১৯৭২-এর মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়া কেন প্রয়োজন by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
বাংলাদেশের মানুষের যথেষ্ট নৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে এবং জাতিকে আশ্বাস দিয়েছে যে রাষ্ট্র কীভাবে আবার মূল সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হতে পারে এবং সে ব্যাপারে কাজ চলছে। এতে আমরা সবাই আশান্বিত হয়েছি এবং আমাদের ভাবার সময় এসেছে যে যেসব কারণ এবং যুক্তির ওপর ভিত্তির ওপর নির্ভর করে আমরা ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাচ্ছি, সেসব কারণ ও যুক্তি জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে। মোট কথা, ক্ষমতাসীন দল এবং আপামর সিভিল সমাজের ওপর আজ এই দায়িত্ব বর্তায় যে তারা যেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বিভিন্ন ফোরামের মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের কথা দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরে। এই কাজটি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে এ কারণে যে ১৯৭২-এর বিরোধীরা ইতিমধ্যে তাদের সেই পুরোনো খেলায় মেতে উঠেছে। দেশে ইসলামের অবস্থান কী হবে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ থাকবে কি থাকবে না ইত্যাদি বিষয়ে এই শ্রেণীর দল ও ব্যক্তি যে বড় ক্ষতি সাধন করতে পারে এবং আমাদের আবার অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে, সেই বিষয়ে বোধকরি আমাদের কারোর কোনো সন্দেহ নেই।
আমরা কেন ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে চাই? এই প্রশ্নের উত্তর একটিই এবং অতি সহজ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা সবাই সংগ্রাম করেছি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে হলে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। জাতির জন্য এটা অত্যন্ত পীড়াদায়ক ব্যাপার যে সেই ১৯৭০-এর দশকের গোড়াতেই আমরা ১৯৭২-এর সংবিধানের মূল চেতনার ওপর আঘাত এনেছিলাম। সংবিধানের লক্ষ্য ছিল দেশে পুরোপুরিভাবে একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের প্রথম সাড়ে তিন বছর অতিবাহিত হয়। হ্যাঁ, দেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি স্থানে পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি জাতি স্বাধীন হলে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, সেই ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদের বাঙালিদের জীবনে আমরা অর্জন করেছি। কিন্তু আমাদের আনন্দের এবং আশার বিষয় ছিল যে আমরা এসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দেশে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছিলাম ১৯৭২-এর সংবিধানের দ্বারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সঙ্গে যাঁরা এই সংবিধান রচনা করেন এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা যে এই সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করেন, তাতে করে আমাদের রাজনীতি পূর্ণতা লাভ করেছিল। আজ এতগুলো বছর পার হয়ে যাওয়ার পর আমাদের সবার মনে কেবল একটাই প্রশ্ন—আমরা কোথায় ভুল করেছিলাম? ভুল যে আমরা করেছিলাম সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভুল না করলে কি আজ যে নতুন সংগ্রামে আমরা জাতিগতভাবে লিপ্ত, সেই সংগ্রামের প্রয়োজন হতো? এবং সর্বপ্রথম যে ভুলটা আমরা করেছি সেটা ছিল সংবিধানে ১৯৭৫ সালের গোড়াতে চতুর্থ সংশোধনী নিয়ে আসা। আমরা যতভাবেই আজ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করি না কেন, তখনকার পরিস্থিতিতে ওই পদক্ষেপের খুবই প্রয়োজন ছিল কি? এই সত্য কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে ওই চতুর্থ সংশোধনী ১৯৭২-এর সংবিধানের ওপর একটি অতর্কিত আঘাত ছিল এবং সেই আঘাতের সদ্ব্যবহার করেছেন ওই সব সামরিক ও বেসামরিক শাসক, যাঁরা বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছেন সেই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে। জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ সংশোধনীর দিকে অগ্রসর না হলে আমাদের সবারই মঙ্গল হতো।
সংবিধানের পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সবারই জানা আছে। সেই ইতিহাস আবার তুলে ধরার খুব একটা প্রয়োজন নেই। তবে আমাদের এই সত্যটি মনে রাখতে হবে যে যদিও চতুর্থ সংশোধনী একটি ভুল পদক্ষেপ ছিল, তার পর যে আক্রমণগুলো সংবিধানের ওপর করা হয়েছে সেগুলো ছিল আমাদের মূল চেতনার ওপর সরাসরি আঘাত। আজ জেনারেল জিয়াউর রহমানের পক্ষের লোকেরা তাঁর সমর্থনে অনেক কথাই বলে থাকেন, যে কথার কোনো অর্থ হয় না। এবং হয় না এ কারণে যে সামরিক শাসকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তিনিই সর্বপ্রথম মূল সংবিধানের চেতনার ওপর আঘাত করেন। এই কাজটি তাঁর এখতিয়ারের বাইরে ছিল। তিনি যেভাবে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে কলমের খোঁচায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন, তা ছিল গর্হিত অপরাধ এবং রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। আমাদের বাংলাদেশের সমাজ যদি সভ্য সমাজ হতো, সচেতন সমাজ হতো, তাহলে এই সংবিধানবিরোধী কাজের জন্য জিয়া এবং ওই সব রাজনীতিবিদ যাঁরা তাঁর এই কার্যকলাপগুলো সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাত। আমাদের সবাইকে লজ্জিত হতে হয় যখন শুনি যে এখনো একশ্রেণীর রাজনীতিক দেশে আছেন, যাঁরা পঞ্চম সংশোধনীর পক্ষে কথা বলেন। যেখানে তাঁদের অনুতপ্ত হওয়ার কথা সেই সংশোধনী সমর্থন করার জন্য সেখানে তাঁরা সেই অগণতান্ত্রিক কাজটির পক্ষে এখনো বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
সংবিধানবিরোধী কাজ শুধু জিয়াই করেননি। আমাদের ভুলতে অসুবিধা হয় যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কত সহজভাবে গোটা জাতির ওপর ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বলে চাপিয়ে দিলেন। যে দেশের মানুষ বেশির ভাগই মুসলমান এবং যুগ যুগ ধরে ইসলামী বিধান পালন করে এসেছে, সেই মানুষকে এরশাদ তাঁর সংকীর্ণ স্বার্থে বলার চেষ্টা করলেন রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম থাকলে তাঁরা আরও ভালো মুসলমান হবেন। এর ফলে যা হয়েছে তা ১৯৭১ সালে আমাদের কাম্য ছিল না। যদি আপনি একযোগে জিয়া, এরশাদ ও বাংলাদেশ জাতীয়দাবাদী দলের রাজনীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন, তাহলে আপনার বুঝতে কোনো অসুবিধা হবে না যে এই সব কিছুর মূলে ছিল বাংলাদেশকে এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা, যে রাষ্ট্রে কেবল মুসলমান সম্প্রদায়ই প্রাধান্য লাভ করবে। ওই যে তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিষয়টি রয়েছে, সেটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই ১৯৪০-এর মুসলিম লীগ প্রবর্তিত দ্বিজাতির তত্ত্বের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। যে ১৯৭২-এর সংবিধানে আমরা যথার্থ কারণেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরেছিলাম, সেই সত্যের বিরুদ্ধে একটি বড় মিথ্যা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের দুঃখ একটাই—আমরা বাঙালি ১৯৭১-এ পাকিস্তান এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছি। কিন্তু এত বিশাল একটি বিজয় আমাদের হাতছাড়া হলো এবং এই বাংলাদেশটাকে একটি ছোট পাকিস্তানে পরিণত করা হলো। জিয়া-এরশাদ-বেগম জিয়া অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে থাকেন। তাঁদের অথবা তাঁদের সমর্থকদের কি একবারও মনে থাকে না সেই ‘জয়বাংলা’র কথা? দেশটা যে সব বাঙালির জন্য এবং এই দেশে যে সব সম্প্রদায়ের মানুষ, সব গোত্রের মানুষ বসবাস করে—এই কথা তাঁদের মেনে নিতে এত কষ্ট কেন হয়?
১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের ইতিহাসকে পুনরায় ফিরে পাওয়া। কেবল ১৯৭২-এর মূল সংবিধানের মধ্য দিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনর্জাগ্রত করতে পারব, আমাদের মনের মধ্যে আমাদের প্রাণের গভীরে। এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে আমাদের শেকড়ে ফিরে যাওয়া এবং সেটা সম্ভব ওই ১৯৭২-এর সংবিধানকে পুনর্বহালের মধ্য দিয়েই। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে উল্লেখ করা দরকার। ১৯৭২-এর সংবিধানে এই দেশে যেসব অবাঙালি জাতি ও গোত্র বসবাস করে—যেমন চাকমা, ম্রো, মারমা, সাঁওতাল ইত্যাদি; তাদের কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেই ভুলটি সংশোধন করা আমাদের সবার দায়িত্ব—আদিবাসী জনগণ তাদের সংস্কৃতি, তাদের ভাষা, তাদের ঐতিহ্য তাদের নিজ আবাসভূমিতে সাংবিধানিকভাবে বজায় রাখবে, তুলে ধরবে—এই বিষয়টি সংবিধানে নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, আমরা যেন বাঙালির চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলতে গিয়ে আদিবাসী জনগণকে আবার অবহেলা না করি, আবার ভুলে না যাই।
ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে হবে। ১৯৭২-এর মূল সংবিধান সেই ইতিহাসের কথাই বলে।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
আমরা কেন ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে চাই? এই প্রশ্নের উত্তর একটিই এবং অতি সহজ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা সবাই সংগ্রাম করেছি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে হলে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। জাতির জন্য এটা অত্যন্ত পীড়াদায়ক ব্যাপার যে সেই ১৯৭০-এর দশকের গোড়াতেই আমরা ১৯৭২-এর সংবিধানের মূল চেতনার ওপর আঘাত এনেছিলাম। সংবিধানের লক্ষ্য ছিল দেশে পুরোপুরিভাবে একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের প্রথম সাড়ে তিন বছর অতিবাহিত হয়। হ্যাঁ, দেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি স্থানে পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি জাতি স্বাধীন হলে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, সেই ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদের বাঙালিদের জীবনে আমরা অর্জন করেছি। কিন্তু আমাদের আনন্দের এবং আশার বিষয় ছিল যে আমরা এসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দেশে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছিলাম ১৯৭২-এর সংবিধানের দ্বারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সঙ্গে যাঁরা এই সংবিধান রচনা করেন এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা যে এই সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করেন, তাতে করে আমাদের রাজনীতি পূর্ণতা লাভ করেছিল। আজ এতগুলো বছর পার হয়ে যাওয়ার পর আমাদের সবার মনে কেবল একটাই প্রশ্ন—আমরা কোথায় ভুল করেছিলাম? ভুল যে আমরা করেছিলাম সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভুল না করলে কি আজ যে নতুন সংগ্রামে আমরা জাতিগতভাবে লিপ্ত, সেই সংগ্রামের প্রয়োজন হতো? এবং সর্বপ্রথম যে ভুলটা আমরা করেছি সেটা ছিল সংবিধানে ১৯৭৫ সালের গোড়াতে চতুর্থ সংশোধনী নিয়ে আসা। আমরা যতভাবেই আজ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করি না কেন, তখনকার পরিস্থিতিতে ওই পদক্ষেপের খুবই প্রয়োজন ছিল কি? এই সত্য কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে ওই চতুর্থ সংশোধনী ১৯৭২-এর সংবিধানের ওপর একটি অতর্কিত আঘাত ছিল এবং সেই আঘাতের সদ্ব্যবহার করেছেন ওই সব সামরিক ও বেসামরিক শাসক, যাঁরা বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছেন সেই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে। জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ সংশোধনীর দিকে অগ্রসর না হলে আমাদের সবারই মঙ্গল হতো।
সংবিধানের পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সবারই জানা আছে। সেই ইতিহাস আবার তুলে ধরার খুব একটা প্রয়োজন নেই। তবে আমাদের এই সত্যটি মনে রাখতে হবে যে যদিও চতুর্থ সংশোধনী একটি ভুল পদক্ষেপ ছিল, তার পর যে আক্রমণগুলো সংবিধানের ওপর করা হয়েছে সেগুলো ছিল আমাদের মূল চেতনার ওপর সরাসরি আঘাত। আজ জেনারেল জিয়াউর রহমানের পক্ষের লোকেরা তাঁর সমর্থনে অনেক কথাই বলে থাকেন, যে কথার কোনো অর্থ হয় না। এবং হয় না এ কারণে যে সামরিক শাসকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তিনিই সর্বপ্রথম মূল সংবিধানের চেতনার ওপর আঘাত করেন। এই কাজটি তাঁর এখতিয়ারের বাইরে ছিল। তিনি যেভাবে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে কলমের খোঁচায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন, তা ছিল গর্হিত অপরাধ এবং রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। আমাদের বাংলাদেশের সমাজ যদি সভ্য সমাজ হতো, সচেতন সমাজ হতো, তাহলে এই সংবিধানবিরোধী কাজের জন্য জিয়া এবং ওই সব রাজনীতিবিদ যাঁরা তাঁর এই কার্যকলাপগুলো সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাত। আমাদের সবাইকে লজ্জিত হতে হয় যখন শুনি যে এখনো একশ্রেণীর রাজনীতিক দেশে আছেন, যাঁরা পঞ্চম সংশোধনীর পক্ষে কথা বলেন। যেখানে তাঁদের অনুতপ্ত হওয়ার কথা সেই সংশোধনী সমর্থন করার জন্য সেখানে তাঁরা সেই অগণতান্ত্রিক কাজটির পক্ষে এখনো বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
সংবিধানবিরোধী কাজ শুধু জিয়াই করেননি। আমাদের ভুলতে অসুবিধা হয় যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কত সহজভাবে গোটা জাতির ওপর ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বলে চাপিয়ে দিলেন। যে দেশের মানুষ বেশির ভাগই মুসলমান এবং যুগ যুগ ধরে ইসলামী বিধান পালন করে এসেছে, সেই মানুষকে এরশাদ তাঁর সংকীর্ণ স্বার্থে বলার চেষ্টা করলেন রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম থাকলে তাঁরা আরও ভালো মুসলমান হবেন। এর ফলে যা হয়েছে তা ১৯৭১ সালে আমাদের কাম্য ছিল না। যদি আপনি একযোগে জিয়া, এরশাদ ও বাংলাদেশ জাতীয়দাবাদী দলের রাজনীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন, তাহলে আপনার বুঝতে কোনো অসুবিধা হবে না যে এই সব কিছুর মূলে ছিল বাংলাদেশকে এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা, যে রাষ্ট্রে কেবল মুসলমান সম্প্রদায়ই প্রাধান্য লাভ করবে। ওই যে তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিষয়টি রয়েছে, সেটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই ১৯৪০-এর মুসলিম লীগ প্রবর্তিত দ্বিজাতির তত্ত্বের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। যে ১৯৭২-এর সংবিধানে আমরা যথার্থ কারণেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরেছিলাম, সেই সত্যের বিরুদ্ধে একটি বড় মিথ্যা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের দুঃখ একটাই—আমরা বাঙালি ১৯৭১-এ পাকিস্তান এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছি। কিন্তু এত বিশাল একটি বিজয় আমাদের হাতছাড়া হলো এবং এই বাংলাদেশটাকে একটি ছোট পাকিস্তানে পরিণত করা হলো। জিয়া-এরশাদ-বেগম জিয়া অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে থাকেন। তাঁদের অথবা তাঁদের সমর্থকদের কি একবারও মনে থাকে না সেই ‘জয়বাংলা’র কথা? দেশটা যে সব বাঙালির জন্য এবং এই দেশে যে সব সম্প্রদায়ের মানুষ, সব গোত্রের মানুষ বসবাস করে—এই কথা তাঁদের মেনে নিতে এত কষ্ট কেন হয়?
১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের ইতিহাসকে পুনরায় ফিরে পাওয়া। কেবল ১৯৭২-এর মূল সংবিধানের মধ্য দিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনর্জাগ্রত করতে পারব, আমাদের মনের মধ্যে আমাদের প্রাণের গভীরে। এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে আমাদের শেকড়ে ফিরে যাওয়া এবং সেটা সম্ভব ওই ১৯৭২-এর সংবিধানকে পুনর্বহালের মধ্য দিয়েই। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে উল্লেখ করা দরকার। ১৯৭২-এর সংবিধানে এই দেশে যেসব অবাঙালি জাতি ও গোত্র বসবাস করে—যেমন চাকমা, ম্রো, মারমা, সাঁওতাল ইত্যাদি; তাদের কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেই ভুলটি সংশোধন করা আমাদের সবার দায়িত্ব—আদিবাসী জনগণ তাদের সংস্কৃতি, তাদের ভাষা, তাদের ঐতিহ্য তাদের নিজ আবাসভূমিতে সাংবিধানিকভাবে বজায় রাখবে, তুলে ধরবে—এই বিষয়টি সংবিধানে নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, আমরা যেন বাঙালির চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলতে গিয়ে আদিবাসী জনগণকে আবার অবহেলা না করি, আবার ভুলে না যাই।
ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে হবে। ১৯৭২-এর মূল সংবিধান সেই ইতিহাসের কথাই বলে।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments