বিভক্ত ঐকমত্য, ভঙ্গুর সংহতি by ড. মাহফুজ পারভেজ
ফেব্রুয়ারি-মার্চ ছিল শাহবাগের গণজাগরণ
মঞ্চের দখলে। এই এপ্রিলে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে হেফাজতে ইসলাম। মে
মাসে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি। এই দুই আদর্শিক জোটের সুস্পষ্ট বিভাজন ছড়িয়ে
গেছে দেশব্যাপী।
মতার্দশিক মেরুকরণের হাত ধরে এই দুই
চিন্তা ও শক্তি কেন্দ্রকে ঘিরে বাংলাদেশের তাবৎ রাজনীতিরও মেরুকরণ ঘটছে।
কোন রাজনৈতিক দল কোন পক্ষে, সেটা আর লুকানো বিষয় নয়। এভাইে বাংলাদেশের
রাজনীতির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজপথে বিভক্ত হলো জাতীয় ঐকমত্য। ভঙ্গুর ও
পরস্পরবিরোধী মতাদর্শের কবলে এখন জাতীয় সংহতি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় সংহতির বিষয়টি বারাবরই দুর্বল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, ধর্মের প্রাধান্য বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা, উদারনৈতিকতা বনাম রক্ষণশীলতার সুপ্ত লড়াই স্বাধীনতার পর থেকেই চলে আসছে। চলমান রাজনীতি ভিন্ন ভিন্ন আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় চিন্তাকে জাতীয় চিন্তার জায়গায় একীভূত করতে পারে নি। দলগুলো ক্ষুদ্র স্বার্থবাদী ক্ষমতার রাজনীতির অনুসারী হওয়ার কারণে কখনও এ পক্ষকে, কখনও ঐ পক্ষকে ব্যবহার করেছে। এবার ঘটলো উল্টো ঘটনা। প্রথমে শাহবাগ থেকে বলা হলো, রাজনীতিকে সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ করতে হবে; ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। আইনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার অভিযোগও উঠল। সরকার দলের দায়িত্বশীল পর্যায়ের অনেকেই বললেন, শাহবাগের চেতনাকে গুরুত্ব দিয়েই সব কিছু করতে হবে এবং করা হবে। দ্রুতই প্রতিক্রিয়া এলো হেফাজতে ইসলামের তরফে। বলা হলো, ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও আঘাত সহ্য করা হবে না। একই সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সৃষ্টি হলো তীব্র বিপরীতমুখী অবস্থা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি পর্যন্ত শাহবাগ বাধাহীন ছিল। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় পর এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার ছাপ দেখা যাওয়ায় দৃশপট বদলে যায়। কিছু পরে শাহবাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্লগারকে পাওয়া গেল ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর বিরোধিতাকারীরূপে। শাহবাগ চিহ্ণিত হলো ধর্মনিরপেক্ষবাদের শক্তিকেন্দ্রে। প্রতিপক্ষ যার নাম দিয়েছে ‘নাস্তিক্যবাদী’।
শাহবাগের প্রতিক্রিয়ায় যে হেফাজতে ইসলাম, সেখানে র্যাডিক্যাল ও অর্থডক্স ইসলামী শক্তিসমূহের ব্যাপক সম্মিলন ঘটেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটে একদা আফগান-স্টাইলে জেহাদ করতে চাওয়া বহু ইসলামী নেতা ও তরুণ হেফাজতে ঠাঁই নিয়েছেন। ‘জামায়াতকে হেফাজতের জন্য এদের সৃষ্টি’ বলে যারা সরল হিসাব দিয়ে এদেরকে রুখতে চাচ্ছেন, তারা মস্ত বড় ভুল করছেন। মডারেট জামায়াতের চেয়ে এক শ গুণ রেজিমেন্টেড ও র্যাডিকেল এই শক্তি সেক্যুল্যর রাজনীতিকেই বিশ্বাস করে না। অতীতে এরা ফতোয়া, নারী নীতি, শিক্ষা নীতি ইত্যাদি ইস্যুতে সরব হলেও এবারই ১৩ দফার বিস্তারিত এজেন্ডা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন। যাতে রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলামীকরণের দাবি পরিস্কার। ১৯৯৬ সালে ফতোয়া বিরোধী আন্দোলন করে এরা ক্ষমতার পালাবদল ঘটিয়ে ছিলেন। এবার কিন্তু তারা তাদের ইস্যুকে আশ্রয় করে রাজনৈতিক ক্ষমতা হাসিলের সুযোগ কাউকে আপাতত দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। তারা তাদের আদর্শের বিজয়ের জন্য সময় নিয়ে ধীর লয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছেন। সরকারের মন্ত্রী, যুব ও ছাত্রনেতাদের সংহতি প্রকাশের নামে সামনে নিয়ে এসে শাহবাগ যে রাজনৈতিক ভুল করেছিল, হেফাজত সেটা করে নি। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী সমর্থন জানাতে এলেও বক্তৃতার সুযোগ পায় নি। একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, কয়েক জন সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান এমপিকে মঞ্চের এক কোণে বসিয়ে রেখেছে। শাহবাগকে মনে হয়েছে সরকার ও প্রশাসনের আশ্রয়ে পুষ্ট। আর হেফাজতকে মনে হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়দাতা।
সামনের দিনগুলোতে শাহবাগ ও হেফাজতের মধ্যে কে জিতবে, সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জাতীয় ঐকমত্যের চেহারাটি কেমন হবে, সেটাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এগুলো বড় কথা হলেও আপাতত মূল বিষয় হলো, এই বিরোধপূর্ণ আদর্শের অতি-উত্তেজিত লড়াইয়ের ফলে বাংলাদেশের আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মারাত্মক রকমের ঝাঁকি খাবে এবং ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। জাতীয় সংহতি ও ঐকমত্যের কাঠামোগত জায়গায় হাত পড়বে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার নানা ক্ষেত্রে কম্পন হবে। এমনিতেই দলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কবলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অতিশয় দুর্বল ও নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বিভিন্ন মত ও পথকে সমঝোতা ও একোমোডেট করতে সরকার ব্যবস্থা ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। সরকার পরিচালনা ও ক্ষমতা বদলের নিয়মতান্ত্রিক, সাংবিধানিক পন্থাতেও মত-পার্থক্য রয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে আছে অনিশ্চিত। নির্বাচনের প্রতি জনগণের একটি বড় অংশ আস্থাহীন ও বিমুখ থাকলে গণতন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বৈধতার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু আর থাকে না। এমন অবস্থায় বলা হচ্ছে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য তৃতীয় শক্তির আগমনের কথা। আরব বসন্তের আবেগে হেফাজতের লক্ষ লক্ষ অনুসারী যদি উদ্বেলিত হয়, তখন যে অবস্থার সৃষ্টি হবে, তাকে কোন শক্তির উত্থান বলে নাম দেওয়া হবে? শাহবাগের গণজাগরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারাও যদি গণজাগরণ ঘটাতে আগ্রহী হন এবং অবস্থান গ্রহণ করেন, তখন পরিস্থিতির চিত্রটি কেমন হবে আর কে সামাল দেবে সেটা? ইতিহাসে প্রথম বারের মতো ছুটির দিনে হরতাল দিয়ে এবং ট্রেন-বাসসহ সকল যানচলাচল বন্ধ করেও হেফাজতের লক্ষাধিক সমর্থককে লংমার্চ থেকে বিরত রাখা যায় নি; ঢাকার পথে তাদেরকে আটকেও রাখা যায় নি। সকল প্রতিবন্ধকতা ভেঙে তারা বিকল্প পথ ও পরিবহণে করে যথাসময়ে সমাবেশ স্থলে চলে এসেছেন। যারা আসতে পারেন নি, তারা চট্টগ্রাম, সিলেট, নরসিংদীতে ইসলামী জাগরণ মঞ্চ তৈরি করে কেন্দ্রীয় দাবির সমর্থনে অবস্থান নিয়েছেন। এপ্রিল মাসব্যাপী বিভিন্ন সভা-সমাবেশের পর আগামী ৫ মে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচিতে তারা আরও অনুপ্রাণিত হয়ে বিপুল শক্তিতে এসে হাজির হবেন বলেই মনে হচ্ছে। গত ৬ এপ্রিলের লংমার্চে তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এমন ইঙ্গিতই দিয়েছে। যেমন দিয়েছে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনীতির জন্য বেশ কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ পূর্বাভাস। হেফাজতের প্রকাশ্য উপস্থিতির পর বাংলাদেশের রাজনীতি এখন আর আওয়ামী লীগ-বিএনপি বৃত্তে সীমাবদ্ধ নেই। রাজনীতির ইস্যুও কেবলমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে সীমিত নেই। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেক অরাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, মতাদর্শিক বিষয়ের তপ্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেছে। এজন্য অবশ্যই ইতিহাসে শাহবাগ আন্দোলনের একটি ভূমিকা থাকবে। কিন্তু সে ভূমিকা এখনও অনির্ধারিত রয়ে গেছে। সেক্যুলার রাজনীতির বিস্তার কিংবা ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান, এই দুইয়ের কোনও একটির মধ্যেই বাংলাদেশের আগামী ভবিষ্যতের চিত্র খুঁজে বের করতে হবে। ধর্ম ও শাহবাগ চেতনার ঐক্য ও সমন্বয়ের জায়গাটিকে মনে হয় দেখাই যাচ্ছে না।
ড. মাহফুজ পারভেজ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments