গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা বলতে কী বোঝায় by ড. হারুন রশীদ
শৃংখলমুক্ত
স্বাধীন গণমাধ্যম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এটা
বললে অত্যুক্তি হবে না যে, দেশে গণমাধ্যম এখন অনেকটাই স্বাধীনতা ভোগ করছে।
গণমাধ্যমের বর্তমান কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একটি বড় পরিবর্তন আসে।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি থাকাকালে মুদ্রণ এবং
প্রকাশনা আইন সংশোধন করেন। ফলে কোনো সরকার চাইলেও এখন আর পত্রিকার প্রকাশনা
(ডিক্লারেশন) বন্ধ করতে পারে না। এটা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বহুলাংশে
নিশ্চিত করেছে। আর যে সমাজে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেখানে
দুর্নীতি, অনিয়ম অনেকাংশেই হ্রাস পায় এবং একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠা লাভ করে। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের গুরুদায়িত্ব হচ্ছে গণমাধ্যমের
স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের গণমাধ্যম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার এ
কথা বলা যায় নির্দ্বিধায়। সরকারি দল, বিরোধী দলের নেতাকর্মী কিংবা যত বড়
শক্তিশালী ব্যক্তিই হোন না কেন, তাদের হাঁড়ির খবর বের করে আনতে গণমাধ্যম
বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। এর কারণ গণমাধ্যমকে প্রতিনিয়ত পাঠকের কাছে জবাবদিহি
করে টিকে থাকতে হয়। তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তার স্বাধীন সত্তার
পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা ব্যতিরেকে বিকল্প কিছু নেই। যারা এ দৌড়ে শামিল
হবেন না, তারা পিছিয়ে পড়বেন, প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না এবং এক সময় সেসব
গণমাধ্যমের অপমৃত্যু হবে। এটাই তাদের নিয়তি।
বলতে গেলে এক্ষেত্রে এক ধরনের নীরব কিংবা প্রকাশ্য প্রতিযোগিতাও আছে। কারা কোন খবরটি কত তাড়াতাড়ি পাঠকের কাছে কতটা নির্ভুলভাবে পৌঁছাতে পারে- এই মানসিকতা তাদের নিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়। এ প্রতিযোগিতা পেশাদারিত্বেরই একটি অংশ। পেশাদারি মনোভাব না থাকলে গণমাধ্যম তার সঠিক চরিত্র বজায় রাখতে পারবে না। এই পেশাদারিত্ব হচ্ছে আসলে পাঠকের কাছে দায়বদ্ধতা। প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে অনেক সময় সঠিকভাবে সঠিক সংবাদ উপস্থাপন সম্ভব হয় না। এখানেই দায়বদ্ধতার ঘাটতির বিষয়টি চলে আসে। এছাড়া অনেক বিষয় আছে যা জনসম্মুখে (পাবলিকলি) আসা উচিত নয়। কিন্তু প্রতিযোগিতার দৌড় কখনও কখনও পরিবেশকে অসুস্থ করে তোলে। ফলে গণমাধ্যম কখনও সমাজে ক্ষতির কারণ হয়। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক এবং বাহক হতে হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তিতে বিভাজিত সমাজ ব্যবস্থায় এর অন্যথা দেখা যায় এখানে। কোনো কোনো গণমাধ্যম দল ও গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে কাজ করে স্বার্থসিদ্ধির জন্য। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরার ক্ষেত্রেও কোনো কোনো গণমাধ্যম পক্ষপাতমূলক আচরণ করে কখনও কখনও। বিশেষ করে গণমাধ্যমের মালিক যে নীতি ও আদর্শ দ্বারা পরিচালিত, সেই গণমাধ্যমে সেই নীতি-আদর্শের প্রতিফলন দেখা যায়। এটা গণমাধ্যমের নীতি-আদর্শের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অবশ্যই সেই দেশের সংবিধান এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের আলোকেই প্রতিষ্ঠিত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। কিন্তু আদালতের কার্যক্রম গণমাধ্যমে বিশেষভাবে উঠে আসছে না। কোনো কোনো গণমাধ্যম বরং উল্টো অবস্থান নিয়েছে, যা স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা এবং নীতি-আদর্শের বলিদান ছাড়া আর কিছুই নয়। বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধগুলো সাক্ষ্য-প্রমাণে যেভাবে উঠে আসছে, অনেক গণমাধ্যমই সেগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরছে না। একাত্তরে ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের চরিত্র নতুন প্রজন্মর কাছে তুলে ধরা গণমাধ্যমের অন্যতম দায়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি দেশ সঠিক ইতিহাস আশ্রয়ী হয়ে না চলতে পারলে তার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছানো কখনোই সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে গণমাধ্যমের আরেকটি প্রধান চরিত্র হল সরকারবিরোধিতা। কোনো কোনো সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম অকারণে সরকার বিরোধিতায় এতটাই মেতে উঠে যে, সরকারকে তারা জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে চায়। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম নেয়, যা গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দেখা দেয়। গণমাধ্যমে অবশ্যই সরকারের সমালোচনা থাকবে। বিশেষ করে বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের রাজনীতি যেখানে কালচারে পরিণত হয়েছে, সেখানে গণমাধ্যম কার্যত রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিরোধী দলের ভূমিকায়ই পালন করছে। বস্তুত গঠনমূলক সমালোচনা গণতন্ত্রের ভিতকে আরও মজবুত করতে পারে। গণমাধ্যমকে এমন আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে যাতে বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠী অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ না পায়। অনেক সময় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এমন সংবাদ পরিবেশন করা হয় যা বিদ্বেষপূর্ণ, চরিত্রহনন ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে এই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন। পরে যদি ভুল স্বীকার করা হয়, তাহলেও কিন্তু ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ মাধ্যমে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যায়।
দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখা হওয়া উচিত গণমাধ্যমের মূল নীতি। কিন্তু অনেক সময় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থই বড় হয়ে ওঠে। কোনো কোনো গণমাধ্যম মালিকের স্বার্থকেই বড় করে দেখে। কারণ মালিকের বিপুল অর্থলগ্নির কারণেই তো ওই গণমাধ্যমটি আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছে। তাই টিকে থাকার স্বার্থে তাকে আপস করতে হয়। মালিক যদি ঋণখেলাপি হন তাহলে ওই গণমাধ্যমে ঋণখেলাপি সম্পর্কে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হবে না। যদি হাউজিং ব্যবসায়ী হন, তাহলেও ওই সম্পর্কে নেতিবাচক কোনো সংবাদ প্রকাশিত হবে না। যদি কালো টাকার মালিক হন, কর ফাঁকি দেন তাহলেও এ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ প্রকাশিত হবে না। বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে এক রকম জিম্মি অবস্থায় আছে গণমাধ্যম। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান যত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গেই জড়িত থাকুক না কেন, প্রচার সংখ্যার জোর না থাকলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি শব্দও প্রকাশিত হবে না। স্বাধীনতা বলি আর দায়বদ্ধতা বলি দুটোই এক্ষেত্রে অচল। পেশাদারি উৎকর্ষ এবং দক্ষতাও একটি প্রধান বিষয়। গণমাধ্যমের একটি ভুল শব্দ অনেক বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। শুধু তাই নয়, কোনটি খবর নয় আর কোনটি খবর, কোন খবরের কতটা গুরুত্ব দেয়া উচিত এ ব্যাপারেও গণমাধ্যমের সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করা যায়।
কুকুর মানুষকে কামড়ালে তা কোনো খবর হবে না, কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড়ালে সেটা খবর। কিন্তু এখন প্রায় সবই খবর। কোনো গণমাধ্যমের মালিক জেলখানা থেকে মুক্তি পেলে সেটাও ওই গণমাধ্যমে ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে দেখানো হয়। অথচ সার্বিকভাবে ওই ঘটনাটির কোনো সংবাদমূল্য আছে কি-না, সেটি বিবেচনায় নেয়া হয় না। বলা হয়ে থাকে ‘তোমার স্বাধীনতা আমার নাকের ডগা পর্যন্ত। এ পর্যন্ত তুমি ছড়ি ঘোরাতে পার। কিন্তু তোমার ছড়ি আমার নাক বা শরীর স্পর্শ করলে সেখানেই স্বাধীনতা বিপন্ন হয়।’ ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তিও স্মরণযোগ্য- ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত নাও হতে পারি কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের অধিকারের জন্য আমি জীবনও দিতে পারি।’
এই স্বাধীনতা তখনই সার্থক হবে যখন তাতে জনকল্যাণের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। প্রসঙ্গত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি নিবন্ধের শরণ নেয়া যায়। সম্প্রতি দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভারতীয় মিডিয়ার গৌরব ও কলঙ্ক’ শিরোনামাঙ্কিত নিবন্ধে তিনি বলেছেন- ‘এখানকার সমস্যা অবশ্য মিডিয়ায় তেমন স্থান পায় না। কেননা সামাজিক বিভাজনই সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে এই পক্ষপাতিত্ব জোগায়। অথচ ভারতের বাস্তবতা অবিরত জনগণের দৃষ্টিগোচরে রাখার জন্য মিডিয়া অধিকতর গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। সংবাদ পরিবেশনায় এই পক্ষপাতিত্ব পাঠকের কাছে কোনোভাবে অপ্রীতিকর মনে না হলেও তা ভারতের সুবিধাবঞ্চিতদের চরম বঞ্চনার প্রতিকার সাধনে রাজনৈতিক অনীহা সৃষ্টিতে প্রভূত অবদান রেখে থাকে। ভাগ্যবান গোষ্ঠীর মধ্যে যেহেতু শুধু ব্যবসায়ী নেতারা ও পেশাজীবী শ্রেণীগুলোই নয়, দেশের বুদ্ধিজীবীদেরও এক বিরাট অংশ রয়েছে, তাই জাতির ব্যতিক্রমধর্মী অগ্রগতির খবর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খুব বেশি প্রচার লাভ করে থাকে এবং যা কিনা বড়জোর অতি পক্ষপাতদুষ্ট এক কাহিনীমাত্র। সেটাকেই কথিত বাস্তবতায় রূপ দেয়া হয়।’ এখানে ‘ভারতের’ জায়গায় ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করলে অবস্থাটি কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে একই থেকে যায়। অমর্ত্য সেনের আরও একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। তার মতে, গণমাধ্যম থাকলে দুর্ভিক্ষও দূর করা সম্ভব। কেননা কোথাও দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সেটা যদি গণমাধ্যমে উঠে আসে, তাহলে সরকার বা রাষ্ট্র সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। ফলে কেউ না খেয়ে মরবে না। একদিকে মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা করে তাকে বিকশিত করা, অন্যদিকে শুধু ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি নিয়ে পাঠককে খদ্দেরে পরিণত করা- গণমাধ্যম যদি এই ধরনের দ্বিচারিতায় লিপ্ত হয়, তাহলে তার স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার জায়গাটি ভীষণভাবে নষ্ট হয়। এতে আর যাই হোক, সাধারণ মানুষের কোনো কল্যাণ হয় না।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট
বলতে গেলে এক্ষেত্রে এক ধরনের নীরব কিংবা প্রকাশ্য প্রতিযোগিতাও আছে। কারা কোন খবরটি কত তাড়াতাড়ি পাঠকের কাছে কতটা নির্ভুলভাবে পৌঁছাতে পারে- এই মানসিকতা তাদের নিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়। এ প্রতিযোগিতা পেশাদারিত্বেরই একটি অংশ। পেশাদারি মনোভাব না থাকলে গণমাধ্যম তার সঠিক চরিত্র বজায় রাখতে পারবে না। এই পেশাদারিত্ব হচ্ছে আসলে পাঠকের কাছে দায়বদ্ধতা। প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে অনেক সময় সঠিকভাবে সঠিক সংবাদ উপস্থাপন সম্ভব হয় না। এখানেই দায়বদ্ধতার ঘাটতির বিষয়টি চলে আসে। এছাড়া অনেক বিষয় আছে যা জনসম্মুখে (পাবলিকলি) আসা উচিত নয়। কিন্তু প্রতিযোগিতার দৌড় কখনও কখনও পরিবেশকে অসুস্থ করে তোলে। ফলে গণমাধ্যম কখনও সমাজে ক্ষতির কারণ হয়। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক এবং বাহক হতে হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তিতে বিভাজিত সমাজ ব্যবস্থায় এর অন্যথা দেখা যায় এখানে। কোনো কোনো গণমাধ্যম দল ও গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে কাজ করে স্বার্থসিদ্ধির জন্য। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরার ক্ষেত্রেও কোনো কোনো গণমাধ্যম পক্ষপাতমূলক আচরণ করে কখনও কখনও। বিশেষ করে গণমাধ্যমের মালিক যে নীতি ও আদর্শ দ্বারা পরিচালিত, সেই গণমাধ্যমে সেই নীতি-আদর্শের প্রতিফলন দেখা যায়। এটা গণমাধ্যমের নীতি-আদর্শের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অবশ্যই সেই দেশের সংবিধান এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের আলোকেই প্রতিষ্ঠিত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। কিন্তু আদালতের কার্যক্রম গণমাধ্যমে বিশেষভাবে উঠে আসছে না। কোনো কোনো গণমাধ্যম বরং উল্টো অবস্থান নিয়েছে, যা স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা এবং নীতি-আদর্শের বলিদান ছাড়া আর কিছুই নয়। বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধগুলো সাক্ষ্য-প্রমাণে যেভাবে উঠে আসছে, অনেক গণমাধ্যমই সেগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরছে না। একাত্তরে ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের চরিত্র নতুন প্রজন্মর কাছে তুলে ধরা গণমাধ্যমের অন্যতম দায়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি দেশ সঠিক ইতিহাস আশ্রয়ী হয়ে না চলতে পারলে তার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছানো কখনোই সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে গণমাধ্যমের আরেকটি প্রধান চরিত্র হল সরকারবিরোধিতা। কোনো কোনো সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম অকারণে সরকার বিরোধিতায় এতটাই মেতে উঠে যে, সরকারকে তারা জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে চায়। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম নেয়, যা গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দেখা দেয়। গণমাধ্যমে অবশ্যই সরকারের সমালোচনা থাকবে। বিশেষ করে বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের রাজনীতি যেখানে কালচারে পরিণত হয়েছে, সেখানে গণমাধ্যম কার্যত রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিরোধী দলের ভূমিকায়ই পালন করছে। বস্তুত গঠনমূলক সমালোচনা গণতন্ত্রের ভিতকে আরও মজবুত করতে পারে। গণমাধ্যমকে এমন আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে যাতে বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠী অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ না পায়। অনেক সময় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এমন সংবাদ পরিবেশন করা হয় যা বিদ্বেষপূর্ণ, চরিত্রহনন ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে এই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন। পরে যদি ভুল স্বীকার করা হয়, তাহলেও কিন্তু ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ মাধ্যমে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যায়।
দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখা হওয়া উচিত গণমাধ্যমের মূল নীতি। কিন্তু অনেক সময় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থই বড় হয়ে ওঠে। কোনো কোনো গণমাধ্যম মালিকের স্বার্থকেই বড় করে দেখে। কারণ মালিকের বিপুল অর্থলগ্নির কারণেই তো ওই গণমাধ্যমটি আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছে। তাই টিকে থাকার স্বার্থে তাকে আপস করতে হয়। মালিক যদি ঋণখেলাপি হন তাহলে ওই গণমাধ্যমে ঋণখেলাপি সম্পর্কে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হবে না। যদি হাউজিং ব্যবসায়ী হন, তাহলেও ওই সম্পর্কে নেতিবাচক কোনো সংবাদ প্রকাশিত হবে না। যদি কালো টাকার মালিক হন, কর ফাঁকি দেন তাহলেও এ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ প্রকাশিত হবে না। বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে এক রকম জিম্মি অবস্থায় আছে গণমাধ্যম। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান যত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গেই জড়িত থাকুক না কেন, প্রচার সংখ্যার জোর না থাকলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি শব্দও প্রকাশিত হবে না। স্বাধীনতা বলি আর দায়বদ্ধতা বলি দুটোই এক্ষেত্রে অচল। পেশাদারি উৎকর্ষ এবং দক্ষতাও একটি প্রধান বিষয়। গণমাধ্যমের একটি ভুল শব্দ অনেক বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। শুধু তাই নয়, কোনটি খবর নয় আর কোনটি খবর, কোন খবরের কতটা গুরুত্ব দেয়া উচিত এ ব্যাপারেও গণমাধ্যমের সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করা যায়।
কুকুর মানুষকে কামড়ালে তা কোনো খবর হবে না, কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড়ালে সেটা খবর। কিন্তু এখন প্রায় সবই খবর। কোনো গণমাধ্যমের মালিক জেলখানা থেকে মুক্তি পেলে সেটাও ওই গণমাধ্যমে ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে দেখানো হয়। অথচ সার্বিকভাবে ওই ঘটনাটির কোনো সংবাদমূল্য আছে কি-না, সেটি বিবেচনায় নেয়া হয় না। বলা হয়ে থাকে ‘তোমার স্বাধীনতা আমার নাকের ডগা পর্যন্ত। এ পর্যন্ত তুমি ছড়ি ঘোরাতে পার। কিন্তু তোমার ছড়ি আমার নাক বা শরীর স্পর্শ করলে সেখানেই স্বাধীনতা বিপন্ন হয়।’ ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তিও স্মরণযোগ্য- ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত নাও হতে পারি কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের অধিকারের জন্য আমি জীবনও দিতে পারি।’
এই স্বাধীনতা তখনই সার্থক হবে যখন তাতে জনকল্যাণের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। প্রসঙ্গত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি নিবন্ধের শরণ নেয়া যায়। সম্প্রতি দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভারতীয় মিডিয়ার গৌরব ও কলঙ্ক’ শিরোনামাঙ্কিত নিবন্ধে তিনি বলেছেন- ‘এখানকার সমস্যা অবশ্য মিডিয়ায় তেমন স্থান পায় না। কেননা সামাজিক বিভাজনই সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে এই পক্ষপাতিত্ব জোগায়। অথচ ভারতের বাস্তবতা অবিরত জনগণের দৃষ্টিগোচরে রাখার জন্য মিডিয়া অধিকতর গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। সংবাদ পরিবেশনায় এই পক্ষপাতিত্ব পাঠকের কাছে কোনোভাবে অপ্রীতিকর মনে না হলেও তা ভারতের সুবিধাবঞ্চিতদের চরম বঞ্চনার প্রতিকার সাধনে রাজনৈতিক অনীহা সৃষ্টিতে প্রভূত অবদান রেখে থাকে। ভাগ্যবান গোষ্ঠীর মধ্যে যেহেতু শুধু ব্যবসায়ী নেতারা ও পেশাজীবী শ্রেণীগুলোই নয়, দেশের বুদ্ধিজীবীদেরও এক বিরাট অংশ রয়েছে, তাই জাতির ব্যতিক্রমধর্মী অগ্রগতির খবর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খুব বেশি প্রচার লাভ করে থাকে এবং যা কিনা বড়জোর অতি পক্ষপাতদুষ্ট এক কাহিনীমাত্র। সেটাকেই কথিত বাস্তবতায় রূপ দেয়া হয়।’ এখানে ‘ভারতের’ জায়গায় ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করলে অবস্থাটি কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে একই থেকে যায়। অমর্ত্য সেনের আরও একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। তার মতে, গণমাধ্যম থাকলে দুর্ভিক্ষও দূর করা সম্ভব। কেননা কোথাও দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সেটা যদি গণমাধ্যমে উঠে আসে, তাহলে সরকার বা রাষ্ট্র সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। ফলে কেউ না খেয়ে মরবে না। একদিকে মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা করে তাকে বিকশিত করা, অন্যদিকে শুধু ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি নিয়ে পাঠককে খদ্দেরে পরিণত করা- গণমাধ্যম যদি এই ধরনের দ্বিচারিতায় লিপ্ত হয়, তাহলে তার স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার জায়গাটি ভীষণভাবে নষ্ট হয়। এতে আর যাই হোক, সাধারণ মানুষের কোনো কল্যাণ হয় না।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট
No comments