ফোকলোর শিক্ষার যুগপূর্তি উৎসব by সাইফুদ্দীন চৌধুরী
মাটি ও মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্কের সঠিক ঠিকানা খুঁজে বের করা, আধুনিক জীবনব্যবস্থার সঙ্গে উপযোগী করে তোলা বর্তমান বিশ্বের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ফসল হিসেবে দেশে প্রথম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র একটি একাডেমিক ডিসিপ্লিন হিসেবে ফোকলোর বিভাগ চালু করা হয়। ১৯৯৮ সালের ২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত এই বিভাগটির আজ ১২ বছর, এক যুগ পূর্তি হচ্ছে। যুগপূর্তি উপলক্ষে ফোকলোর বিভাগ দুই দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন করেছে। এতে রয়েছে ফোকলোর বিষয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার, স্মারক প্রকাশনা, সংগীতানুষ্ঠান, স্মৃতিচারণাসহ অনেক আয়োজন।
ফোকলোর বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে, তা তো আগেই বলেছি। একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম কেন? উদ্দেশ্য একটাই—দীর্ঘকালের গড়ে ওঠা আমাদের যে গৌরবময় অতীত আছে, ঐতিহ্য আছে, নিজস্ব যে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আছে, সর্বোপরি নিজস্ব যে জীবনবোধ আছে, তা সংরক্ষণ করা, তার অতীতের ঠিকানা আবিষ্কার করা। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, রুচি-চাহিদা, আহার-বিহার, পোশাক-পরিচ্ছদ হবে একেবারে এখানকার জল-হাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে তা যেন হারিয়ে না যায়, যুগপৎ তাল মিলিয়ে চলতে পারে—এ জন্যই বাঙালির নিজ ঠিকানা রক্ষার তাগিদে এই বিভাগের যাত্রা শুরু।
একটি কথা এখানে অবশ্যই বলা প্রয়োজন, সাতচল্লিশে দেশ বিভক্তির পরপরই ফোকলোর বিষয়টির প্রতি সুধীজনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মিলনের প্রথম অধিবেশনেই সভাপতির অভিভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ফোকলোরের সংগ্রহ, অনুশীলন ও চর্চার প্রতি দেশবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। দেশের তিনজন লোকবিজ্ঞানী মযহারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, আবু সাইদ জহুরুল হক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফোকলোর বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসে স্বতন্ত্র একাডেমিক ডিসিপ্লিন হিসেবে ফোকলোর পঠন-পাঠনের চেষ্টা চালান। অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যক্ষ থাকাকালে বিএ অনার্স এবং এমএ শ্রেণীর পাঠ্যক্রম ফোকলোর পত্র সংযোজন করেন। স্বতন্ত্র বিভাগ না থাকলেও অধ্যক্ষের কার্যালয়ের নাম দেন ‘ফোকলোরের বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র’। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ছিল, ফোকলোর বিষয় কেবল একটি পত্র হিসেবে নয়, পৃথক বিভাগ হিসেবে তা প্রতিষ্ঠা করা। অধ্যাপক ইসলামের অনুজ অধ্যাপক আবদুল খালেক উপাচার্য হয়ে অগ্রজের সেই স্বপ্ন পূরণ করেন। দেশে একমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগের কার্যক্রম চলছে।
যাতে বিভাগটি আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করতে পারে, এ জন্য ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোর পাঠ্যক্রমের অনুসরণে কোর্সগুলোর রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। পৃথিবীর নামকরা লোকবিজ্ঞানী ড্যানবেন আমোস, লাউরি হাংকো, হেনরি গ্রাসি প্রমুখ ফোকলোর অধ্যয়নে ক্ষেত্র সমীক্ষার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন। এই বিভাগের কোর্সগুলো পুনর্বিন্যাসকালে সেসবের প্রতিও লক্ষ রাখা হয়েছে। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, জাদুঘরতত্ত্ব, দর্শন, সাহিত্য—সবই এ বিভাগের পাঠ্যক্রমের আওতাভুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোকবিজ্ঞানী উইলিয়াম ব্যাসংকন তাঁর ফোকলোর অ্যান্ড এনথ্রোপলজি বইয়ে লিখেছেন, ফোকলোরে মানববিদ্যার বিষয় থাকলেও আদতে তা সামাজিক বিজ্ঞান। উল্লেখ্য, ফোকলোর বিভাগ এখন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম বিদ্যা শৃঙ্খলা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এই বিভাগ থেকে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী ডিগ্রি (অনার্স, মাস্টার্স) নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। বর্তমানেও বিভিন্ন বর্ষে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।
একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, এ বছরই ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ চালু হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মজয়ন্তী উৎসব পালন উপলক্ষে সরকারঘোষিত প্রস্তাবিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েও ফোকলোর বিভাগ সংযোজন করা হবে। বাংলা একাডেমী সূত্রে জানা গেছে, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে জাতীয় ফোকলোর ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের রয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশে ঐতিহ্য চর্চা গতিশীল হবে। আমাদের দেশে ফোকলোর শিক্ষা এখন তুলনামূলক ও আন্তর্জাতিক মাপকাঠির বিচারে ঋদ্ধ। প্রত্যাশা, আমাদের দেশেও ফোকলোরের একাডেমিক পঠন-পাঠনে নতুন নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটবে। জার্মানির লোকতত্ত্ববিদ হারমান বসিঙগার চমৎকার কথাই বলেছেন, এ যুগে এসে ফোকলোর বিলুপ্ত হয়নি—বরং তার রূপান্তর হয়েছে ও পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটবে না।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ফোকলোর বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে, তা তো আগেই বলেছি। একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম কেন? উদ্দেশ্য একটাই—দীর্ঘকালের গড়ে ওঠা আমাদের যে গৌরবময় অতীত আছে, ঐতিহ্য আছে, নিজস্ব যে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আছে, সর্বোপরি নিজস্ব যে জীবনবোধ আছে, তা সংরক্ষণ করা, তার অতীতের ঠিকানা আবিষ্কার করা। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, রুচি-চাহিদা, আহার-বিহার, পোশাক-পরিচ্ছদ হবে একেবারে এখানকার জল-হাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে তা যেন হারিয়ে না যায়, যুগপৎ তাল মিলিয়ে চলতে পারে—এ জন্যই বাঙালির নিজ ঠিকানা রক্ষার তাগিদে এই বিভাগের যাত্রা শুরু।
একটি কথা এখানে অবশ্যই বলা প্রয়োজন, সাতচল্লিশে দেশ বিভক্তির পরপরই ফোকলোর বিষয়টির প্রতি সুধীজনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মিলনের প্রথম অধিবেশনেই সভাপতির অভিভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ফোকলোরের সংগ্রহ, অনুশীলন ও চর্চার প্রতি দেশবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। দেশের তিনজন লোকবিজ্ঞানী মযহারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, আবু সাইদ জহুরুল হক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফোকলোর বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসে স্বতন্ত্র একাডেমিক ডিসিপ্লিন হিসেবে ফোকলোর পঠন-পাঠনের চেষ্টা চালান। অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যক্ষ থাকাকালে বিএ অনার্স এবং এমএ শ্রেণীর পাঠ্যক্রম ফোকলোর পত্র সংযোজন করেন। স্বতন্ত্র বিভাগ না থাকলেও অধ্যক্ষের কার্যালয়ের নাম দেন ‘ফোকলোরের বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র’। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ছিল, ফোকলোর বিষয় কেবল একটি পত্র হিসেবে নয়, পৃথক বিভাগ হিসেবে তা প্রতিষ্ঠা করা। অধ্যাপক ইসলামের অনুজ অধ্যাপক আবদুল খালেক উপাচার্য হয়ে অগ্রজের সেই স্বপ্ন পূরণ করেন। দেশে একমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগের কার্যক্রম চলছে।
যাতে বিভাগটি আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করতে পারে, এ জন্য ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোর পাঠ্যক্রমের অনুসরণে কোর্সগুলোর রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। পৃথিবীর নামকরা লোকবিজ্ঞানী ড্যানবেন আমোস, লাউরি হাংকো, হেনরি গ্রাসি প্রমুখ ফোকলোর অধ্যয়নে ক্ষেত্র সমীক্ষার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন। এই বিভাগের কোর্সগুলো পুনর্বিন্যাসকালে সেসবের প্রতিও লক্ষ রাখা হয়েছে। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, জাদুঘরতত্ত্ব, দর্শন, সাহিত্য—সবই এ বিভাগের পাঠ্যক্রমের আওতাভুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোকবিজ্ঞানী উইলিয়াম ব্যাসংকন তাঁর ফোকলোর অ্যান্ড এনথ্রোপলজি বইয়ে লিখেছেন, ফোকলোরে মানববিদ্যার বিষয় থাকলেও আদতে তা সামাজিক বিজ্ঞান। উল্লেখ্য, ফোকলোর বিভাগ এখন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম বিদ্যা শৃঙ্খলা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এই বিভাগ থেকে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী ডিগ্রি (অনার্স, মাস্টার্স) নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। বর্তমানেও বিভিন্ন বর্ষে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।
একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, এ বছরই ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ চালু হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মজয়ন্তী উৎসব পালন উপলক্ষে সরকারঘোষিত প্রস্তাবিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েও ফোকলোর বিভাগ সংযোজন করা হবে। বাংলা একাডেমী সূত্রে জানা গেছে, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে জাতীয় ফোকলোর ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের রয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশে ঐতিহ্য চর্চা গতিশীল হবে। আমাদের দেশে ফোকলোর শিক্ষা এখন তুলনামূলক ও আন্তর্জাতিক মাপকাঠির বিচারে ঋদ্ধ। প্রত্যাশা, আমাদের দেশেও ফোকলোরের একাডেমিক পঠন-পাঠনে নতুন নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটবে। জার্মানির লোকতত্ত্ববিদ হারমান বসিঙগার চমৎকার কথাই বলেছেন, এ যুগে এসে ফোকলোর বিলুপ্ত হয়নি—বরং তার রূপান্তর হয়েছে ও পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটবে না।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments