জলবায়ু পরিবর্তন -ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশ্বে আরও বন্ধু চাই by হানিফ মাহমুদ
তথ্যপ্রযুক্তির পবিত্র স্থান বলে ধরা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের সিলিকন ভ্যালিকে। বছরের একটি রাত এই স্থানের সেরা রাত। সেরাতে দেওয়া হয় বিশ্বমানবতা পুরস্কার ও তথ্যপ্রযুক্তি উদ্ভাবনে যাঁরা বিশেষ অবদান রেখেছেন, তাঁদের বিশেষ সম্মাননা। সিলিকন ভ্যালির টেক জাদুঘরের ‘ম্যাকহেনরি কনভেনশন’ সেন্টারে এ অনুষ্ঠানে সমাবেশ ঘটে বিশ্বের ধনী ও মেধাবী লোকদের। গত ১৯ নভেম্বর হয়ে গেল এ বছরের অপেক্ষার সেই দিনটি। সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নোবেলজয়ী আল গোরকে দেওয়া হলো ‘বিশ্বমানবতা পুরস্কার, ২০০৯’। ধরিত্রীকে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে বাঁচাতে তিনি যে নিরলসভাবে এক দশক ধরে কাজ করছেন, তার স্বীকৃতিস্বরূপ দেওয়া হলো এই পুরস্কার।
বিশ্বের সব ধনী ও মেধাবী লোকের এ সমাবেশে বক্তৃতায় আল গোর শুরু করলেন দক্ষিণ এশিয়ার একটি নিম্ন আয়ের দেশ বাংলাদেশের সম্ভাব্য বিপদের কথা দিয়ে। জানালেন, সমুদ্রের পানির উচ্চতা একটু বাড়লেই বাংলাদেশ কীভাবে তলিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার জন্য জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা—দুটোরই প্রভাব বেড়েছে। জলোচ্ছ্বাস আরও শক্তি নিয়ে আঘাত হানছে। বড় বন্যা আরও কম বিরতি দিয়ে আসছে। নদীর পলি দিয়ে তৈরি এ ব-দ্বীপের মানুষের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আগে ২০ বছর পর পর জীবন-জীবিকা গোছাতে হতো। আর এখন চার-পাঁচ বছর পরপরই তেমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তারা। তৈরি হচ্ছে লাখ লাখ বাস্তুহারা মানুষ।
বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম এই মানুষটির সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কোনো যোগাযোগ আছে এমন তথ্য কখনোই পাওয়া যায়নি। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি যে সোচ্চার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তার জোরালো দৃষ্টান্ত হিসেবে উঠে আসছে বাংলাদেশের নাম।
এর দুই মাস আগে ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ওয়াশিংটনে মিলিত হন। সেখানে নানা বিষয় নিয়ে উভয়ের মধ্যে কথা হয়। তাঁদের বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনের একটি হুবহু অনুলিপি প্রকাশ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, যা বর্তমানে বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায়। হিলারি ক্লিনটন তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি, নারীর ক্ষমতায়ন, ক্ষুদ্রঋণ—এসব বিষয়ে প্রশংসা করেন। তবে বাংলাদেশ যে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে, সে বিষয়ে উল্লেখ করার মতো তেমন কিছুই বলেননি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বলেছেন তাঁর বক্তব্যের শেষ অংশে। তাঁর বক্তব্যের বেশির ভাগ অংশজুড়েই ছিল বর্তমান সরকারের ভিশন-২০২১ এবং বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে যুক্তরাষ্ট্রের আরও অধিক সহায়তা কামনা। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নথি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে দুই দেশের পররাষ্ট্রবিষয়ক আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে, তা তেমন একটা আলোচিত হয়নি। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ফলাফল মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ আদায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জোরালো সমর্থন দরকার। প্রয়োজন আল গোর ও ক্লিনটন পরিবারের শতভাগ সমর্থন। তাঁরা বাংলাদেশের মানুষের বার্তাবাহক হয়ে উঠতে পারেন।
বাংলাদেশের মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু এসব গুণী লোকের সঙ্গে সরকারের কাজকর্মের সেতুবন্ধে বেশ কিছু দুর্বলতা ইতিমধ্যে দৃশ্যমান।
পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফরেন পলিসির ২০০৯ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ১০০ চিন্তাবিদের একটি তালিকা করেছে। এই তালিকায় আছেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে (আইন সভায়) আইন পাস করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য স্বর্ণপদক দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। গত এপ্রিলে মার্কিন সিনেটর রিচার্ড ডারবিন বিশ্ব-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এক বীরসেনা হিসেবে বাংলাদেশের কৃতী সন্তান মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মার্কিন সিনেটে বিল উত্থাপন করেন। তিনি তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে পেয়ে যান ৭০ জন পৃষ্ঠপোষক সিনেটর। গত ১৩ অক্টোবর প্রস্তাবটি সিনেটে কোনো রকম বিরোধিতা ছাড়াই পাস হয়েছে। এখন হাউসে অনুমোদনের পর প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর প্রয়োজন, যা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কোনো বাঙালির এমন সম্মান এই প্রথম এবং বিরল।
অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দূতকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অতিপরিচিত এই মানুষটির ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও নিয়মিত যোগাযোগ আছে আল গোর, ক্লিনটন পরিবার, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, স্পেনের রানি সোফিয়া ও ব্রিটেনের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে। ক্ষুদ্রঋণসহ গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে সমাজের নানা অংশে ভিন্নমত বা নেতিবাচক ধারণা থাকতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ রকম গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে তাঁর শক্তি যোগ হলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের উপস্থিতি আরও সরবভাবে টের পাওয়া যেত।
গত মে মাসে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন ও জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষতি নিয়ে একটি যৌথ সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাত কোটি লোক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আক্রান্ত হবে। সাড়ে তিন কোটি মানুষ হবে উদ্বাস্তু। জলবায়ুতে উষ্ণতার কারণে যদি সমুদ্রের উচ্চতা ৪৫ সেন্টিমিটার বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে। বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাসে যদি শস্যের ৫০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে একই পরিমাণে দরিদ্রের হার বাড়বে। এমনকি বাংলাদেশ তার মোট দেশজ উত্পাদনের ১২ শতাংশ হারাতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশ কোপেনহেগেন সম্মেলনে এক হাজার কোটি ডলার বা ৬৯ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করবে। বাংলাদেশের যুক্তি হলো, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্র দশমিক ২ ভাগ বাংলাদেশ করে থাকে। অথচ কার্বন নিঃসরণের ফলে জলবায়ুর যে পরিবর্তন, তার অন্যতম ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। উন্নত দেশগুলো বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী, আর বাংলাদেশ দায়ী না হয়েও এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে।
বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরু থেকেই এ ব্যাপারে সোচ্চার। প্রধানমন্ত্রী নিজে সার্বক্ষণিক বিষয়টি তদারক করছেন। কোপেনহেগেন সম্মেলনে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার ব্যাপারে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার জোরালো দাবিও তৈরি করা হয়েছে। তবে সরকারের এসব উদ্যোগ এখনো বিশ্ব নাগরিক সমাজে জোরালো আবেদন তৈরি করতে পারেনি। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে কোপেনহেগেন সম্মেলনকে কেন্দ্র করে রীতিমতো হইচই শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো তেমনভাবে আলোচিত হচ্ছে না। অথচ একটু সক্রিয় হলেই শেখ হাসিনার তত্পরতা বিবিসি, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট-এ আলোচিত হতে পারত। হয়তো তিনি বিশ্বের সব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ল্যারি কিং লাইভ, বিবিসির হার্ড টক বা অপরাহ্ উইনফ্রে শোতে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে বিশ্ববাসীর সঙ্গে সেতু তৈরি করতে পারতেন। পরিণত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তথ্য যে শক্তি এবং তার বড় আকারে প্রচারণা যে বিশ্ব-জনমতের গতিপথ পাল্টে দেয়, তা আর নতুন করে বলার নেই।
সরকার চাইলেই ১০ কোটি ডলারের একটি তহবিল তৈরি করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য দুই বছর মেয়াদি একটি কর্মকৌশল তৈরি করতে পারত। একই সঙ্গে আল গোর, ক্লিনটন পরিবার ও মুহাম্মদ ইউনূসের মতো মিত্রশক্তিকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগিয়ে কোপেনহেগেন সম্মেলনের আগেই জোরালো কূটনৈতিক তত্পরতা দেখাতে পারত।
এতে হাজার কোটি ডলার নয়, জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলায় আগামী এক দশকে আরও বেশি সহায়তা পাওয়া যেত।
হানিফ মাহমুদ: সাংবাদিক।
বিশ্বের সব ধনী ও মেধাবী লোকের এ সমাবেশে বক্তৃতায় আল গোর শুরু করলেন দক্ষিণ এশিয়ার একটি নিম্ন আয়ের দেশ বাংলাদেশের সম্ভাব্য বিপদের কথা দিয়ে। জানালেন, সমুদ্রের পানির উচ্চতা একটু বাড়লেই বাংলাদেশ কীভাবে তলিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার জন্য জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা—দুটোরই প্রভাব বেড়েছে। জলোচ্ছ্বাস আরও শক্তি নিয়ে আঘাত হানছে। বড় বন্যা আরও কম বিরতি দিয়ে আসছে। নদীর পলি দিয়ে তৈরি এ ব-দ্বীপের মানুষের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আগে ২০ বছর পর পর জীবন-জীবিকা গোছাতে হতো। আর এখন চার-পাঁচ বছর পরপরই তেমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তারা। তৈরি হচ্ছে লাখ লাখ বাস্তুহারা মানুষ।
বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম এই মানুষটির সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কোনো যোগাযোগ আছে এমন তথ্য কখনোই পাওয়া যায়নি। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি যে সোচ্চার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তার জোরালো দৃষ্টান্ত হিসেবে উঠে আসছে বাংলাদেশের নাম।
এর দুই মাস আগে ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ওয়াশিংটনে মিলিত হন। সেখানে নানা বিষয় নিয়ে উভয়ের মধ্যে কথা হয়। তাঁদের বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনের একটি হুবহু অনুলিপি প্রকাশ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, যা বর্তমানে বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায়। হিলারি ক্লিনটন তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি, নারীর ক্ষমতায়ন, ক্ষুদ্রঋণ—এসব বিষয়ে প্রশংসা করেন। তবে বাংলাদেশ যে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে, সে বিষয়ে উল্লেখ করার মতো তেমন কিছুই বলেননি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বলেছেন তাঁর বক্তব্যের শেষ অংশে। তাঁর বক্তব্যের বেশির ভাগ অংশজুড়েই ছিল বর্তমান সরকারের ভিশন-২০২১ এবং বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে যুক্তরাষ্ট্রের আরও অধিক সহায়তা কামনা। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নথি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে দুই দেশের পররাষ্ট্রবিষয়ক আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে, তা তেমন একটা আলোচিত হয়নি। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ফলাফল মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ আদায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জোরালো সমর্থন দরকার। প্রয়োজন আল গোর ও ক্লিনটন পরিবারের শতভাগ সমর্থন। তাঁরা বাংলাদেশের মানুষের বার্তাবাহক হয়ে উঠতে পারেন।
বাংলাদেশের মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু এসব গুণী লোকের সঙ্গে সরকারের কাজকর্মের সেতুবন্ধে বেশ কিছু দুর্বলতা ইতিমধ্যে দৃশ্যমান।
পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফরেন পলিসির ২০০৯ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ১০০ চিন্তাবিদের একটি তালিকা করেছে। এই তালিকায় আছেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে (আইন সভায়) আইন পাস করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য স্বর্ণপদক দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। গত এপ্রিলে মার্কিন সিনেটর রিচার্ড ডারবিন বিশ্ব-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এক বীরসেনা হিসেবে বাংলাদেশের কৃতী সন্তান মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মার্কিন সিনেটে বিল উত্থাপন করেন। তিনি তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে পেয়ে যান ৭০ জন পৃষ্ঠপোষক সিনেটর। গত ১৩ অক্টোবর প্রস্তাবটি সিনেটে কোনো রকম বিরোধিতা ছাড়াই পাস হয়েছে। এখন হাউসে অনুমোদনের পর প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর প্রয়োজন, যা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কোনো বাঙালির এমন সম্মান এই প্রথম এবং বিরল।
অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দূতকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অতিপরিচিত এই মানুষটির ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও নিয়মিত যোগাযোগ আছে আল গোর, ক্লিনটন পরিবার, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, স্পেনের রানি সোফিয়া ও ব্রিটেনের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে। ক্ষুদ্রঋণসহ গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে সমাজের নানা অংশে ভিন্নমত বা নেতিবাচক ধারণা থাকতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ রকম গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে তাঁর শক্তি যোগ হলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের উপস্থিতি আরও সরবভাবে টের পাওয়া যেত।
গত মে মাসে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন ও জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষতি নিয়ে একটি যৌথ সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাত কোটি লোক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আক্রান্ত হবে। সাড়ে তিন কোটি মানুষ হবে উদ্বাস্তু। জলবায়ুতে উষ্ণতার কারণে যদি সমুদ্রের উচ্চতা ৪৫ সেন্টিমিটার বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে। বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাসে যদি শস্যের ৫০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে একই পরিমাণে দরিদ্রের হার বাড়বে। এমনকি বাংলাদেশ তার মোট দেশজ উত্পাদনের ১২ শতাংশ হারাতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশ কোপেনহেগেন সম্মেলনে এক হাজার কোটি ডলার বা ৬৯ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করবে। বাংলাদেশের যুক্তি হলো, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্র দশমিক ২ ভাগ বাংলাদেশ করে থাকে। অথচ কার্বন নিঃসরণের ফলে জলবায়ুর যে পরিবর্তন, তার অন্যতম ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। উন্নত দেশগুলো বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী, আর বাংলাদেশ দায়ী না হয়েও এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে।
বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরু থেকেই এ ব্যাপারে সোচ্চার। প্রধানমন্ত্রী নিজে সার্বক্ষণিক বিষয়টি তদারক করছেন। কোপেনহেগেন সম্মেলনে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার ব্যাপারে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার জোরালো দাবিও তৈরি করা হয়েছে। তবে সরকারের এসব উদ্যোগ এখনো বিশ্ব নাগরিক সমাজে জোরালো আবেদন তৈরি করতে পারেনি। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে কোপেনহেগেন সম্মেলনকে কেন্দ্র করে রীতিমতো হইচই শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো তেমনভাবে আলোচিত হচ্ছে না। অথচ একটু সক্রিয় হলেই শেখ হাসিনার তত্পরতা বিবিসি, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট-এ আলোচিত হতে পারত। হয়তো তিনি বিশ্বের সব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ল্যারি কিং লাইভ, বিবিসির হার্ড টক বা অপরাহ্ উইনফ্রে শোতে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে বিশ্ববাসীর সঙ্গে সেতু তৈরি করতে পারতেন। পরিণত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তথ্য যে শক্তি এবং তার বড় আকারে প্রচারণা যে বিশ্ব-জনমতের গতিপথ পাল্টে দেয়, তা আর নতুন করে বলার নেই।
সরকার চাইলেই ১০ কোটি ডলারের একটি তহবিল তৈরি করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য দুই বছর মেয়াদি একটি কর্মকৌশল তৈরি করতে পারত। একই সঙ্গে আল গোর, ক্লিনটন পরিবার ও মুহাম্মদ ইউনূসের মতো মিত্রশক্তিকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগিয়ে কোপেনহেগেন সম্মেলনের আগেই জোরালো কূটনৈতিক তত্পরতা দেখাতে পারত।
এতে হাজার কোটি ডলার নয়, জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলায় আগামী এক দশকে আরও বেশি সহায়তা পাওয়া যেত।
হানিফ মাহমুদ: সাংবাদিক।
No comments