নামকরণ ও নাম কর্তনের রাজনীতি -দলীয়করণ by সোহরাব হাসান
নামে কী-ই বা এসে যায়? তার পরও পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান সরকারও নামবদলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় এসেছিল দিনবদলের স্লোগান দিয়ে। সরকারের মেয়াদ এক বছর পার হতে চললেও জনগণের ভাগ্য কিংবা দিনবদলের কোনো লক্ষণ নেই। গত এক বছরে বিদ্যুত্ উত্পাদন তেমন বাড়েনি, বিনিয়োগে মন্দাও কাটেনি। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দলীয়করণের ভূত চেপে বসেছে। এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তবে গত এক বছরে সরকার দুটি কাজ বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। এক. ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে নেওয়া, দুই. সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামবদল। বিদ্যুত্সাশ্রয়ের কারণ দেখিয়ে গ্রীষ্মকালে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সবাই মেনে নিয়েছিল। কেউ আপত্তি করেনি। শীতকালে এসেও ঘড়ির কাঁটা একই স্থানে রাখার কোনো যুক্তি নেই। এতে স্কুলগামী শিশুদের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, অফিসযাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়ছে—এই সহজ সত্যটি সরকার স্বীকার করছে না। ভাবটা এমন, ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে আনলেই বিদ্যুত্-সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারকে জনগণের মনের কথাটি বুঝতে হয়। অতীতে কোনো সরকার বোঝেনি। এ সরকারও বুঝতে চাইছে না।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের সঙ্গে আমজনতার তেমন সম্পর্ক নেই। তবে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জাতীয় নেতাদের নাম যুক্ত হলে তারা খুশি হয়। নতুন প্রজন্মও ইতিহাস জানতে পারে। পৃথিবীর সব দেশেই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম জাতীয় নেতাদের নামে রাখার চল আছে। সে বিবেচনায় দেশের স্টেডিয়াম ও বিমানবন্দরের নাম ইতিহাসে বরণীয় কোনো ব্যক্তির নামে রাখার মধ্যে আপত্তির কিছু দেখছি না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা সবকিছু নিজেদের নামে করে নিতে চায়; আর অন্য দলের নাম কর্তনে মরিয়া হয়ে ওঠে।
সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়, জোট সরকারের আমলে যেসব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম বদল করা হয়েছিল, সেগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে। এ সিদ্ধান্তের পেছনে তাদের যুক্তি হলো, জোট সরকার গায়ের জোরে নাম বদলে ফেলেছিল। জোট আমলে প্রতিষ্ঠিত স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের পছন্দসই নাম তারা দিতে পারত। দিয়েছেও। কিন্তু আগের সরকারের গড়া প্রতিষ্ঠানের নাম তারা পাল্টাবে কেন? কোন যুক্তিতে তারা ঢাকার বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার কিংবা চট্টগ্রামের এম এ হান্নান বিমানবন্দরের নাম পাল্টাল? অন্যের দেওয়া নাম বদল করার অধিকার তাদের নেই। সেই যুক্তিতে মন্ত্রিসভার এ সিদ্ধান্তে কেউ আপত্তি করবেন না। কিন্তু বর্তমান সরকারও যদি একইভাবে নাম বদল করে, সেটি মেনে নেওয়া যায় না। ২৭ বছর ধরে যে বিমানবন্দরটি জিয়াউর রহমানের নামে পরিচিত হয়ে আসছে, এখন সেটি বদলানোর প্রয়োজন হলো কেন? সরকারি বার্তা সংস্থার খবর অনুযায়ী, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি হজরত শাহজালাল (র.)-এর নামে রাখার ব্যাপারে মন্ত্রিসভা মতৈক্যে পৌঁছেছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে হবে বলে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শেষোক্ত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। আপত্তি হলো জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জিয়ার নাম কর্তন করার সিদ্ধান্তে। জোট সরকার যখন চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে এম এ হান্নানের নাম বদলে হজরত শাহ আমানত (র.)-এর নাম যুক্ত করেছিল তখনো আমরা প্রতিবাদ করেছি। আওয়ামী লীগের ভাষায়, ‘বিএনপি সাম্প্রদায়িক দল এবং তারা মৌলপন্থীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে।’ এখন দেখছি, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আওয়ামী লীগও একই কাজ করতে যাচ্ছে। তারাও বিমানবন্দরে জিয়ার নাম বদলে হজরত শাহজালাল (র.)-এর নাম বসাতে চাইছে। অর্থাত্ ‘সাম্প্রদায়িক’ বিএনপি ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আওয়ামী লীগ দলীয় স্বার্থে ধর্ম ও ধর্মীয় নেতার নাম ব্যবহার করছে।
এর মাধ্যমে সরকার বিএনপির হাতে একটি মোক্ষম ইস্যু এনে দিল। এ মুহূর্তে রাজপথ গরম করার মতো তেমন ইস্যু বিএনপির হাতে নেই। ভারতবিরোধী স্লোগান এখন আর জনগণ গ্রহণ করছে না।
যে সরকার নিজে কিছু করতে পারছে না, সেই সরকারই নামবদলের মাধ্যমে ইতিহাসে নিজের নাম স্থায়ী করতে চায়। আমরা মনে করি এটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা, যা চলে আসছে সেই পাকিস্তান আমল থেকে। ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও সড়কের নাম বদলে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি শাসকেরা। স্বাধীনতার পর আমরা পাকিস্তান আমলের প্রায় সব নাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি। ইতিহাসে যাঁর যে ভূমিকা আছে, তাঁকে স্বীকার করা কিংবা স্মরণ করার মধ্যে অগৌরবের কিছু নেই। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের অন্যতম নায়ক সার্জেন্ট জহুরুল হকের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসের নাম রাখা হয়েছে। এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু সেটি উর্দু ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ইকবালের নাম বাদ দিয়ে কেন? সার্জেন্ট জহুরুল হকের নামে নতুন কোনো হল করাই শোভনীয় হতো।
সরকারি স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নামকরণের দলীয়করণ যেমন কাম্য নয়, তেমনি ইতিহাস নির্মাতাদেরও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার নিন্দনীয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো দলের নন, সমগ্র জাতির। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তাঁর নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হবে, অন্য দল ক্ষমতায় এলে সে নাম মুছে ফেলা হবে—এই অপসংস্কৃতি থেকে দেশবাসী মুক্তি চায়।
ভারতে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে আদর্শ ও নীতির পার্থক্য অনেক। অটল বিহারি বাজপেয়িসহ বিজেপির অনেক নেতাই ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার কঠোর সমালোচক। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তাঁরা ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম মুছে ফেলেননি। কংগ্রেস রাজনীতির আরেক সমালোচক সিপিএমের প্রধান নেতা জ্যোতি বসু কলকাতার যে বাড়িতে থাকেন, তার নাম ‘ইন্দিরা ভবন’। এতে জ্যোতি বসু যদি আদর্শচ্যুত না হয়ে থাকেন, তাহলে আওয়ামী লীগের নেতারা জিয়ার নামকে এত ভয় পাচ্ছেন কেন?
সব ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তুলনাও ঠিক নয়। জিয়ার নামে দেশের প্রধান বিমানবন্দরের নাম হলেই তিনি দেশের প্রধান নেতা হয়ে যাবেন না। গতবারও আওয়ামী লীগ সরকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নামবদলের উদ্যোগ নিয়েছিল। সে সময় যে কথাটি বলেছিলাম, এবারও তা সরকারের নীতিনির্ধারকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। দেশের একটি বিমানবন্দর জিয়ার নামে থাকলে ক্ষতি কী? বাংলাদেশ জুড়েই তো বঙ্গবন্ধুর নাম আছে। কারও নাম কেটে বঙ্গবন্ধু বা অন্য কারও নাম বসালেই তাঁর মাহাত্ম্য বাড়ে না, বরং ক্ষমতাসীনদের দীনতাই প্রকাশ পায়।
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে নামকরণের এই মহামারি ছিল না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু নিজের নামে বড় কোনো প্রতিষ্ঠান করেছেন, সে নজির নেই। বরং তিনি পূর্বসূরি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নামে রাজধানীর উত্তরাংশের নাম রেখেছিলেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে ঢাকার সবচেয়ে বড় উদ্যান এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নামে সবচেয়ে বড় সড়কের নাম রেখেছিলেন। জিয়াউর রহমানও নামের কাঙাল ছিলেন বলে জানা নেই। উত্তরসূরিদের রাজনৈতিক দীনতা ও ব্যক্তিস্বার্থবাদিতা আড়াল করতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও জিয়ার নাম ধার করতে হচ্ছে।
নামবদল কিংবা কর্তনে কোনো দলই পিছিয়ে নেই। আওয়ামী লীগ আমলে যেসব প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের নেতাদের নামে করা হয়েছিল, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেসব নাম কর্তন করে। আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে বিএনপি নেতাদের নাম মুছে ফেলছে। নামবদলের মহড়ায় বাদ পড়েনি চীনের অর্থায়নে নির্মিত বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রও। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ সম্মেলন কেন্দ্রের কাজ শুরু হলেও শেষ হয় বিএনপির আমলে। আওয়ামী লীগ ঠিক করেছিল, এর নাম হবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। বিএনপি এসে রাখে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের আগে বঙ্গবন্ধুর নাম জুড়ে দেয়। এর প্রয়োজন ছিল কি? যে দেশটি অর্থায়ন করেছে, সেই দেশটি নতুন নামকরণকেই বা কীভাবে নিয়েছে?
আমাদের জাতীয় ইতিহাসে নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রধান চরিত্র; কিন্তু একমাত্র চরিত্র নন। তাঁর সঙ্গে এবং সময়ে আরও জাতীয় যে নেতারা ছিলেন, সরকার তাঁদের নামে কেন কিছু করছে না? আমাদের ইতিহাস নির্মাণে মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের অবদানও কম নয়। একটি সড়ক বা হকি স্টেডিয়ামের সঙ্গে তাঁদের নাম যুক্ত করাই কি যথেষ্ট?
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় এসেছিল দিনবদলের স্লোগান দিয়ে। সরকারের মেয়াদ এক বছর পার হতে চললেও জনগণের ভাগ্য কিংবা দিনবদলের কোনো লক্ষণ নেই। গত এক বছরে বিদ্যুত্ উত্পাদন তেমন বাড়েনি, বিনিয়োগে মন্দাও কাটেনি। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দলীয়করণের ভূত চেপে বসেছে। এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তবে গত এক বছরে সরকার দুটি কাজ বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। এক. ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে নেওয়া, দুই. সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামবদল। বিদ্যুত্সাশ্রয়ের কারণ দেখিয়ে গ্রীষ্মকালে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সবাই মেনে নিয়েছিল। কেউ আপত্তি করেনি। শীতকালে এসেও ঘড়ির কাঁটা একই স্থানে রাখার কোনো যুক্তি নেই। এতে স্কুলগামী শিশুদের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, অফিসযাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়ছে—এই সহজ সত্যটি সরকার স্বীকার করছে না। ভাবটা এমন, ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে আনলেই বিদ্যুত্-সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারকে জনগণের মনের কথাটি বুঝতে হয়। অতীতে কোনো সরকার বোঝেনি। এ সরকারও বুঝতে চাইছে না।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের সঙ্গে আমজনতার তেমন সম্পর্ক নেই। তবে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জাতীয় নেতাদের নাম যুক্ত হলে তারা খুশি হয়। নতুন প্রজন্মও ইতিহাস জানতে পারে। পৃথিবীর সব দেশেই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম জাতীয় নেতাদের নামে রাখার চল আছে। সে বিবেচনায় দেশের স্টেডিয়াম ও বিমানবন্দরের নাম ইতিহাসে বরণীয় কোনো ব্যক্তির নামে রাখার মধ্যে আপত্তির কিছু দেখছি না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা সবকিছু নিজেদের নামে করে নিতে চায়; আর অন্য দলের নাম কর্তনে মরিয়া হয়ে ওঠে।
সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়, জোট সরকারের আমলে যেসব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম বদল করা হয়েছিল, সেগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে। এ সিদ্ধান্তের পেছনে তাদের যুক্তি হলো, জোট সরকার গায়ের জোরে নাম বদলে ফেলেছিল। জোট আমলে প্রতিষ্ঠিত স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের পছন্দসই নাম তারা দিতে পারত। দিয়েছেও। কিন্তু আগের সরকারের গড়া প্রতিষ্ঠানের নাম তারা পাল্টাবে কেন? কোন যুক্তিতে তারা ঢাকার বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার কিংবা চট্টগ্রামের এম এ হান্নান বিমানবন্দরের নাম পাল্টাল? অন্যের দেওয়া নাম বদল করার অধিকার তাদের নেই। সেই যুক্তিতে মন্ত্রিসভার এ সিদ্ধান্তে কেউ আপত্তি করবেন না। কিন্তু বর্তমান সরকারও যদি একইভাবে নাম বদল করে, সেটি মেনে নেওয়া যায় না। ২৭ বছর ধরে যে বিমানবন্দরটি জিয়াউর রহমানের নামে পরিচিত হয়ে আসছে, এখন সেটি বদলানোর প্রয়োজন হলো কেন? সরকারি বার্তা সংস্থার খবর অনুযায়ী, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি হজরত শাহজালাল (র.)-এর নামে রাখার ব্যাপারে মন্ত্রিসভা মতৈক্যে পৌঁছেছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে হবে বলে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শেষোক্ত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। আপত্তি হলো জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জিয়ার নাম কর্তন করার সিদ্ধান্তে। জোট সরকার যখন চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে এম এ হান্নানের নাম বদলে হজরত শাহ আমানত (র.)-এর নাম যুক্ত করেছিল তখনো আমরা প্রতিবাদ করেছি। আওয়ামী লীগের ভাষায়, ‘বিএনপি সাম্প্রদায়িক দল এবং তারা মৌলপন্থীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে।’ এখন দেখছি, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আওয়ামী লীগও একই কাজ করতে যাচ্ছে। তারাও বিমানবন্দরে জিয়ার নাম বদলে হজরত শাহজালাল (র.)-এর নাম বসাতে চাইছে। অর্থাত্ ‘সাম্প্রদায়িক’ বিএনপি ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আওয়ামী লীগ দলীয় স্বার্থে ধর্ম ও ধর্মীয় নেতার নাম ব্যবহার করছে।
এর মাধ্যমে সরকার বিএনপির হাতে একটি মোক্ষম ইস্যু এনে দিল। এ মুহূর্তে রাজপথ গরম করার মতো তেমন ইস্যু বিএনপির হাতে নেই। ভারতবিরোধী স্লোগান এখন আর জনগণ গ্রহণ করছে না।
যে সরকার নিজে কিছু করতে পারছে না, সেই সরকারই নামবদলের মাধ্যমে ইতিহাসে নিজের নাম স্থায়ী করতে চায়। আমরা মনে করি এটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা, যা চলে আসছে সেই পাকিস্তান আমল থেকে। ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও সড়কের নাম বদলে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি শাসকেরা। স্বাধীনতার পর আমরা পাকিস্তান আমলের প্রায় সব নাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি। ইতিহাসে যাঁর যে ভূমিকা আছে, তাঁকে স্বীকার করা কিংবা স্মরণ করার মধ্যে অগৌরবের কিছু নেই। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের অন্যতম নায়ক সার্জেন্ট জহুরুল হকের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসের নাম রাখা হয়েছে। এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু সেটি উর্দু ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ইকবালের নাম বাদ দিয়ে কেন? সার্জেন্ট জহুরুল হকের নামে নতুন কোনো হল করাই শোভনীয় হতো।
সরকারি স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নামকরণের দলীয়করণ যেমন কাম্য নয়, তেমনি ইতিহাস নির্মাতাদেরও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার নিন্দনীয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো দলের নন, সমগ্র জাতির। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তাঁর নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হবে, অন্য দল ক্ষমতায় এলে সে নাম মুছে ফেলা হবে—এই অপসংস্কৃতি থেকে দেশবাসী মুক্তি চায়।
ভারতে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে আদর্শ ও নীতির পার্থক্য অনেক। অটল বিহারি বাজপেয়িসহ বিজেপির অনেক নেতাই ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার কঠোর সমালোচক। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তাঁরা ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম মুছে ফেলেননি। কংগ্রেস রাজনীতির আরেক সমালোচক সিপিএমের প্রধান নেতা জ্যোতি বসু কলকাতার যে বাড়িতে থাকেন, তার নাম ‘ইন্দিরা ভবন’। এতে জ্যোতি বসু যদি আদর্শচ্যুত না হয়ে থাকেন, তাহলে আওয়ামী লীগের নেতারা জিয়ার নামকে এত ভয় পাচ্ছেন কেন?
সব ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তুলনাও ঠিক নয়। জিয়ার নামে দেশের প্রধান বিমানবন্দরের নাম হলেই তিনি দেশের প্রধান নেতা হয়ে যাবেন না। গতবারও আওয়ামী লীগ সরকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নামবদলের উদ্যোগ নিয়েছিল। সে সময় যে কথাটি বলেছিলাম, এবারও তা সরকারের নীতিনির্ধারকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। দেশের একটি বিমানবন্দর জিয়ার নামে থাকলে ক্ষতি কী? বাংলাদেশ জুড়েই তো বঙ্গবন্ধুর নাম আছে। কারও নাম কেটে বঙ্গবন্ধু বা অন্য কারও নাম বসালেই তাঁর মাহাত্ম্য বাড়ে না, বরং ক্ষমতাসীনদের দীনতাই প্রকাশ পায়।
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে নামকরণের এই মহামারি ছিল না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু নিজের নামে বড় কোনো প্রতিষ্ঠান করেছেন, সে নজির নেই। বরং তিনি পূর্বসূরি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নামে রাজধানীর উত্তরাংশের নাম রেখেছিলেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে ঢাকার সবচেয়ে বড় উদ্যান এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নামে সবচেয়ে বড় সড়কের নাম রেখেছিলেন। জিয়াউর রহমানও নামের কাঙাল ছিলেন বলে জানা নেই। উত্তরসূরিদের রাজনৈতিক দীনতা ও ব্যক্তিস্বার্থবাদিতা আড়াল করতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও জিয়ার নাম ধার করতে হচ্ছে।
নামবদল কিংবা কর্তনে কোনো দলই পিছিয়ে নেই। আওয়ামী লীগ আমলে যেসব প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের নেতাদের নামে করা হয়েছিল, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেসব নাম কর্তন করে। আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে বিএনপি নেতাদের নাম মুছে ফেলছে। নামবদলের মহড়ায় বাদ পড়েনি চীনের অর্থায়নে নির্মিত বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রও। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ সম্মেলন কেন্দ্রের কাজ শুরু হলেও শেষ হয় বিএনপির আমলে। আওয়ামী লীগ ঠিক করেছিল, এর নাম হবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। বিএনপি এসে রাখে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের আগে বঙ্গবন্ধুর নাম জুড়ে দেয়। এর প্রয়োজন ছিল কি? যে দেশটি অর্থায়ন করেছে, সেই দেশটি নতুন নামকরণকেই বা কীভাবে নিয়েছে?
আমাদের জাতীয় ইতিহাসে নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রধান চরিত্র; কিন্তু একমাত্র চরিত্র নন। তাঁর সঙ্গে এবং সময়ে আরও জাতীয় যে নেতারা ছিলেন, সরকার তাঁদের নামে কেন কিছু করছে না? আমাদের ইতিহাস নির্মাণে মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের অবদানও কম নয়। একটি সড়ক বা হকি স্টেডিয়ামের সঙ্গে তাঁদের নাম যুক্ত করাই কি যথেষ্ট?
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments