গল্প- 'অভিমান' by শিপন দাশ
রাত প্রায় দুটো। মেহেরাজ শুয়ে আছে তার বিছানায়। তবে ঘুমিয়ে নয়, জেগে আছে। এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল সে, কিন্তু লোডশেডিংয়ের ফলে বদ্ধ গরমের জন্য ঘুম ভেঙে গেছে তার। সকালে স্কুলে যেতে হবে বলে রাত সাড়ে ১১টায় শুয়ে পড়েছিল মেহেরাজ। কিন্তু নিশিরাতে এমনভাবে ঘুম ভেঙে যাবে, তা আর কে জানত। অসহ্য গরমের জন্য ঘুম ভাঙার পর সে প্রথমেই অনুভব করল, বিছানা আর বালিশ তার ঘামে পুরোপুরি ভিজে গেছে।
ভালোভাবে চোখ খুলে চারদিকে তাকাতেই তার কিছুটা ভয় ভয় করতে লাগল। কারণ পুরো রুমে জমকালো অন্ধকার, যার ফলে কোথাও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মেহেরাজ উদ্বিগ্ন হয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে টেবিলের ওপর রাখা চার্জলাইটটা অন করল।
ভালোভাবে চোখ খুলে চারদিকে তাকাতেই তার কিছুটা ভয় ভয় করতে লাগল। কারণ পুরো রুমে জমকালো অন্ধকার, যার ফলে কোথাও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মেহেরাজ উদ্বিগ্ন হয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে টেবিলের ওপর রাখা চার্জলাইটটা অন করল।
চার্জলাইটের তীব্র আলোটা চোখে আস্তে আস্তে সয়ে এলে সে ঘড়ির দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল। কিছুটা বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলল, ‘ধুর ছাই, কে যে এত রাতে ঘুমটা ভাঙাল, কালকের ক্লাসটা মনে হয় করতে পারব না।’ হতাশ মনে শোয়া থেকে উঠে বসে রইল কিছুক্ষণ। কী আর করবে ? এমনি ঘামে পুরো শরীর ভিজে চটচট করছে, তার ওপর বদ্ধ গরম...। কারেন্ট না এলে যে ঘুমও আসবে না, এটা সে ভালো করেই জানে। চার্জলাইটের আলোয় এপাশ-ওপাশ তাকাতে তাকাতে হঠাৎ বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে আসার কথা ভাবল সে। যেই ভাবনা, সেই কাজ। বাথরুমে যাওয়ার জন্য মেহেরাজ বিছানা থেকে এক পা মেঝেতে রাখল। ভালো লাগল খুব। মেঝে তুলনামূলকভাবে অনেক ঠান্ডা। ইচ্ছা হলো মেঝেতেই শুয়ে পড়ে। অদ্ভুত ইচ্ছাটাকে দমন করে আরেক পা নামাতে যাবে ঠিক এমন সময় ‘কু-কু-ই-কু’ করে এক অদ্ভুত চিৎকার শুনতে পেল মেহেরাজ। চমকে উঠে ঝট করে মেঝেতে নামানো পা-টা বিছানায় তুলে ফেলল সে। ভয় ও সন্দেহের চোখে তাকাতে লাগল জানালার দিকে। কারণ শব্দটা আসছে বাইরে থেকে। ‘কু-কু-ই-কু’... আবার শোনা গেল চিৎকারটা। আগের বারের চেয়ে আরও জোরে। প্রচণ্ড কৌতূহল এবং ভয় নিয়ে বিছানা থেকে নেমে জানালার দিকে এগিয়ে গেল; তারপর পর্দাটা সামান্য ফাঁক করল মেহেরাজ। কৌতূহলী চোখে দেখতে লাগল বাইরের দৃশ্য।
মেহেরাজের বাড়ি থেকে মেইন রোড খুব কাছে। সারা দিন রোডে গাড়ি আর ফুটপাতে মানুষ গিজগিজ করে। কিন্তু এই গভীর রাতে একটা মানুষ তো দূরে থাকুক, কোনো গাড়িরই ছিটেফোঁটা নেই। ‘কু-কু-ই-কু’ আবার শোনা গেল চিৎকার; তবে ঠিক চিৎকার নয়, চাপা কান্নার মতো শোনাল এবার। মেহেরাজ ঝট করে তাকাল সামনের লাইটপোস্টের দিকে। কারণ শব্দটা আসছে লাইটপোস্টের দিক থেকে। প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না সে। ভালোভাবে তাকাতেই লাইটপোস্টের নিচে দেখতে পেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। দুটি কুকুর দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি, তার মধ্যে একটি কুকুর ছোট ছানাই বলতে গেলে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, চিৎকার বা কান্না করছে কুকুরছানাটাই। প্রচণ্ড বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে মেহেরাজ অবাক দৃষ্টিতে কুকুর দুটির কাণ্ড দেখতে লাগল। এদিকে, চিৎকার করার সঙ্গে সঙ্গে কুকুর ছানাটির তুলনায় বড় কুকুরটি হঠাৎ সটান হয়ে কুকুরছানাটির দিকে এগিয়ে এসে জিহ্বা্রবের করে ছানাটির পেট চেটে দিতে লাগল। পেট চেটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুকুরছানাটি আরও জোরে চিৎকার করে উঠল। এবার চিৎকারটা শোনাল পুরোপুরি কান্নার মতো।
বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে নিয়ে মেহেরাজ মনে মনে ভাবে—কী ব্যাপার, কুকুরছানাটা এমন করছে কেন? কৌতূহল তার আরও দশ গুণ বেড়ে গেল। তাই তীক্ষ চোখে আরও ভালোভাবে তাকাল কুকুর দুটির দিকে। এদিকে কুকুরছানাটি ক্রমে চিৎকার করে চলছে। আর বড় কুকুরটি কেমন যেন ছটফট করতে করতে তার পেট চেটে দিচ্ছে। হঠাৎ মেহেরাজ দেখতে পেল, যে জায়গায় কুকুরটি চেটে দিচ্ছে, সে জায়গায় টকটকে লাল এবং কী রকম ফোলা লাগছে। অদ্ভুত! এ রকম তো আগে কখনো দেখিনি। মনে মনে বিস্মিত হয় মেহেরাজ। এদিকে, কুকুরটির ছটফটানি ক্রমে বাড়ছে। অস্থির হয়ে উঠছে কুকুরটি। আর কুকুরছানাটি কেমন ক্লান্ত-ক্লান্তভাবে ‘কু-ই-কু-ই’ করে যাচ্ছে। একটা ব্যাপারে হঠাৎ সন্দেহ হলো মেহেরাজের। তাই কুকুরছানাটির টকটকে লাল হওয়া জায়গাটিতে তার তীক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল সে। যা ভেবেছে, তা-ই। জায়গাটি টকটকে লাল এমনি হয়নি। এ রকম লাল ও ফোলা হয়ে যায় শুধু কোনো কিছুতে পুড়ে গেলে। ব্যাপারটা খুব সহজেই বুঝতে পারল সে। কারণ মাত্র কিছুদিন আগে তার ডান হাতে ভুলক্রমে ফুটন্ত গরম পানি পড়ে এবং তার হাতও এ রকম টকটকে লাল ও ফুলে গিয়েছিল। কিন্তু কুকুরছানাটির পুড়ল কীভাবে? নিজেকেই প্রশ্ন করল মেহেরাজ। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে তার। চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায় হঠাৎ করেই। তার বন্ধু সোহেল একবার তাকে বলেছিল, অনেক মানুষ আছে নরপিশাচের মতো, যারা নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। যেমন, অনেকেই নাকি ইচ্ছা করে কুকুর-বিড়ালের গায়ে ফুটন্ত গরম পানি কিংবা ভাতের টাটকা গরম মাড় ঢেলে দেয়। তারপর যখন কুকুর-বিড়ালগুলো অসহ্য কষ্ট ও যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে, তখন এসব লোক গলা কাঁপিয়ে হাসতে থাকে।
মেহেরাজ সেদিন সোহেলের কথা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু আজ তার সামনে জ্বলন্ত প্রমাণ দেখে স্বীকার না করে পারল না। আসলেই তো! কুকুরছানাটিকে দেখে তো তা-ই মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা মানুষের কাজ! পৃথিবীতে এত নিষ্ঠুর, নির্মম মানুষ আছে!! মনে মনে বিস্মিত হয় মেহেরাজ। তারপর কিছুক্ষণ কুকুরছানাটির যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মেহেরাজ। তারপর মুচকি হাসি দিয়ে ভাবতে লাগল—বাহ, যারা এ ধরনের জঘন্য নোংরা কাজ করে, তারাই কিনা দাবি করে তারা সৃষ্টির সেরা জীব! হ্যাঁ, এই না হলে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। কথাগুলো ভাবার সঙ্গে সঙ্গে নিজের অজান্তেই হাত মুঠো হয়ে আসে তার। হঠাৎ করেই রাগে সারা শরীর কেঁপে ওঠে। ইচ্ছা করে এই মুহূর্তেই এসব কাজ করা সব নরপিশাচকে গলা টিপে হত্যা করে, যেন পৃথিবীতে আর কেউ এ ধরনের কাজ করতে না পারে। কিন্তু তার ইচ্ছা ইচ্ছাই থেকে যায়। বাস্তবে আর রূপ নেয় না। ‘কু-ই-কু-ই’ করে ভেসে এল কুকুরের কান্নার শব্দ। ঝট করে তাকাতেই দেখতে পেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। কুকুরছানাটি এখন নীরব হয়ে মাটিতে শুয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, মারা গেছে কুকুরছানাটি। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুরটি আকাশের দিকে মুখ তুলে কাঁদছে। হঠাৎ মেহেরাজ আবিষ্কার করল, সে এতক্ষণ কুকুর বলে যা ভেবেছে, তা কুকুর ঠিকই কিন্তু মাদী কুকুর। কিছুটা অবাক হলো মেহেরাজ। তারপর কিছু একটা ভাবতে লাগল এবং হঠাৎ ঘটনাটি বুঝতে বেশিক্ষণ লাগল না তার।
মাদী কুকুরটি হচ্ছে কুকুরছানার মা। আর পারল না সে এই হূদয়ভাঙা দৃশ্য দেখতে, দেখতে চাইলও না মানুষরূপী নরপিশাচদের কবলে পড়া অসহায় দুটি কুকুরকে, যাদের প্রতিটি চিৎকার ও কান্নার মধ্যে রয়েছে লুকানো অভিমান। মানুষের প্রতি অভিমান, পৃথিবীর প্রতি অভিমান, নিয়তির প্রতি অভিমান। পর্দাটা আস্তে করে নামিয়ে দিল মেহেরাজ। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল চোখে। গরম জলের স্পর্শে ভিজে গেল হাতের আঙুল। আশ্চর্য, কাঁদছে সে-ও!
====================================
গল্প- 'মাটির ব্যাংক' গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন' স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা' আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন? ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব' সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর' রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা' আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি' আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার' আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত' আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক' আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ' রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা' রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা' বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য শিল্প-অর্থনীতি 'করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর অনাস্থা নয়, খালেদার আশঙ্কা ছিল ন্যায়বিচার না পাওয়ার খেলা- 'বাংলাদেশ তো আসলে জিততেই চায়নি!' আলোচনা- 'ড. ইউনূসের কেলেঙ্কারি!'
দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ শিপন দাশ
রেলওয়ে পাবলিক হাইস্কুল, চট্টগ্রাম
এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
গল্প- 'মাটির ব্যাংক' গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন' স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা' আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন? ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব' সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর' রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা' আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি' আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার' আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত' আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক' আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ' রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা' রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা' বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য শিল্প-অর্থনীতি 'করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর অনাস্থা নয়, খালেদার আশঙ্কা ছিল ন্যায়বিচার না পাওয়ার খেলা- 'বাংলাদেশ তো আসলে জিততেই চায়নি!' আলোচনা- 'ড. ইউনূসের কেলেঙ্কারি!'
দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ শিপন দাশ
রেলওয়ে পাবলিক হাইস্কুল, চট্টগ্রাম
এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
No comments