ঘাতকদের উল্লাসনৃত্য by সাজেদুল হক
এ দৃশ্য বড় নির্মম। একই সঙ্গে অভিনবও।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর লাশের ওপর উল্লাসনৃত্য বাংলাদেশে নতুন কিছু নয় ।
কিন্তু রোববার পুরান ঢাকায় যা ঘটে গেল তা একেবারেই অভিনব। রাজনীতির সঙ্গে
কোন যোগ ছিল না বিশ্বজিৎ দাসের।
তিনি ছাত্রশিবির করতেন না, ছাত্রদলও করতেন
না। ছিলেন নিরীহ এক দর্জি দোকানি। ছাত্রলীগের সঙ্গে তার কোন শত্রুতা ছিল
না। কিন্তু তারপরও ছাত্রলীগের উন্মত্ত আক্রমণের শিকার হলেন তিনি।
কোন
আক্রোশ না থাকলেও তার ওপর আক্রোশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ছাত্রলীগ ক্যাডাররা।
চাপাতি দিয়ে কোপানো হলো তাকে। যাদের হাতে চাপাতি ছিল না তারা এগিয়ে এলো
লাঠি হাতে। পিটিয়ে হত্যা করা হলো নিরপরাধ এক যুবককে। খুনিদের হাত থেকে
বাঁচতে বিশ্বজিতের আকুতি হৃদয় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে সবার। নিজের ধর্ম
পরিচয় দিয়েও বাঁচতে পারেননি তিনি।
কারা সেই ঘাতক পত্রিকায় পরিচয়সহ তাদের ছবি
ছাপা হয়েছে। টিভি পর্দায়ও দিনভর দেখা গেছে তাদের। কিন্তু মামলা দায়েরের
সময় পুলিশ কোন আসামির নাম খুঁজে পায়নি। আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের।
এ রিপোর্ট যখন লেখা হচ্ছে তখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি কাউকে।
বিশ্বজিৎ দাসের খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। শিবির দমনে কঠোর তিনি। পুলিশের ওপর নির্ভর না করে
যুবলীগ, ছাত্রলীগকে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন শিবির দমনের। কার নির্দেশে
বেপরোয়া ছাত্রলীগ সে প্রশ্নও আবার উঠেছে। আইন ও বিচারমন্ত্রী ব্যারিস্টার
শফিক আহমেদ প্রায়ই কিছু কমন কথা বলেন। ক্ষমার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার
ডাক দেন তিনি। অথচ ক্ষমার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সময় ইতিহাসে সবচেয়ে
বিরল। ৪০ বছরে সর্বমোট ২৫ ফাঁসির আসামি ক্ষমা পেয়েছেন। এর ২১ জনই ক্ষমা
পেয়েছেন বর্তমান সরকারের আমলে। সংবিধান প্রেসিডেন্টকে এ ক্ষমার অধিকার
দিয়েছে। তবে এ ক্ষমার পেছনে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ যে প্রধান ভূমিকা
রেখেছে তাতে সন্দেহ সামান্যই। বিশ্বজিতের খুনিরাও কি তবে ক্ষমা পেয়ে যাবেন।
বাংলাদেশে দলভিত্তিক ক্যাডারদের নির্মমতার বিচারের নজির খুবই কম। লাশের
ওপর উল্লাসনৃত্যের দৃশ্য সম্ভবত সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছিল ২০০৬ সালের ২৮শে
অক্টোবর। সেদিন রাজধানীর পল্টনে লগি-বৈঠার নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন
জামায়াত-শিবিরের ছয় নেতাকর্মী। লাশের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাসনৃত্য করেছিল
হত্যাকারীরা। সে ঘটনা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে
দিয়েছিল। অক্টোবরের খুনিদের বিচার তো দূরের কথা, সে ঘটনায় দায়ের করা মামলাও
প্রত্যাহার করে নিয়েছে বর্তমান সরকার। বর্তমান মহাজোট জমানাতেই নাটোর
উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ বাবুকে পিটিয়ে হত্যা করেও উল্লাস প্রকাশ করা
হয়েছে। রাষ্ট্রবিনাশী এ উল্লাসনৃত্য চলছেই। রাজনৈতিক শিকার ছেড়ে এখন
অরাজনৈতিক শিকারে মন দিয়েছে খুনিরা। সব ধরনের যুক্তি ত্যাগ করেছে তারা।
ক্ষোভ নয়, প্রতিশোধ নয়, শুধুমাত্র সন্দেহের বশেই মানুষ হত্যা করছে তারা।
তবে বিশ্বজিৎ দাসের হত্যা একটি পুরনো প্রশ্ন নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
No comments