বাংলাদেশকে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে- জলবায়ু রাজনীতি by আহমেদ স্বপন মাহমুদজ
জলবায়ু পরিবর্তন যেহেতু এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা, তা সমাধান বা মোকাবিলার জন্যও প্রয়োজন যথেষ্ট প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা। সদিচ্ছার অভাব ও রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞার অভাব লক্ষণীয়। এর পেছনে ধনী দেশগুলোর খামখেয়ালিপনা, বহুজাতিক কোম্পানির মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের লোভ আর মুক্তবাজার অর্থনীতি ও পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়নব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। কলকারখানা, যানবাহনসহ সব ধরনের জ্বালানিনির্ভর যন্ত্র থেকে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস নিঃসরিত হচ্ছে। এসব গ্যাস পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে বন উজাড় হয়ে যাওয়ার ফলে পরিবেশও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। কারখানাজাত কৃষি ও শিল্পায়ন থেকে নিঃসরিত মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণও বেড়ে গেছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী। উত্তরের উন্নত দেশগুলো একসময় দক্ষিণের সম্পদ ও মানুষকে ব্যবহার করে ধনী হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর এই শোষণ, সম্পদ লুণ্ঠন, জ্বালানি সম্পদের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মূল কারণ। কেননা গত দুই দশকে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, উত্পাদনব্যবস্থার পরিবর্তন এবং উন্নত দেশগুলোর জনগণের জীবনযাত্রার মান এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গোটা দুনিয়ায় ভোগবাদের সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে মানবজাতির বিরাট অংশ ক্ষুধা, দারিদ্র্য তথা মানবেতর জীবনযাপন করছে।
গত ৫০ বছরে তাপমাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ। আগামী দশকে এই তাপমাত্রা আরও বাড়বে। পৃথিবীর জলবায়ুতে ছয় লাখ ৫০ হাজার বছর আগে যে তাপমাত্রা ছিল, এখন তা অনেক গুণ বেশি। ১৯৯০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধি পেয়েছে ৭০ ভাগ। জলবায়ু পরিবর্তন এমন একটি সমস্যা, যেখানে একজন ব্যক্তি বা একক রাষ্ট্রপ্রচেষ্টায় কিছু করা সম্ভব নয়। কাজেই দরিদ্র জনগোষ্ঠী যে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে, তা নিরসনে বৈশ্বিক পদক্ষেপ ও দায়দায়িত্ব নিতে হবে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ২০১২ সালের পরের অবস্থা আরও সংকটময় হয়ে উঠবে। উন্নত দেশগুলো জাতিসংঘের ইউএনএফসিসিসির সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমাতে ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে আগ্রহ কম দেখাচ্ছে। বরং উন্নত দেশগুলো একটি নতুন চুক্তি করতে চায়, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোও কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমাতে বাধ্য থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনে কার্বন বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত সুবিধা মুনাফা তৈরি ও মূলত দরিদ্র্য দেশগুলোকে উন্নত দেশের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে।
উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষ করে ছোট দ্বীপদেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এসব জাতি-রাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পৃথিবীর জনসংখ্যার বড় একটা অংশ প্রাকৃতিক সম্পদ, জলবায়ু এবং সর্বোপরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার সনদ ‘কিয়োটো প্রটোকলে’ দরিদ্র ও ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর কথা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। এই সনদে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিকর প্রভাব, জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। এতে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব এবং সম্পদের ওপর মানুষের অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। বরং জ্বালানি সম্পদের বাজারজাতকরণ এবং সরবরাহের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী বা যাদের দায়দায়িত্ব রয়েছে, সে বিষয়টি অবহেলিত হয়েছে। কার্বন-বাণিজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর আগ্রাসন বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে কার্বন নির্গমনের ক্ষেত্র প্রসারিত করা হয়েছে। উন্নত দেশগুলো সহযোগিতার নামে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের ব্যবসা প্রসারের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।
বিশ্বের প্রতি ৪৫ জনের মধ্যে একজন এবং বাংলাদেশের প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হবে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৫ শতাংশের বাস এখানে। আমাদের কার্বন নির্গমনের হার দশমিক ২, সেখানে ১৯৯০ থেকে ২০০৬ সালে শুধু আমেরিকার কার্বন নির্গমন বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭ ভাগ। কার্বন নির্গমনে আমাদের অবদান খুবই নগণ্য, অথচ আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। সমুদ্রের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। সবচেয়ে কম পরিমাণে কার্বন নির্গমনকারী, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিত সমঝোতার ক্ষেত্রে দৃঢ় ও শক্ত অবস্থানে থাকা। প্রয়োজন রাজনৈতিক দৃঢ়তা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও আলোচনার সামর্থ্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সভায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণে নানা ধরনের বক্তব্য ও তহবিল গঠনের দাবি জানাচ্ছেন। এ পদক্ষেপ ইতিবাচক নিঃসন্দেহে, কিন্তু বৃহত্তর উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য ছাড়া লক্ষ্য অর্জন দুরূহ। আন্তর্জাতিক সমঝোতার ক্ষেত্রে দরকষাকষির দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে অভ্যন্তরীণ মতৈক্যও দরকার। অনেক সময়, যেসব বিশেষজ্ঞজন বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেন না নিজেদের মধ্যে। বরং নিজেদের মতানৈক্য দাবিদাওয়াকে দুর্বল করে দেয়। আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, যেসব দাবিদাওয়া তুলে ধরা হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, সেগুলো দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের জনগণের সঙ্গে সব সময় আলোচনা করা হয় না। উল্লেখ্য, জলবায়ু ইস্যুতে রাজনৈতিক মতপার্থক্য, এমনকি নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের বিরোধ নেই। ফলে এমন জাতীয় একটি ইস্যুতে প্রয়োজন আরও বেশি মনোযোগ ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি।
বাংলাদেশকে অভিযোজন (অ্যাডাপটেশন) ও কার্বন নিরসনের (মিটিগেশন) জন্য তহবিল গঠনের দাবির পাশাপাশি উন্নত দেশগুলো যাতে কার্বন নির্গমন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির নিচে রাখে, সে বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। কার্বন-বাণিজ্য ও প্রযুক্তি হস্তান্তর (টেকনোলজি ট্রান্সফার) উপযোগী প্রযুক্তি গ্রহণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থপ্রতিষ্ঠানগুলোর (বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্প ও ভূমিকার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
সম্প্রতি মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের নিয়ে সমুদ্রের পাঁচ মিটার পানির নিচে উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের প্রতিবাদ হিসেবে বৈঠক করেছেন। ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় উত্তরের দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ১৭ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় এভারেস্টে নেপালের প্রায় ২৪ জন মন্ত্রীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নেপালকন্যা হিমালয়ের বরফ আশঙ্কাজনক হারে গলছে। এর ফলে নেপালের জনগোষ্ঠী ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে পড়বে। এর প্রভাব কেবল নেপালে পড়বে তা নয়, এর ফলে এশিয়ার বড় একটা অংশ শুষ্ক হয়ে পড়বে। বলিভিয়াসহ লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ পরিষ্কার রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে নিজস্ব কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের কেবল দাবি উত্থাপন নয়, এমন কর্মসূচি গ্রহণ আবশ্যক, যা সারা দুনিয়ায় প্রভাব ফেলতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কৌশল অপরিহার্য।
বাংলাদেশের দাবির মুখে ‘মাল্টি ডোনার ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এর তদারকের জন্য বিশ্বব্যাংককে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেই কদু সেই লাউয়ের অবস্থা। বিশ্বব্যাংককে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী মনে করা হয় (ক্লাইমেট ক্রিমিনাল), অথচ তহবিল ব্যবস্থাপনা তার দায়িত্বে। কিন্তু ট্রাস্ট ফান্ডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশের নিজস্ব রীতিনীতি ও দেশীয় মালিকানাকে অবজ্ঞার শামিল। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে এ ধরনের তহবিল পরিচালনায় রাষ্ট্রের ভূমিকা আরও জোরালো হওয়া অত্যন্ত জরুরি। না হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের নামে টাকা আসবে, টাকা ব্যয় হবে, কেউ কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হবে; কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যারা প্রকৃতপক্ষে ভুক্তভোগী, তাদের কোনো উপকারে আসবে না। সমতা ও ন্যায়বিচারের দাবিতে বিষয়টি সরকারি এমনকি বেসরকারি মনোযোগেরও দাবি রাখে।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: আহ্বায়ক, ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন অন ক্লাইমেট রিফিউজিস রাইটস।
গত ৫০ বছরে তাপমাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ। আগামী দশকে এই তাপমাত্রা আরও বাড়বে। পৃথিবীর জলবায়ুতে ছয় লাখ ৫০ হাজার বছর আগে যে তাপমাত্রা ছিল, এখন তা অনেক গুণ বেশি। ১৯৯০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধি পেয়েছে ৭০ ভাগ। জলবায়ু পরিবর্তন এমন একটি সমস্যা, যেখানে একজন ব্যক্তি বা একক রাষ্ট্রপ্রচেষ্টায় কিছু করা সম্ভব নয়। কাজেই দরিদ্র জনগোষ্ঠী যে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে, তা নিরসনে বৈশ্বিক পদক্ষেপ ও দায়দায়িত্ব নিতে হবে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ২০১২ সালের পরের অবস্থা আরও সংকটময় হয়ে উঠবে। উন্নত দেশগুলো জাতিসংঘের ইউএনএফসিসিসির সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমাতে ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে আগ্রহ কম দেখাচ্ছে। বরং উন্নত দেশগুলো একটি নতুন চুক্তি করতে চায়, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোও কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমাতে বাধ্য থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনে কার্বন বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত সুবিধা মুনাফা তৈরি ও মূলত দরিদ্র্য দেশগুলোকে উন্নত দেশের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে।
উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষ করে ছোট দ্বীপদেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এসব জাতি-রাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পৃথিবীর জনসংখ্যার বড় একটা অংশ প্রাকৃতিক সম্পদ, জলবায়ু এবং সর্বোপরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার সনদ ‘কিয়োটো প্রটোকলে’ দরিদ্র ও ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর কথা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। এই সনদে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিকর প্রভাব, জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। এতে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব এবং সম্পদের ওপর মানুষের অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। বরং জ্বালানি সম্পদের বাজারজাতকরণ এবং সরবরাহের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী বা যাদের দায়দায়িত্ব রয়েছে, সে বিষয়টি অবহেলিত হয়েছে। কার্বন-বাণিজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর আগ্রাসন বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে কার্বন নির্গমনের ক্ষেত্র প্রসারিত করা হয়েছে। উন্নত দেশগুলো সহযোগিতার নামে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের ব্যবসা প্রসারের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।
বিশ্বের প্রতি ৪৫ জনের মধ্যে একজন এবং বাংলাদেশের প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হবে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৫ শতাংশের বাস এখানে। আমাদের কার্বন নির্গমনের হার দশমিক ২, সেখানে ১৯৯০ থেকে ২০০৬ সালে শুধু আমেরিকার কার্বন নির্গমন বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭ ভাগ। কার্বন নির্গমনে আমাদের অবদান খুবই নগণ্য, অথচ আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। সমুদ্রের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। সবচেয়ে কম পরিমাণে কার্বন নির্গমনকারী, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিত সমঝোতার ক্ষেত্রে দৃঢ় ও শক্ত অবস্থানে থাকা। প্রয়োজন রাজনৈতিক দৃঢ়তা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও আলোচনার সামর্থ্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সভায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণে নানা ধরনের বক্তব্য ও তহবিল গঠনের দাবি জানাচ্ছেন। এ পদক্ষেপ ইতিবাচক নিঃসন্দেহে, কিন্তু বৃহত্তর উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য ছাড়া লক্ষ্য অর্জন দুরূহ। আন্তর্জাতিক সমঝোতার ক্ষেত্রে দরকষাকষির দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে অভ্যন্তরীণ মতৈক্যও দরকার। অনেক সময়, যেসব বিশেষজ্ঞজন বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেন না নিজেদের মধ্যে। বরং নিজেদের মতানৈক্য দাবিদাওয়াকে দুর্বল করে দেয়। আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, যেসব দাবিদাওয়া তুলে ধরা হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, সেগুলো দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের জনগণের সঙ্গে সব সময় আলোচনা করা হয় না। উল্লেখ্য, জলবায়ু ইস্যুতে রাজনৈতিক মতপার্থক্য, এমনকি নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের বিরোধ নেই। ফলে এমন জাতীয় একটি ইস্যুতে প্রয়োজন আরও বেশি মনোযোগ ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি।
বাংলাদেশকে অভিযোজন (অ্যাডাপটেশন) ও কার্বন নিরসনের (মিটিগেশন) জন্য তহবিল গঠনের দাবির পাশাপাশি উন্নত দেশগুলো যাতে কার্বন নির্গমন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির নিচে রাখে, সে বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। কার্বন-বাণিজ্য ও প্রযুক্তি হস্তান্তর (টেকনোলজি ট্রান্সফার) উপযোগী প্রযুক্তি গ্রহণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থপ্রতিষ্ঠানগুলোর (বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্প ও ভূমিকার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
সম্প্রতি মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের নিয়ে সমুদ্রের পাঁচ মিটার পানির নিচে উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের প্রতিবাদ হিসেবে বৈঠক করেছেন। ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় উত্তরের দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ১৭ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় এভারেস্টে নেপালের প্রায় ২৪ জন মন্ত্রীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নেপালকন্যা হিমালয়ের বরফ আশঙ্কাজনক হারে গলছে। এর ফলে নেপালের জনগোষ্ঠী ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে পড়বে। এর প্রভাব কেবল নেপালে পড়বে তা নয়, এর ফলে এশিয়ার বড় একটা অংশ শুষ্ক হয়ে পড়বে। বলিভিয়াসহ লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ পরিষ্কার রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে নিজস্ব কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের কেবল দাবি উত্থাপন নয়, এমন কর্মসূচি গ্রহণ আবশ্যক, যা সারা দুনিয়ায় প্রভাব ফেলতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কৌশল অপরিহার্য।
বাংলাদেশের দাবির মুখে ‘মাল্টি ডোনার ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এর তদারকের জন্য বিশ্বব্যাংককে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেই কদু সেই লাউয়ের অবস্থা। বিশ্বব্যাংককে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী মনে করা হয় (ক্লাইমেট ক্রিমিনাল), অথচ তহবিল ব্যবস্থাপনা তার দায়িত্বে। কিন্তু ট্রাস্ট ফান্ডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশের নিজস্ব রীতিনীতি ও দেশীয় মালিকানাকে অবজ্ঞার শামিল। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে এ ধরনের তহবিল পরিচালনায় রাষ্ট্রের ভূমিকা আরও জোরালো হওয়া অত্যন্ত জরুরি। না হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের নামে টাকা আসবে, টাকা ব্যয় হবে, কেউ কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হবে; কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যারা প্রকৃতপক্ষে ভুক্তভোগী, তাদের কোনো উপকারে আসবে না। সমতা ও ন্যায়বিচারের দাবিতে বিষয়টি সরকারি এমনকি বেসরকারি মনোযোগেরও দাবি রাখে।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: আহ্বায়ক, ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন অন ক্লাইমেট রিফিউজিস রাইটস।
No comments