রিয়েল এস্টেট এজেন্ট সমাচার -দুই দু’গুণে পাঁচ by আতাউর রহমান

আমাদের দেশে আমরা বলি ‘ডেভেলপার’ (‘ইউনিভার্সিটি’ ইত্যাকার আরও অনেক ইংরেজি শব্দের মতো এটাও বাংলা ভাষায় আত্তীকরণ করা হয়ে গেছে); বিলেতে ও মার্কিন মুলুকে ওরা বলে ‘রিয়েল এস্টেট এজেন্ট’। দুটোর মধ্যে অবশ্য খানিকটা গুণগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়—আমাদের দেশে এরা বাসস্থানপ্রত্যাশী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে কইয়ের তেলেই কই ভাজে (তাও যদি সময়মতো প্রতিশ্রুতি পালন করত); আর ওসব দেশে ওরা নিজেদের অর্থায়নে বাসস্থান তৈরি করে অতঃপর বিক্রি করে, উপরন্তু মালিকের পক্ষ থেকে জমি-বাড়ি বিক্রি ও ভাড়া প্রদান ইত্যাদি যাবতীয় কার্যও সম্পাদন করে থাকে।
তো গল্প আছে: এক অনভিজ্ঞ রিয়েল এস্টেট সেলসম্যান কাস্টমারকে অন্ধকারে রেখে পানির নিচের একখণ্ড জমি বিক্রি করার পর তার বসের কাছে জানতে চাইল, কাস্টমার জমি দেখার পর রেগে গিয়ে যদি অ্যাডভান্সের টাকা ফেরত চায়, তাহলে সে তা ফেরত দেবে কি না। বস তখন রেগে গিয়ে বললেন, টাকা ফেরত? তুমি কী ধরনের সেলসম্যান হে? যাও এবং গিয়ে ওর কাছে একটা স্পিডবোট কিংবা নৌকা বিক্রি করে এসো।
আরও আছে: শহরের একটি অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী এক ভদ্রলোক একই বাসায় দীর্ঘদিন বাস করায় ক্লান্ত হওয়ায় বাসাটি বিক্রি করে অন্যত্র স্থানান্তরের উদ্দেশে একটি রিয়েল এস্টেট এজেন্সির শরণাপন্ন হলেন। পরের রোববারের পত্রিকার পাতায় এজেন্সি কর্তৃক প্রদত্ত তাঁর বাসার বিবরণসংবলিত বিজ্ঞাপন পাঠ করে তিনি তড়িঘড়ি এজেন্টকে টেলিফোন করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাসাটি বিক্রি করব না। পত্রিকায় প্রদত্ত আপনাদের বিজ্ঞাপন পড়ে আমার প্রতীতি জন্মেছে যে আমি সারা জীবন এ রকম একটা বাসার স্বপ্নই দেখেছিলাম।
আমাদের দেশেও বাসস্থানসংক্রান্ত এ ধরনের চটকদার বিজ্ঞাপন প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। এই যেমন ইদানীং পত্রিকার পাতায় ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে একটি বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে: ‘চার লাখ টাকায় ফাইভ স্টার হোটেলের মালিকানা।’ ভাবখানা এই যে মাত্র চার লাখ টাকায় একটি পাঁচ তারা হোটেলের মালিক হওয়া যাবে। তাই বিজ্ঞাপনটি বিলেতি জোক বুকে বহু আগে পঠিত একটি চটি গল্পের স্মরণ পাইয়ে দেয়:
এক লোক গাড়ির শোরুমে গেছে ক্যাশ পয়সায় একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি কিনতে। তার কাছে ২০ পেনি শর্ট পড়ে গেল। পাশ দিয়ে একজন পরিচিত লোক যাচ্ছিল। সে দৌড়ে গিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমাকে ২০ পেনি ধার দাও।’ লোকটি বলল, কেন? প্রত্যুত্তরে সে বলল, ‘আমি একটা মার্সিডিজ গাড়ি কিনব।’
‘তাহলে এই নাও ৪০ পেনি’, লোকটি পয়সাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার জন্যও একটা কেনো।’
তা রিয়েল এস্টেট এজেন্ট তথা ডেভেলপারদের চরিত্র দুনিয়ার সর্বত্রই প্রায় সমান—মানুষকে পটিয়েপাটিয়ে রাজি করানোয় লোকগুলো সিদ্ধহস্ত। তবে এতদসত্ত্বেও পাশ্চাত্যে ওরা ন্যূনতম একটা সততার মাপকাঠি মেনে চলে। এই যেমন রিয়েল এস্টেট এজেন্ট কাস্টমারকে বোঝাচ্ছে, ‘এই বাড়িটার সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে—অসুবিধা হচ্ছে, এটার দক্ষিণ দিক পানীয় তৈরির কারখানাসংলগ্ন আর উত্তর দিক চামড়া তৈরির কারখানাসংলগ্ন।’
‘তাহলে সুবিধাটা কী?’ কাস্টমার জিজ্ঞেস করল।
সুবিধাটা হচ্ছে, এজেন্ট জবাব দিল, ‘আপনি সব সময়ই বলতে পারবেন, বাতাসটা কোন দিক থেকে বইছে।’
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আরও অনেক কিছু অবলোকন করা যায়। কাস্টমারকে ভুলিয়েভালিয়ে একবার বড়শিতে গেঁথে ফেলতে পারলেই ব্যস, কেল্লা ফতে। জমি কিংবা ফ্ল্যাট হস্তান্তরের সময়সীমাসংক্রান্ত প্রতিশ্রুতির বরখেলাপিকে এারা কোনো অন্যায়ই মনে করে না। তা ছাড়া ফ্ল্যাটের দাম শনৈঃ শনৈঃ বাড়লে কোনো ছলছুতায় বুকিং বাতিল করে ডাবল পয়সা কামানোতেও কোনো অপরাধবোধ নেই। পাশের ফসলি জমির মালিক ওর জমি স্বেচ্ছায় বিক্রি করতে না চাইলে নিজের জমি ভরাটের নামে ওর জমি বালু দিয়ে ভরাট করে দাও অথবা চতুষ্পার্শ্বের জমি কিনে ফেলে ওকে বেকায়দায় ফেলে দাও; ব্যাটা ওর জমি বিক্রি না করে যাবে কোথায়? ইত্যাদি আরও কত কী! পাশ্চাত্যে আইনের শাসন প্রচলিত আছে বলে এসব কাজ করে সহজে পার পাওয়া যায় না; কিন্তু আমাদের দেশ বলেই সহজে পার পাওয়া যায়।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.