সহিংসতা থেকে বাঁচার একটিই পথ আছে by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
নির্বাচনকালীন
সরকার ব্যবস্থা নিয়ে চলমান সংকট সরকারের মেয়াদের শেষদিকে এসে ক্রমান্বয়ে
জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সরকার চাইছে সংশোধিত সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে
থেকে সংসদ বহাল রেখে, প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-এমপিদের স্বপদে রেখে নিজেদের
মনোনীত নির্বাচন কমিশনের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে। অন্যদিকে
বিরোধী দলসহ নাগরিক সম্প্রদায়ের অধিকাংশ চাইছেন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ
নির্বাচনকালীন সরকার। বিরোধী দল মনে করে, সরকার যেভাবে নির্বাচন করতে চাইছে
তাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে না। তাছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ
নির্বাচন করার মতো পরিবেশ পরিস্থিতি এখনও বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক
দলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক অনাস্থার জায়গাটিতে যেহেতু কোনো উন্নতি হয়নি এবং
নির্বাচন কমিশনকেও নব্বই পরবর্তী সরকারগুলো যেহেতু স্বাধীন ও শক্তিশালী
করতে পারেনি, সে কারণে দলীয় সরকারকে বিশ্বাস করে তার অধীনে নির্বাচনে যেতে
বিরোধীদলীয় অনীহাকে দেশবাসী অযৌক্তিক মনে করছেন না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও
দাতাগোষ্ঠীরা চাইছে সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ
নির্বাচন। সাধারণ মানুষ সংঘাত ও সহিংসতা চান না। তারা চান উভয় দলের মধ্যে
একটি আপসরফা হোক। কিন্তু সে আশা করতে করতে এবং সরকারি দলের পক্ষ থেকে কোনো
সমঝোতা উদ্যোগ গ্রহণ না করায় তারা হতাশ হয়ে পড়ছেন। এখন প্রধানমন্ত্রী
জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যাওয়ায় বিদেশের মাটিতে এ বিষয়ে কী
আলাপ-আলোচনা হয়, অনেকে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
সরকারের ভুলে না যাওয়া ভালো যে, নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করাই উত্তম। এ ব্যাপারে বিদেশীরা সুবিধা করতে পারেন না। আর বিদেশীরা যদি আমাদের সমস্যার সমাধান করে দেন, তাহলে তা রাজনৈতিক নেতাদের জন্য লজ্জার বিষয়। ১৯৯৬ সালে একই রকম সমস্যা সমাধানে বিদেশীরা অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পরে এ দেশের রাজনৈতিক নেতারাই ওই সমস্যার সমাধান করেছিলেন। সমস্যা হল, সরকার আলোচ্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে, চলমান সংকটের মধ্যে আলোচনা-সমঝোতার পথে না গিয়ে, যেভাবেই হোক না কেন নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীর নির্বাচনসংক্রান্ত দুশ্চিন্তা আরও গভীর করে তুলেছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে চলমান ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি এ জোটের নেত্রী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসভা করে দেশবাসীকে তাদের দাবির যৌক্তিকতার পক্ষে অধিকতর সম্পৃক্ত করার কাজে নেমেছেন। এসব জনসভায় বেগম জিয়া বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইলে তার জোট শুধু নির্বাচন প্রত্যাখ্যানই করবে না, তারা এমন নির্বাচন হতে দেবেন না। অন্যদিকে ১৭ সেপ্টেম্বর সিলেটের গোলাপগঞ্জে সরকারি দলের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী যেভাবেই হোক নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, বেগম জিয়া নির্বাচন বানচাল করতে পারবেন না। নির্বাচন নিয়ে দেশের দুই প্রধান নেত্রীর এ পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেখে দেশবাসী বুঝতে পারছেন যে, দশম সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
সরকার যদি সাংবিধানিক কাঠামোর দোহাই দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই এ নির্বাচন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে, আর বিরোধী দল যদি এ নির্বাচন বর্জন করে একে প্রতিহত করার লক্ষ্যে কর্মসূচি দেয়, তাহলে নিশ্চিত রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ভোটারবিহীন একটি যাচ্ছেতাই মার্কা নির্বাচন হয়ে স্বল্পায়ুর সরকার গঠিত হতে পারবে, নাকি তার আগেই অন্য কোনো রকম অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে, তা নিয়ে সুশীল সমাজ চিন্তিত। তবে সময় দ্রুত ফুরিয়ে এলেও এখনই সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য বিরোধী দলের ওপর স্নায়ুচাপ বাড়িয়ে তাদের সমঝোতার দরকষাকষিতে কাবু করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কি-না তা আর মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্পষ্ট হবে। দেশবাসী আনন্দিত হবে যদি সরকার দশম সংসদ নির্বাচনকে রক্তপাত ও সংঘর্ষের পথ থেকে বের করে সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে উৎসব ও আনন্দের পথে নিয়ে আসতে পারে।
এ উপমহাদেশে সাধারণ মানুষের কাছে যে কোনো নির্বাচন একটি সার্বজনীন উপভোগ্য রাজনৈতিক উৎসব। বিশেষ করে পাঁচ বছর পর পর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও ভোটাররা মিলে যে উৎসবের আমেজ গড়ে তোলে, তাকে উপভোগ্য বলা যায়। এ কারণে এ অঞ্চলে পাশ্চাত্যের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে নির্বাচনে ভোটের হার হয় অনেক বেশি। ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু ভেদে সবাই নির্বাচনের সময় সমান মর্যাদা পান বলে সাধারণ গ্রামীণ মানুষ ভোটের অধিকারকে বিশেষ মর্যাদা হিসেবে বিবেচনা করে নিজের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচনে সাগ্রহে ও সানন্দে অংশগ্রহণ করেন। এ কারণে গ্রামীণ স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের হার খুব বেশি হয়। তবে নির্বাচনের পরিবেশ-পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না থাকে, নির্বাচনে যদি সব দল অংশগ্রহণ না করে, নির্বাচনী প্রচারণা ও ভোটদানের নিরাপত্তা যদি সুনিশ্চিত না থাকে, তাহলে ওই নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ হ্রাস পায়। কারণ কোনো রকম হুমকি বা ঝুঁকির মধ্যে সাধারণ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে চান না। কাজেই যখন আমরা আনন্দমুখর বা উৎসবমুখর নির্বাচনের কথা বলি, ওই নির্বাচন বলতে আমরা এমন নির্বাচনকে বোঝাই, যে নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করে, নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে এবং ভোটাররা নির্বিঘেœ ও স্বাধীনভাবে পূর্ণ নিরাপত্তাসহকারে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোট প্রদান করতে পারেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার নিজদলীয় তত্ত্বাবধানে একতরফা নির্বাচন করতে চাইলে সে রকম নির্বাচনে একদিকে যেমন আশংকাজনকভাবে ভোট কম পড়বে, তেমনি সহিংসতার ঝুঁকিও হবে মারাÍক। সরকার এমন নির্বাচন করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তা করতে পারবে কি-না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার লক্ষ্যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর প্রধান বিরোধী দলগুলো চুপ করে ঘরে বসে থাকবে না। তারা ওই নির্বাচন বন্ধ করার জন্য কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি দেবে। এ রকম আন্দোলন কর্মসূচি যাতে সাধারণ মানুষের কাছে অযৌক্তিক মনে না হয় সেজন্য এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিরোধীদলীয় জোটের অর্ধশতাধিক টিম জনগণকে বিরোধীদলীয় আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনুধাবনে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার বিরোধীদলীয় আন্দোলন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার কথা ভাবতে পারে। তবে সরকারের মেয়াদের শেষকালে এসে এসব আন্দোলন গণসমর্থন পেলে ওই আন্দোলন কর্মসূচি দমনে সরকার প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কতটা সহায়তা পাবে তা নিয়ে ভাবার আছে।
সরকারের মনে রাখা ভালো, পে-স্কেলের ঘোষণা আর পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনকে কব্জায় রাখার যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, এ দেশের প্রশাসকরা সরকারের মেয়াদের শেষদিকে এসে রাজনৈতিক অংক করে দায়িত্ব পালন করেন। পরে কোন দল ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করবে সেসব হিসাব বিবেচনায় নিয়েই তারা কাজ করেন। ১৯৯৬ সালে যেসব সরকারি কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ সমর্থিত জনতার মঞ্চে যোগ দিয়েছিলেন, তারা রাজনৈতিক অংক করেই সে কাজে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। একইভাবে আজকের প্রশাসকরাও কোন দলের কতটা গণসমর্থন রয়েছে এবং কারা দশম সংসদ নির্বাচন হলে ওই নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে পারবে, সে অংকটি না করেই তারা সরকারের অন্যায় আদেশ বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের চাকরির ক্যারিয়ারকে ঝুঁকিযুক্ত করবেন বলে মনে হয় না। এরই মধ্যে সরকারি কর্মকর্তারা পাঁচটি হাই ভোল্টেজের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী ফলাফল দেখে বুঝতে পেরেছেন যে, আসন্ন নির্বাচনী যুদ্ধে বেশিরভাগ মানুষ কোন দলকে সমর্থন দেবেন। কাজেই নিজেদের চাকরির ক্যারিয়ারের কথা বিবেচনা করেই তারা সামনের দিনগুলোতে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করবেন। সেজন্য বলা যায়, আগামী দিনগুলোতে সরকার খুব সহজেই সরকারি কর্মকর্তাদের যা খুশি আদেশ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারবে বলে মনে হয় না।
স্মর্তব্য, ১৯৯৬ সালে অনেকটা একই চরিত্রের রাজনৈতিক অচলাবস্থার সময় বিরোধী দল থেকে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও ১৯৯৬ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি বিএনপি একটি যেনতেন ধরনের নির্বাচন করেছিল। ওই নির্বাচনে যে পরিমাণ সহিংসতা ও অনিয়ম হয়েছিল, সরকার আসন্ন দশম সংসদ নির্বাচন একতরফাভাবে করতে চাইলে সে নির্বাচনে সহিংসতা হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। এর কারণ হল, উল্লিখিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন যারা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারা জানতেন যে বিএনপি সরকার ওই নির্বাচনটি ক্ষমতায় থাকার জন্য করবে না। সংসদে সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় দলটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার মধ্য দিয়ে বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নেয়ার জন্য ওই নির্বাচনটি করছে। এ কারণে আওয়ামী লীগসহ অন্য সব বিরোধী দল ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েও ওই নির্বাচন বানচাল করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেনি। আবার নির্বাচনের পর স্বল্পায়ুর সংসদে সরকার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নেয়ার পর বিরোধী দলগুলো ওই সংশোধনীক প্রত্যাখ্যান না করে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু চলমান পরিস্থিতি ও সংকট অন্যরকম। এখন কিন্তু সরকার বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নেয়ার জন্য একতরফা নির্বাচন করবে না। সরকার এ নির্বাচন করবে যে কোনোভাবে জয়লাভ করে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার জন্য। কাজেই এ নির্বাচনকে প্রতিহত করতে গিয়ে বিরোধী দলগুলো সর্বশক্তি নিয়োগে পিছপা হবে না। এর ফলে এ নির্বাচনে বোমাবাজি ও রক্তারক্তি এত বেশি হতে পারে যে, সরকার শেষ পর্যন্ত আদৌ নির্বাচন করতে পারবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ করা যায়। কারণ, অনুমিত সহিংসতা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে সরকার আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের যে সহায়তা পাবে, তার মধ্যে পূর্ণ আন্তরিকতার অভাব থাকতে পারে।
এর পরও যদি সরকার গায়ের জোরে যে কোনো উপায়ে সহিংসতার মধ্যেও নির্বাচন করে ফেলতে চায়, তা হয়তো অনেক ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে করতে পারবে। তবে ওই রকম নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি হবে আশংকাজনকভাবে কম। কারণ, নির্বাচনী সিডিউল ঘোষণা করার পর থেকে চলমান আন্দোলন ও সহিংসতার চিত্র দেখে নির্বাচনের দিন কী পরিমাণ সহিংসতা হতে পারে সে বিষয়টি অনুধাবন করার পর সাধারণ ভোটাররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে চাইবেন না। এর ফলে ওই নির্বাচনটি যুগপৎ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এমন নির্বাচনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করলে ওই সরকারকে প্রথম দিন থেকেই বিরোধীদলীয় অসহযোগিতা ও আন্দোলন মোকাবেলা করতে হবে। ফলে আরেকটি শান্তিপূর্ণ সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঝুঁকির মুখে পড়বে। দেশবাসীর প্রশ্ন, এ নাজুক পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও একাডেমিকদের কাছে এর একটিই উত্তর আছে। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে একটি শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো হাসিমুখে জয়-পরাজয় মেনে নেয়ার সংস্কৃতি চর্চা করে এ দুরবস্থা থেকে জাতিকে বাঁচাত পারে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সরকারের ভুলে না যাওয়া ভালো যে, নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করাই উত্তম। এ ব্যাপারে বিদেশীরা সুবিধা করতে পারেন না। আর বিদেশীরা যদি আমাদের সমস্যার সমাধান করে দেন, তাহলে তা রাজনৈতিক নেতাদের জন্য লজ্জার বিষয়। ১৯৯৬ সালে একই রকম সমস্যা সমাধানে বিদেশীরা অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পরে এ দেশের রাজনৈতিক নেতারাই ওই সমস্যার সমাধান করেছিলেন। সমস্যা হল, সরকার আলোচ্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে, চলমান সংকটের মধ্যে আলোচনা-সমঝোতার পথে না গিয়ে, যেভাবেই হোক না কেন নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীর নির্বাচনসংক্রান্ত দুশ্চিন্তা আরও গভীর করে তুলেছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে চলমান ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি এ জোটের নেত্রী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসভা করে দেশবাসীকে তাদের দাবির যৌক্তিকতার পক্ষে অধিকতর সম্পৃক্ত করার কাজে নেমেছেন। এসব জনসভায় বেগম জিয়া বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইলে তার জোট শুধু নির্বাচন প্রত্যাখ্যানই করবে না, তারা এমন নির্বাচন হতে দেবেন না। অন্যদিকে ১৭ সেপ্টেম্বর সিলেটের গোলাপগঞ্জে সরকারি দলের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী যেভাবেই হোক নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, বেগম জিয়া নির্বাচন বানচাল করতে পারবেন না। নির্বাচন নিয়ে দেশের দুই প্রধান নেত্রীর এ পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেখে দেশবাসী বুঝতে পারছেন যে, দশম সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
সরকার যদি সাংবিধানিক কাঠামোর দোহাই দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই এ নির্বাচন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে, আর বিরোধী দল যদি এ নির্বাচন বর্জন করে একে প্রতিহত করার লক্ষ্যে কর্মসূচি দেয়, তাহলে নিশ্চিত রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ভোটারবিহীন একটি যাচ্ছেতাই মার্কা নির্বাচন হয়ে স্বল্পায়ুর সরকার গঠিত হতে পারবে, নাকি তার আগেই অন্য কোনো রকম অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে, তা নিয়ে সুশীল সমাজ চিন্তিত। তবে সময় দ্রুত ফুরিয়ে এলেও এখনই সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য বিরোধী দলের ওপর স্নায়ুচাপ বাড়িয়ে তাদের সমঝোতার দরকষাকষিতে কাবু করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কি-না তা আর মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্পষ্ট হবে। দেশবাসী আনন্দিত হবে যদি সরকার দশম সংসদ নির্বাচনকে রক্তপাত ও সংঘর্ষের পথ থেকে বের করে সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে উৎসব ও আনন্দের পথে নিয়ে আসতে পারে।
এ উপমহাদেশে সাধারণ মানুষের কাছে যে কোনো নির্বাচন একটি সার্বজনীন উপভোগ্য রাজনৈতিক উৎসব। বিশেষ করে পাঁচ বছর পর পর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও ভোটাররা মিলে যে উৎসবের আমেজ গড়ে তোলে, তাকে উপভোগ্য বলা যায়। এ কারণে এ অঞ্চলে পাশ্চাত্যের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে নির্বাচনে ভোটের হার হয় অনেক বেশি। ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু ভেদে সবাই নির্বাচনের সময় সমান মর্যাদা পান বলে সাধারণ গ্রামীণ মানুষ ভোটের অধিকারকে বিশেষ মর্যাদা হিসেবে বিবেচনা করে নিজের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচনে সাগ্রহে ও সানন্দে অংশগ্রহণ করেন। এ কারণে গ্রামীণ স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের হার খুব বেশি হয়। তবে নির্বাচনের পরিবেশ-পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না থাকে, নির্বাচনে যদি সব দল অংশগ্রহণ না করে, নির্বাচনী প্রচারণা ও ভোটদানের নিরাপত্তা যদি সুনিশ্চিত না থাকে, তাহলে ওই নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ হ্রাস পায়। কারণ কোনো রকম হুমকি বা ঝুঁকির মধ্যে সাধারণ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে চান না। কাজেই যখন আমরা আনন্দমুখর বা উৎসবমুখর নির্বাচনের কথা বলি, ওই নির্বাচন বলতে আমরা এমন নির্বাচনকে বোঝাই, যে নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করে, নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে এবং ভোটাররা নির্বিঘেœ ও স্বাধীনভাবে পূর্ণ নিরাপত্তাসহকারে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোট প্রদান করতে পারেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার নিজদলীয় তত্ত্বাবধানে একতরফা নির্বাচন করতে চাইলে সে রকম নির্বাচনে একদিকে যেমন আশংকাজনকভাবে ভোট কম পড়বে, তেমনি সহিংসতার ঝুঁকিও হবে মারাÍক। সরকার এমন নির্বাচন করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তা করতে পারবে কি-না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার লক্ষ্যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর প্রধান বিরোধী দলগুলো চুপ করে ঘরে বসে থাকবে না। তারা ওই নির্বাচন বন্ধ করার জন্য কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি দেবে। এ রকম আন্দোলন কর্মসূচি যাতে সাধারণ মানুষের কাছে অযৌক্তিক মনে না হয় সেজন্য এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিরোধীদলীয় জোটের অর্ধশতাধিক টিম জনগণকে বিরোধীদলীয় আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনুধাবনে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার বিরোধীদলীয় আন্দোলন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার কথা ভাবতে পারে। তবে সরকারের মেয়াদের শেষকালে এসে এসব আন্দোলন গণসমর্থন পেলে ওই আন্দোলন কর্মসূচি দমনে সরকার প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কতটা সহায়তা পাবে তা নিয়ে ভাবার আছে।
সরকারের মনে রাখা ভালো, পে-স্কেলের ঘোষণা আর পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনকে কব্জায় রাখার যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, এ দেশের প্রশাসকরা সরকারের মেয়াদের শেষদিকে এসে রাজনৈতিক অংক করে দায়িত্ব পালন করেন। পরে কোন দল ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করবে সেসব হিসাব বিবেচনায় নিয়েই তারা কাজ করেন। ১৯৯৬ সালে যেসব সরকারি কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ সমর্থিত জনতার মঞ্চে যোগ দিয়েছিলেন, তারা রাজনৈতিক অংক করেই সে কাজে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। একইভাবে আজকের প্রশাসকরাও কোন দলের কতটা গণসমর্থন রয়েছে এবং কারা দশম সংসদ নির্বাচন হলে ওই নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে পারবে, সে অংকটি না করেই তারা সরকারের অন্যায় আদেশ বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের চাকরির ক্যারিয়ারকে ঝুঁকিযুক্ত করবেন বলে মনে হয় না। এরই মধ্যে সরকারি কর্মকর্তারা পাঁচটি হাই ভোল্টেজের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী ফলাফল দেখে বুঝতে পেরেছেন যে, আসন্ন নির্বাচনী যুদ্ধে বেশিরভাগ মানুষ কোন দলকে সমর্থন দেবেন। কাজেই নিজেদের চাকরির ক্যারিয়ারের কথা বিবেচনা করেই তারা সামনের দিনগুলোতে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করবেন। সেজন্য বলা যায়, আগামী দিনগুলোতে সরকার খুব সহজেই সরকারি কর্মকর্তাদের যা খুশি আদেশ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারবে বলে মনে হয় না।
স্মর্তব্য, ১৯৯৬ সালে অনেকটা একই চরিত্রের রাজনৈতিক অচলাবস্থার সময় বিরোধী দল থেকে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও ১৯৯৬ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি বিএনপি একটি যেনতেন ধরনের নির্বাচন করেছিল। ওই নির্বাচনে যে পরিমাণ সহিংসতা ও অনিয়ম হয়েছিল, সরকার আসন্ন দশম সংসদ নির্বাচন একতরফাভাবে করতে চাইলে সে নির্বাচনে সহিংসতা হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। এর কারণ হল, উল্লিখিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন যারা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারা জানতেন যে বিএনপি সরকার ওই নির্বাচনটি ক্ষমতায় থাকার জন্য করবে না। সংসদে সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় দলটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার মধ্য দিয়ে বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নেয়ার জন্য ওই নির্বাচনটি করছে। এ কারণে আওয়ামী লীগসহ অন্য সব বিরোধী দল ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েও ওই নির্বাচন বানচাল করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেনি। আবার নির্বাচনের পর স্বল্পায়ুর সংসদে সরকার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নেয়ার পর বিরোধী দলগুলো ওই সংশোধনীক প্রত্যাখ্যান না করে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু চলমান পরিস্থিতি ও সংকট অন্যরকম। এখন কিন্তু সরকার বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নেয়ার জন্য একতরফা নির্বাচন করবে না। সরকার এ নির্বাচন করবে যে কোনোভাবে জয়লাভ করে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার জন্য। কাজেই এ নির্বাচনকে প্রতিহত করতে গিয়ে বিরোধী দলগুলো সর্বশক্তি নিয়োগে পিছপা হবে না। এর ফলে এ নির্বাচনে বোমাবাজি ও রক্তারক্তি এত বেশি হতে পারে যে, সরকার শেষ পর্যন্ত আদৌ নির্বাচন করতে পারবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ করা যায়। কারণ, অনুমিত সহিংসতা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে সরকার আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের যে সহায়তা পাবে, তার মধ্যে পূর্ণ আন্তরিকতার অভাব থাকতে পারে।
এর পরও যদি সরকার গায়ের জোরে যে কোনো উপায়ে সহিংসতার মধ্যেও নির্বাচন করে ফেলতে চায়, তা হয়তো অনেক ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে করতে পারবে। তবে ওই রকম নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি হবে আশংকাজনকভাবে কম। কারণ, নির্বাচনী সিডিউল ঘোষণা করার পর থেকে চলমান আন্দোলন ও সহিংসতার চিত্র দেখে নির্বাচনের দিন কী পরিমাণ সহিংসতা হতে পারে সে বিষয়টি অনুধাবন করার পর সাধারণ ভোটাররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে চাইবেন না। এর ফলে ওই নির্বাচনটি যুগপৎ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এমন নির্বাচনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করলে ওই সরকারকে প্রথম দিন থেকেই বিরোধীদলীয় অসহযোগিতা ও আন্দোলন মোকাবেলা করতে হবে। ফলে আরেকটি শান্তিপূর্ণ সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঝুঁকির মুখে পড়বে। দেশবাসীর প্রশ্ন, এ নাজুক পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও একাডেমিকদের কাছে এর একটিই উত্তর আছে। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে একটি শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো হাসিমুখে জয়-পরাজয় মেনে নেয়ার সংস্কৃতি চর্চা করে এ দুরবস্থা থেকে জাতিকে বাঁচাত পারে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments