একটি দরকারি নির্বাচনী ইশতেহার by ড. কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির
রাজনৈতিক
নেতাদের কথাবার্তা, জনসভা, টকশো, পত্রপত্রিকা বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার
নড়াচড়া দেখে মনে হয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পালে মৃদু হাওয়া লেগেছে।
যদিও অনেকের সন্দেহ এখনও কাটেনি নির্বাচন আদৌ হবে কিনা অথবা হলে কিভাবে
হবে। যাই হোক, দলগুলো কম বেশি ব্যস্ত যোগ্য প্রার্থী বাছাই করার কাজে।
সঙ্গে সঙ্গে চলছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনসংযোগ, জনগণের কাছে করছেন বিভিন্ন
ধরনের ওয়াদা। চমক লাগানো নির্বাচনী ইশতেহার সাজাতে দলের নীতিনির্ধারণী
পর্যায়ের নেতা, উপদেষ্টা বা থিংকট্যাংকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে বলা যায়। দেশ
ডিজিটাল না এনালগ হবে এ নিয়ে বিশ্লেষণের শেষ নেই। ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত
থাকা বা হওয়ার চেষ্টায় নেই গাফিলতি। অভিযোগ আছে- জেতার পর বেশিরভাগ
নির্বাচিত প্রতিনিধি তাদের নিজ নির্বাচনী এলাকায় যান কদাচিৎ। নির্বাচিত
প্রতিনিধিরা বলেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষায় রাজধানীতে না থাকলে, আলোচনা-বাহাস
না করলে এলাকার জন্য অর্থ বরাদ্দ কিভাবে আসবে। কথায় যুক্তি একেবারে নেই
বলা যাবে না। যাই হোক, গণতান্ত্রিক দেশ বলে কথা। জনগণের ভোটেই হবে চূড়ান্ত
ফয়সালা।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এদেশের গণতন্ত্র অনেকটা ভোটাভুটি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। জনগণের কথা যাদের ভাবার কথা তারা খুব কমই ভাবেন বলে মনে হয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে অপরিপক্ব বললে অত্যুক্তি হবে না। অপরিপক্বতার পাশাপাশি সীমাহীন দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অপশাসন, হত্যা, গুম, খুন ইত্যাদির কথা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। এত কিছুর পরও দেশ ধারাবাহিকভাবে এগোচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়েছে দেশ। তিন বেলা না খেয়ে থাকতে রাজি কিন্তু এক ঘণ্টা মোবাইল, ফেসবুক ও টুইটার ছাড়া থাকতে পারি না। খাদ্যপণ্য সংরক্ষণে এসেছে যুগান্তকারী সাফল্য, যার কল্যাণে দেশে এখন পচা ফল পাওয়া কঠিন। আবিষ্কৃত হয়েছে ফরমালিন পদ্ধতি, কার্বাইড পদ্ধতি, কীটনাশক পদ্ধতি আরও কত কী! সব পদ্ধতির রয়েছে ক্যারিশমাটিক গুণ। তাই এগুলো দেদারসে ব্যবহার হচ্ছে আমাদের মৌসুমি ফল, শাকসবজি, খাদ্যশস্য, শিশুখাদ্য, পানীয়, মুড়ি, বেকারি পণ্য, জিলাপি, ফাস্ট ফুড, পশুখাদ্য, ওষুধ ইত্যাদিতে।
সম্প্রতি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমার লেখা ‘খাদ্যে ভেজাল : একটি ভিন্ন রকম পর্যালোচনা ও করণীয়’ শীর্ষক একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বোঝানোর চেষ্টা করেছি খাদ্যে ভেজালের কারণে কিভাবে আমরা তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি। নিকষ-কালো অন্ধকারের দিকে গোটা জাতি কিভাবে একটু একটু করে ধাবিত হচ্ছে। বর্ণনা করেছি দেশে বর্তমানে ভেজালের মাত্রা কত ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। ভেজালের ব্যাপ্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চার, পাঁচ বা ছয়স্তরবিশিষ্ট কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী বা দুর্ভেদ্য গ্রিন জোনও এর আওতামুক্ত নয়। ভেজাল এক নীরব ঘাতক হয়ে জাতির ওপর খড়গ হয়ে দেখা দিয়েছে। অবস্থার ভয়াবহতা এমন যে ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সচেতন হয়েও ভেজালের হাত থেকে রেহাই পাওয়া অসম্ভব। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা বিষ-মিশ্রিত খাবার নাকি খাবার মিশ্রিত বিষ খাচ্ছি। ভেজালের কারণে খাদ্য-চিকিৎসার সঙ্গে অন্যসব মৌলিক চাহিদাও কোনো না কোনোভাবে প্রভাবান্বিত হচ্ছে। চিকিৎসক ও গবেষকদের ভাষ্যমতে, অনেক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে খাদ্যে ভেজাল, যা নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক চাপ পর্যন্ত সুবিস্তৃত।
নির্বাচন এলে জনগণ অনেক আশা নিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা পেলেই জনগণ খুশি। অনেককে বলতে শুনেছি- জীবনধারণের খাদ্যেরই যদি নিরাপত্তা না থাকল, তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কিনে কী হবে? সহজ সমীকরণে বলা যায়, দেশের জনগণই যদি ভালোমতো না বাঁচল, ডিজিটাল বা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দিয়ে কী হবে? দেশের মানুষ যদি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষই হয়ে গেল, তাহলে ভিশন-২১ বা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়ে কী হবে? ভবিষ্যৎ প্রজন্ম (দেশের শিশুরা) যদি স্টুপিড হয়ে বেড়ে ওঠে, তাহলে দেশের প্রবৃদ্ধি বা রিজার্ভ গগনচুম্বী হয়ে কী লাভ? গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০২১ সালে দেশের সিংহভাগ মানুষ ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হবে। দেশে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা। খাদ্যপণ্যে ভেজালের সঙ্গে আপস করার নজির পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। দুঃখজনক যে আমাদের দেশে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের প্রভাবে ভেজালবিরোধী অভিযান অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। আমাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। বুঝে না বুঝে আমরা যারা নিজ হাতে ভেজাল মেশাই, খাদ্যপণ্যে বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিক্যাল বা কীটনাশক ব্যবহার করি, কেউই ভেজালের বিস্তৃত জাল থেকে রেহাই পাচ্ছি না- এটা সত্যিকারভাবে আমরা কদাচিৎ অনুধাবন করি।
বিষয়টা এমনও নয় যে, সরকারি দলের সমর্থকরা ক্ষমতার জোরে সব রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহ পরিণতি থেকে বেঁচে যাবে আর বিরোধী দল ভেজাল খেয়ে মরবে। এ রকম হলে সবার আগে আমাদের দেশে সে চর্চা শুরু হতো- অবস্থা দৃষ্টে সে রকমই মনে হয়। বস্তুত ধর্ম-বর্ণ সবার স্বার্থ এখানে সমানভাবে জড়িত। তাই বিষয়টি অনেক গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। খাদ্যে ভেজালের অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিতে সমাধান করার বাস্তবসম্মত অঙ্গীকার হতে পারে আগামী নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। অনেকের মতে, অন্য অনেক ইশতেহারের চেয়ে এর গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি। কাজেই ১৪ বা ১৮ দলীয় জোটের সবাইকে সত্যিকারভাবে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে পারলে নিশ্চয় তা শুধু ওয়াদার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সহজেই বাস্তবায়িত হবে। কয়েক দিন আগে বিরোধীদলীয় নেতা এক জনসভায় সমাজ থেকে মাদক নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন। মাদক সমাজকে ঘুণপোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে- সন্দেহ নেই। অবশ্যই মাদকের কবল থেকে সমাজের ঐশীদের বাঁচাতে হবে। সময়োচিত এ ধরনের ওয়াদা বা সিদ্ধান্তের জন্য সাধুবাদ জানাই। মাদকের মাধ্যমে বিশেষ করে দেশের যুবসমাজের একাংশ ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ভেজালের মাধ্যমে মাদকসেবীর সঙ্গে অন্য সবাই ধ্বংস হচ্ছে। গর্ভের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ- সবাই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কাজেই ভেজালের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। ইচ্ছা করলে অনেক কঠিন কাজও যে অসম্ভব নয়, তা বিগত জোট সরকারের শিক্ষাঙ্গনকে নকলমুক্ত করার কৃতিত্ব থেকেই বোঝা যায়- যা সব মহলে হয়েছিল প্রশংসিত। বিরোধীদলীয় নেতার সময়োপযোগী ওয়াদার সূত্র ধরে জনসাধারণের একজন হিসেবে আশা করতে চাই, ১৮ দলীয় জোট যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে সমাজ থেকে সত্যিকারভাবে মাদক দূর হবে। তেমনিভাবে আশা থাকবে, আগামীতে যে জোটই ক্ষমতায় আসুক, খাদ্যে ভেজালরূপী জাতীয় বিপর্যয়কে সমাজ থেকে দূর করতে প্রয়াস পাবে।
দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে সামনে রেখে, মানুষের চাহিদা বা দেশের সার্বিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার নিরিখে, এক কথায় তাৎক্ষণিক বা সুদূরপ্রসারী জনকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে। খাদ্যে ভেজাল একটি বড় ধরনের জাতীয় সমস্যা- এটা অনস্বীকার্য। সার্বিক বিবেচনায় খাদ্যে ভেজাল রোধ দেশের সচেতন মহলের গণদাবিতে পরিণত হয়েছে বলে অনেকের মতো আমারও মনে হয়। পাশাপাশি অচেতনদেরও দরকার সমানভাবে। দারুণ এ সুযোগকে যে কোনো দলের লুফে নেয়ার কথা। আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দেবে। সেই সঙ্গে সত্যিকারভাবে সে ওয়াদা বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবে, অন্তত নিজের স্বার্থের কথা ভেবে হলেও।
ড. কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির : সহযোগী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়; গবেষক, ইয়াংনাম ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া
দুঃখজনক হলেও সত্য, এদেশের গণতন্ত্র অনেকটা ভোটাভুটি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। জনগণের কথা যাদের ভাবার কথা তারা খুব কমই ভাবেন বলে মনে হয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে অপরিপক্ব বললে অত্যুক্তি হবে না। অপরিপক্বতার পাশাপাশি সীমাহীন দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অপশাসন, হত্যা, গুম, খুন ইত্যাদির কথা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। এত কিছুর পরও দেশ ধারাবাহিকভাবে এগোচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়েছে দেশ। তিন বেলা না খেয়ে থাকতে রাজি কিন্তু এক ঘণ্টা মোবাইল, ফেসবুক ও টুইটার ছাড়া থাকতে পারি না। খাদ্যপণ্য সংরক্ষণে এসেছে যুগান্তকারী সাফল্য, যার কল্যাণে দেশে এখন পচা ফল পাওয়া কঠিন। আবিষ্কৃত হয়েছে ফরমালিন পদ্ধতি, কার্বাইড পদ্ধতি, কীটনাশক পদ্ধতি আরও কত কী! সব পদ্ধতির রয়েছে ক্যারিশমাটিক গুণ। তাই এগুলো দেদারসে ব্যবহার হচ্ছে আমাদের মৌসুমি ফল, শাকসবজি, খাদ্যশস্য, শিশুখাদ্য, পানীয়, মুড়ি, বেকারি পণ্য, জিলাপি, ফাস্ট ফুড, পশুখাদ্য, ওষুধ ইত্যাদিতে।
সম্প্রতি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমার লেখা ‘খাদ্যে ভেজাল : একটি ভিন্ন রকম পর্যালোচনা ও করণীয়’ শীর্ষক একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বোঝানোর চেষ্টা করেছি খাদ্যে ভেজালের কারণে কিভাবে আমরা তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি। নিকষ-কালো অন্ধকারের দিকে গোটা জাতি কিভাবে একটু একটু করে ধাবিত হচ্ছে। বর্ণনা করেছি দেশে বর্তমানে ভেজালের মাত্রা কত ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। ভেজালের ব্যাপ্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চার, পাঁচ বা ছয়স্তরবিশিষ্ট কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী বা দুর্ভেদ্য গ্রিন জোনও এর আওতামুক্ত নয়। ভেজাল এক নীরব ঘাতক হয়ে জাতির ওপর খড়গ হয়ে দেখা দিয়েছে। অবস্থার ভয়াবহতা এমন যে ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সচেতন হয়েও ভেজালের হাত থেকে রেহাই পাওয়া অসম্ভব। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা বিষ-মিশ্রিত খাবার নাকি খাবার মিশ্রিত বিষ খাচ্ছি। ভেজালের কারণে খাদ্য-চিকিৎসার সঙ্গে অন্যসব মৌলিক চাহিদাও কোনো না কোনোভাবে প্রভাবান্বিত হচ্ছে। চিকিৎসক ও গবেষকদের ভাষ্যমতে, অনেক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে খাদ্যে ভেজাল, যা নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক চাপ পর্যন্ত সুবিস্তৃত।
নির্বাচন এলে জনগণ অনেক আশা নিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা পেলেই জনগণ খুশি। অনেককে বলতে শুনেছি- জীবনধারণের খাদ্যেরই যদি নিরাপত্তা না থাকল, তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কিনে কী হবে? সহজ সমীকরণে বলা যায়, দেশের জনগণই যদি ভালোমতো না বাঁচল, ডিজিটাল বা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দিয়ে কী হবে? দেশের মানুষ যদি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষই হয়ে গেল, তাহলে ভিশন-২১ বা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়ে কী হবে? ভবিষ্যৎ প্রজন্ম (দেশের শিশুরা) যদি স্টুপিড হয়ে বেড়ে ওঠে, তাহলে দেশের প্রবৃদ্ধি বা রিজার্ভ গগনচুম্বী হয়ে কী লাভ? গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০২১ সালে দেশের সিংহভাগ মানুষ ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হবে। দেশে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা। খাদ্যপণ্যে ভেজালের সঙ্গে আপস করার নজির পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। দুঃখজনক যে আমাদের দেশে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের প্রভাবে ভেজালবিরোধী অভিযান অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। আমাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। বুঝে না বুঝে আমরা যারা নিজ হাতে ভেজাল মেশাই, খাদ্যপণ্যে বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিক্যাল বা কীটনাশক ব্যবহার করি, কেউই ভেজালের বিস্তৃত জাল থেকে রেহাই পাচ্ছি না- এটা সত্যিকারভাবে আমরা কদাচিৎ অনুধাবন করি।
বিষয়টা এমনও নয় যে, সরকারি দলের সমর্থকরা ক্ষমতার জোরে সব রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহ পরিণতি থেকে বেঁচে যাবে আর বিরোধী দল ভেজাল খেয়ে মরবে। এ রকম হলে সবার আগে আমাদের দেশে সে চর্চা শুরু হতো- অবস্থা দৃষ্টে সে রকমই মনে হয়। বস্তুত ধর্ম-বর্ণ সবার স্বার্থ এখানে সমানভাবে জড়িত। তাই বিষয়টি অনেক গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। খাদ্যে ভেজালের অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিতে সমাধান করার বাস্তবসম্মত অঙ্গীকার হতে পারে আগামী নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। অনেকের মতে, অন্য অনেক ইশতেহারের চেয়ে এর গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি। কাজেই ১৪ বা ১৮ দলীয় জোটের সবাইকে সত্যিকারভাবে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে পারলে নিশ্চয় তা শুধু ওয়াদার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সহজেই বাস্তবায়িত হবে। কয়েক দিন আগে বিরোধীদলীয় নেতা এক জনসভায় সমাজ থেকে মাদক নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন। মাদক সমাজকে ঘুণপোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে- সন্দেহ নেই। অবশ্যই মাদকের কবল থেকে সমাজের ঐশীদের বাঁচাতে হবে। সময়োচিত এ ধরনের ওয়াদা বা সিদ্ধান্তের জন্য সাধুবাদ জানাই। মাদকের মাধ্যমে বিশেষ করে দেশের যুবসমাজের একাংশ ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ভেজালের মাধ্যমে মাদকসেবীর সঙ্গে অন্য সবাই ধ্বংস হচ্ছে। গর্ভের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ- সবাই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কাজেই ভেজালের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। ইচ্ছা করলে অনেক কঠিন কাজও যে অসম্ভব নয়, তা বিগত জোট সরকারের শিক্ষাঙ্গনকে নকলমুক্ত করার কৃতিত্ব থেকেই বোঝা যায়- যা সব মহলে হয়েছিল প্রশংসিত। বিরোধীদলীয় নেতার সময়োপযোগী ওয়াদার সূত্র ধরে জনসাধারণের একজন হিসেবে আশা করতে চাই, ১৮ দলীয় জোট যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে সমাজ থেকে সত্যিকারভাবে মাদক দূর হবে। তেমনিভাবে আশা থাকবে, আগামীতে যে জোটই ক্ষমতায় আসুক, খাদ্যে ভেজালরূপী জাতীয় বিপর্যয়কে সমাজ থেকে দূর করতে প্রয়াস পাবে।
দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে সামনে রেখে, মানুষের চাহিদা বা দেশের সার্বিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার নিরিখে, এক কথায় তাৎক্ষণিক বা সুদূরপ্রসারী জনকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে। খাদ্যে ভেজাল একটি বড় ধরনের জাতীয় সমস্যা- এটা অনস্বীকার্য। সার্বিক বিবেচনায় খাদ্যে ভেজাল রোধ দেশের সচেতন মহলের গণদাবিতে পরিণত হয়েছে বলে অনেকের মতো আমারও মনে হয়। পাশাপাশি অচেতনদেরও দরকার সমানভাবে। দারুণ এ সুযোগকে যে কোনো দলের লুফে নেয়ার কথা। আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দেবে। সেই সঙ্গে সত্যিকারভাবে সে ওয়াদা বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবে, অন্তত নিজের স্বার্থের কথা ভেবে হলেও।
ড. কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির : সহযোগী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়; গবেষক, ইয়াংনাম ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া
No comments