পরীক্ষার ফল নিয়ে বিষোদ্গার নয় by বিমল সরকার
চাটুকারিতা ও তোষামোদী যে একটি জাতিকে
দিনে দিনে কী অন্ধকার ও গভীর অতলে নিয়ে যেতে পারে, এর প্রচুর দৃষ্টান্ত
আমাদের চারপাশে রয়েছে। চাটুকার ও তোষামোদকারীদের কাজই হচ্ছে কারও বা কোনো
কিছুর আসল রূপ, চিত্র, পরিবেশ বা পরিস্থিতিকে আড়াল করে রেখে সবাইকে
বিভ্রান্ত করা। যে কোনোভাবেই হোক কায়েমি স্বার্থ রক্ষা করাই তাদের আসল
লক্ষ্য। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর ওই ফলাফলকে
কেন্দ্র করে সরকারের একেবারে উচ্চমহল থেকে শুরু করে বিরোধী দল এবং বলতে
গেলে সর্বত্র এবার যত আলোচনা, সমালোচনা, মন্তব্য ও অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে
অতীতে কোনো পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে এমনটা লক্ষ্য করা যায়নি। ফলাফলের
ব্যাপারে রাজনীতিকদের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য রাজনীতির ক্ষেত্রে সাময়িক
কিছুটা প্রভাব ফেললে ফেলতেও পারে, তবে তা ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থী ও
অভিভাবকদের জন্য এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয়
না।
প্রধানমন্ত্রী এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ কমার জন্য সরাসরি বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছেন। গত ৩ আগস্ট এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন নিজের সরকারি কার্যালয় গণভবনে ফলাফলের কপি গ্রহণকালে তিনি বলেন, পরীক্ষা চলাকালে বিরোধী দলের হরতালের কারণে ৩২টি বিষয়ের পরীক্ষার সূচি পরিবর্তন করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ফলাফল খারাপের জন্য পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকরা দায়ী নন। এর জন্য বিএনপি ও জামায়াত-শিবির দায়ী। যাদের ফলাফল খারাপ হয়েছে, তারা আগামীতে ভালো করবে বলেও প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। পরবর্তী সময়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবসহ দায়িত্বশীল আরও অনেকেই। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে এসব মন্তব্যের রেশ ধরে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষস্তরের বেশ কয়েকজন নেতা পৃথকভাবে এবারের ফল বিপর্যয়ের জন্য সরকারের নতুন শিক্ষানীতি, সৃজনশীল পদ্ধতির ব্যাপারে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব এবং ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। বিরোধী শিবিরের নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতির বিপরীতে শিক্ষামন্ত্রী এ নিয়ে পাল্টা বিবৃতিও দিয়েছেন।
এদিকে এইচএসসির ফলাফল নিয়ে ফেল করা এবং কাক্সিক্ষত ফলাফল থেকে বঞ্চিত দাবিদার পাস করা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা, অসন্তোষ ও ক্ষোভের অন্ত নেই। এসব পরীক্ষার্থী ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এবং দেশের আরও কয়েকটি স্থানে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়ার কথা উল্লেখ করে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বোর্ডের চেয়ারম্যান ও শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছে। এসব বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীর কর্মকাণ্ড এতদিনে অবশ্য অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, উপর্যুপরি হরতালের যাঁতাকলে গোটা জাতির একেবারে নাভিশ্বাস উঠলেও উল্লিখিত পরীক্ষার্থীরা প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছে, হরতাল নয়, তাদের পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়ার আসল কারণ তড়িঘড়ি করে খাতা দেখা।
আসলে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে এ পর্যন্ত যারা বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন কিংবা মন্তব্য বা অভিমত ব্যক্ত করেছেন, তারা অনেকটাই আবেগপ্রবণ অথবা কারও না কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তা করেছেন বলে মনে হয়েছে। যার ফলে এসবের সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায় সামান্যই। আমাদের দেশে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল সার্বিকভাবে কখনও সুখকর ছিল না, এখনও নেই। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এক একটি পরীক্ষা এবং এগুলোর ফলাফলের দিক দিয়ে গত ৪২ বছরে আমরা খুবই দুঃসময় অতিক্রম করে এসেছি। আর এসব কিছুর জন্য প্রধানত দায়ী শিক্ষার সঙ্গে জড়িত নানা স্তরের কর্তাব্যক্তিরা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব কর্তাব্যক্তি নিজেরা কখনও কোনো কিছুর দায় স্বীকার করতে চান না। বছরের পর বছর তাদের অবহেলা, উদাসীনতা, খামখেয়ালিপনা ও দায়িত্বহীনতার মাশুল গুনতে হয় হাজার হাজার, লাখ লাখ শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের। নিজেদের কৃতকর্ম, বিশেষ করে দুর্বলতা, ব্যর্থতা ও ত্র“টি-বিচ্যুতিগুলোকে আড়াল করে রাখার জন্য অতিউৎসাহী ওই কর্তাব্যক্তিরাই দেশে চালু করেছেন পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার আগে সরকার প্রধানের হাতে ফলাফলের কপি তুলে দেয়ার রীতি- যা বিশ্বের ইতিহাসে একেবারেই নজিরবিহীন! ভাবটা এমন যে, আমরা কেন ফলাফলের ব্যাপারে বলব (যেখানে সাধারণত নেতিবাচক বিষয়ই বেশি থাকে), যা বলার প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলুন।
এবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলকে কেন্দ্র করে সংঘটিত স্বল্পকালীন রাজনৈতিক বাকযুদ্ধ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এখন তারা সবাই মহাব্যস্ত আসল রাজনীতি নিয়ে। আর একটি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগে হয়তো এ নিয়ে রাজনীতিকদের কেউ মুখ খুলবেন না। তবে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা যদি বরাবরের মতো কেবল চুপ করে বসেই থাকেন, তাহলে আমাদের এগোনোর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ফলাফল প্রকাশের দিন তারা যা বুঝিয়েছেন, স্বাভাবিকভাবে প্রধানমন্ত্রী তাই বলেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে অব্যক্ত ও অপ্রিয় কথাগুলোও তো কাউকে না কাউকে বলতে হবে। হরতাল নয়, পরীক্ষার ফলাফল খারাপের কারণ হিসেবে যারা তড়িঘড়ি করে খাতা দেখাকে বড় করে দেখেছেন, তাদের ব্যাপারে আমার কিছুই বলার নেই। উপর্যুপরি হরতালের কারণে মোট ৫৮ দিনের পরীক্ষাসূচির মধ্যে ৩২টি বিষয় বা পত্রের পরীক্ষা যেখানে পেছাতে হয়েছে কিংবা ইংরেজির মতো একটি বিষয়ের পরীক্ষা পরপর চারবার পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত টানা দেড় মাস পর অনুষ্ঠিত হলেও হরতালকে যারা গৌণ করে দেখেন, তাদের ব্যাপারে মন্তব্য করে কোনো ধরনের বিতর্কে জড়ানোর ইচ্ছাও আমার নেই। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোর ডাকা হরতালকেই যারা ফলাফল খারাপের বড় কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন তারাও বোধ করি বিস্মৃত হয়ে পড়েছেন, হরতালের মধ্যেই পরীক্ষা দিয়ে এবার কোনো কোনো সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ৭৯.১৩ ভাগ বা ৭৭.৬৯ ভাগ সফলতা লাভের গৌরব অর্জন করেছে। আরও স্মরণযোগ্য, এবারের পরীক্ষাতেই মাদ্রাসা বোর্ডে ৯১.৪৬ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮৫.০৩ ভাগে গিয়ে পৌঁছেছে।। প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে, ফলাফল খারাপের জন্য পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকরা দায়ী নন, এবার যাদের ফলাফল খারাপ হয়েছে আগামীতে তারা ভালো করবে। কিন্তু কথা হল, আগামীতে পরীক্ষা দিয়ে আসলেই কি তারা সবাই ভালো করবে, ভালো করতে পারবে? আমার তো মনে হয় অকৃতকার্য পরীক্ষার্থী কেবল হাজার হাজার নয়, অঙ্কটি একেবারে লাখের কাছাকাছি উঠে যেতে পারে, সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে কোনো দিনই যাদের পাস করা সম্ভব হবে না। প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যায়, তাহলে এরা এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় অবতীর্ণ হল কেন এবং কীভাবে? এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর কাউকে না কাউকে তো দিতে হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, হরতালের ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ফলাফল খারাপের জন্য পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একেবারে দায়মুক্ত করে দিলেন! ফলে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের যে মোটামুটি একটি রেওয়াজ রয়েছে, তার মধ্যেও নাকি দেখা দিয়েছে অনেকাংশে ভাটা। অন্য সব বিষয়ের মতো শিক্ষাক্ষেত্রে যদি আস্থা ও বিশ্বাসে চিড় ধরে, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। অথচ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এমনকি যুগের পর যুগ আমরা এরূপ সংশয়, সন্দেহ, অনাস্থা, অবিশ্বাস ও অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্য দিয়ে পথ হেঁটে চলেছি। এসব থেকে কোনোভাবেই যেমন মুক্ত নয় খোদ সরকার, তেমনি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ আরও অনেকেই সহজে এর দায় এড়াতে পারবেন না। তবে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্য, শিখিয়ে দেয়া বুলি- যা গোটা জাতিকেই বিভ্রান্ত করতে পারে- এসব ব্যাপারে সবাইকে সব সময় সচেতন থাকতে হবে।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
প্রধানমন্ত্রী এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ কমার জন্য সরাসরি বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছেন। গত ৩ আগস্ট এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন নিজের সরকারি কার্যালয় গণভবনে ফলাফলের কপি গ্রহণকালে তিনি বলেন, পরীক্ষা চলাকালে বিরোধী দলের হরতালের কারণে ৩২টি বিষয়ের পরীক্ষার সূচি পরিবর্তন করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ফলাফল খারাপের জন্য পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকরা দায়ী নন। এর জন্য বিএনপি ও জামায়াত-শিবির দায়ী। যাদের ফলাফল খারাপ হয়েছে, তারা আগামীতে ভালো করবে বলেও প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। পরবর্তী সময়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবসহ দায়িত্বশীল আরও অনেকেই। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে এসব মন্তব্যের রেশ ধরে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষস্তরের বেশ কয়েকজন নেতা পৃথকভাবে এবারের ফল বিপর্যয়ের জন্য সরকারের নতুন শিক্ষানীতি, সৃজনশীল পদ্ধতির ব্যাপারে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব এবং ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। বিরোধী শিবিরের নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতির বিপরীতে শিক্ষামন্ত্রী এ নিয়ে পাল্টা বিবৃতিও দিয়েছেন।
এদিকে এইচএসসির ফলাফল নিয়ে ফেল করা এবং কাক্সিক্ষত ফলাফল থেকে বঞ্চিত দাবিদার পাস করা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা, অসন্তোষ ও ক্ষোভের অন্ত নেই। এসব পরীক্ষার্থী ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এবং দেশের আরও কয়েকটি স্থানে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়ার কথা উল্লেখ করে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বোর্ডের চেয়ারম্যান ও শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছে। এসব বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীর কর্মকাণ্ড এতদিনে অবশ্য অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, উপর্যুপরি হরতালের যাঁতাকলে গোটা জাতির একেবারে নাভিশ্বাস উঠলেও উল্লিখিত পরীক্ষার্থীরা প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছে, হরতাল নয়, তাদের পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়ার আসল কারণ তড়িঘড়ি করে খাতা দেখা।
আসলে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে এ পর্যন্ত যারা বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন কিংবা মন্তব্য বা অভিমত ব্যক্ত করেছেন, তারা অনেকটাই আবেগপ্রবণ অথবা কারও না কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তা করেছেন বলে মনে হয়েছে। যার ফলে এসবের সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায় সামান্যই। আমাদের দেশে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল সার্বিকভাবে কখনও সুখকর ছিল না, এখনও নেই। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এক একটি পরীক্ষা এবং এগুলোর ফলাফলের দিক দিয়ে গত ৪২ বছরে আমরা খুবই দুঃসময় অতিক্রম করে এসেছি। আর এসব কিছুর জন্য প্রধানত দায়ী শিক্ষার সঙ্গে জড়িত নানা স্তরের কর্তাব্যক্তিরা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব কর্তাব্যক্তি নিজেরা কখনও কোনো কিছুর দায় স্বীকার করতে চান না। বছরের পর বছর তাদের অবহেলা, উদাসীনতা, খামখেয়ালিপনা ও দায়িত্বহীনতার মাশুল গুনতে হয় হাজার হাজার, লাখ লাখ শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের। নিজেদের কৃতকর্ম, বিশেষ করে দুর্বলতা, ব্যর্থতা ও ত্র“টি-বিচ্যুতিগুলোকে আড়াল করে রাখার জন্য অতিউৎসাহী ওই কর্তাব্যক্তিরাই দেশে চালু করেছেন পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার আগে সরকার প্রধানের হাতে ফলাফলের কপি তুলে দেয়ার রীতি- যা বিশ্বের ইতিহাসে একেবারেই নজিরবিহীন! ভাবটা এমন যে, আমরা কেন ফলাফলের ব্যাপারে বলব (যেখানে সাধারণত নেতিবাচক বিষয়ই বেশি থাকে), যা বলার প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলুন।
এবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলকে কেন্দ্র করে সংঘটিত স্বল্পকালীন রাজনৈতিক বাকযুদ্ধ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এখন তারা সবাই মহাব্যস্ত আসল রাজনীতি নিয়ে। আর একটি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগে হয়তো এ নিয়ে রাজনীতিকদের কেউ মুখ খুলবেন না। তবে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা যদি বরাবরের মতো কেবল চুপ করে বসেই থাকেন, তাহলে আমাদের এগোনোর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ফলাফল প্রকাশের দিন তারা যা বুঝিয়েছেন, স্বাভাবিকভাবে প্রধানমন্ত্রী তাই বলেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে অব্যক্ত ও অপ্রিয় কথাগুলোও তো কাউকে না কাউকে বলতে হবে। হরতাল নয়, পরীক্ষার ফলাফল খারাপের কারণ হিসেবে যারা তড়িঘড়ি করে খাতা দেখাকে বড় করে দেখেছেন, তাদের ব্যাপারে আমার কিছুই বলার নেই। উপর্যুপরি হরতালের কারণে মোট ৫৮ দিনের পরীক্ষাসূচির মধ্যে ৩২টি বিষয় বা পত্রের পরীক্ষা যেখানে পেছাতে হয়েছে কিংবা ইংরেজির মতো একটি বিষয়ের পরীক্ষা পরপর চারবার পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত টানা দেড় মাস পর অনুষ্ঠিত হলেও হরতালকে যারা গৌণ করে দেখেন, তাদের ব্যাপারে মন্তব্য করে কোনো ধরনের বিতর্কে জড়ানোর ইচ্ছাও আমার নেই। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোর ডাকা হরতালকেই যারা ফলাফল খারাপের বড় কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন তারাও বোধ করি বিস্মৃত হয়ে পড়েছেন, হরতালের মধ্যেই পরীক্ষা দিয়ে এবার কোনো কোনো সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ৭৯.১৩ ভাগ বা ৭৭.৬৯ ভাগ সফলতা লাভের গৌরব অর্জন করেছে। আরও স্মরণযোগ্য, এবারের পরীক্ষাতেই মাদ্রাসা বোর্ডে ৯১.৪৬ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮৫.০৩ ভাগে গিয়ে পৌঁছেছে।। প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে, ফলাফল খারাপের জন্য পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকরা দায়ী নন, এবার যাদের ফলাফল খারাপ হয়েছে আগামীতে তারা ভালো করবে। কিন্তু কথা হল, আগামীতে পরীক্ষা দিয়ে আসলেই কি তারা সবাই ভালো করবে, ভালো করতে পারবে? আমার তো মনে হয় অকৃতকার্য পরীক্ষার্থী কেবল হাজার হাজার নয়, অঙ্কটি একেবারে লাখের কাছাকাছি উঠে যেতে পারে, সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে কোনো দিনই যাদের পাস করা সম্ভব হবে না। প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যায়, তাহলে এরা এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় অবতীর্ণ হল কেন এবং কীভাবে? এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর কাউকে না কাউকে তো দিতে হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, হরতালের ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ফলাফল খারাপের জন্য পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একেবারে দায়মুক্ত করে দিলেন! ফলে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের যে মোটামুটি একটি রেওয়াজ রয়েছে, তার মধ্যেও নাকি দেখা দিয়েছে অনেকাংশে ভাটা। অন্য সব বিষয়ের মতো শিক্ষাক্ষেত্রে যদি আস্থা ও বিশ্বাসে চিড় ধরে, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। অথচ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এমনকি যুগের পর যুগ আমরা এরূপ সংশয়, সন্দেহ, অনাস্থা, অবিশ্বাস ও অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্য দিয়ে পথ হেঁটে চলেছি। এসব থেকে কোনোভাবেই যেমন মুক্ত নয় খোদ সরকার, তেমনি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ আরও অনেকেই সহজে এর দায় এড়াতে পারবেন না। তবে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্য, শিখিয়ে দেয়া বুলি- যা গোটা জাতিকেই বিভ্রান্ত করতে পারে- এসব ব্যাপারে সবাইকে সব সময় সচেতন থাকতে হবে।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
No comments