‘হরতাল কবে শেষ হইবো ভাই?’ by মেহেদী হাসান পিয়াস
ভোর থেকে
শুরু হয় বালু টানার কাজ। চলে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। বালুভর্তি টুপরি (বালু
নেওয়ার বিশেষ ধরনের ঝাঁপি) মাথায় নিয়ে কেউ বালু তুলছেন ট্রাকে। কেউ কেউ
স্তুপে নিয়ে ঢালছেন।
বিভিন্ন বয়সের শ্রমিকেরা এ ভাবেই
প্রতিদিন বালু তোলার কাজ করে থাকেন কাঁচপুর ব্রিজের নিচে। এটিই নারী-পুরুষ
মিলিয়ে কয়েক হাজার বালু শ্রমিকের জীবিকা।
রোজ এ কাজ করে কত টাকা আয় হয় জানতে চাইলে মাথা থেকে টুপরি ও পাগড়ি নামিয়ে বড় করে দম নেন নারী বালুশ্রমিক জাহানারা বেগম (৫০)। কোমরে গোঁজা আঁচল টেনে মুখ মুছতে মুছতে জানান, প্রতিদিন এক থেকে দেড়শ টালি আয় করা যায়।
টালি হলো হলুদ ও নীল রঙের ছোট ছোট পাথর। প্রতি টুপরি বালু নিয়ে ঢালার পর একটি করে টালি পান প্রত্যেক শ্রমিক। হলুদ রঙের প্রতি টালির সমমান তিন টাকা, নীল রঙের টালি দুই টাকা। ঘাট থেকে দূরের স্তুপে নিয়ে গেলে প্রতি টুপরির জন্য একটি হলুদ টালি। আর ঘাটের কাছাকাছি রাখা ট্রাকে নিয়ে গেলে প্রতি টুপরির জন্য একটি নীল টালি। এভাবে প্রতিদিন যে যতো টালি আয় করতে পারে, তার উপরই নির্ভর করে তাদের দৈনিক উপার্জন।
নূরজাহান বেগম দৈনিক সর্বোচ্চ সাড়ে ৩শ’ টাকা আয় করতে পারেন। তবে তা শরীরের উপর নির্ভর করে। স্বামী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তার চারজনের সংসার। ছেলে জাহাঙ্গীর এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, মেয়ে রুপা প্রাইমারি পাশ করেছে কেবল। নূরজাহান বেগমের রোজগারেই চলে এ সংসার। স্বামী অসুস্থতার কারণে কোনো কাজই করতে পারেন না।
নূরজাহান বেগম বাংলানিউজকে আরও বলেন, “স্বামী-সন্তান নিয়া কোনো রকম খেয়ে-পরে বাঁইচা আছি বাবা। শরীরে কুলায় না। তাই জিরায়া জিরায়া কাম করি। হেই সকালে না খায়া কামে আসি। তিনডা পর্যন্ত কাম কইরা যে টেহা পাই, হেইডা দিয়া চলে না বাজান। ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করতাসে, তাদেরও খরচ আছে। ” তিনি আরও জানান, বুধবার হরতালের কারণে গাড়ি আসেনি। তাই কাজও বন্ধ ছিল।
নূরজাহান বেগমের সঙ্গে কথা বলতে দেখে কাজ ফেলে তিন সন্তান নিয়ে ছুটে আসেন লিপি দাস। তার কৃশকায় শরীরে অভাবের ছাপ স্পষ্ট। দেখেই বোঝা যায় যে কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল, এরই মধ্যে তিন সন্তান। বড় ছেলের নাম জয়, মেয়ে সপ্তমী আর কোলের ছোট ছেলের নাম পুলক দাস।
কিশোরগঞ্জের ভাটি এলাকা ইটনা থেকে স্বামী জয়রি দাসের সঙ্গে সন্তানদের নিয়ে ৮-৯ মাস আগে এসেছিলেন ঢাকায়। এলাকায় ভিটে-বাড়ি, সহায়-সম্বল সবই হারিয়েছেন। তার ভাষায়, “বানের পানিতে ভাইসা গেছে সব। ওইখানে থাকলে এতোদিনে না খায়া মরতে হইতো।”
ভাটি এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় মাছ ধরা ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না সারা বছর। ফসল ফলে বছরে মাত্র একবার। স্বামী-স্ত্রী মিলে রোজগার করলে সন্তানদের নিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবেন, এদের মানুষ করতে পারবেন- এমন স্বপ্ন নিয়েই জীবিকার সন্ধানে ঢাকা ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু মাস যেতে না যেতেই বুঝে গেলেন, এখানে পেট চালানো মোটেও সহজ কাজ নয়। শেষমেষ এলাকার পরিচিত একজনের মাধ্যমে বালু টানার এ কাজে যোগ দেন স্বামী-স্ত্রী দুজনই। থাকেন পাশ্ববর্তী বউবাজার এলাকায়।
লিপি দাস বলেন, “হরতাল চললে আমরার চলে না স্যার। কাইল (বুধবার) ঋণ কইরা খাইসি। দোহানে বাহিও (বাকি) দিতে চায় না। আমরারে চিনে কেলা যে বাহি দিব?” পাশেই কয়েকটি বিস্কুটের কৌটা ও চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে বসা বৃদ্ধকে দেখিয়ে বলেন, “হে কাইল বাহি নিয়া দিসে।”
বড় ছেলেমেয়ে দুটো স্কুলে যায় কিনা জানতে চাইলে লিপি বলেন, “খাইতেই ফারে না, আবার ইস্কুল যাইব। হেই কফাল কি আছে?”
এসময় হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন, “আফনে কি স্যার সরকারি লুক?” উত্তরে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও লিপি বুঝতে পারেননি সাংবাদিক আসলে কাকে বলে। তখন বললাম, “আমরা পত্রিকায় লিখি।”
এবার বুঝতে পেরে লিপির সরল দাবি, “সরকারের কাছে লেইখ্যা দেন না স্যার, গ্রামে আমরারে একটা ঘর বানায়া দিতে।” এর উত্তর খুঁজে না পেয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার বিয়ে হয়েছে কতো বছর বয়সে?” উত্তরে লিপি বললেন, “ছুডু বেলায়।” এরপর কোলের শিশু পুলককে বড় ছেলের কোলে দিয়ে মাথায় পাগড়ি চেপে টুপরি হাতে চলে গেলেন বালু তুলতে।
কাঁচপুর ব্রিজের এই ঘাটে বালু আসে দুই ধরনের। মেঘনার বিভিন্ন ঘাট থেকে আসে সাদা বালু আর সুনামগঞ্জ থেকে আসে বড় বড় দানার লাল বালু। সাদা বালু আবার দুই প্রকার। শ্রমিকদের ভাষায় ‘বিডি বালু’ ও ‘আস্তর বালু’। লাল রঙের পাথুরে দানার বালুর আরেক নাম হলো সিলেকশন বালু।
এখানে বালু উত্তোলনের কাজ করা অধিকাংশ শ্রমিক সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার ভাটি এলাকা থেকে এসেছেন। বৃহস্পতিবারই বালু উত্তোলনের কাজে প্রথম যোগ দিয়েছেন মো. হুমায়ুন (৩০)। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে।
হুমায়ুন জানান, আগে তিনি কার্গো থেকে সারের বস্তা নামাতেন। প্রতি বস্তার জন্য দুই টাকা করে পেতেন। ওই কাজে পোষায় না বলে বালু তোলার কাজ নিয়েছেন। এ কাজ করে পোষাবে কিনা, বেলা ৩টার পর তা বোঝা যাবে বলে জানান। স্ত্রী-সন্তানসহ চার জনের সংসার তার।
হুমায়ুন জানতে চান, “হরতাল কবে শেষ হইবো ভাই?”
বালুর ঘাটে বসে যে বৃদ্ধ চা-বিড়ি, বিস্কুট বিক্রি করেন তার নাম মো. আবুল কাশেম চৌধুরী। বয়স ষাটের উপরে। পেটে অপারেশনের কারণে ভারী কাজ করতে পারেন না। তাই পলিথিন বিছিয়ে এখানে বসেই বিক্রি করেন সামান্য চা, একটি-দুটি বিস্কিট বা কয়েকটা বিড়ি-সিগারেট।
আবুল কাশেম বাংলানিউজকে জানান, এই বালু তোলার কাজ যারা করে, তাদের কাছেই তিনি চা, বিড়ি, সিগারেট বিক্রি করেন। তার দু’জনের সংসার। চার ছেলেমেয়ের সবারই বিয়ে হয়েছে। ছেলেরা দেখে না বলে এই বয়সেও এ কাজ করে চলতে হচ্ছে।
আবুল কাশেমের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার হাওর অঞ্চল ধর্মপাশায়। প্রতি বছরই বন্যার পানিতে ফসল তলিয়ে যায়। ধান করতে গিয়ে ঋণ করেছিলেন, এখনও পরিশোধ করতে পারেননি। প্রতিদিন যা রোজগার হয়, তা থেকে ঋণ পরিশোধের জন্য কিছু জমা করেন। ঋণ মাথায় নিয়ে তিনি মারা যেতে চান না বলেই শত অভাবের মধ্যেও ঋণের জন্য টাকা জমাতে ভুলেন না।
একই এলাকার আক্কাস মিয়া কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই জানালেন, পরিশ্রমের তুলানায় টালির দাম কম। প্রতিদিন ৯ ঘণ্টা কাজ করলে রাতে ব্যাথা আসে শরীরে। যদিও নারী শ্রমিকদের তুলনায় পুরুষরা বেশি আয় করে থাকেন। দুই বছর ধরে তিনি এ কাজ করে আসছেন। দুই বছর আগে টালির দাম যা ছিল এখনও তাই আছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “দুই বছর আগের দিন কি আর আছে, কইন তো চাচা? সব কিছুরই তো দাম বাড়ছে। হেরা (বালু ব্যবসায়ীরা) বালুর দাম বাড়াইছে, টিফের (ট্রিপের) দাম বাড়ছে, খালি আমরার টালির দাম বাড়ে নাই। গরীবরে সবাই মারে চাচা।”
আক্কাস বলেন, “এই যে হরতাল দিতাসে, এতে আমরার এক পয়সার লাভ আছে? হরতাল দিলেই তো আমরার ফেডে লাত্থি (পেটে লাথি)।”
ওই এলাকা ঘুরে জানা গেছে, কাঁচপুর ব্রিজের নিচে শীতলক্ষ্যার এ ঘাটে দুই থেকে আড়াইশ’ জনের একটি সিন্ডিকেট বালু ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধভাবে। এসব ব্যবসায়ীরা প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা আয় করেও সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নদীতীরের ঘাটে অসংখ্য টং (ছোট কাঠের ঘর) রয়েছে। এসব টং ঘরে দুই-তিনজন করে হিসাব-নিকাশের কাজ করেন। ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে একাধিক টংয়ের ব্যক্তিরা কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। কেউ কেউ জানান, মালিকের নিষেধ আছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নেতা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ক্ষমতার পালা বদল হলে এখানকার ব্যবসায়ও পরিবর্তন ঘটে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতারাই এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা গেছে।
No comments