শিক্ষায় বৈষম্য রেখে পরীক্ষায় সাম্য by আবুল মোমেন
এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের আনন্দোজ্জ্বল ছবি ছাপানো হয় সব কাগজে। পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদকেরা যথেষ্ট পরিশ্রম করে বিত্তহীন পরিবারের জপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকেন। এদের নামকরণ হয়েছে অদম্য প্রতিভা বা অদম্য মেধাবী। ফলাফল নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যেও অলিখিত প্রতিযোগিতা আছে।
একসময় এসএসসির সমমানের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষাকে বাংলায় বলা হতো প্রবেশিকা পরীক্ষা। এ নামকরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। সেকালের প্রবেশিকা বা আজকের এসএসসি পরীক্ষা হলো জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা, যেটা পাস করলে অনুমোদিত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সনদ পাওয়া যায়। এর একটা স্বীকৃতি সমাজে এবং নানা কর্তৃপক্ষের কাছে মেলে। ফলে এটার জোরে জীবনে উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে যায়, অতীতে ভালো চাকরিও জুটে যেত, আজকের দিনেও চাকরির বাজারে অন্যান্য সনদের মধ্যেও এটির রয়েছে স্বতন্ত্র গুরুত্ব।
আজকের এসএসসি ও এইচএসসি—এ উভয় পরীক্ষারই ভূমিকা বস্তুত প্রবেশিকা পরীক্ষার মতো, যদি আমরা এ নামকরণের মূল তাৎপর্য অনুধাবন করি। একজন মানুষের পরিণত জীবনের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে এ দুটি পরীক্ষা। এর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করা যায় মূল জীবনে। বস্তুত, একজন মানুষের আসল পরীক্ষা শুরু হয় তার পর থেকে।
মানুষের আসল পরীক্ষা তো অঙ্কে-ইংরেজিতে, ভূগোলে-ইতিহাসে, সমাজে-ধর্মে কত নম্বর পেল তা নয়। মানুষের আসল পরীক্ষা হলো তার বিবেচনাশক্তি, ন্যায়-অন্যায় বোধ, বিচক্ষণতা, সম্প্রীতিবোধ, কর্মদক্ষতা, সংবেদনশীলতা ইত্যাদি মানবিক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কতটা সে জীবনে ধারণ করে, লালন করে, পালন করে তার ওপর। স্কুলে-কলেজে পড়াশোনা-পরীক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এসব গুণ বিকাশের মাধ্যমে তাদের একেকজন যোগ্য মানুষ হয়ে ওঠার কথা। আমাদের শিক্ষা কি সেই লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে? যদি তাই হতো তাহলে এ দেশে মানুষের এমন আকাল হতো না। দুঃখ করে বলতে হতো না যে এ দেশে অনেক ভালো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল-আমলা-শিক্ষক-রাজনীতিক আছেন বটে, কিন্তু ভালো মানুষের বড়ই অভাব।
এ দুটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে যখন দেশজুড়ে এবং পত্রপত্রিকায় হইচই চলতে থাকে, তখন আমার মনে পড়ে যায় ইতালির এক স্কুলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের লেখা একটি বইয়ের কথা। বইটির ইংরেজি নাম লেটার টু এ টিচার আর বাংলা নাম আপনাকে বলছি, স্যার...। ইতালির পাহাড়ি খনি অঞ্চলে অবস্থিত এ স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই গরিব, সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত এবং অনেকেই শেষ পর্যন্ত পড়া চালিয়ে যেতে পারেনি, স্কুলে ও পরিবারে সর্বত্র গঞ্জনা আর লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে। ওদের এই বঞ্চনা-গঞ্জনার জায়গা থেকে এই স্কুলের আটজন ছাত্র চিঠি লিখেছে শিক্ষকদের কাছে, যাঁরা কিনা ওদের প্রতি প্রয়োজনীয় সহানুভূতি ও ধৈর্য দেখাননি। এক জায়গায় ওরা বলছে, ‘পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার অজুহাতে মেধাহীন ছাত্র হিসেবে আমাদের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দাও তোমরা। স্কুলে থাকবে শুধু যারা পড়া পারে, ভালো পারে তারা। ভাবো একবার, হাসপাতালগুলো বলছে যে “আমরা রোগী রাখব না, সুস্থ মানুষদেরই রাখব”।’
আমাদের অনেক বিখ্যাত স্কুল—বলা যায় প্রায় সব বিখ্যাত স্কুল—পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে অন্যদের টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে নিম্নশ্রেণী থেকেই দুর্বল ছাত্রদের ছাঁটাই-প্রক্রিয়া চালিয়ে ক্রমান্বয়ে সুস্থ রোগীদের হাসপাতাল বা সবল ছাত্রদের স্কুলে পরিণত হয়। সুস্থ মানুষের হাসপাতাল যেমন হাস্যকর এবং অমানবিক ব্যাপার—এ ধরনের স্কুলগুলোও তো তাই।
আমাদের সংবিধান শিক্ষাকে সব শিশুর অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেই শিক্ষার মধ্যে কোনো বৈষম্য রাখার অবকাশ নেই। সবার জন্য একই শিক্ষা, অন্তত প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত, থাকার কথা। শিক্ষা যদি শিশুর অধিকার হয়ে থাকে এবং সেই শিক্ষা যদি সবার জন্য প্রাথমিক পর্যন্ত একই মানের হওয়ার কথা হয়—তাহলে গুরুতর কতকগুলো অসংগতি শিক্ষার গোড়া থেকেই কি তৈরি হচ্ছে না?
আমরা জানি, স্কুলের ভৌত কাঠামো, সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষকের মান, ছাত্রবেতন ইত্যাদি মৌলিক বিষয়ে কত রকমের স্তর বিদ্যমান আমাদের শিক্ষাঙ্গনে। বরং বলা যায়, দেশের কোনো দুটি স্কুলের মধ্যে এই বুনিয়াদি বিষয়ে সমতা নেই। তারপর, বা তার ওপর, রয়েছে বাবা-মা ও পরিবারের আর্থিক ও ভৌত অসম বাস্তবতা। ফলে এ অসম বাস্তবতার ফলাফল তো অসম হতে বাধ্য। আমরা জানি, কোনো ধরনের প্রতিযোগিতার আগে সব প্রতিযোগীর জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়। আমাদের দুই রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে প্রায়ই আমরা লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড অর্থাৎ প্রতিযোগিতার ময়দানে সমতা রক্ষার দাবি উঠতে দেখি। অসম বাস্তবতার এ পাবলিক পরীক্ষা বস্তুত অন্যায় নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ক্যাডেট কলেজের একজন ছাত্রের জন্য সরকারের বার্ষিক ব্যয় প্রায় ৭৪ হাজার টাকা আর সরকারি হাইস্কুলের ছাত্রের জন্য সরকার ব্যয় করে দুই হাজার টাকা, বেসরকারি স্কুলে তা আরও কম। এই সামান্য তথ্যটি বিবেচনায় নিলে ক্যাডেট কলেজের জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রটির বিবেক কী বলবে? তার ফলাফল নিশ্চয় গৌরবের, কিন্তু যে বৈষম্যের ভিত্তির ওপর এ গৌরব রচিত হয়েছে তা কি লজ্জাজনক নয়? ক্যাডেট কলেজগুলোতে এবং ভিকারুন নিসা বা ইস্পাহানীর মতো ‘সবল’ স্কুলগুলোতে প্রতি শ্রেণীতে ক্রমান্বয়ে স্ক্রিনিং করেই কেবল সুস্থ মানুষদের অর্থাৎ ‘সবল ছাত্রদের’ সেবা দেওয়া হয়। স্কুলের জন্য এটা কতটা গৌরবের আর কতটা লজ্জার তা কি একবার ভাবব না?
‘সবার জন্য শিক্ষা’ স্লোগানটি বেশ পুরোনো, কিন্তু বারবার সময় পিছিয়েও তা অধরাই থেকে গেছে। বর্তমানে স্লোগানটি ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে ‘সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা’ হয়েছে। মানের তারতম্য কতটা তা স্কুলগুলোর সুযোগ-সুবিধা, স্কুলভিত্তিক ছাত্রপিছু বার্ষিক সরকারি বরাদ্দ এবং সর্বোপরি এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে পরিষ্কার বোঝা যায়। সুযোগ-সুবিধার অসমতা, বরাদ্দের অসাম্য, ফলাফলের বৈষম্য এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থার বৈষম্য এর মূলে কাজ করছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা আমরা রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারব না, এমনকি বর্তমান ধারার রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চলতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আশা করা যায় না। পরিবারের এ অসম বাস্তবতার কারণে সবার জন্য সমান সুযোগ তথা প্রতিযোগিতা ও পরীক্ষার জন্য লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড তৈরির দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে। তবে সরকার সে দায়িত্ব নিতে এবং পালন করতে পারবে যদি সমাজের সচেতন অংশ থেকে এ ব্যাপারে চাপ তৈরি হয়। সমাজের সচেতন মানুষেরা যদি নিজেরাই এই অসম ব্যবস্থার বিষম ফল নিয়ে মেতে ওঠে তবে সরকার বাস্তবতার পরিবর্তনে কাজ করার প্রণোদনাও পাবে না, চাপও অনুভব করবে না।
এখানে আবারও মনে করিয়ে দিতে চাইব যে, এসএসসি ও এইচএসসি বাস্তবেই আধুনিক মানবজীবনের প্রবেশিকা পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবেই জীবনের মূল পর্বে প্রবেশ করা যাবে, যেখানে প্রতিটি মানুষকে জীবনযাপনের সূত্রে নানা রকমের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। সেসব পরীক্ষায় পাস করার ওপর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাফল্য নির্ভর করে। এখন দেখা যাচ্ছে, কিশোর বয়সী ছাত্র সফল, বড় হয়ে পেশাগত বা বস্তুগত মানদণ্ডে ব্যক্তি হিসেবে তার সাফল্যও কম নয়, কিন্তু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র কেবলই ব্যর্থ হচ্ছে, অবক্ষয় ঠেকানো যাচ্ছে না। দুর্নীতি, অপরাধ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে, এমনকি বিভিন্ন পেশাগত দায়িত্বেও দেখা যাচ্ছে, মানের অবনতি ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রেই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে মানের লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে শিক্ষকের মানের অধোগতি বুঝতে অসুবিধা হয় না। স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের মান নেমে গেছে, শিক্ষকতার মান নেমেছে। এই যদি বাস্তবতা হয় তাহলে শিক্ষায় অগ্রগতি কীভাবে ঘটবে? পরিসংখ্যানে সংখ্যাগত যে উন্নয়ন আমরা দেখি তাতে শিক্ষার ব্যবহারিক ও আদর্শিক মান যাচাই হয় না সব সময়। এসব বিষয়ে অসচেতন থেকে সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিছক একটি বুলিতেই পরিণত হবে।
এ অবস্থায় আমাদের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত? বর্তমান এ অসাম্যের বাস্তবতায় গা না ভাসিয়ে সমতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে। এখনই আমরা সব স্কুলকে একই মানে আনতে পারব না। প্রথম ধাপটি হবে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা। এ জন্য ভবন, মানে ও সংখ্যায় শিক্ষক এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পরিকল্পিতভাবে আদর্শ অবস্থায় নিতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগগুলোকেও ন্যূনতম একই চাহিদা পূরণ করতে হবে।
প্রাক-প্রাথমিকসহ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকছে নয়টি শ্রেণী। এ ধরনের একটি আদর্শ স্কুলে শ্রেণীপ্রতি কত ছাত্র, স্কুলের সর্বমোট কত ছাত্র, ৩০ জন ছাত্রপিছু একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকমণ্ডলী, মেধাবী তরুণদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার মতো বেতন-ভাতা, গ্রন্থাগার, উন্নত ও সুমুদ্রিত পাঠ্যবই, বিজ্ঞানকিট, মাঠ (কয়েকটি স্কুল মিলে হতে পারে), দারোয়ান-মালি-আয়াসহ সহযোগী কর্মী ইত্যাদি এবং ক্লাসসংখ্যা, পরীক্ষা, সহশিক্ষা কার্যক্রমসহ বছরের একটি কর্মপরিকল্পনার ছক শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া থাকবে। এভাবে সরকারও স্কুল চালাবে আর বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও ন্যূনতম এ শর্তগুলো পূরণ করতে হবে।
এভাবেই হয়তো আমরা শিক্ষার এক নতুন যুগে পদার্পণ করতে পারব।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
একসময় এসএসসির সমমানের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষাকে বাংলায় বলা হতো প্রবেশিকা পরীক্ষা। এ নামকরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। সেকালের প্রবেশিকা বা আজকের এসএসসি পরীক্ষা হলো জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা, যেটা পাস করলে অনুমোদিত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সনদ পাওয়া যায়। এর একটা স্বীকৃতি সমাজে এবং নানা কর্তৃপক্ষের কাছে মেলে। ফলে এটার জোরে জীবনে উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে যায়, অতীতে ভালো চাকরিও জুটে যেত, আজকের দিনেও চাকরির বাজারে অন্যান্য সনদের মধ্যেও এটির রয়েছে স্বতন্ত্র গুরুত্ব।
আজকের এসএসসি ও এইচএসসি—এ উভয় পরীক্ষারই ভূমিকা বস্তুত প্রবেশিকা পরীক্ষার মতো, যদি আমরা এ নামকরণের মূল তাৎপর্য অনুধাবন করি। একজন মানুষের পরিণত জীবনের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে এ দুটি পরীক্ষা। এর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করা যায় মূল জীবনে। বস্তুত, একজন মানুষের আসল পরীক্ষা শুরু হয় তার পর থেকে।
মানুষের আসল পরীক্ষা তো অঙ্কে-ইংরেজিতে, ভূগোলে-ইতিহাসে, সমাজে-ধর্মে কত নম্বর পেল তা নয়। মানুষের আসল পরীক্ষা হলো তার বিবেচনাশক্তি, ন্যায়-অন্যায় বোধ, বিচক্ষণতা, সম্প্রীতিবোধ, কর্মদক্ষতা, সংবেদনশীলতা ইত্যাদি মানবিক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কতটা সে জীবনে ধারণ করে, লালন করে, পালন করে তার ওপর। স্কুলে-কলেজে পড়াশোনা-পরীক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এসব গুণ বিকাশের মাধ্যমে তাদের একেকজন যোগ্য মানুষ হয়ে ওঠার কথা। আমাদের শিক্ষা কি সেই লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে? যদি তাই হতো তাহলে এ দেশে মানুষের এমন আকাল হতো না। দুঃখ করে বলতে হতো না যে এ দেশে অনেক ভালো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল-আমলা-শিক্ষক-রাজনীতিক আছেন বটে, কিন্তু ভালো মানুষের বড়ই অভাব।
এ দুটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে যখন দেশজুড়ে এবং পত্রপত্রিকায় হইচই চলতে থাকে, তখন আমার মনে পড়ে যায় ইতালির এক স্কুলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের লেখা একটি বইয়ের কথা। বইটির ইংরেজি নাম লেটার টু এ টিচার আর বাংলা নাম আপনাকে বলছি, স্যার...। ইতালির পাহাড়ি খনি অঞ্চলে অবস্থিত এ স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই গরিব, সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত এবং অনেকেই শেষ পর্যন্ত পড়া চালিয়ে যেতে পারেনি, স্কুলে ও পরিবারে সর্বত্র গঞ্জনা আর লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে। ওদের এই বঞ্চনা-গঞ্জনার জায়গা থেকে এই স্কুলের আটজন ছাত্র চিঠি লিখেছে শিক্ষকদের কাছে, যাঁরা কিনা ওদের প্রতি প্রয়োজনীয় সহানুভূতি ও ধৈর্য দেখাননি। এক জায়গায় ওরা বলছে, ‘পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার অজুহাতে মেধাহীন ছাত্র হিসেবে আমাদের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দাও তোমরা। স্কুলে থাকবে শুধু যারা পড়া পারে, ভালো পারে তারা। ভাবো একবার, হাসপাতালগুলো বলছে যে “আমরা রোগী রাখব না, সুস্থ মানুষদেরই রাখব”।’
আমাদের অনেক বিখ্যাত স্কুল—বলা যায় প্রায় সব বিখ্যাত স্কুল—পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে অন্যদের টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে নিম্নশ্রেণী থেকেই দুর্বল ছাত্রদের ছাঁটাই-প্রক্রিয়া চালিয়ে ক্রমান্বয়ে সুস্থ রোগীদের হাসপাতাল বা সবল ছাত্রদের স্কুলে পরিণত হয়। সুস্থ মানুষের হাসপাতাল যেমন হাস্যকর এবং অমানবিক ব্যাপার—এ ধরনের স্কুলগুলোও তো তাই।
আমাদের সংবিধান শিক্ষাকে সব শিশুর অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেই শিক্ষার মধ্যে কোনো বৈষম্য রাখার অবকাশ নেই। সবার জন্য একই শিক্ষা, অন্তত প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত, থাকার কথা। শিক্ষা যদি শিশুর অধিকার হয়ে থাকে এবং সেই শিক্ষা যদি সবার জন্য প্রাথমিক পর্যন্ত একই মানের হওয়ার কথা হয়—তাহলে গুরুতর কতকগুলো অসংগতি শিক্ষার গোড়া থেকেই কি তৈরি হচ্ছে না?
আমরা জানি, স্কুলের ভৌত কাঠামো, সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষকের মান, ছাত্রবেতন ইত্যাদি মৌলিক বিষয়ে কত রকমের স্তর বিদ্যমান আমাদের শিক্ষাঙ্গনে। বরং বলা যায়, দেশের কোনো দুটি স্কুলের মধ্যে এই বুনিয়াদি বিষয়ে সমতা নেই। তারপর, বা তার ওপর, রয়েছে বাবা-মা ও পরিবারের আর্থিক ও ভৌত অসম বাস্তবতা। ফলে এ অসম বাস্তবতার ফলাফল তো অসম হতে বাধ্য। আমরা জানি, কোনো ধরনের প্রতিযোগিতার আগে সব প্রতিযোগীর জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়। আমাদের দুই রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে প্রায়ই আমরা লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড অর্থাৎ প্রতিযোগিতার ময়দানে সমতা রক্ষার দাবি উঠতে দেখি। অসম বাস্তবতার এ পাবলিক পরীক্ষা বস্তুত অন্যায় নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ক্যাডেট কলেজের একজন ছাত্রের জন্য সরকারের বার্ষিক ব্যয় প্রায় ৭৪ হাজার টাকা আর সরকারি হাইস্কুলের ছাত্রের জন্য সরকার ব্যয় করে দুই হাজার টাকা, বেসরকারি স্কুলে তা আরও কম। এই সামান্য তথ্যটি বিবেচনায় নিলে ক্যাডেট কলেজের জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রটির বিবেক কী বলবে? তার ফলাফল নিশ্চয় গৌরবের, কিন্তু যে বৈষম্যের ভিত্তির ওপর এ গৌরব রচিত হয়েছে তা কি লজ্জাজনক নয়? ক্যাডেট কলেজগুলোতে এবং ভিকারুন নিসা বা ইস্পাহানীর মতো ‘সবল’ স্কুলগুলোতে প্রতি শ্রেণীতে ক্রমান্বয়ে স্ক্রিনিং করেই কেবল সুস্থ মানুষদের অর্থাৎ ‘সবল ছাত্রদের’ সেবা দেওয়া হয়। স্কুলের জন্য এটা কতটা গৌরবের আর কতটা লজ্জার তা কি একবার ভাবব না?
‘সবার জন্য শিক্ষা’ স্লোগানটি বেশ পুরোনো, কিন্তু বারবার সময় পিছিয়েও তা অধরাই থেকে গেছে। বর্তমানে স্লোগানটি ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে ‘সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা’ হয়েছে। মানের তারতম্য কতটা তা স্কুলগুলোর সুযোগ-সুবিধা, স্কুলভিত্তিক ছাত্রপিছু বার্ষিক সরকারি বরাদ্দ এবং সর্বোপরি এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে পরিষ্কার বোঝা যায়। সুযোগ-সুবিধার অসমতা, বরাদ্দের অসাম্য, ফলাফলের বৈষম্য এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থার বৈষম্য এর মূলে কাজ করছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা আমরা রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারব না, এমনকি বর্তমান ধারার রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চলতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আশা করা যায় না। পরিবারের এ অসম বাস্তবতার কারণে সবার জন্য সমান সুযোগ তথা প্রতিযোগিতা ও পরীক্ষার জন্য লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড তৈরির দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে। তবে সরকার সে দায়িত্ব নিতে এবং পালন করতে পারবে যদি সমাজের সচেতন অংশ থেকে এ ব্যাপারে চাপ তৈরি হয়। সমাজের সচেতন মানুষেরা যদি নিজেরাই এই অসম ব্যবস্থার বিষম ফল নিয়ে মেতে ওঠে তবে সরকার বাস্তবতার পরিবর্তনে কাজ করার প্রণোদনাও পাবে না, চাপও অনুভব করবে না।
এখানে আবারও মনে করিয়ে দিতে চাইব যে, এসএসসি ও এইচএসসি বাস্তবেই আধুনিক মানবজীবনের প্রবেশিকা পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবেই জীবনের মূল পর্বে প্রবেশ করা যাবে, যেখানে প্রতিটি মানুষকে জীবনযাপনের সূত্রে নানা রকমের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। সেসব পরীক্ষায় পাস করার ওপর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাফল্য নির্ভর করে। এখন দেখা যাচ্ছে, কিশোর বয়সী ছাত্র সফল, বড় হয়ে পেশাগত বা বস্তুগত মানদণ্ডে ব্যক্তি হিসেবে তার সাফল্যও কম নয়, কিন্তু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র কেবলই ব্যর্থ হচ্ছে, অবক্ষয় ঠেকানো যাচ্ছে না। দুর্নীতি, অপরাধ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে, এমনকি বিভিন্ন পেশাগত দায়িত্বেও দেখা যাচ্ছে, মানের অবনতি ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রেই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে মানের লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে শিক্ষকের মানের অধোগতি বুঝতে অসুবিধা হয় না। স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের মান নেমে গেছে, শিক্ষকতার মান নেমেছে। এই যদি বাস্তবতা হয় তাহলে শিক্ষায় অগ্রগতি কীভাবে ঘটবে? পরিসংখ্যানে সংখ্যাগত যে উন্নয়ন আমরা দেখি তাতে শিক্ষার ব্যবহারিক ও আদর্শিক মান যাচাই হয় না সব সময়। এসব বিষয়ে অসচেতন থেকে সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিছক একটি বুলিতেই পরিণত হবে।
এ অবস্থায় আমাদের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত? বর্তমান এ অসাম্যের বাস্তবতায় গা না ভাসিয়ে সমতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে। এখনই আমরা সব স্কুলকে একই মানে আনতে পারব না। প্রথম ধাপটি হবে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা। এ জন্য ভবন, মানে ও সংখ্যায় শিক্ষক এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পরিকল্পিতভাবে আদর্শ অবস্থায় নিতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগগুলোকেও ন্যূনতম একই চাহিদা পূরণ করতে হবে।
প্রাক-প্রাথমিকসহ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকছে নয়টি শ্রেণী। এ ধরনের একটি আদর্শ স্কুলে শ্রেণীপ্রতি কত ছাত্র, স্কুলের সর্বমোট কত ছাত্র, ৩০ জন ছাত্রপিছু একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকমণ্ডলী, মেধাবী তরুণদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার মতো বেতন-ভাতা, গ্রন্থাগার, উন্নত ও সুমুদ্রিত পাঠ্যবই, বিজ্ঞানকিট, মাঠ (কয়েকটি স্কুল মিলে হতে পারে), দারোয়ান-মালি-আয়াসহ সহযোগী কর্মী ইত্যাদি এবং ক্লাসসংখ্যা, পরীক্ষা, সহশিক্ষা কার্যক্রমসহ বছরের একটি কর্মপরিকল্পনার ছক শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া থাকবে। এভাবে সরকারও স্কুল চালাবে আর বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও ন্যূনতম এ শর্তগুলো পূরণ করতে হবে।
এভাবেই হয়তো আমরা শিক্ষার এক নতুন যুগে পদার্পণ করতে পারব।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments