বিএনপির নতুন ধারার রাজনীতিটা কী? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বিএনপি
ঘোষণা দিয়েছে তারা আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে দেশকে নতুন
ধারার রাজনীতি উপহার দেবে। এই নতুন ধারার রাজনীতিটা কী তা অবশ্য এখনও তারা
খোলাসা করে বলেননি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা না হলে বিএনপি
নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, তা অনেকের কাছেই এখনও স্পষ্ট নয়, কিন্তু খালেদা
জিয়া ইতিমধ্যেই নির্বাচনী প্রচারণা অভিযানে নেমে গেছেন এবং এই প্রচার
অভিযানে তার একটি কথা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বারবারই বলছেন, ‘বিএনপি
আর প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি করবে না।’ ‘দেশনেত্রী’কে তার
উপদেষ্টারা এ কথাটা বুঝিয়ে দিয়েছেন কিনা জানি না যে, ‘বিএনপি আর
প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না’, এই কথা দ্বারা দলনেত্রী স্বীকার করে নিলেন,
তারা এতদিন প্রতিহিংসার রাজনীতি করেছেন। এটা যদি খালেদা জিয়ার সরল
স্বীকারোক্তি হয় এবং তার দল জামায়াত, হেফাজতসহ উগ্র মৌলবাদী চক্রগুলোর
সন্ত্রাসী রাজনীতির বাহুবন্ধন ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ ও
প্রসারিত মধ্যপথে নেমে আসবে তার ইঙ্গিত হয়, তাহলে বিএনপি নেত্রীর নতুন
ধারার রাজনীতির ঘোষণাটির তাৎপর্য স্পষ্ট হয়। তা না হলে দলনেত্রীর এই ঘোষণা
হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই প্রমাণিত হবে- এটা নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢেলে দেশের
মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা। আমি বিএনপির নেতৃস্থানীয় একাধিক বন্ধুকে
জিজ্ঞাসা করেছি, তারা নতুন ধারার রাজনীতি বলতে কী বোঝাচ্ছেন। তারা আমাকে
স্পষ্ট করে কিছু বোঝাতে পারেননি। কেবল বলেছেন, বিএনপি আর অতীতের ধারায়
রাজনীতি করবে না। আমার প্রশ্ন, দলটির এই অতীতের ধারা কী? দেশের অনেক
নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতেই, বিএনপির চরিত্র ও রাজনীতির বৈশিষ্ট্য
হল (ক) একজন সেনাপ্রধানের ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনে সেনা ছাউনিতে সেনাশাসনের
সিভিল ফেস হিসেবে বিএনপির জন্ম নেয়া। (খ) পাকিস্তানে যেমন মস্ক এন্ড
মিলিটারির মিলনে একটি অগণতান্ত্রিক এবং আরও সাম্প্রদায়িক শাসক শক্তি গড়ে
উঠেছিল, বাংলাদেশেও তার অনুকরণ করা হয় এবং বিএনপির পেছনে একদিকে
ক্যান্টনমেন্ট এবং অন্যদিকে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরাজিত সাম্প্রদায়িক ও কট্টর
মৌলবাদী দলগুলো জড়ো হয়।
(গ) স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত হওয়া মুসলিম লীগের রাজনীতির উত্তরাধিকার বিএনপি গ্রহণ করে এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই অসাম্প্রদায়িক নামটি তার পরিচয় হয়। ভারতে এই একই কাজটি করেছে কট্টর সাম্প্রদায়িক বিজেপি। মহাÍা গান্ধীকে হত্যার পর হিন্দু মহাসভা নামক ঘাতক দলটি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় জনতা দল বা বিজেপি এই অসাম্প্রদায়িক নামের খোলসে এই দলটির আবির্ভাব ঘটে। শিবসেনা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ইত্যাদি জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী উপদলগুলোর সংমিশ্রণে বিজেপি আরও উগ্র সাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হয়। অতীতের হিন্দু মহাসভার চেয়েও বিজেপির সাম্প্রদায়িক উগ্রতা বেশি। যদিও দলটির বাইরের খোলস হচ্ছে বাংলাদেশের বিএনপির মতো গণতান্ত্রিক। তারা গণতান্ত্রিক সেজে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে একাধিকবার দেশ শাসনও করেছে। কিন্তু এই দলের হাতেই গুজরাটের গোধরা হত্যাকাণ্ড এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসসহ সংখ্যালঘু নিপাত বা এথনিক ক্লিনসিংয়ের জঘন্য মানবতাবিরোধী ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং বর্তমানেও তারা গুজরাটে মুসলিম নিধনের হোতা এবং বুচার অফ গুজরাট নামে পরিচিত নরেন্দ্রনাথ মোদিকে আগামী সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী করার ঘোষণা দিয়েছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি এই অসাম্প্রদায়িক নামের আড়ালে দলটি অতীতের মুসলিম লীগ রাজনীতির উত্তরাধিকার গ্রহণ করে। অতীতের মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে উগ্র মৌলবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটেনি; কিন্তু বাংলাদেশে বিএনপির রাজনীতিতে তা ঘটেছে এবং এখন তার চেহারা প্রকাশ্য।
অতীতে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ রাজনীতি বর্তমানের বিএনপি রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও মৌলবাদমুক্ত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে নূরুল আমিনের সর্বশেষ মুসলিম লীগ সরকার ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুলি চালিয়েছে, প্রাদেশিক পরিষদের ৩৫টি উপনির্বাচন ঠেকিয়ে রেখেছে, ৪৫ হাজার রাজনৈতিক বন্দিতে কারাগার ভরে ফেলেছে এ কথা সত্য; কিন্তু ১৯৫৪ সালে সম্পূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ যে নির্বাচনটি তারা অনুষ্ঠান করেছে, তার নজির কী বিএনপির কুষ্ঠিনামায় নেই।
গোটা মুসলিম লীগ সরকার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনসহ প্রদেশের ওই নির্বাচনে শুধু পরাজিত হওয়া নয়, জামানত হারিয়েছে; কিন্তু নির্বাচনের ফলকে প্রভাবিত করার জন্য তারা প্রশাসনকে ব্যবহার করেনি; রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড চালায়নি, নির্বাচনের সময় নির্যাতন চালিয়ে হিন্দু ভোটদাতাদের দেশ ছাড়া করেনি। সবচেয়ে বড় কথা, তখনকার ছোট-বড় মৌলবাদী দলগুলোকে নির্বাচনের সময় তাদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেনি। ’৫৪-এর নির্বাচনের সময় শক্তিশালী না হলেও জামায়াত দলটি ছিল। শক্তিশালী মৌলবাদী দল ছিল নেজামে ইসলাম। নেজাম বরং হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টে যোগ দিয়েছে। মুসলিম লীগের পক্ষে যায়নি। মুসলিম লীগের এই কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি এই দলটিরই ঐতিহ্য ও রাজনীতির উত্তরাধিকারী বিএনপির কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ভারতে বিজেপি যেমন অতীতের হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক নীতির সঙ্গে উগ্র হিন্দুত্ববাদের যোগ ঘটিয়েছে; বাংলাদেশেও তেমনি মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিএনপির হাতে উগ্র মৌলবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশটির গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এক সর্বনাশা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
সেনা ছাউনিতে জন্ম নিয়ে বিএনপি বহুকাল সেনাশাসনের সিভিল ফেস হিসেবে কাজ করেছে। তার ক্ষমতার পেছনে ছিল পাকিস্তানের মতো ‘মিলিটারি এন্ড মস্ক’। বর্তমানে তার সর্বাধিক নির্ভরতা জামায়াতের মতো ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী এবং হেফাজতের (পেছনে হিজবুত ইত্যাদি হিংস্র মৌলবাদী সংস্থা) ওপর। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির একাধিকবার কারসাজি ও জালিয়াতি; তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিকৃত ও কলুষিত করা, নির্বাচনে প্রশাসনকে ব্যবহার, তাদের শাসনামলের অসংখ্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, নির্বাচনকালে (২০০১) প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নির্বাচনপ্রার্থী, কর্মী, সমর্থক- বিশেষ করে সংখ্যালঘু ভোটদাতাদের ওপর নির্মম অত্যাচার আজ প্রমাণিত ইতিহাস। বিএনপির নেতানেত্রীরা আজ তা গলার জোরে অস্বীকার করতে পারেন; কিন্তু তাতে ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না।
এটা উপমহাদেশের ইতিহাসের এক চরম ট্রাজেডি- দুই শতাব্দীর বিদ্রোহ, বিপ্লব ও আন্দোলন দ্বারা যে উপমহাদেশ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই উপমহাদেশের বিরাট অংশ ভারতে আজ উগ্র হিন্দু মৌলবাদী বিজেপি দ্বিতীয় বৃহত্তম দল এবং যে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় জাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত লড়াই করে স্বাধীন হয়েছে সেই বাংলাদেশে আজ সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র মৌলবাদনির্ভর বিএনপি দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। তারা একাধিকবার ক্ষমতায় গেছে। দেশটির মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ও সেক্যুলার চরিত্রকে ধ্বংস করেছে এবং তাদের আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা (আশংকা) আছে।
বাংলাদেশের জনমানসে এখন একটা অদ্ভুত পরস্পরবিরোধী মানসিকতা কাজ করছে। যাদের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আওয়ামী লীগ সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন এবং বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির জয় এবার ঠেকানো যাবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে তারাই আবার বলেন, ‘এবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশ শুধু আধা তালেবানি রাষ্ট্র হবে না; সেক্যুলারিস্ট দলগুলোর ওপর এমন নির্যাতন নেমে আসবে, নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর এমন অত্যাচার শুরু হবে, যা ২০০১ সালের বর্বরতাকেও হার মানাবে, বিএনপির সহযোগী জামায়াত শুধু ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে খালাস করে আনবে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যে মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী এখনও সরব ও সক্রিয় তাদের হয় ’৭১-এর মতো নিপাত, না হয় দেশ ছাড়া করার ব্যবস্থা করবে। একই মুখে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী কথা শুনে আমি তাদের বলি, আপনারা দেশের সচেতন মানুষ যদি এই আশংকাই করেন যে, বিএনপি (দোসর জামায়াত-হেফাজত) আবার ক্ষমতায় আসতে পারে এবং এলে আফগানিস্তানের মতো ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, তাহলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের যত বড় দোষত্র“টিই থাকুক, তার বিরোধিতায় আপনারা এমন উচ্চকণ্ঠ কেন? আপনারাই তো বিএনপি-জামায়াতের আবার ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে দিচ্ছেন। আমার এই কথার সদুত্তর অধিকাংশ বন্ধুর কাছ থেকে পাই না।
অদ্ভুত এক সাইকি এখন কাজ করছে দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষের মনে। তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে আর পছন্দ করছেন না। আবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে সেই ভয়ে তারা ভীত। এই ভয় থেকে তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হলে বিএনপিকে ভোট দেবেন কিনা তাও এখন পর্যন্ত এক সন্দেহের বিষয়। সম্ভবত দেশের এক বিপুলসংখ্যক ভোটদাতার মনের এই সন্দেহ ও ভয়ের কথা অনুমান করেই বিএনপি নেত্রী এখন তার নির্বাচনী প্রচারণায় ‘আর প্রতিহিংসার রাজনীতি করব না’ এই কথাটি বারবার বলে এই সন্দেহ ও ভয় দূর করার চেষ্টা করছেন এবং বিএনপি নতুন ধারায় রাজনীতি করবে বলে দেশবাসীর মনে নতুন ধাঁধা সৃষ্টি করতে চাইছেন। কিন্তু বিএনপির রাজনীতির এই নতুন ধারাটি কী হবে, তা জানতে চেয়ে বিএনপির নেতৃস্থানীয় একাধিক বন্ধুর কাছ থেকে কোনো স্পষ্ট ধারণা পাইনি। এই নতুন ধারাটি কি তাহলে সোনার পাথর বাটি?
বিএনপি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। অবশ্যই ইচ্ছা করলে সে তার রাজনীতিতে নতুন ধারার জন্ম দিতে পারে। এই ধারাটি হল- সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র মৌলবাদী রাজনীতি ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির উদার ও মধ্যপথে অবিলম্বে চলে আসা। জামায়াত, হেফাজত ইত্যাদি স্বাধীনতা-বিরোধী ও গণবিরোধী চক্রগুলোর জোট থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছোট-বড় দলের সঙ্গে নতুন করে জোট গঠন করা। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ কোনো ভূমিকা গ্রহণ না করা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুস্পষ্ট কর্মসূচিভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা; আওয়ামী-বিরোধিতার নামে গোটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান না নেওয়া। সহিংস ও সন্ত্রাসী রাজনীতি পরিহার করে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে দাবি-দাওয়া আদায়ের চেষ্টা করা। সংসদে ফিরে যাওয়া। পারবেন বিএনপি নেতানেত্রীরা এই শর্তগুলো পূরণ করে সুস্থ, স্বাভাবিক, গণতান্ত্রিক রাজনীতির নতুন ধারা সৃষ্টি করতে? বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি তা পারবে তা আমার মনে হয় না। এটা পারার আন্তরিকতাও তাদের মধ্যে নেই। থাকলে জামায়াতের সহিংস ও সন্ত্রাসী রাজনীতির সঙ্গে মিতালি তারা আরও দৃঢ় করতেন না। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মুখে সমর্থন করেও সেই বিচার ও দণ্ড ভণ্ডুল করার জন্য হেফাজতি তাণ্ডবে সমর্থন জানাতেন না এবং তাদের দ্বারা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের নীলনকশা তৈরি করতেন না।
বিএনপি নতুন ধারার রাজনীতি করবে ঘোষণা দেয়ার পর যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হওয়ার পর তাকেসহ যুদ্ধাপরাধী, মানবতার শত্র“দের রক্ষার জন্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে তাদের আইনজীবীদের ঝাঁপিয়ে পড়া কোন নতুন ধারার রাজনীতির আভাস দেয়? সব শেষে অক্টোবর মাসের শেষ দিক থেকে আবার হরতালের নামে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও সন্ত্রাসের রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া কি হবে বিএনপির নতুন ধারার রাজনীতি? আর এই রাজনীতি দ্বারা কি বিএনপি দেশবাসীকে বেশিদিন বিভ্রান্ত করে রাখতে পারবে?
(গ) স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত হওয়া মুসলিম লীগের রাজনীতির উত্তরাধিকার বিএনপি গ্রহণ করে এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই অসাম্প্রদায়িক নামটি তার পরিচয় হয়। ভারতে এই একই কাজটি করেছে কট্টর সাম্প্রদায়িক বিজেপি। মহাÍা গান্ধীকে হত্যার পর হিন্দু মহাসভা নামক ঘাতক দলটি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় জনতা দল বা বিজেপি এই অসাম্প্রদায়িক নামের খোলসে এই দলটির আবির্ভাব ঘটে। শিবসেনা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ইত্যাদি জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী উপদলগুলোর সংমিশ্রণে বিজেপি আরও উগ্র সাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হয়। অতীতের হিন্দু মহাসভার চেয়েও বিজেপির সাম্প্রদায়িক উগ্রতা বেশি। যদিও দলটির বাইরের খোলস হচ্ছে বাংলাদেশের বিএনপির মতো গণতান্ত্রিক। তারা গণতান্ত্রিক সেজে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে একাধিকবার দেশ শাসনও করেছে। কিন্তু এই দলের হাতেই গুজরাটের গোধরা হত্যাকাণ্ড এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসসহ সংখ্যালঘু নিপাত বা এথনিক ক্লিনসিংয়ের জঘন্য মানবতাবিরোধী ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং বর্তমানেও তারা গুজরাটে মুসলিম নিধনের হোতা এবং বুচার অফ গুজরাট নামে পরিচিত নরেন্দ্রনাথ মোদিকে আগামী সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী করার ঘোষণা দিয়েছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি এই অসাম্প্রদায়িক নামের আড়ালে দলটি অতীতের মুসলিম লীগ রাজনীতির উত্তরাধিকার গ্রহণ করে। অতীতের মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে উগ্র মৌলবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটেনি; কিন্তু বাংলাদেশে বিএনপির রাজনীতিতে তা ঘটেছে এবং এখন তার চেহারা প্রকাশ্য।
অতীতে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ রাজনীতি বর্তমানের বিএনপি রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও মৌলবাদমুক্ত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে নূরুল আমিনের সর্বশেষ মুসলিম লীগ সরকার ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুলি চালিয়েছে, প্রাদেশিক পরিষদের ৩৫টি উপনির্বাচন ঠেকিয়ে রেখেছে, ৪৫ হাজার রাজনৈতিক বন্দিতে কারাগার ভরে ফেলেছে এ কথা সত্য; কিন্তু ১৯৫৪ সালে সম্পূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ যে নির্বাচনটি তারা অনুষ্ঠান করেছে, তার নজির কী বিএনপির কুষ্ঠিনামায় নেই।
গোটা মুসলিম লীগ সরকার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনসহ প্রদেশের ওই নির্বাচনে শুধু পরাজিত হওয়া নয়, জামানত হারিয়েছে; কিন্তু নির্বাচনের ফলকে প্রভাবিত করার জন্য তারা প্রশাসনকে ব্যবহার করেনি; রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড চালায়নি, নির্বাচনের সময় নির্যাতন চালিয়ে হিন্দু ভোটদাতাদের দেশ ছাড়া করেনি। সবচেয়ে বড় কথা, তখনকার ছোট-বড় মৌলবাদী দলগুলোকে নির্বাচনের সময় তাদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেনি। ’৫৪-এর নির্বাচনের সময় শক্তিশালী না হলেও জামায়াত দলটি ছিল। শক্তিশালী মৌলবাদী দল ছিল নেজামে ইসলাম। নেজাম বরং হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টে যোগ দিয়েছে। মুসলিম লীগের পক্ষে যায়নি। মুসলিম লীগের এই কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি এই দলটিরই ঐতিহ্য ও রাজনীতির উত্তরাধিকারী বিএনপির কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ভারতে বিজেপি যেমন অতীতের হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক নীতির সঙ্গে উগ্র হিন্দুত্ববাদের যোগ ঘটিয়েছে; বাংলাদেশেও তেমনি মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিএনপির হাতে উগ্র মৌলবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশটির গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এক সর্বনাশা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
সেনা ছাউনিতে জন্ম নিয়ে বিএনপি বহুকাল সেনাশাসনের সিভিল ফেস হিসেবে কাজ করেছে। তার ক্ষমতার পেছনে ছিল পাকিস্তানের মতো ‘মিলিটারি এন্ড মস্ক’। বর্তমানে তার সর্বাধিক নির্ভরতা জামায়াতের মতো ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী এবং হেফাজতের (পেছনে হিজবুত ইত্যাদি হিংস্র মৌলবাদী সংস্থা) ওপর। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির একাধিকবার কারসাজি ও জালিয়াতি; তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিকৃত ও কলুষিত করা, নির্বাচনে প্রশাসনকে ব্যবহার, তাদের শাসনামলের অসংখ্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, নির্বাচনকালে (২০০১) প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নির্বাচনপ্রার্থী, কর্মী, সমর্থক- বিশেষ করে সংখ্যালঘু ভোটদাতাদের ওপর নির্মম অত্যাচার আজ প্রমাণিত ইতিহাস। বিএনপির নেতানেত্রীরা আজ তা গলার জোরে অস্বীকার করতে পারেন; কিন্তু তাতে ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না।
এটা উপমহাদেশের ইতিহাসের এক চরম ট্রাজেডি- দুই শতাব্দীর বিদ্রোহ, বিপ্লব ও আন্দোলন দ্বারা যে উপমহাদেশ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই উপমহাদেশের বিরাট অংশ ভারতে আজ উগ্র হিন্দু মৌলবাদী বিজেপি দ্বিতীয় বৃহত্তম দল এবং যে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় জাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত লড়াই করে স্বাধীন হয়েছে সেই বাংলাদেশে আজ সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র মৌলবাদনির্ভর বিএনপি দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। তারা একাধিকবার ক্ষমতায় গেছে। দেশটির মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ও সেক্যুলার চরিত্রকে ধ্বংস করেছে এবং তাদের আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা (আশংকা) আছে।
বাংলাদেশের জনমানসে এখন একটা অদ্ভুত পরস্পরবিরোধী মানসিকতা কাজ করছে। যাদের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আওয়ামী লীগ সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন এবং বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির জয় এবার ঠেকানো যাবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে তারাই আবার বলেন, ‘এবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশ শুধু আধা তালেবানি রাষ্ট্র হবে না; সেক্যুলারিস্ট দলগুলোর ওপর এমন নির্যাতন নেমে আসবে, নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর এমন অত্যাচার শুরু হবে, যা ২০০১ সালের বর্বরতাকেও হার মানাবে, বিএনপির সহযোগী জামায়াত শুধু ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে খালাস করে আনবে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যে মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী এখনও সরব ও সক্রিয় তাদের হয় ’৭১-এর মতো নিপাত, না হয় দেশ ছাড়া করার ব্যবস্থা করবে। একই মুখে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী কথা শুনে আমি তাদের বলি, আপনারা দেশের সচেতন মানুষ যদি এই আশংকাই করেন যে, বিএনপি (দোসর জামায়াত-হেফাজত) আবার ক্ষমতায় আসতে পারে এবং এলে আফগানিস্তানের মতো ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, তাহলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের যত বড় দোষত্র“টিই থাকুক, তার বিরোধিতায় আপনারা এমন উচ্চকণ্ঠ কেন? আপনারাই তো বিএনপি-জামায়াতের আবার ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে দিচ্ছেন। আমার এই কথার সদুত্তর অধিকাংশ বন্ধুর কাছ থেকে পাই না।
অদ্ভুত এক সাইকি এখন কাজ করছে দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষের মনে। তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে আর পছন্দ করছেন না। আবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে সেই ভয়ে তারা ভীত। এই ভয় থেকে তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হলে বিএনপিকে ভোট দেবেন কিনা তাও এখন পর্যন্ত এক সন্দেহের বিষয়। সম্ভবত দেশের এক বিপুলসংখ্যক ভোটদাতার মনের এই সন্দেহ ও ভয়ের কথা অনুমান করেই বিএনপি নেত্রী এখন তার নির্বাচনী প্রচারণায় ‘আর প্রতিহিংসার রাজনীতি করব না’ এই কথাটি বারবার বলে এই সন্দেহ ও ভয় দূর করার চেষ্টা করছেন এবং বিএনপি নতুন ধারায় রাজনীতি করবে বলে দেশবাসীর মনে নতুন ধাঁধা সৃষ্টি করতে চাইছেন। কিন্তু বিএনপির রাজনীতির এই নতুন ধারাটি কী হবে, তা জানতে চেয়ে বিএনপির নেতৃস্থানীয় একাধিক বন্ধুর কাছ থেকে কোনো স্পষ্ট ধারণা পাইনি। এই নতুন ধারাটি কি তাহলে সোনার পাথর বাটি?
বিএনপি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। অবশ্যই ইচ্ছা করলে সে তার রাজনীতিতে নতুন ধারার জন্ম দিতে পারে। এই ধারাটি হল- সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র মৌলবাদী রাজনীতি ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির উদার ও মধ্যপথে অবিলম্বে চলে আসা। জামায়াত, হেফাজত ইত্যাদি স্বাধীনতা-বিরোধী ও গণবিরোধী চক্রগুলোর জোট থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছোট-বড় দলের সঙ্গে নতুন করে জোট গঠন করা। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ কোনো ভূমিকা গ্রহণ না করা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুস্পষ্ট কর্মসূচিভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা; আওয়ামী-বিরোধিতার নামে গোটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান না নেওয়া। সহিংস ও সন্ত্রাসী রাজনীতি পরিহার করে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে দাবি-দাওয়া আদায়ের চেষ্টা করা। সংসদে ফিরে যাওয়া। পারবেন বিএনপি নেতানেত্রীরা এই শর্তগুলো পূরণ করে সুস্থ, স্বাভাবিক, গণতান্ত্রিক রাজনীতির নতুন ধারা সৃষ্টি করতে? বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি তা পারবে তা আমার মনে হয় না। এটা পারার আন্তরিকতাও তাদের মধ্যে নেই। থাকলে জামায়াতের সহিংস ও সন্ত্রাসী রাজনীতির সঙ্গে মিতালি তারা আরও দৃঢ় করতেন না। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মুখে সমর্থন করেও সেই বিচার ও দণ্ড ভণ্ডুল করার জন্য হেফাজতি তাণ্ডবে সমর্থন জানাতেন না এবং তাদের দ্বারা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের নীলনকশা তৈরি করতেন না।
বিএনপি নতুন ধারার রাজনীতি করবে ঘোষণা দেয়ার পর যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হওয়ার পর তাকেসহ যুদ্ধাপরাধী, মানবতার শত্র“দের রক্ষার জন্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে তাদের আইনজীবীদের ঝাঁপিয়ে পড়া কোন নতুন ধারার রাজনীতির আভাস দেয়? সব শেষে অক্টোবর মাসের শেষ দিক থেকে আবার হরতালের নামে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও সন্ত্রাসের রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া কি হবে বিএনপির নতুন ধারার রাজনীতি? আর এই রাজনীতি দ্বারা কি বিএনপি দেশবাসীকে বেশিদিন বিভ্রান্ত করে রাখতে পারবে?
No comments