চারদিক -বিলেতে ইফতার পার্টি by রাশেদ রাফি
এখন সবাই ঈদের জন্য অপেক্ষা করছে। ঈদের আগে আপনাদের একটু বিলেতের ইফতার পার্টির খবর দিই। আমরা সেদিন খুব আনন্দ করে সেই ইফতার পার্টিতে শরিক হয়েছিলাম। বিলেতে থাকা বাংলাদেশিদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কখন তাদের দেশের কথা বেশি মনে পড়ে? তাহলে অধিকাংশ মানুষই বলবে, রমজান ও দুই ঈদে।
কারণ, বাংলাদেশ কিংবা অন্য যেকোনো মুসলিম দেশে রমজান মাসজুড়ে এবং দুই ঈদে যে বিশেষ ধর্মীয়, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ভাবগাম্ভীর্য বজায় থাকে, বিলেতে তা নেই।
যদিও পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় বাংলাদেশিদের পদচারণে বোঝাই যাবে না এটা ঢাকার গুলিস্তান, না লন্ডনের কোনো অঞ্চল। আসলে ব্যস্ততার কারণে কেউ চাইলেও ওই পরিবেশটা তৈরি করে নিতে পারে না। তবে সুযোগ পেলে মনের সাধ মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা সবাই কম-বেশি করে। বিশেষ করে, বিলেতে পড়তে আসা ছাত্রদের মধ্যে এটা বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন ঈদের দিন ব্যস্ততা থাকলে ঈদের পরে কোনো ছুটির দিনে চেষ্টা করা হয় ঈদের আমেজ তৈরি করে ষোলোকলা পুরিয়ে নেওয়ার। এ বিষয়ে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় আমি গত বছর বিস্তারিত লিখেছিলাম।
আচ্ছা, এবার ইফতার পার্টির কথা বলা যাক। কদিন আগের এক সন্ধ্যায় ভাতিজা শিহাব ও তার বন্ধু লিটনকে নিয়ে ভাগনে রোমেলের বাসায় গিয়েছিলাম ইফতারের দাওয়াতে। আমরা কিছু সময় আগেই চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু অনেকেই এসেছেন ঠিক সময়েরও অনেক পরে। যদিও সময়টা ইফতারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর বাংলাদেশের ইফতার পার্টিতে যেমন সবাই শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন, এখানে তেমনটা দেখা গেল না। তবে টিভিতে আজান হওয়ার পর একজন একটা গ্লাস হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশে বললেন, ‘কারও পানি লাগবে?’
রোমেল ও তার ‘ফ্যামিলি ৬৪’-এর সবাই তখনো রান্নাবান্নায় মশগুল। অল্পক্ষণের মধ্যেই বসার ঘরে আড্ডায় থাকা সবাইকে বুট, পেঁয়াজু, বেগুনি, কফিনি, আলুনি, মাছুনি—এসব দেওয়া হলো (পাশে বাংলা দোকান না থাকায় ওরা আমাদের মুড়ি এনে দিতে পারেনি)। এসব প্লেটে সাজানোর সময় তখন ছিল না। বড় কয়েকটা ট্রে থেকে সবাই ইচ্ছেমতো পছন্দের খাবার বেছে নিতে থাকল। এরই মধ্যে বিশাল এক হাঁড়ি এনে মেঝেতে রাখা হলো।
একজন বালিকা হাঁড়ি থেকে ছোট ছোট বাটিতে নিয়ে ডালের মতো কিছু একটা সবার মধ্যে বিতরণ করতে থাকলেন। আমি খেয়ে বুঝলাম ‘হালিম’ এবং রান্নাটা ভালোই হয়েছে। এক দাওয়াতি মেহমান বলে উঠলেন, ‘জিনিসটা কী? খেতে তো হালিমের মতোই লাগছে।’
আয়োজকদের কেউ কথা বলল না। কিন্তু যখন খেতে খেতে হাঁড়ি পুরো খালি এবং সবার মুখে প্রশংসা, তখন মি. আকিব বলে উঠলেন, ‘আমি অনেক কষ্ট-যত্ন করে মামা হালিমটা রান্না করেছি।’
সঙ্গে সঙ্গেই জমে থাকা হাসির ফানুসটা ফেটে গেল। ততক্ষণে আমার খাওয়া শেষ। একটু ভেতরে গিয়ে দেখি বালক-বালিকার দল রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। খাবারের সুগন্ধিতে ভরপুর রান্নাঘর। ইফতার পার্টি তো নয়, যেন বিয়েবাড়ি। রোমেল আমাকে ওদের উঠোন-বাগান দেখাতে নিয়ে গেল। আমার জায়গাটা পছন্দ হলো।
জিজ্ঞেস করলাম ‘ফ্যামিলি ৬৪’ নামে তোমাদের অনানুষ্ঠানিক গানের দলটার উদ্ভব এখানেই নাকি? রোমেলের জবাব, ‘আবার জিগায়।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আজ তাহলে তোমাদের গানের দলটাকে একটা আনুষ্ঠানিক ব্যান্ডে রূপ দিয়ে যাব। ততক্ষণে গিটারিস্ট রাজা ভাই গিটার হাতে চলে এলেন। আমি ভোকাল সজল ভাইয়ের খোঁজ করলাম। ওরা বলল, তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমার সহ্য হলো না।
আমি হেসে বলতে থাকলাম, ‘আরে, এ আবার কেমন ভোকাল, যে প্রস্তুতি নিতে হয়! ভোকাল হতে হবে আমার মতো, যখন অনুরোধ তখনই গান’—বলেই আমি শুরু করে দিলাম। অঞ্জনের ‘ম্যারি অ্যান’ থেকে শুরু করে চার-পাঁচটা গেয়েও ফেললাম। কিন্তু তার পরও ভোকালের হদিস মিলল না।
এরই মধ্যে বিরিয়ানি, কোপ্তা, চিংড়ি ভুনা, দেশি গরুর ভুনাসহ নানান খাবারের খবর এল। আবার সবাই বসার ঘরে ফিরে গেলাম। চেখে দেখলাম প্রতিটা খাবার চমৎ কার মজা হয়েছে। মনে হলো আমাদের এই আনাড়ি রাঁধুনিদের রান্না বাংলাদেশের ঘরোয়া রান্নার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। চাপে পড়ে রান্না শিখতে গিয়ে আমরা সবাই এখন পাকা রাঁধুনি।
যা-ই হোক, খাওয়া শেষে আবার গান শুরু হলো। চলতে চলতে রাত একটায় ইফতার পার্টির সমাপ্তি হলো। সেটা বুঝি তখন সেহির পার্টি হয়ে গেছে। শেষে ‘ফ্যামিলি ৬৪’-এর প্রথম অ্যালবামের নাম ঠিক করে দিয়ে ভাতিজা শিহাবকে নিয়ে রাত আড়াইটায় বাসায় ফিরলাম।
রাশেদ রাফি
Sea.sky_rafi@yahoo.com
যদিও পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় বাংলাদেশিদের পদচারণে বোঝাই যাবে না এটা ঢাকার গুলিস্তান, না লন্ডনের কোনো অঞ্চল। আসলে ব্যস্ততার কারণে কেউ চাইলেও ওই পরিবেশটা তৈরি করে নিতে পারে না। তবে সুযোগ পেলে মনের সাধ মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা সবাই কম-বেশি করে। বিশেষ করে, বিলেতে পড়তে আসা ছাত্রদের মধ্যে এটা বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন ঈদের দিন ব্যস্ততা থাকলে ঈদের পরে কোনো ছুটির দিনে চেষ্টা করা হয় ঈদের আমেজ তৈরি করে ষোলোকলা পুরিয়ে নেওয়ার। এ বিষয়ে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় আমি গত বছর বিস্তারিত লিখেছিলাম।
আচ্ছা, এবার ইফতার পার্টির কথা বলা যাক। কদিন আগের এক সন্ধ্যায় ভাতিজা শিহাব ও তার বন্ধু লিটনকে নিয়ে ভাগনে রোমেলের বাসায় গিয়েছিলাম ইফতারের দাওয়াতে। আমরা কিছু সময় আগেই চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু অনেকেই এসেছেন ঠিক সময়েরও অনেক পরে। যদিও সময়টা ইফতারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর বাংলাদেশের ইফতার পার্টিতে যেমন সবাই শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন, এখানে তেমনটা দেখা গেল না। তবে টিভিতে আজান হওয়ার পর একজন একটা গ্লাস হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশে বললেন, ‘কারও পানি লাগবে?’
রোমেল ও তার ‘ফ্যামিলি ৬৪’-এর সবাই তখনো রান্নাবান্নায় মশগুল। অল্পক্ষণের মধ্যেই বসার ঘরে আড্ডায় থাকা সবাইকে বুট, পেঁয়াজু, বেগুনি, কফিনি, আলুনি, মাছুনি—এসব দেওয়া হলো (পাশে বাংলা দোকান না থাকায় ওরা আমাদের মুড়ি এনে দিতে পারেনি)। এসব প্লেটে সাজানোর সময় তখন ছিল না। বড় কয়েকটা ট্রে থেকে সবাই ইচ্ছেমতো পছন্দের খাবার বেছে নিতে থাকল। এরই মধ্যে বিশাল এক হাঁড়ি এনে মেঝেতে রাখা হলো।
একজন বালিকা হাঁড়ি থেকে ছোট ছোট বাটিতে নিয়ে ডালের মতো কিছু একটা সবার মধ্যে বিতরণ করতে থাকলেন। আমি খেয়ে বুঝলাম ‘হালিম’ এবং রান্নাটা ভালোই হয়েছে। এক দাওয়াতি মেহমান বলে উঠলেন, ‘জিনিসটা কী? খেতে তো হালিমের মতোই লাগছে।’
আয়োজকদের কেউ কথা বলল না। কিন্তু যখন খেতে খেতে হাঁড়ি পুরো খালি এবং সবার মুখে প্রশংসা, তখন মি. আকিব বলে উঠলেন, ‘আমি অনেক কষ্ট-যত্ন করে মামা হালিমটা রান্না করেছি।’
সঙ্গে সঙ্গেই জমে থাকা হাসির ফানুসটা ফেটে গেল। ততক্ষণে আমার খাওয়া শেষ। একটু ভেতরে গিয়ে দেখি বালক-বালিকার দল রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। খাবারের সুগন্ধিতে ভরপুর রান্নাঘর। ইফতার পার্টি তো নয়, যেন বিয়েবাড়ি। রোমেল আমাকে ওদের উঠোন-বাগান দেখাতে নিয়ে গেল। আমার জায়গাটা পছন্দ হলো।
জিজ্ঞেস করলাম ‘ফ্যামিলি ৬৪’ নামে তোমাদের অনানুষ্ঠানিক গানের দলটার উদ্ভব এখানেই নাকি? রোমেলের জবাব, ‘আবার জিগায়।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আজ তাহলে তোমাদের গানের দলটাকে একটা আনুষ্ঠানিক ব্যান্ডে রূপ দিয়ে যাব। ততক্ষণে গিটারিস্ট রাজা ভাই গিটার হাতে চলে এলেন। আমি ভোকাল সজল ভাইয়ের খোঁজ করলাম। ওরা বলল, তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমার সহ্য হলো না।
আমি হেসে বলতে থাকলাম, ‘আরে, এ আবার কেমন ভোকাল, যে প্রস্তুতি নিতে হয়! ভোকাল হতে হবে আমার মতো, যখন অনুরোধ তখনই গান’—বলেই আমি শুরু করে দিলাম। অঞ্জনের ‘ম্যারি অ্যান’ থেকে শুরু করে চার-পাঁচটা গেয়েও ফেললাম। কিন্তু তার পরও ভোকালের হদিস মিলল না।
এরই মধ্যে বিরিয়ানি, কোপ্তা, চিংড়ি ভুনা, দেশি গরুর ভুনাসহ নানান খাবারের খবর এল। আবার সবাই বসার ঘরে ফিরে গেলাম। চেখে দেখলাম প্রতিটা খাবার চমৎ কার মজা হয়েছে। মনে হলো আমাদের এই আনাড়ি রাঁধুনিদের রান্না বাংলাদেশের ঘরোয়া রান্নার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। চাপে পড়ে রান্না শিখতে গিয়ে আমরা সবাই এখন পাকা রাঁধুনি।
যা-ই হোক, খাওয়া শেষে আবার গান শুরু হলো। চলতে চলতে রাত একটায় ইফতার পার্টির সমাপ্তি হলো। সেটা বুঝি তখন সেহির পার্টি হয়ে গেছে। শেষে ‘ফ্যামিলি ৬৪’-এর প্রথম অ্যালবামের নাম ঠিক করে দিয়ে ভাতিজা শিহাবকে নিয়ে রাত আড়াইটায় বাসায় ফিরলাম।
রাশেদ রাফি
Sea.sky_rafi@yahoo.com
No comments