আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি' by এম.এম.আকাশ

মপ্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যদিয়ে পরিবহনের মাধ্যমে ভারতেরই এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর প্রসঙ্গে নানা পরস্পর বিরোধী বক্তব্য উত্থাপন করা হচ্ছে। কেউ একে বলছেন নিছক 'কানেক্টিভিটি', কেউ একে বলছেন 'করিডোর', কেউ কেউ আবার এই একই বিষয়কে 'ট্রানজিট' নামে অভিহিত করেছেন। এ নিয়ে অনর্থক সৃষ্টি করা হয়েছে শব্দের এক ধূম্রজাল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী একে 'কানেকটিভিটি' অভিহিত করে দাবি করেছেন যে এটি কোন নতুন বিষয় নয়।
আগে থেকেই নাকি বাংলাদেশ ভারতকে এই সুবিধা দিয়ে আসছিল। তার ভাষ্যমতে- বিএনপি আমলেই তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী তিন বছর আগে নয়াদিলিস্নতে এ ধরনের সুবিধা প্রদানের শর্ত সম্বলিত একটি চুক্তি তিন বছরের জন্য অনুমোদন করেছিলেন এবং যেহেতু ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে সেজন্য অতীতের ধারাবাহিকতায় এটিকেই আওয়ামী লীগ সরকার অনুমোদন দিচ্ছে মাত্র। সেই দিক থেকে এটি মৌলিকভাবে নতুন কোন নীতিগত 'শিফট নয়, বরং এটি একটি রুটিন ব্যাপার।
প্রশ্ন হচ্ছে আসল ব্যাপারটা কি এবং এটি বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের জন্য যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে? প্রথমেই বলে নেয়া ভাল যে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ নিয়ে আগে থেকেই একটি বহুপাক্ষিক আঞ্চলিক সংগঠন 'সার্ক' গঠিত হয়েছিল এবং দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করে এদের পারস্পরিক উন্নতির জন্য একযোগে সহযোগিতা করার নীতির প্রতি অতীতে বিএনপি সরকার এবং আওয়ামী লীগ সরকার উভয়েই বহুবার নিজ নিজ অঙ্গীকার প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন। তবে 'সার্ক'-এর আওতায় সকল দেশগুলো যেমন সম্মিলিতভাবে নিজেদের মধ্যে চুক্তি করতে পারে তেমনি আবার যেকোন সদস্য দেশ আলাদাভাবে স্বীয় উদ্যোগে অন্য সদস্যের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তিও করতে পারে। প্রত্যেকটি সার্ক সদস্য দেশের এই বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সুযোগ এবং অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে আরো মনে রাখতে হবে যে 'সার্ক'-এর ভেতরে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হচ্ছে ভারত এবং ভারতের সঙ্গে ক্ষুদ্র অন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক যেহেতু অপেক্ষাকৃত 'সবল' এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বলের মধ্যে সম্পর্ক সে জন্য স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে জন্ম নেয় নানা ধরনের আস্থাহীনতা, ভুল বোঝাবুঝি ও টেনশান। বিশেষত নানা ঐতিহাসিক কারণে এ অঞ্চলের অনেক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মধ্যেই সৃষ্টি হয়ে আছে ভারত বিরোধী মনোভাব। যাকে ওই দেশগুলোর কোন কোন রাজনৈতিক দল স্বীয় সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতেও চাইতে পারে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই আলোচ্য ইসু্যটিও রাজনৈতিকভাবে খুবই সংবেদনশীল ইসু্য এবং এর একটি সাবধানী ও সামগ্রিক আলোচনা ছাড়া মীমাংসায় আসা ঠিক হবে না। তবে এ কথাও ঠিক 'ইসু্যটি' আসলে কি তা নিয়ে বর্তমানে যে শব্দগত বিভ্রান্তি রয়েছে সেটিরই সমাধান হওয়া উচিত সর্বাগ্রে।
'ওয়েবস্টারস: নিউ টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ডিকশনারি' (আনত্র্যাববিজ্ড্, উইলিয়াম কলিন্স পাবলিশার্স, ১৯৭৯) তে আমরা 'ট্রানজিট' শব্দের যে সংজ্ঞা পাই তা হচ্ছে "ওহঃবৎ ঈড়ঁহঃৎু চধংংধমব' বা "ওহঃৎধ ঈড়ঁহঃৎু চধংংধমব" অর্থাৎ একই দেশের দুইটি জায়গার মধ্যে যোগাযোগের পথ বা 'দুই দেশের দুই পৃথক জায়গার মধ্যে যোগাযোগের পথ' উভয়কেই ট্রানজিট নামে অভিহিত করা সম্ভব। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ভারত যদি বাংলাদেশ হয়ে ইরানে যায় বা ভারতেরই ভিতরে কলকাতা থেকে দিলিস্ন হয়ে জয়পুরে যায় তাহলে এই উভয় পথকেই মধ্যবর্তী স্থানে ট্রানজিটসহ যাতায়াতের পথ হিসাবে অভিহিত করা সম্ভব। কিন্তু একই ডিকশনারিতে আবার 'করিডোর' শব্দকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, 'অ ংঃৎরঢ় ড়ভ ষধহফ ভড়ৎসরহম ধ ঢ়ধংংধমব ধিু নবঃবিববহ ঃড়ি ড়ঃযবৎরিংব ংবঢ়ধৎধঃবফ ঢ়ধৎঃং ড়ভ ধ পড়ঁহঃৎু' অর্থাৎ 'একটি ক্ষুদ্র স্থলপথ যার মাধ্যমে একই দেশের এক জায়গায় থেকে পৃথকায়িত আরেক জায়গায় যাওয়া সম্ভব।' একই ডিকশনারিতে আবার ঈড়হহবপঃরাব শব্দের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে। 'ঞযধঃ যিরপয পড়হহবপঃং- অর্থাৎ যে কোন যোগাযোগের পথ।' শব্দগুলোর বিশেষ বিশেষ এই অর্থগুলো নিয়ে সমপ্রতি অনর্থক এক ধূম্রজালের সৃষ্টি করা হয়েছে।
যাই হোক এতক্ষণে পাঠকের কাছে নিশ্চয়ই একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে কেউ যদি ভারতের সঙ্গে পূর্ণ ট্রানজিট সমর্থন করেন তাহলে ব্যাপকার্থে তিনি 'করিডোরও' সমর্থন করতে পারেন। তবে কেউ ভারতের সঙ্গে করিডোরের বিরোধিতা করে ভারতকে পূর্ণ ট্রানজিট সুবিধা নাও দিতে রাজি হতে পারেন। তবে একথা সত্য যে অতীত চুক্তির অধীনে ভারতকে আমরা জলপথে করিডোর সুবিধা দিচ্ছি, কিন্তু স্থলপথে দিচ্ছি আংশিক ট্রানজিট সুবিধা। আর 'কানেকটিভিটি' বললে অবশ্য এর অধীনে 'ট্রানজিট' 'করিডোর' ইত্যাদি সবই চলে আসবে। তখন সবরকম সুবিধাই ভারতকে দেয়ার প্রশ্ন চলে আসবে।
বর্তমানে আমাদের দেশে যে বিতর্ক হচ্ছে তার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভারতকে আলাদাভাবে স্থলপথে 'করিডোর সুবিধা' আমরা দিব কি না? একথা ঠিক জলপথে 'করিডোর' সুবিধা এখনই আছে, সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে স্থলপথেও তা প্রসারিত হবে কি না? এটা ঠিক যে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করে তা পুনরায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের সাতবোন রাজ্যগুলিতে রপ্তানি করার সুযোগ বা সেই অর্থে আংশিক পণ্য ট্রানজিট সুবিধা বর্তমানেই রয়েছে। এটাকে ঠিক 'করিডোর' না বলে বলতে হবে 'পণ্য প্রবাহের ট্রানজিট'। বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশে এসে, সেখানে কিছুক্ষণ থেকে পরে ভারতের অন্য অঞ্চলে যাচ্ছে। তবে একেবারেই না থেমে করিডোর দিয়ে চলে যাচ্ছে না। 'করিডোর' ইসু্যতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে এখন যত বিতর্কই হোক প্রকৃতপক্ষে বহু আগেই এক্ষেত্রে 'সাপ্টার' ১২তম অধ্যায়ে বহুপাক্ষিক ট্রানজিট-এর বিনিময়ে ভারতকে করিডোর সুবিধা প্রদানের বিষয়ে এই উভয় দলের কিন্তু ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিএনপি-র তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মোস্তাফিজুর রহমানই তখন বলেছিলেন যে ভারত যদি নেপাল ও ভুটানকে তাদের অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পণ্য পরিবহনের ট্রানজিট সুযোগ দেয় তাহলে তাদেরও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতীয় পণ্যের পরিবহনের ট্রানজিট দিতে তাদের কোন আপত্তি থাকবে না। তখন এটাকে 'করিডোর' না 'ট্রানজিট' বলা হবে এই সূক্ষ্ম বিতর্ক তারা আর উঠাবেন না। এই অবস্থান থেকে বিএনপি-র সরে আসার কোন কারণ এখনও নেই।
যাই হোক আমাদের উচিত হবে বিষয়টি সামগ্রিক আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। শব্দের ধূম্রজালের মধ্যে আটকে না থেকে 'বহুপাক্ষিক ট্রানজিট'-এর মাধ্যমে প্রত্যেকের যাতে লাভ হয় এবং সামরিক স্বার্থে যাতে 'ট্রানজিট' সুবিধা ব্যবহূত না হয় সেটিই হবে সকলের কাম্য।
=====================
আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং  আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'  আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক'  আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা'  বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য  শিল্প-অর্থনীতি 'করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর  অনাস্থা নয়, খালেদার আশঙ্কা ছিল ন্যায়বিচার না পাওয়ার  খেলা- 'বাংলাদেশ তো আসলে জিততেই চায়নি!'  আলোচনা- 'ড. ইউনূসের কেলেঙ্কারি!'  খেলা- 'বাংলাদেশকে মাটিতে নামাল জিম্বাবুয়ে'  'ধরিত্রীকে বাঁচাতে কানকুনে সফল হতেই হবে'  স্মরণ- 'চিত্রা ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আওয়ামী লীগে মিলন ও বিচ্ছেদের নাটকখবর- উইকিলিকসের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র  রাজনৈতিক আলোচনা- 'প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের প্রত্যাশা আলোচনা- 'পায়ে পড়ি বাঘ মামা, বেঁচে থাকো'  আন্তর্জাতিক- 'পুরনো বন্ধুকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত চীন  আমরাই পারি 'দ্বিতীয় রাজধানী' গড়তে  খবর- পুলিশি হরতাল  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'উপদেশের খেসারত'


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ এম.এম.আকাশ
অর্থনীতিবিদ


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.