আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?' by এ কে এম জাকারিয়া

ভারতের পার্লামেন্ট কয়েক দিন ধরে অচল রয়েছে। দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে দুর্নীতির এক অভিযোগ ওঠার পর গত ১০ নভেম্বর থেকে অধিবেশন আর চলছে না। দ্বিতীয় প্রজন্মের (টু জি) মোবাইল ফোনের লাইসেন্স দেওয়া নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর বিরোধী দলগুলো যৌথ পার্লামেন্টারি কমিটির মাধ্যমে তা তদন্তের দাবি করে আসছে, ভারতীয় রাজনীতিতে যা টু জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ নিয়ে টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে।
সরকারি দল যৌথ পার্লামেন্টারি কমিটির মাধ্যমে তদন্তে রাজি হচ্ছে না। অন্যদিকে, বিরোধী দল তাদের দাবিতে অনড়। ভারতের পার্লামেন্ট তাই এখনো অচল। ভারতীয় পার্লামেন্টের এই দিন বিশেকের অচল দশা নিয়ে দেশটিতে সমালোচনার শেষ নেই। দুই কক্ষের ভারতীয় পার্লামেন্টের লোকসভা ও রাজ্যসভার এক দিনের অধিবেশনে খরচ হয় আনুমানিক সাত কোটি ৮০ লাখ রুপি। সংসদ না চললে প্রতি ঘণ্টায় ক্ষতির অঙ্ক এক কোটি ৭৬ লাখ রুপির কাছাকাছি। পার্লামেন্ট অচলের মেয়াদ এক দিন বাড়ছে আর ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। রাজনীতিতে যা হয়, এই ক্ষতির জন্য সরকারি দল ও বিরোধী দল একে অপরকে দায়ী করে আসছে। এই অচল পরিস্থিতির মধ্যে সরকারি দল কংগ্রেসের সদস্যরা তাঁদের দৈনিক ভাতা না নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। কারণ ‘কাজ নেই, ভাতও নেই’—এই নীতি মেনে চলতে চান তাঁরা।
ভারতের সংসদবিষয়ক মন্ত্রী পি কে বনসালের সঙ্গে দেখা করে কংগ্রেস দলের অনেক সদস্য তাঁদের ভাতা না নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। এই সদস্যরা বলেছেন, লোকসভা অচল হওয়ার পর যেহেতু তাঁরা কোনো কাজ করতে পারছেন না, তাই তাঁরা প্রতিদিনের দুই হাজার টাকা ভাতা নেবেন না। দলের মুখপাত্র ও পার্লামেন্ট সদস্য মনীশ তিওয়ারি লোকসভা সচিবালয়ে চিঠি দিয়ে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে পার্লামেন্ট অচল থাকলে তিনি বেতন নেবেন না। সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীও একই ধরনের চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, যত দিন পার্লামেন্ট অচল থাকবে, তত দিন তাঁরা ভাতা নেবেন না। লোকসভা ও রাজ্যসভায় সব মিলিয়ে কংগ্রেসের সদস্যসংখ্যা ২০৭ যোগ ৭১, অর্থাৎ ২৭৮ জন। কংগ্রেসের সব সদস্য ভাতা নেওয়া বন্ধ করলে প্রতিজনে দুই হাজার টাকা করে প্রতিদিন বাঁচবে পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার রুপি। প্রতিদিনের খরচের তুলনায় (সাত কোটি ৮০ লাখ রুপি) এই সাশ্রয় খুবই সামান্য। কিন্তু কাজ না করলে ভাতা না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে কংগ্রেসের সদস্যরা যে নৈতিক অবস্থানটি তুলে ধরেছেন, তার মূল্যই বা কম কী!
কংগ্রেস সদস্যদের এই উদ্যোগকে বিরোধী দল বিজেপি অবশ্য ‘দৃষ্টি ফেরানোর কৌশল’ বলে মনে করেছেন। বিজেপির মুখপাত্র প্রকাশ যাভাদকার বলেছেন, ‘কংগ্রেস বিষয়টি থেকে দৃষ্টি ফেরানোর জন্য “কাজ নেই, ভাতাও নেই” ধরনের কৌশল বেছে নিয়েছে। যৌথ তদন্ত কমিশন গঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা সরে আসব না।’ এসবই রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক। কংগ্রেসের সদস্যদের কাজ না করলে ভাতা না নেওয়ার ঘোষণা দৃষ্টি ফেরানোর কৌশল কি না, সেই বিতর্ক আপাতত তোলা থাক।
বাংলাদেশে বর্তমান নবম জাতীয় সংসদে বিরোধী পক্ষ বলা যায় সংসদ শুরুর পর থেকেই অনুপস্থিত। তাদের বেশ কিছু দাবি-দাওয়া রয়েছে। এই দাবি-দাওয়া যৌক্তিক কি না, সেই বিতর্কও তোলা থাক। যৌক্তিক-অযৌক্তিক যা-ই হোক, বিরোধী দলের (বিএনপি ও জামায়াত) সংসদ সদস্যরা সংসদে যান না গত ৪৩ কার্যদিবস। মানে সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন না। ৪০ হাজার টাকা গাড়ির ভাতাসহ মাসে তাঁরা সম্মানী নেন লাখ খানেক টাকা। সংসদ অধিবেশন চললে প্রতিদিনের ভাতা ৫০০ টাকা। কেউ সংসদে না গেলে পাবেন অর্ধেক। সেই হিসাবে বিরোধী দলের সদস্যরা অধিবেশনে যোগ না দিয়েও গত ৪৩ দিনে প্রতিদিন ২৫০ টাকা করে ভাতা পেয়েছেন। সংসদে যাচ্ছেন না যেসব সদস্য, তাঁদের কারও মাথায় কখনো ভাতা-সম্মানী না নেওয়ার চিন্তা এসেছে বলে আমরা শুনিনি। সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত অবশ্য আমাদের দেশের বিরোধী দলগুলোর সংসদ সদস্যরা নিজেরা নেন না, দল নেয়। দলের ভাবনায়ও এমন চিন্তা কখনো দেখা যায়নি।
সংসদে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে বর্তমান বিরোধী দল বিএনপির ভাবনা সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। বিএনপি নাকি নীতিগতভাবে আর সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপি গত ৪৩ কার্যদিবস সংসদে যায়নি, ভবিষ্যতেও যখন না যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?
দেশের নাগরিক হিসেবে এই প্রশ্ন আমরা করতে পারি। কিন্তু আমরা এ-ও জানি, এ ধরনের সিদ্ধান্ত তাঁরা নেবেন না। তাঁরা সংসদে যাবেন না কিন্তু বেতন-ভাতা ঠিকই নেবেন। শুধু বেতন-ভাতা কেন, অন্যান্য সুবিধাও ঠিকই পেতে চাইবেন। মেক্সিকোর কানকুনে জলবায়ু সম্মেলনের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে স্থান পাননি বিরোধী দল বিএনপির কোনো সংসদ সদস্য। সরকারি দল আওয়ামী লীগের ছোট মনের পরিচয় পাওয়া গেল এতে। বোঝা গেল, ক্ষমতাসীন দলের যে উদারতা থাকা উচিত, তার ধারে-কাছেও নেই আওয়ামী লীগ। কিন্তু প্রতিনিধিদলে স্থান না পেয়ে বিএনপির যে আক্ষেপ, সেটা কতটুকু যৌক্তিক? বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুক এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে এ নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। ‘দেশ থেকে এক বিরাট প্রতিনিধিদল জলবায়ু সম্মেলনে যাচ্ছে। কিন্তু এই দলে বিএনপির কেউ নেই। কপ ১৬-তে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, সে সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।’ যে সংসদে দিনের পর দিন বিএনপি অনুপস্থিত, সেই সংসদের সদস্য হিসেবে দলের সংসদ সদস্যদের কানকুনে যাওয়া কেন জরুরি হয়ে পড়েছে?
দরকারটি আমরা জানি। কানকুনে যাওয়া মানে রাষ্ট্রের পয়সায় বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ! সংসদে না গিয়ে যদি বেতন-ভাতা নেওয়া যায়, তবে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হবে কেন? তবে আমাদের অনুদার সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিএনপির সংসদ সদস্যদের সেই সুযোগ দেয়নি। কানকুনের প্রতিনিধিদলে বিএনপির কোনো সংসদ সদস্যকে না রেখে সংসদে না যাওয়া বিএনপিকে যেন শিক্ষা দিতে চেয়েছে সরকারি দল। যেমন বিরোধী দল, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারি দল!
ভারতের পার্লামেন্টের অচলাবস্থা এখনো কাটেনি। ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, ১৩ ডিসেম্বর পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশন শেষ হওয়ার আগে এই অচলাবস্থা কাটার সম্ভাবনা কম। টু জি স্পেকট্রাম দুর্নীতির তদন্তে সরকারি দল কংগ্রেস এখনো যৌথ পার্লামেন্টারি কমিটি (জেপিসি) গঠন না করার ব্যাপারে অটল রয়েছে। তবে পার্লামেন্ট সচল করতে সরকারি দলের উদ্যোগের অভাব নেই। লোকসভায় সরকারি দলের নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় বিরোধী বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানিকে ফোন করে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন এবং পার্লামেন্ট সচল রাখতে বিরোধী দলের সমর্থন চেয়েছেন। বিজেপি জেপিসি গঠন ছাড়া অন্য কোনো প্রস্তাব মানতে রাজি হয়নি। আদভানি স্পষ্ট বলেছেন, ‘সরকার পার্লামেন্টের প্রতি দায়বদ্ধ, তাই জেপিসিই একমাত্র পথ।’ এই দরকষাকষির মধ্যে রাজনীতি আছে, কিন্তু পার্লামেন্টকে সচল করার চেষ্টাও আছে।
আশির দশকে বোফর্স কেলেঙ্কারির ঘটনায় বিরোধী দল ভারতীয় পার্লামেন্টের দুই কক্ষই বর্জন করেছিল টানা ৪৫ দিন। এ ধরনের বড় কোনো ঘটনা ছাড়াই বাংলাদেশে বিরোধী দল ৪৩ কার্যদিবস ধরে সংসদ বর্জন করে চলেছে। বিরোধী দলকে সংসদে নেওয়ার যে একটা দায় সরকারি দলের রয়েছে, সেটা তাদের বিবেচনায় আছে বলে মনে হয় না। সরকারি দলের নেতারা মাঝে মাঝে রুটিন করে বিরোধী দলকে সংসদে যাওয়ার আহ্বান জানান। এর বাইরে আর কোনো উদ্যোগ নেই। বিরোধী দল সংসদের বাইরে থাকবে, এটাই যেন নিয়ম হয়ে গেছে। গত সংসদে, মানে অষ্টম জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ৩৭৩ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ বর্জন করেছে ২২৩ দিন। এর আগে সপ্তম জাতীয় সংসদে সেই সময়ের বিরোধী দল বিএনপি ৩৮২ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ বর্জন করেছে ১৬৩ দিন। এবার এরই মধ্যে ৪৩ দিন হয়ে গেছে।
সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হচ্ছে ৫ ডিসেম্বর। আর সংসদে না যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তে যদি বিএনপি অটল থাকে, তবে এই অধিবেশনেও সংসদে অনুপস্থিত থাকবে বিএনপি। টানা ৯০ দিন সংসদে অনুপস্থিত থাকলে সংসদ সদস্যপদ যাবে। দলীয়ভাবে আরও ৪৭ দিন সংসদে না যাওয়ার সুযোগ আছে বিএনপির। মানে আরও দুই অধিশেন সংসদে যোগ না দিয়েও সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা (সরকারি দলের বৈরি আচরণে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ বাদ পড়তে পারে) সবই পাওয়া যাবে। সংসদে অনুপস্থিতির ৯০ দিন হয়ে গেলে এক দিনের জন্য হয়তো আবার যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে। বেতন-ভাতা তো আর ছাড়া যায় না!
=====================
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'  আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং  আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'  আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক'  আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা'  বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য  শিল্প-অর্থনীতি 'করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর  অনাস্থা নয়, খালেদার আশঙ্কা ছিল ন্যায়বিচার না পাওয়ার  খেলা- 'বাংলাদেশ তো আসলে জিততেই চায়নি!'  আলোচনা- 'ড. ইউনূসের কেলেঙ্কারি!'  খেলা- 'বাংলাদেশকে মাটিতে নামাল জিম্বাবুয়ে'  'ধরিত্রীকে বাঁচাতে কানকুনে সফল হতেই হবে'  স্মরণ- 'চিত্রা ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আওয়ামী লীগে মিলন ও বিচ্ছেদের নাটক'


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
 লেখকঃ এ কে এম জাকারিয়া
সাংবাদিক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.