স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং

সিদ্ধার্থ শংকর চলে গেছেন। ৬ নভেম্বর কলকাতায় ৯০ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল এখন থেকে ৬০ বছর আগে লন্ডনে। তাঁর স্ত্রী মায়ার মাধ্যমে। মায়ার বাবা ডা. ভট্টাচার্য কৃষ্ণ মেনন হাইকমিশনার হওয়ার আগে পেশায় ছিলেন ডাক্তার। আজ খুব কম লোকই জানেন যে তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন। তখন একটা কথা প্রচলিত ছিল যে বেলা দুপুর হওয়ার পর তিনি যা করেন সব নেশার মধ্যে করেন।
ব্রিটেনের একটি পত্রিকার সম্পাদক একবার প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁর সম্মানে যে ভোজসভার আয়োজন করা হয়, সেখানেও মেনন টেনে এসেছিলেন। সেই ভোজসভায় মেনন স্যুপ ছাড়া আর কিছু নিলেন না। ভোজের পর সব আনুষ্ঠানিকতার সময় সারাক্ষণ মেনন চোখ বুঝে মাথাটা বুকের ওপর ফেলে রাখলেন। সে দৃশ্য দেখে পণ্ডিত নেহরু আমাকে রাগ হয়ে বললেন, 'তুমি তোমার বসের দিকে খেয়াল রাখতে পার না? তুমি দেখতে পাচ্ছ না যে তাঁর তবিয়ত ঠিক নেই? পণ্ডিতজি জানতেন না যে তাঁর তবিয়ত পুরোপুরি ঠিক আছে।
ডা. ভট্টাচার্য আমারও পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। সেই সুবাদে তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়।
এর কয়েক বছর পর একদিন হোটেল তাজের বুক স্টোরে মিসেস ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার দেখা হলো। তিনি আমাকে জানালেন, ব্যারিস্টার রায়ের সঙ্গে মায়ার বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি আরো জানালেন, ব্যারিস্টার রায় কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন। তিনি বেঙ্গল কংগ্রেস কমিটির অধ্যক্ষ ছিলেন। এর কিছুকাল পর রায় পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন। এরও কিছু দিন পর কলকাতার শিখদের একটি সংস্থা গুরু নানক সম্পর্কে কিছু বলার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ করে। অনুষ্ঠানটি ছিল ইস্টার্ন হোটেলে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর স্ত্রী ছিলেন মুখ্য অতিথি। আমি কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি এবং শেষ মিনিটে অনুষ্ঠানে গিয়ে উপস্থিত হই। হলে তখন তিল ধারণের জায়গা নেই। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর স্ত্রী তখন মঞ্চে, ফুলের মালায় তাঁদের গলা ভরে গেছে। আমি মঞ্চে উঠতেই মায়া আমাকে পাঞ্জাবি স্টাইলে ঝাপ্পি দিয়ে স্বাগত জানায়। এ সময় উপস্থিত জনতা করতালিসহ হর্ষধ্বনিতে হলঘর মুখরিত করে তোলে। আমি সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সঙ্গে হাত মেলাই।
তখন থেকেই সিদ্ধার্থ যখনই মুম্বাই আসতেন তখনই মায়া আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসত। তখন তিনি দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলির সম্পাদক এবং তাঁকে মুম্বাই থাকতে হতো। এরপর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং সব বড় বড় নেতাকে জেলখানায় পুরে দিতে থাকেন। তখন গণতন্ত্র উদ্ধারে সিদ্ধার্থ আইনি লড়াই চালিয়ে যান। জয়প্রকাশ নারায়ণসহ নেতারা গণতন্ত্র উদ্ধারে সীমা অতিক্রম করেন। দেশের সংহতি হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু জরুরি অবস্থার পর রাতারাতি অবস্থা শান্ত হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা ফিরে আসে। স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয়।
সিদ্ধার্থের সঙ্গে আমার আবার দেখা হয় যখন ইন্দিরা গান্ধীর দল অপ্রত্যাশিতভাবে নির্বাচনে পরাজিত হয়। আড়াই বছর পর তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। যখন আমাকে দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়, তখন গান্ধী আমার জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেন। তিনি আমাকে রাজ্যসভার সদস্য পদের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার মতো করে দ্য হিন্দুস্তান টাইমসের সম্পাদক মনোনীত করেন। সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে থাকার কারণে তখন আমার নামে এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে সমন জারি করা হয়। আমার ওপর আদালত অবমাননার দায়। কারণ আমি বিপথগামী ন্যায়াধিকারীর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করেছি। সিদ্ধার্থ তখন আমার জন্য এগিয়ে আসেন। দুই জজের একটি বেঞ্চ। আদালত ভরা উকিল গিজগিজ করছে। সিদ্ধার্থ যখন আমার পক্ষে দাঁড়ালেন তখন একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মি. রায় মহোদয়, আমি আপনার যুক্তি শুনেছি, আমি আপনার মক্কেলকে কাল পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। হয় আদালতের কাছে তিনি ক্ষমা চাইবেন অথবা তাঁকে জেল খাটার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। সিদ্ধার্থ আমাকে বললেন, আমার ওপর ভরসা রাখুন, আমার বিশ্বাস, আমি আপনাকে জামানতের মাধ্যমে ছাড়িয়ে নিয়ে যাব।
সিদ্ধার্থের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হওয়ার কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। পাঞ্জাবে যখন রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হলো, তখন রাজীব গান্ধী তাঁকে সেখানকার রাজ্যপাল নিযুক্ত করলেন। তখন এক দশক পাঞ্জাবে উথালপাথাল অবস্থা চলেছিল। তিনি পাঞ্জাবে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, পাঞ্জাবে অপারেশন ব্লু স্টার একটি বড় ভুল ছিল এবং এ অপারেশন পরিহার করা উচিত ছিল।
আমি তাঁকে পাঞ্জাবি উচ্চারণ শেখানোর বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিফলে গেছে। আমি তাঁর পাঞ্জাবি ভাষায় শপথ গ্রহণ করা দেখেছি। ছয় ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার বাঙালি বাবু দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরও তাঁকে মনে হয়েছে পাগড়িধারী-কেশধারী সরদার। শপথ গ্রহণ শেষে তিনি নেমে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার পাঞ্জাবি উচ্চারণ কেমন হয়েছে? আমি বললাম, খুব সুন্দর, কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি যে আপনি পাঞ্জাবি বলছেন না, বাংলা বলছেন।
===================================
আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'  আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক'  আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা'  বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য  শিল্প-অর্থনীতি 'করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর  অনাস্থা নয়, খালেদার আশঙ্কা ছিল ন্যায়বিচার না পাওয়ার  খেলা- 'বাংলাদেশ তো আসলে জিততেই চায়নি!'  আলোচনা- 'ড. ইউনূসের কেলেঙ্কারি!'  খেলা- 'বাংলাদেশকে মাটিতে নামাল জিম্বাবুয়ে'  'ধরিত্রীকে বাঁচাতে কানকুনে সফল হতেই হবে'  স্মরণ- 'চিত্রা ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আওয়ামী লীগে মিলন ও বিচ্ছেদের নাটকখবর- উইকিলিকসের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র  রাজনৈতিক আলোচনা- 'প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের প্রত্যাশা আলোচনা- 'পায়ে পড়ি বাঘ মামা, বেঁচে থাকো'  আন্তর্জাতিক- 'পুরনো বন্ধুকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত চীন  আমরাই পারি 'দ্বিতীয় রাজধানী' গড়তে  খবর- পুলিশি হরতাল  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'উপদেশের খেসারত'  গল্প- 'স্বপ্নভঙ্গের ইতিবৃত্ত'  স্মরণ- 'জগদীশচন্দ্র বসুর কথা বলি'


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ  খুশবন্ত সিং
ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক ও সুবিখ্যাত লেখক
হিন্দি ভাষার পত্রিকা দৈনিক ভাস্কর থেকে ঈষৎ সংক্ষিপ্ত অনুবাদঃ মহসীন হাবিব


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.