মোদিকে কেন ভয় by আসফি রশীদ
ভারতে
আগামী বছরের মে মাসে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি তার প্রধানমন্ত্রী
প্রার্থী হিসেবে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদির নাম ঘোষণা
করার পর দেশটির মুসলমান সম্প্রদায় এবং বিপুলসংখ্যক সেক্যুলার হিন্দু,
খ্রিস্টান ও শিখ নাগরিক উদ্বিগ্ন। যদিও এ নির্বাচনে বিজেপির জয়লাভ এখনও
নিশ্চিত নয়। নির্বাচনে কোনো দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের সম্ভাবনা প্রায়
নেই। কোয়ালিশন সরকার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কোয়ালিশন বিজেপির নেতৃত্বে হলে
তবেই প্রধানমন্ত্রী হবেন নরেন্দ্র মোদি। তারপরও তাকে নিয়ে দেশে-বিদেশে
উৎকণ্ঠার শেষ নেই। মোদিকে বিজেপি ও দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর
একজন কট্টর নেতার প্রতিকৃতি হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। ২০০২ সালে গুজরাটে
রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িত থাকার অভিযোগ এখনও তাড়া করে ফিরছে
তাকে। ওই ঘটনায় হাজারের ওপর নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়, যাদের সিংহভাগই
ছিল মুসলমান। নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি হল, ওই ঘটনায় তার
প্রশাসন জড়িয়ে পড়েছিল অথবা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। নিরীহ
মানুষদের হত্যার দায়ে প্রায় ৩০ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও কনস্টেবল এখনও কারাভোগ
করছেন। সম্প্রতি একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ওই বিচারবহির্ভূত
গণহত্যা ছিল নরেন্দ্র মোদিকে একজন শক্তিশালী হিন্দু নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
করার উদ্দেশ্যে গুজরাট সরকারের একটি পরিকল্পিত নীতির বাস্তবায়ন।
স্বভাবতই ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশে এমন একজন সাম্প্রদায়িক নেতার সরকারের শীর্ষ পদে আসীন হওয়ার আশংকায় দেশটির মুক্তবুদ্ধি ও উদারপন্থী মানুষ উদ্বিগ্ন। যে বহু মত, পথ, ভাষা, ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের ওপর ভিত্তি করে ভারত রাষ্ট্রটি দাঁড়িয়ে আছে- সেই আদর্শের বিরুদ্ধপথের একজন যাত্রী প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি দেশটিকে কোথায় নিয়ে যাবেন- এ প্রশ্ন অনেকেরই। প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মোদির নাম ঘোষিত হওয়ার পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, তিনি মনে করেন না নরেন্দ্র মোদি একজন ভালো প্রধানমন্ত্রী হবেন। তার সেক্যুলার ইমেজ না থাকায় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হোন তা তিনি (অমর্ত্য সেন) চান না। ভারতের কন্নড়ভাষী প্রখ্যাত লেখক ড. ইউ আর আনানথামুরথি বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি যে দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেই দেশে তিনি (আনানথামুরথি) থাকবেন না। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। লক্ষেèৗয়ের দারুল উলুম নাদওয়াতুল শিক্ষায়তনের ইসলামবিষয়ক পণ্ডিত সালমান আল নাদভি বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি ভারতের মুসলমানদের এক নম্বর শত্র“।
কেবল নিজ দেশে নয়, নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলে তার সঙ্গে বহির্বিশ্ব বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক কী হবে, সে প্রশ্নও উঠছে। মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিপর্যয়ের মুখে পড়ার আশংকা করছেন অনেকেই। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারতের বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বড় ধরনের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মোদির বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের মনোভাব বরাবরই নেতিবাচক। ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাকে ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ (অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি) ঘোষণা করে গুজরাটে তাদের কূটনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র মোদির ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। তবে এটিও সত্য, যুক্তরাষ্ট্র তার নিজ স্বার্থেই বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যে পাঁচ ব্যক্তিকে তিনি তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করেন, তাদের একজন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কিন্তু ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামা রক্ষণশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদিকেও কি বন্ধু মনে করবেন? মোদিই বা কিভাবে ভুলে যাবেন তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অতীত আচরণের কথা?
মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের নাটকীয় উন্নতি হতে পারে। ইসরাইল ইতিমধ্যেই ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা অংশীদার। ১৯৯২ সালে কংগ্রেস সরকার ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও পরবর্তী সময়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়েই ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, সে সম্পর্ক শুধুই নিরাপত্তাবিষয়ক অংশীদারভিত্তিক ছিল না, বরং এর সঙ্গে একধরনের ধর্মীয় ও আদর্শগত অনুভূতিও কাজ করেছিল উভয় সরকারের মধ্যে। ২০০৩ সালে ওয়াশিংটনে মার্কিন ইহুদি সম্প্রদায়ের এক সমাবেশে বক্তৃতাদানকালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইসরাইলের সমন্বয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় জোট গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, ‘বর্তমান সময়ের কুৎসিৎ দর্শন সন্ত্রাসবাদ যৌথভাবে মোকাবেলা করা।’ ওই বক্তৃতায় ব্রজেশ মিত্র বলেছিলেন, মারাত্মক সন্ত্রাসবাদী প্ররোচনার ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের রাজনৈতিক ও নৈতিক ক্ষমতা থাকবে প্রস্তাবিত এ জোটের। সে বছরেরই সেপ্টেম্বরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন ভারত সফর করেন। সেটাই ছিল কোনো ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফর।
সাধারণত ভারতীয় রাজনীতিকরা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভোট হারানোর ভয়ে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক এড়িয়ে চলেন। সে দেশে সফরে যান না অথবা কোনো ইসরাইলি নেতাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণও জানান না। তবে মোদি হলেন মুষ্টিমেয় ভারতীয় রাজনীতিকদের একজন, যিনি ইসরাইল সফরে গিয়েছিলেন। কাজেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়াটাই স্বাভাবিক, যার পরিণামে মুসলমান প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শীতল হয়ে উঠতে পারে। মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে ভারতের প্রধান বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার আশংকা প্রবল। আগের বিজেপি শাসনামলে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত দু’দফা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মোদির তুলনায় অনেক বেশি উদারপন্থী অটল বিহারি বাজপেয়ি। তার সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কূটনৈতিক উদ্যোগও নিয়েছিল, যে নীতি বর্তমান কংগ্রেস সরকারের সময়েও অব্যাহত আছে। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে এ পরিস্থিতি কি পাল্টে যাবে?
ভারতে যেমন বিজেপির ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশে একই সম্ভাবনা রয়েছে বিএনপির। এর আগে বিএনপি (২০০১-০৬) ও বিজেপি (১৯৯৯-২০০৪) ক্ষমতায় থাকার সময়ে দু’দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত শীতল পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের এত অবনতি আর হয়নি। এ সময় ভারতের একটি বড় অভিযোগ ছিল, সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশ আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। তৎকালীন বিএনপি সরকার এ অভিযোগ বারবার অস্বীকার করলেও ভারতের বিজেপি সরকার তা বিশ্বাস করেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারতের মাথাব্যথার সবচেয়ে বড় এ কারণটি দূর করে এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দেয় বলেও খবর রয়েছে। বস্তুত বর্তমানে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং ভারতে মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকায় মনে করা হয়েছিল, এটি দু’দেশের সম্পর্কোন্নয়নের জন্য সবচেয়ে অনুকূল সময়। দুর্ভাগ্যজনক যে, তা সত্ত্বেও দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হয়নি। এজন্য ভারত সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বিরোধী দল বিজেপিও অনেক ক্ষেত্রে বাগড়া দিয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ ভারতের পার্লামেন্টে সীমান্ত চুক্তি বিল পাসে বাধা দেয়া। নরেন্দ্র মোদি ইতিপূর্বে একাধিকবার তার ভাষায় ‘অবৈধ বাংলাদেশীদের প্রবেশে বিএসএফ কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায়’ ভারত সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। সীমান্তে বাংলাদেশীদের প্রতি বিএসএফের আচরণের কথা সবাই জানেন- যা শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের নাগরিকদের কাছেও সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। তারপরও সেটা যদি ‘কঠোর ব্যবস্থা’ না হয়ে থাকে, তাহলে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের আচরণ কী হবে এবং বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে- এসব নিয়ে বাংলাদেশেরও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে বৈকি। আগামীতে যিনিই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন, আমরা তার কাছ থেকে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ প্রত্যাশা করি।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
স্বভাবতই ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশে এমন একজন সাম্প্রদায়িক নেতার সরকারের শীর্ষ পদে আসীন হওয়ার আশংকায় দেশটির মুক্তবুদ্ধি ও উদারপন্থী মানুষ উদ্বিগ্ন। যে বহু মত, পথ, ভাষা, ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের ওপর ভিত্তি করে ভারত রাষ্ট্রটি দাঁড়িয়ে আছে- সেই আদর্শের বিরুদ্ধপথের একজন যাত্রী প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি দেশটিকে কোথায় নিয়ে যাবেন- এ প্রশ্ন অনেকেরই। প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মোদির নাম ঘোষিত হওয়ার পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, তিনি মনে করেন না নরেন্দ্র মোদি একজন ভালো প্রধানমন্ত্রী হবেন। তার সেক্যুলার ইমেজ না থাকায় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হোন তা তিনি (অমর্ত্য সেন) চান না। ভারতের কন্নড়ভাষী প্রখ্যাত লেখক ড. ইউ আর আনানথামুরথি বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি যে দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেই দেশে তিনি (আনানথামুরথি) থাকবেন না। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। লক্ষেèৗয়ের দারুল উলুম নাদওয়াতুল শিক্ষায়তনের ইসলামবিষয়ক পণ্ডিত সালমান আল নাদভি বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি ভারতের মুসলমানদের এক নম্বর শত্র“।
কেবল নিজ দেশে নয়, নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলে তার সঙ্গে বহির্বিশ্ব বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক কী হবে, সে প্রশ্নও উঠছে। মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিপর্যয়ের মুখে পড়ার আশংকা করছেন অনেকেই। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারতের বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বড় ধরনের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মোদির বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের মনোভাব বরাবরই নেতিবাচক। ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাকে ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ (অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি) ঘোষণা করে গুজরাটে তাদের কূটনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র মোদির ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। তবে এটিও সত্য, যুক্তরাষ্ট্র তার নিজ স্বার্থেই বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যে পাঁচ ব্যক্তিকে তিনি তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করেন, তাদের একজন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কিন্তু ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামা রক্ষণশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদিকেও কি বন্ধু মনে করবেন? মোদিই বা কিভাবে ভুলে যাবেন তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অতীত আচরণের কথা?
মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের নাটকীয় উন্নতি হতে পারে। ইসরাইল ইতিমধ্যেই ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা অংশীদার। ১৯৯২ সালে কংগ্রেস সরকার ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও পরবর্তী সময়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়েই ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, সে সম্পর্ক শুধুই নিরাপত্তাবিষয়ক অংশীদারভিত্তিক ছিল না, বরং এর সঙ্গে একধরনের ধর্মীয় ও আদর্শগত অনুভূতিও কাজ করেছিল উভয় সরকারের মধ্যে। ২০০৩ সালে ওয়াশিংটনে মার্কিন ইহুদি সম্প্রদায়ের এক সমাবেশে বক্তৃতাদানকালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইসরাইলের সমন্বয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় জোট গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, ‘বর্তমান সময়ের কুৎসিৎ দর্শন সন্ত্রাসবাদ যৌথভাবে মোকাবেলা করা।’ ওই বক্তৃতায় ব্রজেশ মিত্র বলেছিলেন, মারাত্মক সন্ত্রাসবাদী প্ররোচনার ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের রাজনৈতিক ও নৈতিক ক্ষমতা থাকবে প্রস্তাবিত এ জোটের। সে বছরেরই সেপ্টেম্বরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন ভারত সফর করেন। সেটাই ছিল কোনো ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফর।
সাধারণত ভারতীয় রাজনীতিকরা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভোট হারানোর ভয়ে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক এড়িয়ে চলেন। সে দেশে সফরে যান না অথবা কোনো ইসরাইলি নেতাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণও জানান না। তবে মোদি হলেন মুষ্টিমেয় ভারতীয় রাজনীতিকদের একজন, যিনি ইসরাইল সফরে গিয়েছিলেন। কাজেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়াটাই স্বাভাবিক, যার পরিণামে মুসলমান প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শীতল হয়ে উঠতে পারে। মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে ভারতের প্রধান বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার আশংকা প্রবল। আগের বিজেপি শাসনামলে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত দু’দফা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মোদির তুলনায় অনেক বেশি উদারপন্থী অটল বিহারি বাজপেয়ি। তার সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কূটনৈতিক উদ্যোগও নিয়েছিল, যে নীতি বর্তমান কংগ্রেস সরকারের সময়েও অব্যাহত আছে। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে এ পরিস্থিতি কি পাল্টে যাবে?
ভারতে যেমন বিজেপির ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশে একই সম্ভাবনা রয়েছে বিএনপির। এর আগে বিএনপি (২০০১-০৬) ও বিজেপি (১৯৯৯-২০০৪) ক্ষমতায় থাকার সময়ে দু’দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত শীতল পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের এত অবনতি আর হয়নি। এ সময় ভারতের একটি বড় অভিযোগ ছিল, সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশ আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। তৎকালীন বিএনপি সরকার এ অভিযোগ বারবার অস্বীকার করলেও ভারতের বিজেপি সরকার তা বিশ্বাস করেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারতের মাথাব্যথার সবচেয়ে বড় এ কারণটি দূর করে এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দেয় বলেও খবর রয়েছে। বস্তুত বর্তমানে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং ভারতে মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকায় মনে করা হয়েছিল, এটি দু’দেশের সম্পর্কোন্নয়নের জন্য সবচেয়ে অনুকূল সময়। দুর্ভাগ্যজনক যে, তা সত্ত্বেও দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হয়নি। এজন্য ভারত সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বিরোধী দল বিজেপিও অনেক ক্ষেত্রে বাগড়া দিয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ ভারতের পার্লামেন্টে সীমান্ত চুক্তি বিল পাসে বাধা দেয়া। নরেন্দ্র মোদি ইতিপূর্বে একাধিকবার তার ভাষায় ‘অবৈধ বাংলাদেশীদের প্রবেশে বিএসএফ কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায়’ ভারত সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। সীমান্তে বাংলাদেশীদের প্রতি বিএসএফের আচরণের কথা সবাই জানেন- যা শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের নাগরিকদের কাছেও সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। তারপরও সেটা যদি ‘কঠোর ব্যবস্থা’ না হয়ে থাকে, তাহলে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের আচরণ কী হবে এবং বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে- এসব নিয়ে বাংলাদেশেরও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে বৈকি। আগামীতে যিনিই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন, আমরা তার কাছ থেকে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ প্রত্যাশা করি।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
No comments