পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য -ধর্ম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামে পারিবারিক জীবনে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের ব্যাপারে যেসব দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, এতে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে সন্তানের জীবনে দায়িত্ব পালনের দিক থেকে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো অধ্যায় নেই। পিতা-মাতার কারণেই সন্তান ইহজগতের মুখ দেখতে পেরেছে। সন্তান জন্মের পরই মা সর্বপ্রথম তাঁর প্রাণপ্রিয় শিশুকে মাতৃদুগ্ধপানে আগলে রাখেন। এই যে মমতাময়ী মা, তাঁর কারণেই পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য হয়। যাঁর উষ্ণ ক্রোড়ে থেকে বাল্যাবস্থায় অসহায় শিশুটি নিরাপদে বেড়ে ওঠে। যখন মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বিকাশ ঘটে, তখন থেকেই ওই ভ্রূণ অর্থাত্ ভবিষ্যত্ শিশুটি মায়ের রক্তস্রোত থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টি পেয়ে থাকে। এটি মহান সৃষ্টিকর্তার এক অপরূপ মহিমা। তেমনই এ অপার দয়ার গুণেই সন্তানের যেকোনো বিপদ-আপদে তাঁদের প্রার্থনা ওষুধের মতোই কাজ করে। ছেলেমেয়েরা মানুষ হওয়াই বাবা-মায়ের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিদান। তাই জীবদ্দশায় মা-বাবার প্রতিটি সন্তানের যথাযথ দায়িত্ব পালন করে তাঁদের প্রতি সদা-সর্বদা কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। পিতা-মাতার প্রতি নেককার সন্তানের দোয়া কামনা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া কর, যেমনভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ২৪)
সন্তান প্রতিটি মা-বাবার কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তেমনি সন্তানের কাছে তার পিতা-মাতা আশীর্বাদস্বরূপ। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সন্তান যতই বয়োবৃদ্ধ হোক না কেন, পিতা-মাতার কাছে তারা সর্বদা শিশুর মতো। আজন্ম সন্তান পিতা-মাতার কাছে স্নেহ, আদর আর দয়া-মায়াতেই লালিত-পালিত হয়। পিতা-মাতা কখনো সন্তানের অমঙ্গল কামনা করেন না, বরং শত দুঃখ-কষ্ট পেলেও সন্তানের জন্য শুভ কামনা করেন এবং দোয়া করে থাকেন। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসা যতই আত্মিক হোক না কেন, জনক-জননী হিসেবে পিতা-মাতার অধিকার ও তাঁদের প্রতি সন্তানের কর্তব্য পালনে যথেষ্ট দায়দায়িত্ব পালন করতে হয়। পরবর্তী জীবনে এ দায়িত্ব ও কর্তব্যের কারণেই সন্তানের ওপর পিতা-মাতার অধিকার আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না এবং তোমরা পিতা-মাতার সঙ্গে সত্ ও সদয় ব্যবহার করো।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৬) রাসুলুল্লাহ (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি মাতা-পিতার সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টিও মাতা-পিতার অসন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল।’ (মিশকাত)
বাবা-মা সন্তানকে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা স্ব্বীকার করে জীবনসংগ্রাম-যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়েও বড় করেন, মানুষ করে গড়ে তোলেন, কিন্তু তাঁরা সন্তানের কাছ থেকে কোনো রকম প্রতিদান আশা করেন না। তবে সন্তানকে আদর্শবান করার জন্য একজন বাবা হিসেবে যে যেই ধর্মে বিশ্বাস করেন, সেই ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেওয়া উচিত। প্রত্যেককে সত্কাজে উত্সাহিত করা, মন্দকাজের জন্য সবকিছু ভুলে শাসন করা এবং ভালো কাজের জন্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে বাহবা দিতে হবে। কোনো ভদ্র পরিবারের সুসন্তান আদর্শচ্যুত হয় না। আদর্শ না থাকলে সন্তানকে সঠিক পথে রাখা যায় না। তাই বাবা-মায়ের উচিত, প্রতিটি সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে তার মধ্যে বিবেকবোধ জাগ্রত করে দেওয়া। জন্মগতভাবে সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার যে অধিকার রয়েছে তা অনেকের কাছ থেকে আদায় করা যায় না। কেবল সন্তানই পিতা-মাতার প্রতি তার কর্তব্য পালন করে তাদের অধিকারকে অক্ষুণ্ন রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে সন্তানের দায়িত্বই মূলত মুখ্য বিষয়। সন্তানের ধন-সম্পদের ওপর পিতা-মাতারই সর্বপ্রথম অধিকার রয়েছে। পিতা-মাতার জন্য সামর্থ্য এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সন্তানকে সম্পদ ব্যয় করতেই হবে। পিতা-মাতার জন্য খরচ না করে সম্পদ পুঞ্জীভূত করা কোনো অবস্থাতেই সঠিক নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সুসন্তানই পিতা-মাতার প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টিতে একবার তাকাবে, তার প্রতিদানে আল্লাহ তাকে এক হজের সওয়াব দান করবেন। যদি কোনো ব্যক্তি নিজের হায়াত বৃদ্ধি এবং প্রশস্ত রুজি কামনা করে থাকে, তাহলে সে যেন নিজের পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো আচরণ এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।’
যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে পিতা-মাতার আনুগত্য করে, তার জন্য জান্নাতের দুটি দরজা খেলা থাকবে এবং যে ব্যক্তি তাঁদের অবাধ্য হবে, তার জন্য জাহান্নামের দুটি দরজা খোলা থাকবে। যদি পিতা-মাতার মধ্যে থেকে একজনই ছিল, তবে জান্নাত বা জাহান্নামের একটি দরজা খোলা থাকবে। এ কথা শুনে জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, জাহান্নামের এই শাস্তিবাণী কি তখনো প্রযোজ্য যখন পিতা-মাতা ব্যক্তির প্রতি জুলুম করে? রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তরে তিনবার বললেন, ‘যদি পিতা-মাতা সন্তানের ওপর জুলুমও করে, তবুও পিতা-মাতার অবাধ্যতার কারণে সন্তান জাহান্নামে যাবে। অর্থাত্ পিতা-মাতার কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার সন্তানের নেই। তাঁরা জুলুম করলেও সন্তান সেবা-যত্ন ও আনুগত্যের হাত গুটিয়ে নিতে পারবে না।’ (মিশকাত) এক ব্যক্তি নবীজির কাছে এসে জিহাদ করার অনুমতি চাইলে তিনি বললেন, ‘তোমার পিতা-মাতা জীবিত আছেন কি?’ লোকটি জবাব দিল: ‘হ্যাঁ, জীবিত আছেন।’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘তাহলে তাঁদের দুজনের জন্য জিহাদ কর (অর্থাত্ তাদের দুজনের খেদমত কর)।’
পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া বা তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা হারাম ও কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেওয়া এবং গালাগালি করা জঘন্যতম খারাপ কাজ। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহ তাআলা সব গুনাহ মাফ করে দেন, কিন্তু যে ব্যক্তি পিতা-মাতার সঙ্গে নাফরমানি করে, তাঁদের মনে কষ্টদায়ক হয় এমন কাজ করে, তাকে পরকালের পূর্বে দুনিয়াতেই বিভিন্ন বিপদাপদে লিপ্ত করে দেওয়া হয়।’ (বায়হাকি) নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ যে গুনাহের শাস্তি চান, তা কিয়ামতের দিন পর্যন্ত বিলম্বিত করে থাকেন। কিন্তু পিতা-মাতার নাফরমানির শাস্তি মৃত্যুর পূর্বে জীবিতাবস্থায় তড়িঘড়ি করে প্রদান করে থাকেন।’ (রাওয়াহুল হাকিম)
একবার এক ব্যক্তি রাসুলে করিম (সা.)-এর খেদমতে এসে আরজ করলেন, ‘হে রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমার পিতা-মাতার ইন্তেকাল হয়েছে, তাঁদের জন্য আমার কী কী হক পালনীয়? নবী করিম (সা.) বলেন, ‘নামাজ আদায় করে গুনাহখাতা মাফের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা ফরিয়াদ করো এবং তাদের কোথাও কোনো ওয়াদা থাকলে তাও যথাযথ পালন করো।’ আরেকবার কোনো এক ব্যক্তি নবী করিমকে (সা.) প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হে রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমি কার সঙ্গে আদব রক্ষা করব ও সদ্ব্যবহার করব। তিনি তাত্ক্ষণিক বলে দিলেন, ‘তোমার পিতা-মাতার সঙ্গে।’ লোকটি আবার বলল, ‘তাঁরা তো ইন্তেকাল করেছেন।’ নবী করিম (সা.) জবাবে বললেন, ‘তাঁর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।’ কোনো মানবসন্তান যদি পিতা-মাতাকে অবজ্ঞা, অবহেলা ও ঘৃণার চোখে দেখে এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে—এটা আদৌ ইসলামসম্মত নয়; যা ধর্ম ও সমাজের নীতিমালার ঘোরতর পরিপন্থী। সুতরাং পার্থিব জীবনে উন্নতি এবং পরকালে বেহেশত পেতে হলে অবশ্যই পিতা-মাতার প্রতি সেবা-যত্ন, মান-সম্মান ও আনুগত্য থাকতে হবে। সর্বোপরি স্মরণ ও বরণ করে নিতে হবে ইসলামে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য অপরিসীম।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.