বৈশ্বিক উষ্ণায়ন -কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ও জলবায়ু: আমরা কী করব by আবেদ চৌধুরী

রসায়নের পুস্তক ও গবেষণাগারের গণ্ডি ছেড়ে কার্বন এখন এক বহুল প্রচলিত শব্দ। কারণ, জলবায়ুর পরিবর্তনে কার্বনসংশ্লিষ্ট যৌগ কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) গ্যাসের ভূমিকা। কার্বনসংক্রান্ত নিরন্তর আলোচনায় এ কথা মনে রাখা দরকার, কার্বনের নিজের নিঃসৃত হওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। যা নিঃসৃত হয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে, তা হলো কার্বন ও অক্সিজেনের সম্মিলনে গঠিত গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড। নির্ভেজাল কার্বন (C) কখনো কয়লা কিংবা দ্যুতিময় হীরা। কয়লা যখন পোড়ানো হয় কিংবা জ্বালানো হয় জীবাশ্ম জ্বালানি, তখন কার্বনের সঙ্গে অক্সিজেন যুক্ত হয়ে তৈরি হয় অতিবিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড কিংবা পরিবেশের জন্য দূষণকারী গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড। সাধারণত কোমল পানীয়তে যা বুদ্বুদে ভরে দেয়, তা হলো কার্বন ডাই-অক্সাইড।
পরিবেশ উষ্ণকারী গ্যাস কিন্তু শুধু কার্বন ডাই-অক্সাইড নয়, আরও দুটো গ্যাস আছে মিথেন (CH4) কিংবা নাইট্রাস অক্সাইড (N2O)। এই উষ্ণকরণে তারা ভূমিকা রাখছে। কিন্তু যেহেতু মূল ভূমিকায় আছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, তাই কার্বন নিয়ে এত কথাবার্তা। মূলত এই তিনটি গ্যাসকে বলা হয়ে থাকে গ্রিনহাউস গ্যাস বা GHG। বিশ্ব উষ্ণকরণের পরিভাষা হিসেবে আলোচনায় তাই কার্বন নিঃসরণের কথা না বলে গ্রিনহাউস গ্যাস বা GHG-র কথা বলাই অধিকতর সংগত।
গ্রিনহাউসের সঙ্গে কিন্তু বিশ্বব্যাপী পরিবেশ আন্দোলন গ্রিন মুভমেন্ট বা গ্রিন আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। শীতকালে প্রবল শৈত্যে যখন তাপমাত্রা গাছ, ফুল বা শাকসবজির বেড়ে ওঠার জন্য অনুকূল নয়, তখন কাচের ঢাকনা দিয়ে যে ঘর তৈরি হয়, সে ঘরকে বলা হয় গ্রিনহাউস। গ্রিনহাউসের কাচ কিংবা পরিষ্কার প্লাস্টিক ভেদ করে আলো এসে গ্রিনহাউসের ভেতরের স্থানকে করে তোলে উষ্ণ। এর কারণ হলো, সূর্যের আলোয় সৃষ্ট উষ্ণতা কাচ ভেদ করে চলে যেতে পারে না, উষ্ণতা গ্রিনহাউসের ঘেরে আটকা পড়ে। পৃথিবীর উষ্ণ হয়ে যাওয়া বর্ণনা করতে গিয়ে এই গ্রিনহাউসের গরম হয়ে থাকার ব্যাপারটি রূপক হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
কিন্তু পৃথিবীকে উষ্ণ করে রাখার জন্য মহাশূন্যে কোনো কাচের স্বচ্ছ ঢাকনা নেই, যা আছে তা হলো এমন সব গ্যাসের ক্ষীণ আস্তরণ, যা সূর্যরশ্মিকে পৃথিবীতে আসতে দেয়, কিন্তু রশ্মির কারণে পৃথিবী তেতে যখন আবার এই উষ্ণতাকে মহাশূন্যের দিকে পাঠায়, তখন এই গ্যাসগুলো সেই উষ্ণতাকে তাদের শরীরে আটকে রাখে। ঠিক যেমন রাখে গ্রিনহাউসের কাচ।
এই গ্যাসগুলোর কারণে পৃথিবীতে জীবন সম্ভব হয়েছে। ১৮২৯ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী জোসেফ ফুরিয়ারের মাথায় এ ধারণা আসে। গ্যাসের বায়বীয় পরিমণ্ডলের বাইরে তাপমাত্রা -১৯০C আর ভূপৃষ্ঠে ১৪.৪০C। কোনো গ্রিনহাইজ গ্যাস যদি না থাকত, তাহলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা হতো -১৯০C, কোনো জীবনই তাহলে সম্ভব হতো না। ভূপৃষ্ঠ ও বায়বীয় পরিমণ্ডলের বাইরে তাপমাত্রার এই তফাতটা বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছিল উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। মনে হচ্ছে, পৃথিবী যেন লেপ মুড়ি দিয়ে আছে, কিন্তু সেই বায়বীয় লেপটি কী? ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন টিন্ডাল বিভিন্ন গ্যাসের ওপর আলোর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছিলেন। টিন্ডাল দেখতে পেলেন, সূর্যরশ্মিকে কার্বন ডাই-অক্সাইড বা কয়লা গ্যাস (কয়লা পোড়ালে নির্গত হয় বলে এমন নাম) আটকায় না, কিন্তু তাপ যা ইনফ্রারেড রশ্মির মাধ্যমে সঞ্চালিত হয়, তা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসে আটকা পড়ে। বস্তুত টিন্ডালের এই গবেষণাই দেখিয়ে দেয় যে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতার মূল কারণ কী। আর দুটো গ্যাস অক্সিজেন কিংবা নাইট্রোজেন উষ্ণতাকে আটকাতে পারে না, তাই পৃথিবীকে উষ্ণ রাখতে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।
বিশ্বব্যাপী এখন ভয়ের পাগলাঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড। তার মধ্যে প্রধান কার্বন ডাই-অক্সাইড। বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণে এই গ্যাস বাড়ছে। পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে নিঃসন্দেহে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমাতে হবে। কিন্তু বাড়ছে আরও দুটো গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড। শেষ দুটোর নিঃসরণের কারণ মূলত কৃষি। তাই তাদের নিঃসরণ কমাতে হলে বিশ্বব্যাপী কৃষিকে বদলাতে হবে।
আবহাওয়া থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড কীভাবে কমানো যায়? নিঃসন্দেহে কমাতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন পেট্রলের ব্যবহার। পৃথিবীর গর্ভ থেকে সব জ্বালানি বের করে এনে তাদের পুড়িয়ে লাখো-কোটি গাড়ি চালানোর যে জীবনব্যবস্থা আমরা পৃথিবীর মানুষ তৈরি করেছি, সেই অত্যাধুনিক গাড়িতে গাড়িময় পৃথিবী আমাদের জন্য হয়ে গেছে মরণফাঁদ। যেহেতু পৃথিবীর ধনী দেশগুলো সবচেয়ে বেশি গাড়ি চালাচ্ছে, সেহেতু তাদের কলকারখানা নিঃসরণ করছে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড। তাই তারাই মূলত এ সমস্যার জন্য দায়ী।
এর সমাধানের জন্য এগিয়ে আসতে হবে বিজ্ঞানকে। বৃক্ষবিজ্ঞান (Plant Science) এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। ভূমিকা রাখবে নতুন ধরনের কৃষি। এই সমাধানে, হোক তা অভিযোজন কিংবা মিটিগেশন। এতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
যদিও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে, তবুও এর সমাধানের বিজ্ঞানে যোগদানে চিন্তা ও মেধা নিয়ে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।
আবেদ চৌধুরী: জিনবিজ্ঞানী।
kanihati@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.