভাবমূর্তির এই নেতিবাচক প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে বিদেশে আমাদের প্রকৃত বন্ধুরা সবচেয়ে ফলপ্রসূ হতে পারে। প্রয়াত রাজনীতিবিদ তাকেশি হায়াকাওয়ার মতো বাংলাদেশের বিশিষ্ট বন্ধুরা জাপানে আমাদের দেশ সম্পর্কে সার্বিক নেতিবাচক ধারণা কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠায় সাহায্য করেছিলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক একটি উদ্যোগের প্রশংসা অবশ্যই করতে হয়। সেই উদ্যোগটি ছিল জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রছাত্রীকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো এবং কাছে থেকে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ দেশের সঠিক পরিচিতি তাঁদের সামনে তুলে ধরা। জাপানের সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর যে কয়েক শ বাংলাদেশি নাগরিককে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় জাপানে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, সেই দলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা একেবারে কম নয়।
আজ যাঁরা ছাত্র, ভবিষ্যতে তাঁরাই দেশ পরিচালনার হাল ধরবেন বলে তরুণদের আমন্ত্রণ জানানো অবশ্যই এমন এক ভবিষ্যৎমুখী ভাবনা, ভবিষ্যতে যা হয়তো দুই দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে তুলতে সহায়ক হবে। জাপান সরকার অনেক আগে থেকে সেই বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছে বলেই বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যেও অনেকে আমন্ত্রিত হয়ে জাপান ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন। সেই মাপকাঠিতে আমরা অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। উদ্যোগটি এ কারণে আরও বেশি অর্থবহ যে, আমন্ত্রিত সেই শিক্ষার্থীদের সবাই টোকিও বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও বাংলার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াবলি নিয়ে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। ধরে নেওয়া যায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে তাঁদের অনেকেই পেশাগত জীবনে সম্ভবত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবেন। বাংলাদেশের সঙ্গে এক দীর্ঘমেয়াদি বন্ধনে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা তাঁদের বেলায় অন্য যেকোনো জাপানি নাগরিকের চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণেই এখন থেকে দেশের পরিচয় তাঁদের সামনে আরও ভালোভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সেই বন্ধনকে অনেক বেশি অর্থবহ করে তোলা হয়তো সম্ভব। উদ্যোগের সূচনা টোকিও বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর আগে বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ কোর্স চালু হওয়ার সময় থেকে। টোকিওতে বাংলাদেশের দূতাবাস সেই সময় থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে আসছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও দূতাবাসের সক্রিয় সহযোগিতার হাত প্রসারিত আছে এবং সেই সূত্র ধরেই রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের পাঠ শেষ করা ছাত্রছাত্রীদের সপ্তাহ খানেকের জন্য বাংলাদেশ ভ্রমণের সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে করেছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই প্রস্তাবের গুরুত্ব অনুধাবন করে এতে সায় দেওয়ায় ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয়ার্ধে বাস্তবায়িত হয় জাপানে বাংলার ছাত্রছাত্রীদের সেই কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ ভ্রমণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের নেতৃত্বে ১০ জন ছাত্রের সেই দলটি বাংলাদেশে ছয় দিন অবস্থানকালে ভাষাশহীদদের স্মরণে আয়োজিত বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ছাড়াও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের দেওয়া নৈশভোজে যোগ দিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে বাংলা ভাষায় আন্তরিকভাবে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিল। এ ছাড়া জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তারা গিয়েছিল এবং মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সুন্দরবন দেখার সুযোগও তাদের হয়েছিল।
সড়কপথে সুন্দরবন যাওয়া ছিল আরেক মনোরম অভিজ্ঞতা। এ ছাড়া তারা খুলনা শহরে জেলা প্রশাসকের আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিল্পীদের নৃত্য ও সংগীত পরিবেশনা কাছ থেকে দেখে আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের চমৎকার কিছু দৃষ্টান্ত উপভোগ করেছে। সে অনুষ্ঠানে জাপানি ছাত্রছাত্রীরাও মঞ্চে উঠে পরিষ্কার বাংলায় ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’ গাইতে শুরু করলে অভিভূত স্থানীয় শিল্পী ও দর্শকেরাও কণ্ঠ মেলান। সবশেষে লঞ্চে সুন্দরবন ভ্রমণ তাদের জন্য যেন ছিল বাংলার সমৃদ্ধ প্রকৃতিকে কাছে থেকে দেখে মুগ্ধ হওয়া। ছয় দিনের নানা রকম অভিজ্ঞতায় ভরপুর ভ্রমণের শেষে দেশে ফিরে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলে তাদের প্রায় সবাইকেই বিষণ্ন হতে দেখা গেছে। সেই বিষণ্নতা ছিল বাংলাদেশকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারার পর হঠাৎ করেই অল্প সময়ের মধ্যে বিচ্ছেদ তৈরি হওয়ার বিষণ্নতা। ছাত্রছাত্রীদের প্রায় সবাইকেই বলতে শোনা গেছে, আবারও তারা ফিরে আসবে বাংলাদেশের চমৎকার পরিবেশে। তাদের সবার কাছেই বাংলাদেশের যে দিকটিকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে, তা হলো দেশটির মানুষ। বাংলাদেশের মানুষের আন্তরিকতায় তারা মুগ্ধ। ফলে ভবিষ্যতে আবারও কাজের সূত্রে বাংলাদেশে আসতে হলে অতিথিপরায়ণ বাংলাদেশিদের আতিথেয়তার কথা তারা অবশ্যই মনে রাখবে। বাংলাদেশ ভ্রমণের স্মৃতি তাদের মনে যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ফিরতি পথে বিমানযাত্রায় তাদের মধ্যে কারও কারও চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। আশা করা যায়, বাংলাদেশ সরকার জাপানে বাংলা নিয়ে লেখাপড়া করা তরুণদের আমন্ত্রণ জানানোর এই কর্মসূচি কেবল একবারের মধ্যে সীমিত না রেখে নিয়মিত এক বার্ষিক আয়োজনে পরিণত করে নেবে। বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তির এই আকালের সময়ে এর চেয়ে ফলপ্রসূ ও অর্থবহ উদ্যোগ অন্য কিছুতে তো আর হতে পারে না।
টোকিও, জাপান
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
টোকিও, জাপান
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments