দয়া করে আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধ করুন by ড. আর এম দেবনাথ
যে
আশংকা করা হচ্ছিল, তাই এখন ঘটছে- ঘটছে ব্যাংকিং খাতে। অনেক দিন থেকেই
খবরের কাগজগুলো রিপোর্ট করছিল যে চট্টগ্রামের ব্যাংক ব্যবসা ভালো নয়। বড় বড়
গ্রাহক ব্যাংকের টাকা পরিশোধে গাফিলতি করছে, ব্যর্থ হচ্ছে। তারা ‘ঋণ
খেলাপি’তে পরিণত হতে পারে। এতে জড়িত কমপক্ষে এক ডজন সরকারি ও বেসরকারি
ব্যাংক। যেসব ব্যবসায়ী টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ী। তারা আমদানিকারক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সারাদেশের
ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। খবরের কাগজগুলো অনেক সময় এদের
‘সিন্ডিকেট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। চাল, ডাল, নুন, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ,
মরিচ, আদা, রসুন, ছোলা, সরিষার তেল, গম-আটা, মশলাপাতি ইত্যাদির ব্যবসায়ী
তারা। বলা হয়, এরা অনেকেই চার্টার করে পণ্য আমদানি করে। স্বাধীনতার পর
২০-২৫ জন আমদানিকারক একসঙ্গে মিলে যত পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে পারত, এখন
একজনই তার চেয়ে বেশি আমদানি করার ক্ষমতা রাখে। পণ্য চলে আসে ‘আউটার
অ্যাঙ্করেজে’। ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয় পরে। এমনই শক্তিশালী গ্র“পের ব্যবসায়ী
চট্টগ্রামের আমাদানিকারকরা। একেকজনের নাম-সুনাম আকাশচুম্বী। ব্যাংকার
বাহাদুররা তাদের কাছে গিয়ে বসে থাকে। তোয়াজ করে। ব্যাংকে ব্যাংকে মারামারি
হয়। সহায়-সম্পত্তি তাদেরই। এটা চট্টগ্রামেই হোক, নোয়াখালী-কুমিল্লাতেই হোক,
কিংবা ঢাকা মহানগরীতেই হোক অথবা হোক দেশের অন্যত্র। রমরমা ব্যবসা তাদের।
এতবড় ভূমিকা দিলাম কেন? দিলাম একটা প্রকাশিত খবরের তাৎপর্য বোঝার জন্য। খবরটি দেশের একটি দৈনিকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে। রীতিমতো আতংকের খবর। ভয় পাওয়ার মতো খবর। এর থেকে শিক্ষা নেয়ার ব্যাপার আছে। কী সেই খবর?
খবরের শিরোনাম : ‘চট্টগ্রামের ২২ প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি নিলামে : ১,১৮৯ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ অধিক লাভের আশায় জমি ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ’। এই শিরোনাম পড়ে কিছু বোঝা যায়, কিছু বোঝা যায় না। বোঝা যায়, নিলামে যখন উঠেছে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। যেহেতু ব্যাংক ঋণ আদায়ের বিষয়, সেহেতু নিশ্চয়ই মামলা হয়েছে অর্থ ঋণ আদালতের অধীনে। যেহেতু মামলা হয়েছে, তাই ধরে নেয়া যায় ঋণগুলো ‘ব্যাড অ্যান্ড লস’ ক্যাটাগরিভুক্ত। ব্যাংকের খারাপ ঋণের প্রথম ধাপ স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট (এসএমএ)। তার পরের ধাপ সাব-স্ট্যান্ডার্ড অর্থাৎ ঋণের জ্বর হয়েছে। তার পরের ধাপ ডাউটফুল (সন্দেহজনক), অর্থাৎ ঋণ বিছানায় শুয়ে পড়েছে। কী হয় বলা যায় না। তার পরের ধাপ ‘ব্যাড অ্যান্ড লস’, অর্থাৎ ঋণ লাইফ সাপোর্টে আছে, তা উদ্ধারের আর আশা নেই। এ সর্বশেষ ধাপে গেলে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে পুরোপুরি ‘প্রভিশন’ করে- এতে মুনাফা কমে। কারণ মুনাফা থেকেই ‘প্রভিশন’ করা হয়। অর্থাৎ ‘ব্যাড অ্যান্ড লস’ ক্যাটাগরিতে পড়েছে চট্টগ্রামের ২২টি বিখ্যাত ও বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক কী করবে? টাকা উদ্ধারের সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ১২টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক মামলা করেছে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব জমি-দালান-কোঠা জামানত (বন্ধক) হিসেবে রেখেছিল, তা এখন নিলামে উঠেছে। তারপর কী হবে? নিলামে ‘দরদাতা’ পাওয়া যাবে কি? কঠিন প্রশ্ন, কঠিন উত্তর। ব্যাংকগুলোর যে অভিজ্ঞতা তাতে সন্দেহ করাই যায়। সন্দেহ করা হয়, দরদাতা বা সম্পত্তি ক্রেতা পাওয়া যাবে কি-না! সন্দেহ, কেউ সাহস করে বড় বড় ব্যবসায়ীর জমি কিনতে যাবে কি-না! কত জমি? রিপোর্ট মোতাবেক জমি ও সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় তিন হাজার ৮০০ শতক। এ সম্পত্তি বিক্রি করে ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা আদায় হওয়ার কথা।
দেখা যাক, এসব মামলা-নিলামের ফলাফল কী দাঁড়ায়! আমি কিন্তু আশাবাদী নই। যদি ক্রেতা পাওয়া যায়, তাহলে ব্যাংকের মালিকদের মহাভাগ্য। প্রশ্ন আরও আছে। যে সম্পত্তি নিলামে উঠেছে, তা আসলে/বাস্তবে আছে কি-না? দ্বিতীয় প্রশ্ন, জমির মূল্য ঠিক আছে কি-না? তৃতীয় প্রশ্ন, জমির মালিকানা (টাইটেল) ঠিক আছে কি-না? অনেক অনেক প্রশ্ন। এসব প্রশ্ন কেন করলাম? শুনেছি চট্টগ্রামে জমি ‘বন্ধক’ দেয়ার জন্য ব্যবস্থা আছে। এসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাজই হচ্ছে জমির দুই নম্বরি ডকুমেন্ট তৈরি করা। মিউটেশন তৈরি করা। সেসব জমি ব্যাংকে ‘মর্টগেজ’ দেয়া। এটাই একশ্রেণীর দালালদের ব্যবসা। বাস্তবে সম্পত্তি আছে কি-না তাই প্রশ্ন করলাম। যদি সম্পত্তি থেকে থাকে, যদি টাইটেল ঠিক থেকে থাকে তাহলে প্রশ্ন, এত জমি কেনার এ মুহূর্তে ক্রেতা আছে কি-না? আমি সন্দেহ বাতিক লেখক, তাই এ প্রশ্নগুলো তুলে রাখলাম। আমি ভুল প্রমাণিত হলে ব্যাংকের কপাল ভালো হবে।
এখন দেখা যাক কারা এসব গ্রাহক? গ্রাহকদের মধ্যে আছে : নুরজাহান গ্র“প, মোস্তাফা গ্র“প, এমইবি গ্র“প, সিদ্দিক ট্রেডার্স। আরও আছে হারুন ট্রেডিং, রুমানা এন্টারপ্রাইজ, মনোয়ারা ট্রেডিং, আইমান এন্টারপ্রাইজ, মঈনুদ্দিন কর্পোরেশন, এসএস ইন্টারন্যাশনাল। এরা সবাই চট্টগ্রামের বড় বড় ব্যবসায়ী। আরও বড়, এদের চেয়ে বড় ব্যবসায়ী আছেন। খবরে প্রকাশ, তাদের অবস্থান ভালো নয়। তারা ঋণ পুনঃতফসিল, ওভারডিউ এবং নানা কায়দা করে ব্যাংকের টাকা আটকে রেখেছে। তাদের অবস্থাও ভালো নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, এরা সবাই ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ী। এরাই সয়াবিন ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করে, উচ্চমূল্যে বিক্রি করে বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। মানুষের ভোগান্তি ঘটিয়ে যারা পয়সা কামাই করেছে তারা এখন বলছে, পণ্যে তারা লোকসান দিয়েছে। পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। পণ্যের টাকা আদায় হচ্ছে না। তারা এখন ‘কেয়ারটেকার সরকারকেও’ দোষারোপ করছেন। তারা দোষারোপ করছেন ব্যাংকারদের। বলছেন, ব্যাংকাররা আগে বিপদে পড়লে আমদানিকারকের সাহায্যে এগিয়ে আসত। ঋণ পুনঃতফসিল করত, নতুনভাবে সুযোগ দিত- নতুন ঋণ দিয়ে যাতে ব্যবসায়ীরা লোকসান পুষিয়ে নিতে পারেন। তারা আরও বলছেন, তারা জমি কিনেছেন। তা এখন বিক্রি করতে পারছেন না। করতে পারলে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারতেন। বলা যায়, শত যুক্তি তারা এখন দিচ্ছেন। কিন্তু এ কথার জবাব তারা দেবেন কি, যে মুনাফা তারা আগে করেছেন তা কী করেছেন? সেই টাকা কি সরকারকে দিয়ে দিয়েছেন? লাভ হলে নিজের, লোকসান হলে ব্যাংকের- এটা তো কাজের কথা নয়। এটা তো ঠিক, লাভ ও লোকসান উভয়ই ব্যবসায়ীর- নাকি তা নয়? হতে পারে কোনো কোনো ব্যবসায়ী লোকসান দিয়েছেন। সবাই একসঙ্গে লোকসান দিয়েছেন এবং দিয়েছেন সব পণ্যে- একথা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন।
ব্যাংকাররা আগের তুলনায় কঠোরতর হয়েছে। হয়েছে নানা ‘স্ক্যামে’র কারণে। এসব ‘স্ক্যাম’ ব্যবসায়ীরাই করেছেন। ‘হলমার্ক’ যে কেলেংকারি করল, ‘বিসমিল্লাহ গ্র“প’ যে কেলেংকারি করল- কখনও কি ‘এফবিসিসিআই’ এর নিন্দা করেছে? তারা কি সেই টাকা উদ্ধারে কোনো ভূমিকা রেখেছে? না তা তারা করছে না। ‘আইবিপি’ ট্রাস্ট রিসিটের মাধ্যমে দেয়া ঋণের যে অপব্যবহার হচ্ছে, সে সম্পর্কে কি এফবিসিসিআই কিছু বলছে? না, তারা কিছুই বলে না। বলির পাঁঠা ব্যাংকাররা। ব্যাংকারদের মধ্যে অসৎ লোক আছে, চোর-চামার আছে। তাই বলে সবাই চোর নয়। অথচ সব ব্যাংকারকে, একটা পেশাকে যে দিনের পর দিন হেয় করা হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা কি সে সম্বন্ধে কিছু বলছেন? না, তারা কিছু বলছেন না। দোষী ব্যাংকাররা। এখন ব্যাংকাররা যদি তাদের ভুল-ক্রটি শুধরানোর চেষ্টা করেন এবং সেটা করতে গিয়ে যদি তারা আগের মতো সাহায্য-সহযোগিতা ব্যবসায়ীদের না করতে পারেন, তাহলে তাতে দোষের কী? শত হোক ব্যাংকারদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুশাসন মানতে হবে। সর্বনিু ব্যাংকিং নৈতিকতা পালন করতে হবে। এতে দোষের কী?
তবে একটি কথা বলা দারকার। আজকের এ দশার জন্য, ব্যাংকিং ব্যবসার বর্তমান অবস্থার জন্য ‘আগ্রাসী ব্যাংকিং’ দায়ী। অযৌক্তিকভাবে ম্যানেজারদের মুনাফা, আমানত, ঋণ ইত্যাদি টার্গেট দেয়া হচ্ছে। যে শাখার আমানত ১০০ কোটি টাকা, তাকে বলা হচ্ছে আমানত আনতে হবে ২০০ কোটি টাকার। মুনাফা আছে এক কোটি টাকা। বলা হচ্ছে, মুনাফা করতে হবে দুই কোটি টাকা।
ব্যক্তিগতভাবে অফিসারদের আমানতের টার্গেট দেয়া হয় দ্বিগুণ-তিনগুণ। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ৪৭টি ব্যাংক ছিল। যোগ হয়েছে আরও ছয়টি। প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা। ছোট অর্থনীতি, ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে ব্যবসা বাড়াতে হবে। এমডি সাহেবের বেতন ৪ লাখ, ৬ লাখ, ৮ লাখ টাকা মাসে। কর্মচারীর বেতন কম। অতি উৎসাহী এমডি সাহেবরা নিজের বেতন হালাল করার জন্য কর্মচারীদের জীবন বিপন্ন করে ছাড়ছে। লোকের চাকরি খাচ্ছে। পোষ্য লোকদের জায়গায় জায়গায় বসাচ্ছে। ব্যাংকের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ‘প্রতিযোগিতার’ কারণে কাস্টমার সিলেকশনে ভুল হচ্ছে। ব্যাংকাররা নিজেদের মুনাফার টার্গেট পূরণের জন্য ‘অনিয়ম’ করছে, খারাপ কাস্টমারকে ভালো করছে। মধ্য বয়সে চাকরি যখন যাবেই, তাই কিছু টাকা কামাই করে নাও। এটা করতে হলে ভালো কাস্টমার দিয়ে তা হবে না। যেনতেন ধরনের একজন কাস্টমার ধর, ঋণ দাও। ‘মর্টগেজ’ ঠিক আছে কি-না, পণ্যের গুণ ঠিক আছে কি-না, পণ্যের বাজার আছে কি-না- এসব দেখার প্রয়োজন নেই। লাভ দরকার। দু’দিন পর কী হবে, তা ভাবার দরকার নেই। চট্টগ্রামের ব্যাংকিং ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এ শিক্ষাই পাওয়া যায়।
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম
এতবড় ভূমিকা দিলাম কেন? দিলাম একটা প্রকাশিত খবরের তাৎপর্য বোঝার জন্য। খবরটি দেশের একটি দৈনিকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে। রীতিমতো আতংকের খবর। ভয় পাওয়ার মতো খবর। এর থেকে শিক্ষা নেয়ার ব্যাপার আছে। কী সেই খবর?
খবরের শিরোনাম : ‘চট্টগ্রামের ২২ প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি নিলামে : ১,১৮৯ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ অধিক লাভের আশায় জমি ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ’। এই শিরোনাম পড়ে কিছু বোঝা যায়, কিছু বোঝা যায় না। বোঝা যায়, নিলামে যখন উঠেছে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। যেহেতু ব্যাংক ঋণ আদায়ের বিষয়, সেহেতু নিশ্চয়ই মামলা হয়েছে অর্থ ঋণ আদালতের অধীনে। যেহেতু মামলা হয়েছে, তাই ধরে নেয়া যায় ঋণগুলো ‘ব্যাড অ্যান্ড লস’ ক্যাটাগরিভুক্ত। ব্যাংকের খারাপ ঋণের প্রথম ধাপ স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট (এসএমএ)। তার পরের ধাপ সাব-স্ট্যান্ডার্ড অর্থাৎ ঋণের জ্বর হয়েছে। তার পরের ধাপ ডাউটফুল (সন্দেহজনক), অর্থাৎ ঋণ বিছানায় শুয়ে পড়েছে। কী হয় বলা যায় না। তার পরের ধাপ ‘ব্যাড অ্যান্ড লস’, অর্থাৎ ঋণ লাইফ সাপোর্টে আছে, তা উদ্ধারের আর আশা নেই। এ সর্বশেষ ধাপে গেলে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে পুরোপুরি ‘প্রভিশন’ করে- এতে মুনাফা কমে। কারণ মুনাফা থেকেই ‘প্রভিশন’ করা হয়। অর্থাৎ ‘ব্যাড অ্যান্ড লস’ ক্যাটাগরিতে পড়েছে চট্টগ্রামের ২২টি বিখ্যাত ও বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক কী করবে? টাকা উদ্ধারের সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ১২টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক মামলা করেছে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব জমি-দালান-কোঠা জামানত (বন্ধক) হিসেবে রেখেছিল, তা এখন নিলামে উঠেছে। তারপর কী হবে? নিলামে ‘দরদাতা’ পাওয়া যাবে কি? কঠিন প্রশ্ন, কঠিন উত্তর। ব্যাংকগুলোর যে অভিজ্ঞতা তাতে সন্দেহ করাই যায়। সন্দেহ করা হয়, দরদাতা বা সম্পত্তি ক্রেতা পাওয়া যাবে কি-না! সন্দেহ, কেউ সাহস করে বড় বড় ব্যবসায়ীর জমি কিনতে যাবে কি-না! কত জমি? রিপোর্ট মোতাবেক জমি ও সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় তিন হাজার ৮০০ শতক। এ সম্পত্তি বিক্রি করে ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা আদায় হওয়ার কথা।
দেখা যাক, এসব মামলা-নিলামের ফলাফল কী দাঁড়ায়! আমি কিন্তু আশাবাদী নই। যদি ক্রেতা পাওয়া যায়, তাহলে ব্যাংকের মালিকদের মহাভাগ্য। প্রশ্ন আরও আছে। যে সম্পত্তি নিলামে উঠেছে, তা আসলে/বাস্তবে আছে কি-না? দ্বিতীয় প্রশ্ন, জমির মূল্য ঠিক আছে কি-না? তৃতীয় প্রশ্ন, জমির মালিকানা (টাইটেল) ঠিক আছে কি-না? অনেক অনেক প্রশ্ন। এসব প্রশ্ন কেন করলাম? শুনেছি চট্টগ্রামে জমি ‘বন্ধক’ দেয়ার জন্য ব্যবস্থা আছে। এসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাজই হচ্ছে জমির দুই নম্বরি ডকুমেন্ট তৈরি করা। মিউটেশন তৈরি করা। সেসব জমি ব্যাংকে ‘মর্টগেজ’ দেয়া। এটাই একশ্রেণীর দালালদের ব্যবসা। বাস্তবে সম্পত্তি আছে কি-না তাই প্রশ্ন করলাম। যদি সম্পত্তি থেকে থাকে, যদি টাইটেল ঠিক থেকে থাকে তাহলে প্রশ্ন, এত জমি কেনার এ মুহূর্তে ক্রেতা আছে কি-না? আমি সন্দেহ বাতিক লেখক, তাই এ প্রশ্নগুলো তুলে রাখলাম। আমি ভুল প্রমাণিত হলে ব্যাংকের কপাল ভালো হবে।
এখন দেখা যাক কারা এসব গ্রাহক? গ্রাহকদের মধ্যে আছে : নুরজাহান গ্র“প, মোস্তাফা গ্র“প, এমইবি গ্র“প, সিদ্দিক ট্রেডার্স। আরও আছে হারুন ট্রেডিং, রুমানা এন্টারপ্রাইজ, মনোয়ারা ট্রেডিং, আইমান এন্টারপ্রাইজ, মঈনুদ্দিন কর্পোরেশন, এসএস ইন্টারন্যাশনাল। এরা সবাই চট্টগ্রামের বড় বড় ব্যবসায়ী। আরও বড়, এদের চেয়ে বড় ব্যবসায়ী আছেন। খবরে প্রকাশ, তাদের অবস্থান ভালো নয়। তারা ঋণ পুনঃতফসিল, ওভারডিউ এবং নানা কায়দা করে ব্যাংকের টাকা আটকে রেখেছে। তাদের অবস্থাও ভালো নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, এরা সবাই ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ী। এরাই সয়াবিন ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করে, উচ্চমূল্যে বিক্রি করে বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। মানুষের ভোগান্তি ঘটিয়ে যারা পয়সা কামাই করেছে তারা এখন বলছে, পণ্যে তারা লোকসান দিয়েছে। পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। পণ্যের টাকা আদায় হচ্ছে না। তারা এখন ‘কেয়ারটেকার সরকারকেও’ দোষারোপ করছেন। তারা দোষারোপ করছেন ব্যাংকারদের। বলছেন, ব্যাংকাররা আগে বিপদে পড়লে আমদানিকারকের সাহায্যে এগিয়ে আসত। ঋণ পুনঃতফসিল করত, নতুনভাবে সুযোগ দিত- নতুন ঋণ দিয়ে যাতে ব্যবসায়ীরা লোকসান পুষিয়ে নিতে পারেন। তারা আরও বলছেন, তারা জমি কিনেছেন। তা এখন বিক্রি করতে পারছেন না। করতে পারলে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারতেন। বলা যায়, শত যুক্তি তারা এখন দিচ্ছেন। কিন্তু এ কথার জবাব তারা দেবেন কি, যে মুনাফা তারা আগে করেছেন তা কী করেছেন? সেই টাকা কি সরকারকে দিয়ে দিয়েছেন? লাভ হলে নিজের, লোকসান হলে ব্যাংকের- এটা তো কাজের কথা নয়। এটা তো ঠিক, লাভ ও লোকসান উভয়ই ব্যবসায়ীর- নাকি তা নয়? হতে পারে কোনো কোনো ব্যবসায়ী লোকসান দিয়েছেন। সবাই একসঙ্গে লোকসান দিয়েছেন এবং দিয়েছেন সব পণ্যে- একথা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন।
ব্যাংকাররা আগের তুলনায় কঠোরতর হয়েছে। হয়েছে নানা ‘স্ক্যামে’র কারণে। এসব ‘স্ক্যাম’ ব্যবসায়ীরাই করেছেন। ‘হলমার্ক’ যে কেলেংকারি করল, ‘বিসমিল্লাহ গ্র“প’ যে কেলেংকারি করল- কখনও কি ‘এফবিসিসিআই’ এর নিন্দা করেছে? তারা কি সেই টাকা উদ্ধারে কোনো ভূমিকা রেখেছে? না তা তারা করছে না। ‘আইবিপি’ ট্রাস্ট রিসিটের মাধ্যমে দেয়া ঋণের যে অপব্যবহার হচ্ছে, সে সম্পর্কে কি এফবিসিসিআই কিছু বলছে? না, তারা কিছুই বলে না। বলির পাঁঠা ব্যাংকাররা। ব্যাংকারদের মধ্যে অসৎ লোক আছে, চোর-চামার আছে। তাই বলে সবাই চোর নয়। অথচ সব ব্যাংকারকে, একটা পেশাকে যে দিনের পর দিন হেয় করা হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা কি সে সম্বন্ধে কিছু বলছেন? না, তারা কিছু বলছেন না। দোষী ব্যাংকাররা। এখন ব্যাংকাররা যদি তাদের ভুল-ক্রটি শুধরানোর চেষ্টা করেন এবং সেটা করতে গিয়ে যদি তারা আগের মতো সাহায্য-সহযোগিতা ব্যবসায়ীদের না করতে পারেন, তাহলে তাতে দোষের কী? শত হোক ব্যাংকারদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুশাসন মানতে হবে। সর্বনিু ব্যাংকিং নৈতিকতা পালন করতে হবে। এতে দোষের কী?
তবে একটি কথা বলা দারকার। আজকের এ দশার জন্য, ব্যাংকিং ব্যবসার বর্তমান অবস্থার জন্য ‘আগ্রাসী ব্যাংকিং’ দায়ী। অযৌক্তিকভাবে ম্যানেজারদের মুনাফা, আমানত, ঋণ ইত্যাদি টার্গেট দেয়া হচ্ছে। যে শাখার আমানত ১০০ কোটি টাকা, তাকে বলা হচ্ছে আমানত আনতে হবে ২০০ কোটি টাকার। মুনাফা আছে এক কোটি টাকা। বলা হচ্ছে, মুনাফা করতে হবে দুই কোটি টাকা।
ব্যক্তিগতভাবে অফিসারদের আমানতের টার্গেট দেয়া হয় দ্বিগুণ-তিনগুণ। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ৪৭টি ব্যাংক ছিল। যোগ হয়েছে আরও ছয়টি। প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা। ছোট অর্থনীতি, ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে ব্যবসা বাড়াতে হবে। এমডি সাহেবের বেতন ৪ লাখ, ৬ লাখ, ৮ লাখ টাকা মাসে। কর্মচারীর বেতন কম। অতি উৎসাহী এমডি সাহেবরা নিজের বেতন হালাল করার জন্য কর্মচারীদের জীবন বিপন্ন করে ছাড়ছে। লোকের চাকরি খাচ্ছে। পোষ্য লোকদের জায়গায় জায়গায় বসাচ্ছে। ব্যাংকের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ‘প্রতিযোগিতার’ কারণে কাস্টমার সিলেকশনে ভুল হচ্ছে। ব্যাংকাররা নিজেদের মুনাফার টার্গেট পূরণের জন্য ‘অনিয়ম’ করছে, খারাপ কাস্টমারকে ভালো করছে। মধ্য বয়সে চাকরি যখন যাবেই, তাই কিছু টাকা কামাই করে নাও। এটা করতে হলে ভালো কাস্টমার দিয়ে তা হবে না। যেনতেন ধরনের একজন কাস্টমার ধর, ঋণ দাও। ‘মর্টগেজ’ ঠিক আছে কি-না, পণ্যের গুণ ঠিক আছে কি-না, পণ্যের বাজার আছে কি-না- এসব দেখার প্রয়োজন নেই। লাভ দরকার। দু’দিন পর কী হবে, তা ভাবার দরকার নেই। চট্টগ্রামের ব্যাংকিং ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এ শিক্ষাই পাওয়া যায়।
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম
No comments