গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন' by নাইর ইকবাল

কাজ শেষ হওয়ার আগের দিন কাদামাটির বস্তা ফেলে ১২ মিটার উঁচু অনেকগুলো মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে,অনেকটা দ্বীপের মতো, মাঝখানের ফাঁকগুলো গলে পানি ঢুকছে ভেতরে। এক লাখ বস্তার এই ছোট ছোট মজুদ শেষবারের মতো পরীক্ষা করে লোকজন নিয়ে মাছ ধরার ডিঙিনৌকায় তীরে ফিরে এলেন হান্স ফান ডুইফেনইক। ইতিমধ্যে জোয়ারের উচ্চতা বাড়তে শুরু করেছে, বাড়ছে ঢেউয়ের মাতামাতিও।
দেখতে দেখতে আধ ঘণ্টার মধ্যে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে দাঁড়াল দুই মিটারের ওপরে (৬ দশমিক ৬ ফুট), প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে ওই উচ্চতা। দ্বীপসদৃশ মজুদগুলোর ফাঁক গলে হু হু করে পানি ঢুকছে। এই তীব্র জলস্রোতে মাটির বস্তা ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল, আশঙ্কা ছিল কৃত্রিমভাবে তৈরি করা বস্তার নিচেরকার বাঁশের মাচা সরে যাওয়ার, ভেসে যেতে পারত বস্তার মজুদের এসব খণ্ড খণ্ড দ্বীপও। অর্থাৎ ছয় মাস ধরে গড়ে তোলা অসমাপ্ত বাঁধ যে কোনো সময় নস্যাৎ হয়ে যেতে পারত সাগরের ওই তীব্র স্রোতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বস্তার মজুদ টিকে রইল, টিকে রইল কৃত্রিমভাবে তৈরি করা বাঁশের মাচার ওপরকার দ্বীপগুলোও।
পরদিন সকালে দ্বীপ-অভিমুখে এক হাজার মানুষের কাফেলা রওনা হলো, দ্বীপগুলোতে লাল কাপড়ের ঝান্ডা টানিয়ে দেওয়া হলো। শ্রমিকদের মধ্যে দারুণ এক উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছে। ঘোষণা হয়েছে সারা দিনের কাজ শেষে ১০০ টাকা করে দেওয়া হবে প্রত্যেককে। আর যে দল আগে কাজ শেষ করতে পারবে, সে দলের প্রত্যেককে অতিরিক্ত পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হবে আরও ১০ টাকা।
জোয়ার মরে গিয়ে সর্বনিম্ন অবস্থায় পৌঁছাতেই বস্তার দ্বীপ-মধ্যবর্তী ফাঁকগুলো ভরাটের কাজ শুরু হলো। বস্তা ফেলে থরে থরে উঁচু হতে শুরু করল নদীর তলদেশ থেকে বাঁধের সারি। নদীতে বাঁধ তৈরির এই পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করা হয় নেদারল্যান্ডে, ১৯৫৩ সালে।
মহুরি সেচপ্রকল্প এলাকার জন্য এই বাঁধের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক, ফেনীর নদীতে মেশা এই বাঁধ তৈরিতে অর্থ জুগিয়েছে বিশ্বব্যাংক, ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিটি, কানাডা ও বাংলাদেশ। এই প্রকল্পের আওতায় ছিল ১ দশমিক ২০০ হেক্টরের (তিন হাজার একর) জলাধার, পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা জলকপাট আর ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের জন্য একাধিক খাল।
এই প্রকল্পের প্রায় সব কাজ সম্পন্ন হয় খালি হাতে। চিটাগাং পার্বত্য অঞ্চল থেকে ট্রাকে করে মাটি এনে নদীতীরে চটের বস্তায় প্রথমে ভরা হয়, নদীর বালি খুব মিহি হওয়ার কারণেই মূলত ব্যবহার করা হয় পাহাড়ি দানাদার মাটি। প্রকল্প এলাকায় নিজস্ব ভাটায় পোড়ানো হয় এক কোটি ২০ লাখ ইট। তারপর হাতে ইট ভেঙে সেই ইটের সুড়কিতে তৈরি হয় বাঁধের প্রথম কংক্রিটের স্থাপনা। কিন্তু অধিকাংশ কাজে স্থানীয় লোকবল ব্যবহার করা সত্ত্বেও তিন হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের পুরো কাঠামো তৈরিতে খরচ পড়ে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
লাল ঝান্ডা লাগানো অংশগুলোয় ছয় লাখ পাটের বস্তা ফেলে সাত ঘণ্টা বিরতিহীন কাজে তৈরি হয়, ওপরে তিন মিটার চওড়া আর দুই মিটার উঁচু বাঁধের। ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার আগে আগে বাঁধ যখন শেষ হলো, তখন সাগরের জোয়ার আবার বাড়তে শুরু করেছে কিন্তু সমুদ্রমুখী দিকের বাঁধ ততক্ষণে ঢেকে দেওয়া হয়েছে পলিথিন ফেব্রিক্সে। ওদিকে মানুষের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখতে আশপাশের গ্রাম থেকে নতুন জামাকাপড় পরে উৎসবের সাজে হাজির হয়েছেন শত শত মানুষ। একেকটা দলের কাজ শেষ হচ্ছে আর ফুলের মালা পরিয়ে উৎসব শুরু হয়ে যাচ্ছে। পরের সপ্তাহে ট্রাকে ট্রাকে মাটি ফেলে বাঁধের উচ্চতা নিয়ে যাওয়া হলো ফাল্গুন ও চৈত্রের জোয়ারভাটার উচ্চতায়। শেষ হলো সাগর বেঁধে ফেলার অতিমানবীয় এক কর্মযজ্ঞের।
যেভাবে তৈরি হলো গোটা বাঁধ
আজ থেকে ২৫ বছর আগের অভূতপূর্ব এই ঘটনা বাংলাদেশের কার্যকর মানবসম্পদের প্রমাণ বহন করে। ১৯৮৫ সালে ফেনীতে মুহুরী সেচ প্রকল্প তৈরিতে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করেছিলেন। সে সময় ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিটির প্রকৌশলী হিসেবে ফেনীতে ওই কাজের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে এ দেশে এসেছিলেন হান্স ফান ডুইফেনইক।
মুহুরী সেচ প্রকল্পে নদীশাসনের জন্য কয়েকটি ধাপে কাজ সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে নদীর তলদেশের ক্ষয় প্রতিরোধে বাঁশের চাটাই স্থাপন করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে বাঁশের চাটাইয়ের ওপর মাটিভর্তি চটের বস্তা দিয়ে তা ভরাট করা হয়। তৃতীয় ধাপে মাটির বস্তার ওপর আলগা মাটি দিয়ে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো হয়। চতুর্থ ধাপে ইট বিছিয়ে ও কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে বাঁধটির একটি শক্তিশালী চেহারা দেওয়া হয়। এভাবেই নির্মিত হয় ফেনীর মুহুরী সেচ প্রকল্প। তিন হাজার মিটার দীর্ঘ বাঁধটি তৈরির জন্য ১৫ হাজার শ্রমিককে অসংখ্য দলে বিভক্ত করা হয়। এতে কাজের গতি অনেক বেড়ে যায়। কাজের সময় শ্রমিকদের শৃঙ্খলাও ছিল দেখার বিষয়। তাঁরা কাজটিকে খুব আপন করে নেয়। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, নদীগর্ভে প্রতিবছর হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার চেয়ে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে এমন কিছু দাঁড় করিয়ে ফেলা উত্তম, যার মাধ্যমে অনন্তকাল তাঁরা সুবিধা ভোগ করবেন। নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে এতটুকু কষ্ট তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন। তা ছাড়া প্রতিটি বস্তা বহন করার জন্য পাঁচ টাকা সে সময়ের প্রেক্ষাপটে তাঁদের জন্য ছিল বেশ ভালো একটা পারিশ্রমিক। বেশি টাকা উপার্জন করার লক্ষ্যে অনেক শ্রমিক একসঙ্গে একের অধিক বস্তা বহন করে কাজের গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেক গুণ।
১৯৮৭ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় লেখা বিশেষ নিবন্ধে প্রকল্পের অন্যতম ডাচ প্রকৌশলী হান্স ফান ডুইফেনইক ওই প্রকল্পের শ্রমিকদের কাজের স্বতঃস্ফূর্ততা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘শ্রমিকদের প্রতিটি দল তাদের নিজেদের অংশের কাজ যখন শেষ করত, তখন তারা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে যেত। তারা নিজেদের দলের নেতাকে কাঁধে তুলে নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে। নিজেদের অংশের কাজ শেষ হওয়ার দিনটিকে তারা এমনভাবে পালন করেছে, যেন সেটি কোনো বিশেষ উৎসবের দিন। কাজের শেষ দিনে তারা নিজেদের সবচেয়ে সুন্দর শার্ট, পাঞ্জাবি অথবা লুঙ্গিটি পরে এসেছে। অনেকের মাথাতেই ছিল টুপি ও চোখে সুরমা। কেউ কেউ সেদিন সুগন্ধিও ব্যবহার করেছে।
২৫ বছর আগে তৈরি হওয়া ফেনীর মুহুরী বাঁধ ও সেচ প্রকল্পের সুফল আজও পাচ্ছে এলাকার মানুষ। এ দেশের মানুষের এমনই সব বিস্ময়কর উদ্যোগের যোগফলই কৃষির সমৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এ দেশের মানুষ কতটা পরিশ্রমী, কতটা উদ্যমী—এর একটা চমৎকার বিজ্ঞাপন হতে পারে ২৫ বছর আগের ওই গল্প। ১৯৮৫ সালে ফেনীতে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া সেচ প্রকল্পটির সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বব্যাংক ও ডাচ সরকার পরবর্তী সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এমনই একটি প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে সেটি বাংলাদেশের ফেনীর মতো এতটা সফল হয়নি।
বাংলাদেশের মানুষ যেখানে নিজেদের চেষ্টা ও পরিশ্রমে প্রমত্তা সাগরকে বেঁধে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে এ দেশের চেহারা পরিবর্তন করে দেওয়া তাঁদের দ্বারাই সম্ভব। প্রয়োজন কেবল সৎ আর উদ্যমী নেতৃত্বের।
=====================
স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'  আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং  আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'  আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক'  আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা'  বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য  শিল্প-অর্থনীতি 'করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর  অনাস্থা নয়, খালেদার আশঙ্কা ছিল ন্যায়বিচার না পাওয়ার  খেলা- 'বাংলাদেশ তো আসলে জিততেই চায়নি!'  আলোচনা- 'ড. ইউনূসের কেলেঙ্কারি!'  খেলা- 'বাংলাদেশকে মাটিতে নামাল জিম্বাবুয়ে'  'ধরিত্রীকে বাঁচাতে কানকুনে সফল হতেই হবে'


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ নাইর ইকবাল


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.