স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর by জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
গ্রামের পাঠশালায় আমার প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা শুরু হলো। আমার আব্বাও কলকাতা থেকে বাঁকুড়া বদলি হলেন। এর মাস দুয়েকের মধ্যেই আমরা উঠলাম স্কুলডাঙ্গা রোডে আমাদের বাসায়। আমি ভর্তি হলাম বাঁকুড়া জিলা স্কুলে। ক্লাস ফাইভে। বাঁকুড়ায় আমরা ছিলাম দুই বছর। এরপর জলপাইগুড়ি। জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে আমি ক্লাস সেভেনের ছাত্র। মাত্র এক বছর ছিলাম জলপাইগুড়িতে। এরপর আব্বা বদলি হলেন যশোরে, জিলা স্কুলে।
নিজের জেলায় তিনি তদবির করেই বদলি হয়েছিলেন, আমার আশি-ঊর্ধ্ব বয়সী পিতামহের কাছে থাকার যুক্তি দেখিয়ে। যশোর জিলা আমি স্কুলে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিই।
নিজের জেলায় তিনি তদবির করেই বদলি হয়েছিলেন, আমার আশি-ঊর্ধ্ব বয়সী পিতামহের কাছে থাকার যুক্তি দেখিয়ে। যশোর জিলা আমি স্কুলে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিই।
পুরো ছয় বছর পিতার কাছে সান্নিধ্যে থাকার ফলে আমার জীবনে এর প্রভাব ছিল দীর্ঘস্থায়ী। আমার লেখাপড়ার ওপর আব্বার ছিল সতর্ক দৃষ্টি। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা করেছি। যেখানে যতটা সম্ভব। কথাটা বলছি এ জন্য যে যশোরে এসে খেলাধুলায় নিয়মিত হতে পারিনি। তখন মহাযুদ্ধ চলছে। একপর্যায়ে যশোরে ভালো রকম সেনা-সমাবেশ হলো। আমরা আমাদের স্কুল থেকে বিতাড়িত হলাম। শহরের এক প্রান্তে এক পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি চাচড়ার রাজবাড়ি। আমাদের স্কুল এখানে সরে এল। আমরা স্কুলের সঙ্গে আমাদের খেলার মাঠও হারালাম। কিছুদিন পর অবশ্য একটা বিকল্প মাঠের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
খেলাধুলায় কিছুটা সময় দেওয়ার ব্যাপারে আব্বার কোনো আপত্তি ছিল না। কেবল একটি নিয়ম মেনে চলতে হয়েছে—খেলার পর বাইরে আর নয়। বাসায় ফিরতে হবে ও পড়ার টেবিলে বসতে হবে।
আমার ছোট ভাই ছিল আমার চেয়ে দেড় বছরের ছোট। স্বভাবে আমার বিপরীত, অত্যন্ত ক্রীড়াপরায়ণ ও বহির্মুখী। যশোরে থাকার সময় এই ভাইটিকে আমি হারাই ও বেশ একা হয়ে পড়ি। যশোরে আব্বা বাসা করেননি। আমরা সবাই জিলা স্কুলের মুসলিম হোস্টেলে থেকেছি। মাকে শ্বশুরের সংসারে ফিরে যেতে হয়েছিল।
পেছন ফিরে তাকিয়ে যখন দেখি, আমার স্কুলজীবনের তিনটি স্কুলের মধ্যে একধরনের অভিন্নতা লক্ষ করি। এর কারণ, তিনটিই সরকারি স্কুল এবং এগুলোর মধ্যে মৌলিক ঐক্য ছিল কয়েকটি ক্ষেত্রে। ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা ৩০-৩৫-এ সীমাবদ্ধ ছিল। কেবল জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে আমাদের ক্লাসে দুটি সেকশন পেয়েছি। শিক্ষকেরা ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ। এবং সব ছাত্রকে চিনতেন। মাঝেমধ্যে এঁদের মধ্যে কেউ বদলি হয়ে যেতেন। তখন সে উপলক্ষে একটা বিদায় অনুষ্ঠান হতো। বিদায়ী শিক্ষকের চোখে জল দেখা দিত। বক্তাদের কণ্ঠে দুঃখের সুর বাজত। একমাত্র বিলাত ফেরত হেডমাস্টার ছাড়া আর কোনো শিক্ষকের মধ্যে কোনোরূপ সাহেবিয়ানা ছিল না। নেহাতই ছা-পোষা নিম্নমধ্যবিত্তদের কাছে সেটা আশা করাও যায় না। বাড়তি আয়, প্রাইভেট টিউশনি থেকে তাঁরা সযত্ন দূরত্ব রক্ষা করতেন।
ড্রিল ও ড্রয়িংয়ের জন্য যে দুজন শিক্ষক ছিলেন তাঁরা শুধু নিচের ক্লাসে পড়াতেন। দুজন ড্রিল মাস্টার পেয়েছি, যাঁরা ছিলেন যুদ্ধ-ফেরত, হাবিলদার। একজন ড্রিল মাস্টার বিখ্যাত ছিলেন তাঁর বুড়ো আঙুলের গাট্টার জন্য। সেই গাট্টা যারা খেয়েছে, তারা কখনো ভুলবে না। একজন ড্রয়িং মাস্টার। যিনি ক্লাস ফাইভে বাংলা পড়াতেন, তাঁর বিদ্যার দৌড় পরীক্ষা করতে গিয়ে আমি লজ্জা পেয়েছিলাম। এ কারণেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে আমি ক্লাসের মধ্যে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, স্যার, কটাক্ষ মানে কী। সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল, বক্রদৃষ্টি। আমি বসে পড়লাম।
তিস্তা নদীর পাড়ে, জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলের অবস্থান ছিল ভারি সুন্দর। শহরের মাঝখানে করলা নদীর ওপর ছিল একটা ঝুলন্ত সেতু। সেই সেতু পার হয়ে, একটা সচ্ছল-সুন্দর পাড়া পেরিয়ে আমরা হেঁটেই আসতাম স্কুলে। স্কুলের সামনে বাগান, বাগান পেরিয়ে মাঠ। প্রাচীনতায় যশোর ও বাঁকুড়া ছিল এগিয়ে—আমার ছাত্রজীবনেই এ দুটি স্কুল শতবর্ষ পূরণ করেছে। জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলের বয়স সম্বন্ধে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে স্কুলভবনটি যে অনেক নতুন, চেহারাতেই সেটা ধরা পড়ত। বাঁকুড়া ও যশোর জিলা স্কুলের ভবনও ছিল শতবর্ষী। জলপাইগুড়ি থাকতেই, সে বছর (১৯৪১) আগস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কদিন আগে থেকেই উদ্বেগজনক খবর আসছিল। যেদিন মৃত্যু সংবাদ এল, সেদিন হেড মাস্টার নিজে ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে স্কুল ছুটি দিয়ে দিলেন।
বাঘের পিঠে চড়া যায়, তবে পিঠ থেকে নামা যায় না। নামলেই বাঘে খায়। ফাইভ থেকে টেন—ছয় বছর তিনটি স্কুলে ক্লাসের ফার্স্ববয় হওয়ায় আমার অবস্থা ছিল তাই। স্থানচ্যুত হওয়া চলবে না—আমার কানে আব্বার সেই গুঞ্জন শুনে এসেছি ম্যাট্রিক পর্যন্ত। পরে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন হেড মাস্টার বীরেশচন্দ্র সেন। তিনি ম্যাট্রিকে আমার জন্য একেবারে ওপরের দিকে জায়গা কল্পনা করতেন। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলতেন, ও একটু অলস প্রকৃতির। বেশি খাটাখাটুনির মধ্যে নেই। হেড মাস্টারের আশঙ্কা পুরো হয়নি। তবে পরীক্ষার ফল ভালোই হয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজে আমি প্রথম গ্রেডের স্কলারশিপ নিয়েই পড়াশোনা করেছি।
আমি প্রথম বক্তৃতা দেই, যখন যশোর জিলা স্কুলে আমি অষ্টম শ্রেণীতে। স্কুলের মাঠে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল এবং চীনের মাদাম চিয়াং কাইশেক তখন ভারত ভ্রমণে ছিলেন। শিক্ষকেরা কিছু বলার আগে ছাত্রদের মধ্য থেকে দু-একজন বলবে, এই প্রত্যাশায় শিক্ষকদের দৃষ্টি নিচু ক্লাস থেকে ওপরের দিকে উঠতে উঠতে, ক্লাস এইটে এসে থেমে গেল ও আমার প্রতি নিবদ্ধ হলো। আমার কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। তবু উঠতেই হলো। আমি আমার জীবনের প্রথম বক্তৃতা করলাম, একেবারেই উপস্থিত বক্তৃতা। আমার আব্বার ধারণায়, আমি ব্যর্থ হইনি। এ জীবনে আমি অনেক বক্তৃতা করেছি, ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক এবং এটাকে আমার বিধিলিপি বলেই মেনে নিয়েছি। কিন্তু এর সূত্রপাত যে এত শিগগির হবে কখনো ভাবিনি।
আমার স্কুলজীবন নিয়ে যখনই ভাবি, একই সঙ্গে তিনটি স্কুল আমার মানসচক্ষে ভেসে ওঠে, বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর।
===============================
ফিচার- তাঁহাদের দান ফিচার- ডায়ানার আংটি গল্প- 'অভিমান' গল্প- 'মাটির ব্যাংক' গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন' স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা' আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন? ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব' সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর' রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা' আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি' আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার' আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত' আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক' আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ' রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা' রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা' বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য শিল্প-অর্থনীতি 'করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর
দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
ফিচার- তাঁহাদের দান ফিচার- ডায়ানার আংটি গল্প- 'অভিমান' গল্প- 'মাটির ব্যাংক' গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন' স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা' আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন? ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব' সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর' রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা' আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি' আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার' আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত' আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক' আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ' রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা' রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা' বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য শিল্প-অর্থনীতি 'করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর
দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
No comments