টিভি: বিনোদন ও পাবলিক সার্ভিসের মধ্যে সমন্বয় by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
সরকার কোনো নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই নতুন ১০টি টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দিয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। যেমনটি করেছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার। এটা আমাদের দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সরকার তথা প্রশাসনের আরও নানা ক্ষেত্রে আমরা বিএনপির সরকারের সমালোচিত পদক্ষেপগুলো বর্তমান সরকারের আমলেও দেখতে পাচ্ছি। অনেকে মনে করেন, বিএনপি খুব খারাপ দল আর আওয়ামী লীগ ভালো। তারা সরকারের কার্যক্রমে এসব অভিন্ন উপাদান দেখতে পায় না। আসলে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বড় দুটি দল একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। রাজনীতিসচেতন মহল যত শিগগির এটা উপলব্ধি করতে পারবে, ততই দেশের মঙ্গল। সরকারি প্রশাসন পরিচালনায় নীতি-নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সুশাসন সোনার হরিণ হয়েই থাকবে।
নতুন ১০টি টিভি চ্যানেলের অনুমোদনে সরকারের একচোখা নীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালিত টেলিভিশন ও বেতারের স্বায়ত্তশাসন প্রদানে নীরবতা অবলম্বন সরকারের ‘দলকানা’ মিডিয়া-নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। অনেকে আওয়ামী লীগ সরকারের এই আচরণে অবাক হলেও আমি হইনি। কারণ, আমার কাছে বড় দুটি দল হলো দূষিত রাজনীতির প্রতিনিধি। তাই সরকার পরিচালনায় উনিশ-বিশ তারতম্য ঘটলেও মূল নীতিমালা মোটামুটি একই। সেই নীতিমালা কী? ‘নির্বাচনে জিততে পারলে সবকিছু আমার দখলে থাকবে।’ নতুন টিভি চ্যানেল অনুমোদনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কয়েকটি লাইসেন্স পাওয়া টিভি চ্যানেলের উদ্যোক্তা এখন টাকা লগ্নিকারী খুঁজছেন। কী আশ্চর্য ব্যাপার! আমরা তো জানি, এসব লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনকারীর আর্থিক সক্ষমতাও একটা প্রধান বিবেচনার বিষয় হয়ে থাকে। তাহলে তাঁদের ক্ষেত্রে কি তা দেখা হয়নি? শুধু দলীয় চেহারা দেখেই তাঁদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে? যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে আরও একটা অন্যায় হয়েছে। অবশ্য সংবাদপত্রের প্রতিবেদন যে সত্য, তা হলফ করে বলা শক্ত। আজকাল বহু মিথ্যা, ভুল বা আধাসত্য প্রতিবেদন সংবাদপত্রে ছাপা হয়ে থাকে। যা-ই হোক, আশা করি যাঁরা টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স পেয়েছেন, তাঁরা নিজের টাকায় হোক বা অন্যের টাকায় হোক, শিগগিরই তাঁদের চ্যানেল চালু করতে পারবেন।
নতুন টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স প্রসঙ্গে আরেকটু আলোচনা করতে চাই। প্রথমত. দলীয় বিবেচনায় নয়, যোগ্যতার কারণেই টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়া উচিত। এটা নিয়ে কারও দ্বিমতের অবকাশ নেই। এর সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় সরকার বিবেচনা করতে পারে। যেমন: ১. সরকার কি কয়েক বছর অন্তর নতুন আবেদনকারীকে টিভি লাইসেন্স দিয়েই যাবে? অন্তত নতুন সরকার এলেই কি একপ্রস্থ টিভি লাইসেন্স দিতে হবে? এটা কি সংবিধানের নির্দেশনা? আমাদের বিজ্ঞাপন বাজার, সামাজিক চাহিদা ইত্যাদি কিছুই কি সরকারের বিবেচনায় আসতে পারে না? মুক্তবাজার অর্থনীতির তাগিদে কি সরকার সবকিছু অবাধে অনুমোদন দিতে পারে?
২. এ ক্ষেত্রে সামাজিক চাহিদা কি সরকারের অগ্রাধিকার হতে পারে না? শিক্ষা চ্যানেল, উন্নয়ন চ্যানেল, স্বাস্থ্য চ্যানেল, ক্রীড়া চ্যানেল, শিশুতোষ চ্যানেল ইত্যাদি চালু হলে সমাজে এক বড় পরিবর্তন ঘটতে পারে। এ ধরনের চ্যানেল যাঁরা চালু করতে চাইবেন, তাঁদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া যায়। যেমন: যন্ত্রপাতি আমদানিতে কর মুক্তি, প্রথম পাঁচ বছর আয়কর থেকে মুক্তি, বিদেশি অনুদান নেওয়ার সুযোগ ইত্যাদি।
সম্প্রতি লাইসেন্স পাওয়া ব্যক্তিরা যদি সরকারের কাছে আবেদন করে জানান যে তাঁরা বিনোদননির্ভর চ্যানেল না করে ‘বিশেষ চ্যানেল’ করবেন। আমার প্রস্তাব: সরকার যেন তাঁদের নানা আর্থিক প্রণোদনা দেয়। বাংলাদেশে বিনোদন চ্যানেলের আর চাহিদা আছে বলে মনে হয় না। একটা সফল বিনোদন চ্যানেল পরিচালনায় যত প্রতিভাবান ও কুশলী ব্যক্তির প্রয়োজন, বাংলাদেশ এখনো তা সৃষ্টি করতে পারেনি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে (খবর, টক শো) টিভি চ্যানেল পরিচালনার অভিপ্রায় থাকলে সেটা অবশ্য ভিন্ন কথা। তাঁদের টাকার বা লোকের অভাব কোনো দিনই হবে না। আর অনুষ্ঠানে মানের তোয়াক্কা না করলে তো কথাই নেই। তাঁকে আর পায় কে! বর্তমানে চালু কয়েকটি টিভি চ্যানেল সে রকম কোনো কিছু তোয়াক্কা না করেই চলছে। তাঁরা যা দেখাচ্ছেন, সেটাই নাকি সেরা!! এ রকম আত্মতৃপ্তিতে নিমজ্জিত থাকতে পারলে অনেক সুখ! অনুষ্ঠানের মান বৃদ্ধির দুশ্চিন্তা বহন করতে হয় না।
৩. নতুন টিভি লাইসেন্স যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা যদি ‘ফিফটি-ফিফটি’ নীতিতেও আসেন, তাহলেও সরকার তাঁদের সীমিত প্রণোদনা দিতে পারে। যেমন, তাঁরা যদি অঙ্গীকার করেন যে বেলা দুইটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সময়ের ৫০ ভাগ সময় আমরা টার্গেট দর্শকের জন্য বিশেষ ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করব, তাহলে তাঁদেরও পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিংয়ের সীমিত সরকারি সহায়তা দেওয়া যায়। এমনকি সরকারের বিভিন্ন বিভাগ উপযুক্ত টিভি অনুষ্ঠান তৈরি করেও প্রচারের জন্য দিতে পারে।
প্রথমত. এটা একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত। সরকারকে আগে এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারপর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে এর বিস্তারিত নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এই ‘ফিফটি-ফিফটি’ নীতি এ জন্য প্রয়োজন যে আমাদের দেশে শতভাগ ‘শিক্ষা’ বা ‘উন্নয়ন’ চ্যানেল করলে তা প্রয়োজন অনুযায়ী বিজ্ঞাপন বা স্পন্সর পাবে বলে মনে হয় না। বিজ্ঞাপনদাতাদের সেই উদারতা এখনো সৃষ্টি হয়নি। কাজেই টিভি চ্যানেলকে তথাকথিত বিনোদন অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতেই হবে। সেটা যেন প্রাইম টাইমের শুধু ৫০ ভাগ হয়, সেটাই এখন দেখা দরকার। এখানে আমি ‘প্রাইম টাইমের’ ওপর জোর দিচ্ছি। কারণ, রাত ১২টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত যত উন্নয়নের অনুষ্ঠানই দেখানো হোক, টার্গেট দর্শকের তা কোনো কাজে আসবে না। কাজেই প্রচারের সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এ ধরনের কোনো নীতি বা ব্যবস্থাপনায় না গেলে আমরা পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিংয়ের স্বাদ পাব বলে মনে হয় না। প্রাইভেট টিভি-মালিকের পক্ষে একটি সম্পূর্ণ অবিনোদন চ্যানেল পরিচালনা করা সংগত কারণেই সম্ভব হবে না। অথচ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের জন্য দরকার নানা রকম পাবলিক সার্ভিস টিভি চ্যানেল। বিনোদন ও পাবলিক সার্ভিসের মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটানো ছাড়া এর কোনো সমাধান দেখি না। এবং এ ধরনের সমন্বয় ঘটাতে হলে সরকারকে নানা রকম আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। এ ছাড়া এ রকম মিশ্র টিভি চ্যানেলের কথা ভাবাও যাবে না। বেসরকারি খাতে প্রায় সবাই প্রধানত মুনাফা ও অংশত রাজনৈতিক, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য টিভি চ্যানেল দিয়েছেন। টিভি চ্যানেল পরিচালনা একটি ব্যয়বহুল ব্যবসা। একমাত্র সস্তা বিনোদন অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই সেই ব্যয় তুলে আনা সম্ভব। সরকার যদি আর্থিক প্রণোদনা না দেয়, তাহলে কারও পক্ষেই পরিকল্পিতভাবে ও প্রতিদিন বড় একটা সময় জুড়ে পাবলিক সার্ভিসের টিভি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা সম্ভব হবে না।
আরেকটা উপায় ছিল ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ (বিটিভি)। বিটিভির একটা দ্বিতীয় চ্যানেল দর্শকের এই অভাব কিছুটা দূর করতে পারত। কিন্তু শুধু একটা চ্যানেল হলে একচেটিয়াত্বের আশঙ্কা থাকে। তদুপরি বিটিভি টেরিস্ট্রিয়াল হিসেবেও একচেটিয়াত্ব ভোগ করছে। সেটাও সরকারের পক্ষে খুব অনৈতিক কাজ হচ্ছে। বর্তমানে বিটিভি যেভাবে তথ্য মন্ত্রণালয় ও সরকারি দলের প্রভাবে পরিচালিত হয়, তাতে একই পদ্ধতিতে দ্বিতীয় চ্যানেল চালু না হলেই ভালো। (ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলান!) তবে বিটিভি যদি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হতো, বিশেষজ্ঞ বোর্ডের কাছে তার জবাবদিহি থাকত, বোর্ড স্বাধীনভাবে বিটিভির আয়-ব্যয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারত, তাহলে বিটিভির পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব হতো। আমার এখন আর মনে হয় না, বড় দুই দলের শাসনকালে বিটিভির চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব। ঢাকার দলকানা সাংস্কৃতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীরাও বিটিভির এই পরিণতি নীরবে মেনে নিয়েছেন। এখন আর এ ব্যাপারে তাঁদের কোনো কণ্ঠ শোনা যায় না। দূষিত রাজনীতির এটাও একটা লক্ষণ। সংস্কৃতি, শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তি মহলে স্বাধীন কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে অনেককেই নতজানু হতে হয় ক্ষমতার কাছে। কাজেই বিটিভির ওপর ভরসা করার কোনো সুযোগ আর নেই। এখন নতুন টিভি চ্যানেলগুলো নিয়েই ভাবার কিছু সুযোগ রয়েছে; যদি সরকার পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিংয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
নতুন ১০টি টিভি চ্যানেলের অনুমোদনে সরকারের একচোখা নীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালিত টেলিভিশন ও বেতারের স্বায়ত্তশাসন প্রদানে নীরবতা অবলম্বন সরকারের ‘দলকানা’ মিডিয়া-নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। অনেকে আওয়ামী লীগ সরকারের এই আচরণে অবাক হলেও আমি হইনি। কারণ, আমার কাছে বড় দুটি দল হলো দূষিত রাজনীতির প্রতিনিধি। তাই সরকার পরিচালনায় উনিশ-বিশ তারতম্য ঘটলেও মূল নীতিমালা মোটামুটি একই। সেই নীতিমালা কী? ‘নির্বাচনে জিততে পারলে সবকিছু আমার দখলে থাকবে।’ নতুন টিভি চ্যানেল অনুমোদনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কয়েকটি লাইসেন্স পাওয়া টিভি চ্যানেলের উদ্যোক্তা এখন টাকা লগ্নিকারী খুঁজছেন। কী আশ্চর্য ব্যাপার! আমরা তো জানি, এসব লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনকারীর আর্থিক সক্ষমতাও একটা প্রধান বিবেচনার বিষয় হয়ে থাকে। তাহলে তাঁদের ক্ষেত্রে কি তা দেখা হয়নি? শুধু দলীয় চেহারা দেখেই তাঁদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে? যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে আরও একটা অন্যায় হয়েছে। অবশ্য সংবাদপত্রের প্রতিবেদন যে সত্য, তা হলফ করে বলা শক্ত। আজকাল বহু মিথ্যা, ভুল বা আধাসত্য প্রতিবেদন সংবাদপত্রে ছাপা হয়ে থাকে। যা-ই হোক, আশা করি যাঁরা টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স পেয়েছেন, তাঁরা নিজের টাকায় হোক বা অন্যের টাকায় হোক, শিগগিরই তাঁদের চ্যানেল চালু করতে পারবেন।
নতুন টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স প্রসঙ্গে আরেকটু আলোচনা করতে চাই। প্রথমত. দলীয় বিবেচনায় নয়, যোগ্যতার কারণেই টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়া উচিত। এটা নিয়ে কারও দ্বিমতের অবকাশ নেই। এর সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় সরকার বিবেচনা করতে পারে। যেমন: ১. সরকার কি কয়েক বছর অন্তর নতুন আবেদনকারীকে টিভি লাইসেন্স দিয়েই যাবে? অন্তত নতুন সরকার এলেই কি একপ্রস্থ টিভি লাইসেন্স দিতে হবে? এটা কি সংবিধানের নির্দেশনা? আমাদের বিজ্ঞাপন বাজার, সামাজিক চাহিদা ইত্যাদি কিছুই কি সরকারের বিবেচনায় আসতে পারে না? মুক্তবাজার অর্থনীতির তাগিদে কি সরকার সবকিছু অবাধে অনুমোদন দিতে পারে?
২. এ ক্ষেত্রে সামাজিক চাহিদা কি সরকারের অগ্রাধিকার হতে পারে না? শিক্ষা চ্যানেল, উন্নয়ন চ্যানেল, স্বাস্থ্য চ্যানেল, ক্রীড়া চ্যানেল, শিশুতোষ চ্যানেল ইত্যাদি চালু হলে সমাজে এক বড় পরিবর্তন ঘটতে পারে। এ ধরনের চ্যানেল যাঁরা চালু করতে চাইবেন, তাঁদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া যায়। যেমন: যন্ত্রপাতি আমদানিতে কর মুক্তি, প্রথম পাঁচ বছর আয়কর থেকে মুক্তি, বিদেশি অনুদান নেওয়ার সুযোগ ইত্যাদি।
সম্প্রতি লাইসেন্স পাওয়া ব্যক্তিরা যদি সরকারের কাছে আবেদন করে জানান যে তাঁরা বিনোদননির্ভর চ্যানেল না করে ‘বিশেষ চ্যানেল’ করবেন। আমার প্রস্তাব: সরকার যেন তাঁদের নানা আর্থিক প্রণোদনা দেয়। বাংলাদেশে বিনোদন চ্যানেলের আর চাহিদা আছে বলে মনে হয় না। একটা সফল বিনোদন চ্যানেল পরিচালনায় যত প্রতিভাবান ও কুশলী ব্যক্তির প্রয়োজন, বাংলাদেশ এখনো তা সৃষ্টি করতে পারেনি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে (খবর, টক শো) টিভি চ্যানেল পরিচালনার অভিপ্রায় থাকলে সেটা অবশ্য ভিন্ন কথা। তাঁদের টাকার বা লোকের অভাব কোনো দিনই হবে না। আর অনুষ্ঠানে মানের তোয়াক্কা না করলে তো কথাই নেই। তাঁকে আর পায় কে! বর্তমানে চালু কয়েকটি টিভি চ্যানেল সে রকম কোনো কিছু তোয়াক্কা না করেই চলছে। তাঁরা যা দেখাচ্ছেন, সেটাই নাকি সেরা!! এ রকম আত্মতৃপ্তিতে নিমজ্জিত থাকতে পারলে অনেক সুখ! অনুষ্ঠানের মান বৃদ্ধির দুশ্চিন্তা বহন করতে হয় না।
৩. নতুন টিভি লাইসেন্স যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা যদি ‘ফিফটি-ফিফটি’ নীতিতেও আসেন, তাহলেও সরকার তাঁদের সীমিত প্রণোদনা দিতে পারে। যেমন, তাঁরা যদি অঙ্গীকার করেন যে বেলা দুইটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সময়ের ৫০ ভাগ সময় আমরা টার্গেট দর্শকের জন্য বিশেষ ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করব, তাহলে তাঁদেরও পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিংয়ের সীমিত সরকারি সহায়তা দেওয়া যায়। এমনকি সরকারের বিভিন্ন বিভাগ উপযুক্ত টিভি অনুষ্ঠান তৈরি করেও প্রচারের জন্য দিতে পারে।
প্রথমত. এটা একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত। সরকারকে আগে এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারপর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে এর বিস্তারিত নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এই ‘ফিফটি-ফিফটি’ নীতি এ জন্য প্রয়োজন যে আমাদের দেশে শতভাগ ‘শিক্ষা’ বা ‘উন্নয়ন’ চ্যানেল করলে তা প্রয়োজন অনুযায়ী বিজ্ঞাপন বা স্পন্সর পাবে বলে মনে হয় না। বিজ্ঞাপনদাতাদের সেই উদারতা এখনো সৃষ্টি হয়নি। কাজেই টিভি চ্যানেলকে তথাকথিত বিনোদন অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতেই হবে। সেটা যেন প্রাইম টাইমের শুধু ৫০ ভাগ হয়, সেটাই এখন দেখা দরকার। এখানে আমি ‘প্রাইম টাইমের’ ওপর জোর দিচ্ছি। কারণ, রাত ১২টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত যত উন্নয়নের অনুষ্ঠানই দেখানো হোক, টার্গেট দর্শকের তা কোনো কাজে আসবে না। কাজেই প্রচারের সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এ ধরনের কোনো নীতি বা ব্যবস্থাপনায় না গেলে আমরা পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিংয়ের স্বাদ পাব বলে মনে হয় না। প্রাইভেট টিভি-মালিকের পক্ষে একটি সম্পূর্ণ অবিনোদন চ্যানেল পরিচালনা করা সংগত কারণেই সম্ভব হবে না। অথচ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের জন্য দরকার নানা রকম পাবলিক সার্ভিস টিভি চ্যানেল। বিনোদন ও পাবলিক সার্ভিসের মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটানো ছাড়া এর কোনো সমাধান দেখি না। এবং এ ধরনের সমন্বয় ঘটাতে হলে সরকারকে নানা রকম আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। এ ছাড়া এ রকম মিশ্র টিভি চ্যানেলের কথা ভাবাও যাবে না। বেসরকারি খাতে প্রায় সবাই প্রধানত মুনাফা ও অংশত রাজনৈতিক, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য টিভি চ্যানেল দিয়েছেন। টিভি চ্যানেল পরিচালনা একটি ব্যয়বহুল ব্যবসা। একমাত্র সস্তা বিনোদন অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই সেই ব্যয় তুলে আনা সম্ভব। সরকার যদি আর্থিক প্রণোদনা না দেয়, তাহলে কারও পক্ষেই পরিকল্পিতভাবে ও প্রতিদিন বড় একটা সময় জুড়ে পাবলিক সার্ভিসের টিভি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা সম্ভব হবে না।
আরেকটা উপায় ছিল ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ (বিটিভি)। বিটিভির একটা দ্বিতীয় চ্যানেল দর্শকের এই অভাব কিছুটা দূর করতে পারত। কিন্তু শুধু একটা চ্যানেল হলে একচেটিয়াত্বের আশঙ্কা থাকে। তদুপরি বিটিভি টেরিস্ট্রিয়াল হিসেবেও একচেটিয়াত্ব ভোগ করছে। সেটাও সরকারের পক্ষে খুব অনৈতিক কাজ হচ্ছে। বর্তমানে বিটিভি যেভাবে তথ্য মন্ত্রণালয় ও সরকারি দলের প্রভাবে পরিচালিত হয়, তাতে একই পদ্ধতিতে দ্বিতীয় চ্যানেল চালু না হলেই ভালো। (ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলান!) তবে বিটিভি যদি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হতো, বিশেষজ্ঞ বোর্ডের কাছে তার জবাবদিহি থাকত, বোর্ড স্বাধীনভাবে বিটিভির আয়-ব্যয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারত, তাহলে বিটিভির পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব হতো। আমার এখন আর মনে হয় না, বড় দুই দলের শাসনকালে বিটিভির চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব। ঢাকার দলকানা সাংস্কৃতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীরাও বিটিভির এই পরিণতি নীরবে মেনে নিয়েছেন। এখন আর এ ব্যাপারে তাঁদের কোনো কণ্ঠ শোনা যায় না। দূষিত রাজনীতির এটাও একটা লক্ষণ। সংস্কৃতি, শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তি মহলে স্বাধীন কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে অনেককেই নতজানু হতে হয় ক্ষমতার কাছে। কাজেই বিটিভির ওপর ভরসা করার কোনো সুযোগ আর নেই। এখন নতুন টিভি চ্যানেলগুলো নিয়েই ভাবার কিছু সুযোগ রয়েছে; যদি সরকার পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিংয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
No comments