মুসলিম ঐতিহ্যময় হিজরি সাল by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ইসলামের ইতিহাসে চান্দ্রবর্ষের আরবি সাল গণনার সূচনা হয়। হিজরি নববর্ষ পৃথিবীর ১৫০ কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের আবেগ-অনুভূতি ও ইসলামি আচার-অনুষ্ঠান, সর্বোপরি ইবাদত-বন্দেগির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। হিজরি সাল ইসলামের একটি মৌলিক ও গৌরবোজ্জ্বল দিক এবং মুসলমানদের অশেষ ঐতিহ্যের অবদানে অতি পবিত্র, মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়ায় বিশ্বের সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত। কালের আবর্তনে ঘটমান সব ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে আল্লাহ তাআলা মানুষকে উপদেশ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে সেসব দিবসের কথা বলা হয়েছে, যাতে বিভিন্ন সমপ্রদায়, জাতি-গোষ্ঠীর জয়-পরাজয় ও উত্থান-পতনের বহুবিধ ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা মানবজাতির জন্য বিশেষভাবে শিক্ষণীয়। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাদেরকে আল্লাহর দিবসগুলোর দ্বারা উপদেশ দাও। নিশ্চয়ই এতে চরম ধৈর্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য শিক্ষা রয়েছে।’ (সুরা ইবরাহীম, আয়াত-৫)
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সাহাবায়ে কিরামের পরামর্শক্রমে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে হিজরি সালের প্রথম প্রচলন শুরু হয়। এর আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিসহ যাবতীয় চিঠি ও কাগজপত্রে নির্দিষ্ট কোনো সাল-তারিখ ব্যবহূত হয়নি। এ সময় ইসলামি সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটতে থাকলে এর প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হতে লাগল। বিভিন্ন দিক থেকে এ ব্যাপারে মতামত ও পরামর্শ আসতে থাকল। বর্ণিত আছে যে ইরাকের কুফা নগরের গভর্নর হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) একদা খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে প্রেরিত পত্রে লিখে পাঠালেন, ‘হে আমিরুল মুমিনীন! আপনার পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনেক চিঠিপত্র আমাদের কাছে আসে। এতে অনেক জরুরি বিষয় থাকে। কিন্তু সেই চিঠিগুলোতে কোনো সাল, তারিখের উল্লেখ থাকে না। ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আইনকানুন প্রয়োগে অনেক সময় সমস্যা সৃষ্টি হয়। আমরা বুঝতে পারি না যে পত্রটি কখন লেখা, কখন পাঠানো হলো, আমাদের কাছে পৌঁছাতে কত দিন লাগল? পত্রে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় ফরমানটি কোন্ দিন থেকে কার্যকর হবে? কাজেই পত্রে কোনো তারিখ উল্লেখ থাকলে ভালো হয়।’
দূরদর্শী খলিফা হজরত ওমর (রা.) পত্রটি হাতে পেয়ে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করলেন এবং এর প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুধাবন করলেন। তিনি কালবিলম্ব না করে হজরত ওসমান (রা.) এবং হজরত আলী (রা.)সহ শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কিরামদের নিয়ে একটি পরামর্শসভার আহ্বান করলেন। আলোচ্য বিষয় ‘গণনা ও তারিখ’ কখন থেকে শুরু করা হবে। বিষয়ের গুরুত্ব ও তাত্পর্য তুলে ধরে সবার মতামত জানতে চাইলেন। সবাই খোলামনে নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করলেন। বিশিষ্ট সাহাবিদের কেউ কেউ বললেন, রাসুলে করিম (সা.)-এর জন্মতারিখ থেকে সূচনা ধরে সাল-তারিখ নির্ধারণ করা হোক। কেউ বললেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকাল থেকে শুরু ধরা হোক। কেউ বললেন, নবুওয়্যাত প্রাপ্তির সময় থেকে আরম্ভ হোক। সবাই নিজ নিজ বক্তব্যের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরলেন। প্রাচীনকাল থেকে আরব দেশে চাঁদের হিসাবে আরবি মাসের প্রচলন থাকলেও তখন হিজরি সালের প্রবর্তন হয়নি। তত্কালীন আরবে সর্বশেষ সংঘটিত উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা থেকে তারা দিন-রাতের হিসাব করত। ইসলামের আবির্ভাবের আগে তাদের হিসাবের সূচনা ছিল ‘আমুল ফিল’-এর ঘটনা স্মরণে হস্তী বর্ষের প্রচলন। তাই সাহাবায়ে কিরাম ঐতিহাসিক বড় ঘটনাকে সূচনা ধরে অভিমত ব্যক্ত করলেন।
হজরত ওমর (রা.) সুদীর্ঘ পর্যালোচনার পর সবার কথা অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শুনে একটি সংক্ষিপ্ত নীতিনির্ধারণী ভাষণ দিলেন। বক্তব্যে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মকাল থেকে ধরলে খ্রিষ্টানদের সাদৃশ্য হয়ে যায়, কারণ তারা হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মতারিখ থেকে তাদের তারিখ গণনা করে; নবীজির ইন্তেকাল থেকে ধরলে বিচ্ছেদের শোককে স্থায়ীভাবে ধারণ হয়ে যায়, কেননা তাঁর জীবনাবসান মুমিনের কাছে একটি দুঃখের সংবাদ; আবার নবুওয়্যাত প্রাপ্তি থেকে ধরলে বিষয়টি শুধুু আধ্যাত্মিক হয়ে যায় প্রভৃতি যুক্তি উপস্থাপন করে হিজরত থেকে চান্দ্রবর্ষের সূচনা ধরার নতুন প্রস্তাব পেশ করলেন। কেননা হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মধ্য দিয়ে এক নতুন বিজয়ের সূচনা হয়েছিল। বিজ্ঞ খলিফার এই নব চিন্তাধারার পাণ্ডিত্যময় ও যুক্তিপূর্ণ ভাষণ উপস্থিত সবার মনঃপূত হলো। সবাই একবাক্যে তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাকে বিনাবাক্যব্যয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন করলেন।
এমনিভাবে সূচনা হলো নতুন আরবি তারিখ হিজরি নববর্ষ। যদিও মহানবী (সা.) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন, যেহেতু তাঁর প্রস্তুতি এবং আকাবার শেষ বায়আতের পর তিনি হিজরতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রথম যে চাঁদটি উদিত হয়েছিল তা ছিল মহররম মাসের। অন্য সাহাবিদের হিজরত মহররম থেকে শুরু হয়েছিল তাই হিজরি সালের প্রথম মাস মহররম থেকে ধরা হলো। ইসলামে কোনো দিবস বা রজনীকে বাহ্যিক আয়োজনে উদ্যাপন করার বিধান নেই যেমন সত্য, তেমনি ইসলামের বিধান বা ধর্মীয় বিষয়কে গুরুত্বহীন বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। ইবাদতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় আরবি তারিখ ও সালের হিসাব স্মরণ রাখা উচিত। কালের বিবর্তনে সময়ের এ যোগ-বিয়োগ, পালাবদল চিরন্তন, শাশ্বত, চির বাস্তব। সুতরাং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিটি ঐতিহাসিক দিন-রাত্রি, মাস ও বছর মুসলমানদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর মানুষের মধ্যে এ দিনগুলোর পর্যায়ক্রমে আমি আবর্তন ঘটাই।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৪০)
যদিও হিজরতের সময়কাল থেকে হিজরি সাল বা চান্দ্রবর্ষ গণনা আরম্ভ হয়, কিন্তু এ পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে চান্দ্রমাসের গণনা শুরু হয়েছে। আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকেই সৃষ্টিকর্তার বিধানে মাসের সংখ্যা বারো (১২)। আবার দিবা-রাত্রি মিলে ২৪ ঘণ্টার এক দিনে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায় করার হুকুম অনেক আয়াতের মাধ্যমেই বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাস গণনায় মাস ১২টি, তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত, এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার কোরো না।’ (সুরা আত তাওবা, আয়াত-৩৬)
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই চান্দ্রমাসের হিসাব মহান আল্লাহর গণনায় রয়েছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ চান্দ্রমাসের হিসাব করে চলেছে। প্রাচীনকাল থেকে পূর্ববর্তী সব নবীর শরিয়তে ১২ চান্দ্রমাসকে এক বছর গণনা করা হতো এবং তন্মধ্যে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব—এ পবিত্র চারটি মাসকে বরকতময় ও সম্মানিত মনে করা হতো। এ মাসগুলোকে ‘আশ-শাহরুল হারাম’ বা অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাস বলা হতে। এই চার মাসে যেকোনো ইবাদতের সওয়াব অনেক বৃদ্ধি পায়। তেমনি এ সময়ে পাপাচার করলে তার পরিণাম এবং শাস্তিও কঠোরভাবে ভোগ করতে হয়। পূর্ববর্তী শরিয়তসমূহে এ মাসগুলোতে সব ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মারামারি ও খুনোখুনি নিষিদ্ধ ছিল।
বর্তমানে মুসলিম উম্মাহয় চাঁদের হিসাবে সারা বিশ্বে মহররমে আশুরা, সফরে আখেরি চাহার শোম্বা, রবিউল আউয়ালে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), রজবে শবে মিরাজ, শাবানে শবে বরাত, মাহে রমজানে মাসব্যাপী রোজা, জুমাতুল বিদা ও শবে কদর, শাওয়ালে ঈদুল ফিতর, জিলহজ মাসে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হজ, ঈদুল আজহা ও কোরবানিসহ অনেক বিধিবদ্ধ ইবাদত-বন্দেগি ও ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হওয়ায় হিজরি সালের গুরুত্ব প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অন্তস্থলজুড়ে সমানভাবে বিশেষ মর্যাদায় সমাসীন রয়েছে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সাহাবায়ে কিরামের পরামর্শক্রমে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে হিজরি সালের প্রথম প্রচলন শুরু হয়। এর আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিসহ যাবতীয় চিঠি ও কাগজপত্রে নির্দিষ্ট কোনো সাল-তারিখ ব্যবহূত হয়নি। এ সময় ইসলামি সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটতে থাকলে এর প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হতে লাগল। বিভিন্ন দিক থেকে এ ব্যাপারে মতামত ও পরামর্শ আসতে থাকল। বর্ণিত আছে যে ইরাকের কুফা নগরের গভর্নর হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) একদা খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে প্রেরিত পত্রে লিখে পাঠালেন, ‘হে আমিরুল মুমিনীন! আপনার পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনেক চিঠিপত্র আমাদের কাছে আসে। এতে অনেক জরুরি বিষয় থাকে। কিন্তু সেই চিঠিগুলোতে কোনো সাল, তারিখের উল্লেখ থাকে না। ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আইনকানুন প্রয়োগে অনেক সময় সমস্যা সৃষ্টি হয়। আমরা বুঝতে পারি না যে পত্রটি কখন লেখা, কখন পাঠানো হলো, আমাদের কাছে পৌঁছাতে কত দিন লাগল? পত্রে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় ফরমানটি কোন্ দিন থেকে কার্যকর হবে? কাজেই পত্রে কোনো তারিখ উল্লেখ থাকলে ভালো হয়।’
দূরদর্শী খলিফা হজরত ওমর (রা.) পত্রটি হাতে পেয়ে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করলেন এবং এর প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুধাবন করলেন। তিনি কালবিলম্ব না করে হজরত ওসমান (রা.) এবং হজরত আলী (রা.)সহ শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কিরামদের নিয়ে একটি পরামর্শসভার আহ্বান করলেন। আলোচ্য বিষয় ‘গণনা ও তারিখ’ কখন থেকে শুরু করা হবে। বিষয়ের গুরুত্ব ও তাত্পর্য তুলে ধরে সবার মতামত জানতে চাইলেন। সবাই খোলামনে নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করলেন। বিশিষ্ট সাহাবিদের কেউ কেউ বললেন, রাসুলে করিম (সা.)-এর জন্মতারিখ থেকে সূচনা ধরে সাল-তারিখ নির্ধারণ করা হোক। কেউ বললেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকাল থেকে শুরু ধরা হোক। কেউ বললেন, নবুওয়্যাত প্রাপ্তির সময় থেকে আরম্ভ হোক। সবাই নিজ নিজ বক্তব্যের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরলেন। প্রাচীনকাল থেকে আরব দেশে চাঁদের হিসাবে আরবি মাসের প্রচলন থাকলেও তখন হিজরি সালের প্রবর্তন হয়নি। তত্কালীন আরবে সর্বশেষ সংঘটিত উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা থেকে তারা দিন-রাতের হিসাব করত। ইসলামের আবির্ভাবের আগে তাদের হিসাবের সূচনা ছিল ‘আমুল ফিল’-এর ঘটনা স্মরণে হস্তী বর্ষের প্রচলন। তাই সাহাবায়ে কিরাম ঐতিহাসিক বড় ঘটনাকে সূচনা ধরে অভিমত ব্যক্ত করলেন।
হজরত ওমর (রা.) সুদীর্ঘ পর্যালোচনার পর সবার কথা অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শুনে একটি সংক্ষিপ্ত নীতিনির্ধারণী ভাষণ দিলেন। বক্তব্যে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মকাল থেকে ধরলে খ্রিষ্টানদের সাদৃশ্য হয়ে যায়, কারণ তারা হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মতারিখ থেকে তাদের তারিখ গণনা করে; নবীজির ইন্তেকাল থেকে ধরলে বিচ্ছেদের শোককে স্থায়ীভাবে ধারণ হয়ে যায়, কেননা তাঁর জীবনাবসান মুমিনের কাছে একটি দুঃখের সংবাদ; আবার নবুওয়্যাত প্রাপ্তি থেকে ধরলে বিষয়টি শুধুু আধ্যাত্মিক হয়ে যায় প্রভৃতি যুক্তি উপস্থাপন করে হিজরত থেকে চান্দ্রবর্ষের সূচনা ধরার নতুন প্রস্তাব পেশ করলেন। কেননা হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মধ্য দিয়ে এক নতুন বিজয়ের সূচনা হয়েছিল। বিজ্ঞ খলিফার এই নব চিন্তাধারার পাণ্ডিত্যময় ও যুক্তিপূর্ণ ভাষণ উপস্থিত সবার মনঃপূত হলো। সবাই একবাক্যে তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাকে বিনাবাক্যব্যয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন করলেন।
এমনিভাবে সূচনা হলো নতুন আরবি তারিখ হিজরি নববর্ষ। যদিও মহানবী (সা.) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন, যেহেতু তাঁর প্রস্তুতি এবং আকাবার শেষ বায়আতের পর তিনি হিজরতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রথম যে চাঁদটি উদিত হয়েছিল তা ছিল মহররম মাসের। অন্য সাহাবিদের হিজরত মহররম থেকে শুরু হয়েছিল তাই হিজরি সালের প্রথম মাস মহররম থেকে ধরা হলো। ইসলামে কোনো দিবস বা রজনীকে বাহ্যিক আয়োজনে উদ্যাপন করার বিধান নেই যেমন সত্য, তেমনি ইসলামের বিধান বা ধর্মীয় বিষয়কে গুরুত্বহীন বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। ইবাদতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় আরবি তারিখ ও সালের হিসাব স্মরণ রাখা উচিত। কালের বিবর্তনে সময়ের এ যোগ-বিয়োগ, পালাবদল চিরন্তন, শাশ্বত, চির বাস্তব। সুতরাং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিটি ঐতিহাসিক দিন-রাত্রি, মাস ও বছর মুসলমানদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর মানুষের মধ্যে এ দিনগুলোর পর্যায়ক্রমে আমি আবর্তন ঘটাই।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৪০)
যদিও হিজরতের সময়কাল থেকে হিজরি সাল বা চান্দ্রবর্ষ গণনা আরম্ভ হয়, কিন্তু এ পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে চান্দ্রমাসের গণনা শুরু হয়েছে। আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকেই সৃষ্টিকর্তার বিধানে মাসের সংখ্যা বারো (১২)। আবার দিবা-রাত্রি মিলে ২৪ ঘণ্টার এক দিনে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায় করার হুকুম অনেক আয়াতের মাধ্যমেই বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাস গণনায় মাস ১২টি, তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত, এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার কোরো না।’ (সুরা আত তাওবা, আয়াত-৩৬)
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই চান্দ্রমাসের হিসাব মহান আল্লাহর গণনায় রয়েছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ চান্দ্রমাসের হিসাব করে চলেছে। প্রাচীনকাল থেকে পূর্ববর্তী সব নবীর শরিয়তে ১২ চান্দ্রমাসকে এক বছর গণনা করা হতো এবং তন্মধ্যে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব—এ পবিত্র চারটি মাসকে বরকতময় ও সম্মানিত মনে করা হতো। এ মাসগুলোকে ‘আশ-শাহরুল হারাম’ বা অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাস বলা হতে। এই চার মাসে যেকোনো ইবাদতের সওয়াব অনেক বৃদ্ধি পায়। তেমনি এ সময়ে পাপাচার করলে তার পরিণাম এবং শাস্তিও কঠোরভাবে ভোগ করতে হয়। পূর্ববর্তী শরিয়তসমূহে এ মাসগুলোতে সব ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মারামারি ও খুনোখুনি নিষিদ্ধ ছিল।
বর্তমানে মুসলিম উম্মাহয় চাঁদের হিসাবে সারা বিশ্বে মহররমে আশুরা, সফরে আখেরি চাহার শোম্বা, রবিউল আউয়ালে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), রজবে শবে মিরাজ, শাবানে শবে বরাত, মাহে রমজানে মাসব্যাপী রোজা, জুমাতুল বিদা ও শবে কদর, শাওয়ালে ঈদুল ফিতর, জিলহজ মাসে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হজ, ঈদুল আজহা ও কোরবানিসহ অনেক বিধিবদ্ধ ইবাদত-বন্দেগি ও ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হওয়ায় হিজরি সালের গুরুত্ব প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অন্তস্থলজুড়ে সমানভাবে বিশেষ মর্যাদায় সমাসীন রয়েছে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments