মুক্তিযুদ্ধের মর্ম: হিংসা, ঘৃণা ও বৈষম্যহীনতা
ষোলোই ডিসেম্বরের কয়েক সপ্তাহ পরে জেলখানায় যাই। পুলিশের গাড়িতে কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে নেমে ভেতরে ঢুকে অন্য রকম অনুভূতি হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে এই জেলখানার ইতিহাস একাকার হয়ে আছে। শুধু চোর, ডাকাত, খুনি ও অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত ও দণ্ডিতরাই নয়, এই জেলখানায় কত রাজনৈতিক সংগঠনের দেশপ্রেমিক নেতা-কর্মী তাঁদের জীবনের কত অমূল্য সময় কাটিয়েছেন। মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব ছিলেন। ছিলেন অসংখ্য জাতীয়তাবাদী, বামপন্থী ও কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী। যাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছেন, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন; তাঁদের ঠাঁই হয়েছে এই কারাগারে। তাঁরা বিনা বিচারে বছরের পর বছর এখানে কাটিয়েছেন যৌবনের অমূল্য দিনগুলো। তাঁদের কোনো অপরাধ ছিল না। অপরাধ যদি হয়েই থাকে, তা তাঁদের দেশপ্রেম। জেলখানায় গিয়ে তাঁদের কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হই। অন্যদিকে এই কারাগারেই যুগে যুগে ঠাঁই হয়েছে অনেক সমাজবিরোধী, মানবতাবিরোধী ও দেশদ্রোহীর। বস্তুত তাদেরই এখানে থাকার কথা, তাদের জন্যই এই স্থাপনা তৈরি। আমি যেদিন যাই, সেদিনও কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের সংখ্যাই ছিল বেশি। তখন সাধারণ অপরাধীর সংখ্যা কম। নিয়াজীর আত্মসমর্পণের পরপরই বহু পাকিস্তানি দালালকে গ্রেপ্তার করে জেলে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করার কয়েক দিন পরে একদিন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যেসব বিখ্যাত দালাল আটক আছেন, তাঁদের অবস্থা সচক্ষে দেখে আসো। পরদিন তিনি আইজি আবদুল খালেক, আইজি বা ডিআইজি প্রিজন ও অন্যান্য কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে কারাগারে যান। আমরা কয়েকজন তাঁর সঙ্গে যাই।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার তাজউদ্দীন সাহেবের অতি পরিচিত জায়গা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অনেকবার তাঁকে ওখানকার বাসিন্দা হতে হয়েছে। তিনি জেলের ভেতরে গিয়ে ঘুরে ঘুরে অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। কিছুটা বিব্রতও বোধ করেন। শুধু পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক নেতারা নন, বন্দী ছিলেন লেখক-বুদ্ধিজীবীদের অনেকে। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক কাজী দীন মোহাম্মদ প্রমুখ। ড. দীন মোহাম্মদকেও কিছু একটা জিজ্ঞেস করেন। কারা পরিদর্শন শেষে তাজউদ্দীন সাহেব সাংবাদিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কিছুক্ষণ কথা বলেন। তাঁর কথার মধ্যে একটি কথা ছিল, ‘এখানে তো দেখলাম অনেকেই আমাদের আগের চেনাজানা লোক।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু ছিল একটি পরিপূর্ণ যুদ্ধ এবং প্রথাগত যুদ্ধ নয় জনযুদ্ধ, সেখানে দেখা যায় একই পরিবারের দুই ভাই গেছেন মুক্তিযুদ্ধে, আরেক ভাই পাকিস্তানি বাহিনীর দালালি করেছেন। এক ভাই অস্ত্র হাতে নিয়ে হত্যা করেছেন শত্রু সৈন্যকে, অন্য ভাই পাকিস্তানিদের সরবরাহ করা অস্ত্রে হত্যা করেছেন মুক্তিসেনা বা স্বাধীনতাকামীদের। সাম্প্রতিক সময়েই ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধে এমনটি হয়নি। সেখানে অধিকৃত মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে হো চি মিনের সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করেছেন। সেখানে রাজাকার আলবদর ছিল না। সৈয়দ আলী আহসান কলকাতায় গিয়ে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁর ভাই সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন দেশে থেকে দখলদার সরকারকে সহযোগিতা করেছেন। হয়েছেন উপাচার্য। একই পরিবারে স্বাধীনতাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা এবং শান্তিবাহিনীর রাজাকার আলবদর থাকায় স্বাধীনতার পরে সংহত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের কাজটি কঠিন হয়ে পড়ে। যতই আদর্শ থাকুক, একটি সময় রক্তসম্পর্ক, আত্মীয়তা ও বন্ধুত্ব বড় হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে যে উপাদানটি যোগ হয় তা হলো বঙ্গবন্ধুর স্নেহশীলতা। কিন্তু তাঁর সেই ক্ষমাশীলতার মর্যাদা স্বাধীনতাবিরোধীরা দেয়নি। কারণ, জাতি হিসেবেই আমাদের মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধের চেয়ে কৃতঘ্নতার উপাদান বেশি। স্বাধীনতাবিরোধীরা কোনো জাতির সর্বোচ্চ বিশ্বাসঘাতক। যেকোনো প্রাণীর মতো মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তারাও একদিন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু যুগ যুগ মানুষ তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। যেমন, মীর জাফর, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, রায় দুর্লভ চিরকাল ঘৃণার পাত্র। ঘৃণা জিনিসটি মানুষের মনের ব্যাপার। সভ্য জগতে আনুষ্ঠানিকভাবে তা প্রকাশের প্রয়োজন হয় না। জীবিত বা মৃত কারও প্রতি অথবা কোনো গোত্রের প্রতি প্রকাশ্যে ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে খাঁটি দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটে না। দেশপ্রেম অতি উঁচু স্তরের মানবিক মূল্যবোধ। রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ১২ মার্চ জানিয়েছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা স্তম্ভের’ পাশাপাশি দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় রাজাকারদের প্রতি নতুন প্রজন্মের সন্তানদের ঘৃণা জানানোর জন্য ‘ঘৃণা স্তম্ভ’ নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ খেতাবে ভূষিত করার প্রক্রিয়া চলছে।’ [সমকাল, ১৩ মার্চ]
মাননীয় মন্ত্রীর এই নীতিনির্ধারণী বক্তব্য আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন মনে হয়েছে। ২০০৮ বা ২০১৪-এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয়, তাতে এ ধরনের কোনো অঙ্গীকার ছিল বলে মনে পড়ে না। কয়েক দিন আগে তিনি ঘোষণা করেছেন, আরও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাকে বীর উত্তম, বীর বিক্রম প্রভৃতি খেতাব দেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধুর সরকার যাঁদের খেতাব দিয়েছে, তার বাইরে ৪৩ বছর পরে আবার নতুন করে খেতাব দেওয়া শুরু হলে অন্য দলের মুক্তিযোদ্ধারা না পেলেও শুধু দলীয় মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব দিয়েই সন্তুষ্ট করতে পারবে বলে মনে হয় না। দাবিদার যে কত বের হবে, তা এখন কল্পনাও করা যাবে না। তা ছাড়া যত দেরিতেই হোক, কোনো না কোনো দিন যখন অন্য কোনো দলের সরকার আসবে, তারা যে বিপুলসংখ্যক দলীয় লোককে মুক্তিযোদ্ধার খেতাব দেবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়। একদিন এমন ব্যক্তিও খেতাব পাবেন, একাত্তরে যার বয়স ছিল পাঁচ মাস। অথবা এমন কোনো বৃদ্ধ, যিনি একাত্তরে পাকিস্তানিদের সেনাক্যাম্পে ফাইফরমাশ খেটেছেন। আমাদের এ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টান্ত প্রচুর। আমার ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধুপ্রতিম জনাব মোজাম্মেল হককে আমি খুব ভালোভাবে জানি ’৭২ থেকে। আমাদের অগ্রজপ্রতিম সাংবাদিক টঙ্গীর অধিবাসী প্রয়াত মীজানুর রহমান, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুবই স্নেহভাজন এবং তাঁর অফিস ও বাসভবনে যখন-তখন ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত, মোজাম্মেল ভাইকে ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। তিনি অতি সজ্জন ও সরল মানুষ। খাঁটি আওয়ামী লীগের নেতা। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে মন্ত্রিসভায় নেওয়ায় আমি সন্তুষ্ট হই। শপথ নেওয়ার কয়েক মিনিট পরেই তাঁর সঙ্গে আমার কোলাকুলি ও কথা হয়। তখনই বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সুযোগ আছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে তাঁর কাজ করার আগ্রহও রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে কৃষক শ্রমিক পরিবারেই মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বিপুল। তাঁদের অনেকেই আর্থিক অসচ্ছলতায় রয়েছেন। অনেকে ভাতা পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তাঁদের ভাতা বাড়িয়েছে। কিছু সুযোগ-সুবিধাও। আরও সম্মানজনকভাবে যাতে তাঁরা জীবনযাপন করতে পারেন, সে ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় করতে পারে। দেশজুড়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মুক্তিযোদ্ধা স্তম্ভ এবং ঘৃণা স্তম্ভ বানিয়ে জাতিকে আত্মমর্যাদাশীল ও সুসংহত করা যাবে না। দেশটি ছোট ও ঘনবসতিপূর্ণ। হিংসা ও হানাহানির সুবন্দোবস্ত করা হলে তার কুফল ভোগ করবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। বিশেষ করে গ্রামপ্রধান এই দেশে। ঘৃণা স্তম্ভ বানানোর বিষয়টি ও অন্যান্য নতুনতর সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদের কোনো সভায় আলোচনার পর গৃহীত হয়েছে কি না, জানি না। দু-একটি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত জাতির ও দলের অপূরণীয় ক্ষতি করে। মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেওয়াটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল। প্রশাসন বিভক্ত হয়ে যায়।
মাননীয় মন্ত্রীর এই নীতিনির্ধারণী বক্তব্য আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন মনে হয়েছে। ২০০৮ বা ২০১৪-এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয়, তাতে এ ধরনের কোনো অঙ্গীকার ছিল বলে মনে পড়ে না। কয়েক দিন আগে তিনি ঘোষণা করেছেন, আরও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাকে বীর উত্তম, বীর বিক্রম প্রভৃতি খেতাব দেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধুর সরকার যাঁদের খেতাব দিয়েছে, তার বাইরে ৪৩ বছর পরে আবার নতুন করে খেতাব দেওয়া শুরু হলে অন্য দলের মুক্তিযোদ্ধারা না পেলেও শুধু দলীয় মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব দিয়েই সন্তুষ্ট করতে পারবে বলে মনে হয় না। দাবিদার যে কত বের হবে, তা এখন কল্পনাও করা যাবে না। তা ছাড়া যত দেরিতেই হোক, কোনো না কোনো দিন যখন অন্য কোনো দলের সরকার আসবে, তারা যে বিপুলসংখ্যক দলীয় লোককে মুক্তিযোদ্ধার খেতাব দেবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়। একদিন এমন ব্যক্তিও খেতাব পাবেন, একাত্তরে যার বয়স ছিল পাঁচ মাস। অথবা এমন কোনো বৃদ্ধ, যিনি একাত্তরে পাকিস্তানিদের সেনাক্যাম্পে ফাইফরমাশ খেটেছেন। আমাদের এ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টান্ত প্রচুর। আমার ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধুপ্রতিম জনাব মোজাম্মেল হককে আমি খুব ভালোভাবে জানি ’৭২ থেকে। আমাদের অগ্রজপ্রতিম সাংবাদিক টঙ্গীর অধিবাসী প্রয়াত মীজানুর রহমান, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুবই স্নেহভাজন এবং তাঁর অফিস ও বাসভবনে যখন-তখন ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত, মোজাম্মেল ভাইকে ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। তিনি অতি সজ্জন ও সরল মানুষ। খাঁটি আওয়ামী লীগের নেতা। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে মন্ত্রিসভায় নেওয়ায় আমি সন্তুষ্ট হই। শপথ নেওয়ার কয়েক মিনিট পরেই তাঁর সঙ্গে আমার কোলাকুলি ও কথা হয়। তখনই বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সুযোগ আছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে তাঁর কাজ করার আগ্রহও রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে কৃষক শ্রমিক পরিবারেই মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বিপুল। তাঁদের অনেকেই আর্থিক অসচ্ছলতায় রয়েছেন। অনেকে ভাতা পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তাঁদের ভাতা বাড়িয়েছে। কিছু সুযোগ-সুবিধাও। আরও সম্মানজনকভাবে যাতে তাঁরা জীবনযাপন করতে পারেন, সে ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় করতে পারে। দেশজুড়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মুক্তিযোদ্ধা স্তম্ভ এবং ঘৃণা স্তম্ভ বানিয়ে জাতিকে আত্মমর্যাদাশীল ও সুসংহত করা যাবে না। দেশটি ছোট ও ঘনবসতিপূর্ণ। হিংসা ও হানাহানির সুবন্দোবস্ত করা হলে তার কুফল ভোগ করবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। বিশেষ করে গ্রামপ্রধান এই দেশে। ঘৃণা স্তম্ভ বানানোর বিষয়টি ও অন্যান্য নতুনতর সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদের কোনো সভায় আলোচনার পর গৃহীত হয়েছে কি না, জানি না। দু-একটি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত জাতির ও দলের অপূরণীয় ক্ষতি করে। মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেওয়াটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল। প্রশাসন বিভক্ত হয়ে যায়।
যার পরিণামে ২১টি বছর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়। সামরিক-বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের অন্যভাবে পুরস্কৃত করা যেত। ওই সিদ্ধান্তের পর ৯৫ শতাংশ কর্মকর্তা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চাননি। সব দেশেরই স্বাধীনতাসংগ্রামের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। অনেক দেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মিল নেই। পাকিস্তান এমনিতেই ছিল ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত—দুই মুল্লুকে দুই খণ্ড। লাখ লাখ বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন। সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনে ছিলেন। হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তাঁদের অনেকে অংশ নেওয়ার অশেষ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। সেটা তাঁদের অপরাধ নয়। কলকাতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা অবদান রেখেছেন বেশি কিন্তু ছিলেন নিরাপদে। করাচিতে একাত্তরে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ছিলেন হায়েনার খাঁচার মধ্যে। তাঁদের বেদনাকে মূল্য না দেওয়া ছিল চরম নির্বুদ্ধিতা। দুই বছর পর তাঁরা যখন দেশে ফেরেন, জাতিসংঘের মাধ্যমে তাঁদের দুই বছরের জুনিয়রকে ‘স্যার’ বলতে বাধ্য করা হয়। মুখে তাঁরা ‘স্যার’ বলেছেন বটে, তাঁদের বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। কারও কারও মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা জেগেছে। প্রায় সব দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অর্থ ও তাৎপর্য তাদের সব জনগোষ্ঠীর কাছে অভিন্ন। বাংলাদেশে তা নয়। এক এক শ্রেণীর কাছে এক এক রকম। তা ছাড়া বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খোলামেলাভাবে একাডেমিক আলোচনাও বিপজ্জনক। কিছু কথা রেখেঢেকে বলতে হয়। যৌন প্রসঙ্গে গুরুজনের সামনে আলোচনা যেমন নিষিদ্ধ (taboo), তেমনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্ত আলোচনাও— বিশেষ প্রচলিত ডিসকোর্সের বাইরে ভিন্ন ব্যাখ্যা—দেশদ্রোহিতার শামিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অর্থ বা ব্যাখ্যা এক এক শ্রেণীর কাছে এক এক রকম হওয়ার কারণ কী? খুব বাস্তব কারণ রয়েছে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধারাও সবাই অভিন্ন মত পোষণ করেন না। যিনি একাত্তরের ২৬ মার্চ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন শত্রুর বিরুদ্ধে, তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের যে আবেদন, যিনি আট মাস নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ‘পাকসেনাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে’ পড়েন, তাঁর কাছে অন্য রকম আবেদন। যাঁরা ভারতের মাটিতে থেকে যুদ্ধ করেছেন আর যাঁরা বাংলাদেশের মাটিতে থেকে লড়াই করেছেন—তাঁদের মনোজগৎ এক রকম হতে পারে না। যাঁরা স্বপ্রণোদিত হয়ে এদিক-ওদিক থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে পাকিস্তানি বাহিনীর মোকাবিলা করেছেন গেরিলা কায়দায় কাদের সিদ্দিকীর মতো, তাঁদের সঙ্গে সার্ভিস থেকে যোগ দেওয়া সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনার মিল হবে না। যাঁরা নয় মাস দালালি না করলেও জীবিকার জন্য টিক্কা সরকারের চাকরি-বাকরি করেছেন, তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য অন্য রকম।
যে গরিবের তিনটি ছেলেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছেন, তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধ এক জিনিস। যে উচ্চবিত্তের এক ছেলে শহীদ হয়েছেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও মিডিয়াকে অন্যভাবে ব্যবহার করবেন। যেসব হিন্দুর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর রাজাকার, তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ এক জিনিস আর সেপ্টেম্বর মাসে এক পাঞ্জাবি তাঁর ঢাকার বাড়িটি যাঁর কাছে পানির দামে বেঁচে দিয়ে চলে যান, তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধ অন্য জিনিস। যাঁরা সেদিন মোনাজাত করেছেন যে পাকিস্তানটা টিকে থাকুক, তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ একটা ‘গন্ডগোল’ ছাড়া কিছু নয়। ৪৩ বছর যাবৎ বিভিন্ন গোত্র নিজ নিজ স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করছে। ফলে মূল চেতনাটি গেছে হারিয়ে। জাতিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে যাঁরা যুদ্ধ করেন, তাঁদের কাছে চাকরিতে দুই বছরের সিনিয়রিটি তুচ্ছ, দুটি ইনক্রিমেন্ট হাস্যকর প্রাপ্তি। আজ মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট ব্যবহূত হয় প্রমোশনের জন্য, চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য, জাতীয় পদক-পুরস্কারের জন্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অমেধাবী সন্তানদের ভর্তির জন্য, ভালো পোস্টিংয়ের জন্য। মহাজোটের আমলে সম্ভবত আজ ৯৯ শতাংশ সরকারি চাকুরে মুক্তিযোদ্ধা—কারও বয়স ৪৪-এর কম হলেও। যে দল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, যেসব দলের একাত্তরে জন্মই হয়নি এবং যেসব দল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল পাকিস্তান রক্ষা করতে, তারা মুক্তিযুদ্ধকে অপব্যবহার করলে দুঃখ নেই। কিন্তু যে দল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই দলের কাছে মুক্তিযুদ্ধের মহিমা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার চেয়ে বেদনার আর কিছু হতে পারে না। যে জিনিস হাজার বছরে কোনো জাতির জীবনে একবারই মাত্র আসে, তাকে যার-তার সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। ‘আর একটি মুক্তিযুদ্ধ’ বা ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের’ কথা শোনা যায় দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখে। তাতে মুক্তিযুদ্ধের মহিমা ক্ষুণ্ন হয়। মুুক্তিযুদ্ধ হয়েই ছিল একটি সংহত, সম্প্রীতিপূর্ণ ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠনের জন্য, যেখানে থাকবে না হিংসা, ঘৃণা ও বৈষম্যের কোনো স্থান।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments